আগের পর্ব:নতুন জীবন- নয়
সব অসুন্দর আর অমঙ্গলের শুরু হয় একইভাবে। খুব ছোট কোন বিকৃতি থেকে, যেমন সোফির একটা বাড়তি আঙ্গুল, বা আমার এই অন্যের সাথে মনে মনে কথা বলা...
আমার মনে হতে লাগলো, খুব ছোট হলেও, বিকৃত সৃষ্টিকে ধ্বংস করে না ফেললে আমাদের সুন্দর সমাজ হয় প্রান্তভূমির মত বিকৃতি দিয়ে ভরে যাবে, অথবা এক্সেল খালুর বর্ণিত দক্ষিণের এলাকার মত হয়ে যাবে যেখানে অদ্ভুত মানুষদের দেখে মনে হয় সেটা ঈশ্বর বিহীন এক এলাকা, যেখানে বিরাজ করে কেবল অমঙ্গল আর অসুন্দর...
(এগারো)
নিজেকে নিয়ে আমার খুব ভয় হতে থাকলো। মাঝে মাঝে একা বসে কাঁদতাম, কেন আমি অন্যদের মত হতে পারলাম না এজন্য। প্রতি রাতে আমি মনপ্রাণ দিয়ে ঈশ্বরকে ডাকতে লাগলাম, "হে ঈশ্বর, দয়া করে আমাকে অন্যদের মত করে দাও। আমি ওদের থেকে অন্যরকম হতে চাই না। কাল সকাল থেকেই যেন আমি অন্য সবার মত হয়ে যাই।"
কিন্তু সকালে পরীক্ষা করে দেখতাম কিছুই বদলায়নি, আমি আগের মতই রোজালিন আর অন্যদের সাথে যোগাযোগ করতে পারছি। আমার প্রার্থনা ঈশ্বর পূর্ণ করেন নি বলে খুব মনখারাপ হত। তারপর যখন রান্না ঘরে সকালের খাবার খেতে যেতাম, তখন দেয়ালে ঝোলানো নীতিকথার থেকে চোখ পড়ত:
" যে কোনো বিকৃত সৃষ্টি ঈশ্বরের কাছে চরম ঘৃণ্য, মানুষের কাছেও ঘৃণ্য।"
এই বাক্য পড়ার সাথে সাথেই মনের মধ্যে ভয়ের কাঁপন শুরু হত। কয়েক রাত ধরে প্রার্থনা করার পরও কিছু ঘটল না; একদিন সকালে যখন প্রাতরাশ খেয়ে রান্নাঘর থেকে বের হচ্ছি, এক্সেল খালু ডাক দিলেন। বললেন, ক্ষেতে নিড়াণী দেবার কাজে আমার সাহায্য দরকার, আমি যেন উনার সাথে কাজে যাই।
বেশ কয়েক ঘণ্টা কাজ করার পর বিশ্রাম নেবার জন্য আমরা ছায়ায় বসলাম। খালু আমাকে একটা পিঠা খেতে দিলেন, নিজে আরেকটা খেতে খেতে জিজ্ঞেস করলেন,
- তোমার কী হয়েছে ডেভীবাবা? তোমাকে খুব মনমরা দেখছি কদিন ধরে। কেউ কি তোমাদের কথা জেনে গেছে?
- না, খালু। কেউ জানে নি।
একটু সময় চুপ করে থেকে আমি খালুকে হ্যারিয়েট খালা আর তার বাচ্চার কথা বললাম। বলতে বলতে আমি কাঁদতে লাগলাম, কষ্টের কথা খালুকে বলতে পেরে মন হালকা লাগছিল।
বলা শেষ করে খালুর দিকে তাকালাম, খালুর এমন কঠিন চেহারা আগে কখনো দেখিনি।
- তাহলে এই ব্যাপার,
মাথা নাড়তে নাড়তে আপনমনে খালু বললেন।
- এইসব ঘটল কারণ বাচ্চাটা অন্যরকম ছিল... সোফিও অন্যরকম ছিল... আমার খুব ভয় হচ্ছে খালু, আমিও তো অন্যরকম, ধরা পড়লে আমার কী হবে...?
আমাকে আশ্বস্ত করার জন্য খালু আমার কাঁধে হাত রাখলেন।
- কেউ কখনও জানতে পারবে না। একমাত্র আমি জানি, কিন্তু আমি কখনো কাউকে বলছি না।
- কিন্তু আমাদের একজনের সাথে যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেছে কিছুদিন ধরে। তোমাকে বলেছিলাম খালু, মনে আছে?
- মনে আছে। আমি খোঁজখবরও করেছি, তখন জানতে পেরেছি, তুমি যেই সময়ে কথাটা বলেছিল, সেসময় একটা ছেলে দুর্ঘটনায় মারা গেছে। ওর নাম ওয়াল্টার ব্রেন্ট, বয়স ছিল নয় বছর। একজায়গায় গাছ কাটা হচ্ছিল, ও তার পাশে ঘোরাঘুরি করার সময় গাছ চাপা পড়ে মারা যায়... তাহলে নিশ্চিন্তে থাকতে পারো, ওর কথা কেউ জানতে পারেনি।
- কোন জায়গায় এটা হয়েছে? আমি জিজ্ঞেস করলাম।
- এখান থেকে নয়/ দশ মাইল দূরে, চিপিং এলাকার এক খামারে।
আমি একটু ভেবে দেখলাম, চিপিংয়ের দিক থেকেই কথা বলত ছেলেটা। হয়ত এটাই কারণ, হঠাৎ মারা গেছে বলেই হয়তো এভাবে হঠাৎ যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেছে...
এক্সেল খালু কথা বললেন,
- তোমাকে বাইরে থেকে দেখে কেউ অন্যরকম বলে বুঝবে না, যদি না তুমি নিজে এমন কিছু করে ফেল যাতে লোকে তোমাকে সন্দেহ করে... যদি সবসময় সাবধানে থাকো, কেউ কিছু জানতে পারবে না।
- ওরা সোফির সাথে কী করেছিল খালু?
বহুবার করা প্রশ্নটা আরেকবার করলাম, আগের মতোই খালু এর উত্তর এড়িয়ে গিয়ে বলতে লাগলেন,
- আমি তোমাকে তো আগেও বলেছি, আমরা কেউ কি জানি ঈশ্বরের প্রতিরূপ কী, মানুষের কোন আদল সেই প্রতিরূপের কাছাকাছি বলা যায়? আমরা ধরেই নিয়েছি প্রাচীন মানুষেরা ঈশ্বরের প্রতিরূপ ছিলেন, আমরা তাদের মত হবার জন্য সাধনা করছি, কিন্তু কেন আমরা তাদের মত হতে চাই? কারণ আমরা তাদের বিস্ময়কর ক্ষমতার কথা জানি, তারা কত উন্নতি করেছিলেন সেসব কিছু জানি, তাই আমরা তাদের মত হতে চাই, যেন আমরাও তাদের মত উন্নতির শিখরে উঠে যেতে পারি। প্রাচীন মানুষদের নিয়ে এই গল্পগুলোর বেশিরভাগই আমার কাছে অতিরঞ্জিত বলে মনে হয়; আর সত্যি যদি হয়ও, তাতেই কি? আজ কোথায় তারা, আর কোথায় তাদের সেই উন্নত পৃথিবী?
- ঈশ্বরের অভিশাপে তাঁরা ধ্বংস হয়ে গেছেন।
- বটেই তো, বটেই তো!! একেবারে ধর্মগুরুদের মুখের কথা বলছ! তাই না? এইসব কথা শুনে শুনে বলা সহজ, কিন্তু পৃথিবীতে পরিভ্রমণ করলে পরে এসব নিয়ে তুমি নতুন করে ভাবতে, তখন আর সবকিছুকেই ঈশ্বরের অভিশাপ বলে ভাবত না। বল তো ঈশ্বরের অভিশাপটা কী হতে পারে? এটা হতে পারে প্রচন্ড ঝড়, বন্যা বা দাবানল, কিন্তু আমরা পৃথিবী পরিভ্রমণ করে যা দেখেছি তা কী ধরনের অভিশাপ? মাইলের পর মাইল জুড়ে পোড়াভূমি, কালো সৈকতে ধ্বংসস্তুপ যা রাতে জ্বলজ্বলে হয়ে ওঠে এগুলো কিসের জন্য হয়েছিল? অথচ দেখ তার মাঝেও কিছু প্রাণ টিকে রইল, বিকৃতি নিয়েও প্রাণের উন্মেষ ঘটতে লাগলো... ঈশ্বরের অভিশাপেই সব ধ্বংস হবে, তাহলে সব একেবারে ধ্বংস হলো না কেন?
ঈশ্বরকে নিয়ে খালুর সমস্যাটা কোথায় আমি বুঝতে পারছিলাম না; ঈশ্বর তার যা ইচ্ছা হবে তাই করতে পারেন। কথাটা খালুকে বললাম।
- কিন্তু ডেভীবাবা, আমরা বিশ্বাস করি ঈশ্বর জ্ঞানী এবং সুবিবেচক, এটা আমরা বিশ্বাস করি, তাই না? কিন্তু ওদিকে আমরা যা দেখি...
দূর দিগন্তের দিকে দেখিয়ে এক্সেল খালু বলতে লাগলেন, এটা কোন বিবেচক ঈশ্বরের কাজ হতে পারে না। তাহলে এটা কেন ঘটল?
- কিন্তু ঈশ্বরের অভিশাপ... আমি আবার বলতে গেলাম, মাঝপথে খালু থামিয়ে দিলেন।
- এটা একটা কথা, যা ধর্মগুরুরা চালু করেছেন। ধর্মগুরুদের তলিয়ে ভাবা উচিত, প্রাচীন মানুষেরা কেমন ছিলেন... ওরা এমন কী করেছিলেন যার শাস্তি হিসাবে পৃথিবীতে এই মহাদুর্যোগ নেমে এসেছিল? ধর্মগুরুদের আরো ভাবা উচিত, এই যে তারা সবসময় আমাদের উপদেশ দিচ্ছেন যে, প্রাচীন মানুষের মতো হতে পারলেই আমরা আবার পৃথিবীকে তাদের মত করে গড়ে তুলতে পারব, এটা করে আমাদের লাভটা কী হবে? গড়ে তোলার পর সেই পৃথিবীতে কি আবার মহাদুর্যোগের অভিশাপ নেমে আসতে পারে না? আমার মনে হয় ডেভী, প্রাচীন মানুষেরা অতি জ্ঞানবান ছিলেন, কিন্তু তারা অতি বড় কোন ভুল করেছিলেন...
আমি অনেক কথাই বুঝতে পারিনি, কিন্তু আমার মনে একটা প্রশ্ন জেগেছিল।
- কিন্তু খালু, প্রাচীন মানুষের মত করে পৃথিবীকে গড়ে তোলা ছাড়া অন্য আর কী করার আছে?
- আমরা আমাদের মতোই থাকব, আমাদের মতো করেই পৃথিবীকে গড়ব।
- ঠিক বুঝলাম না। আমরা ঈশ্বরের প্রতিরূপ হতে চেষ্টা করব না? বিকৃতি নষ্ট করব না?
- করব, কিন্তু কেন করব সেটা আমাদের আগে বুঝতে হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে, মানুষের এমন কিছু আছে যা অন্য কোন প্রাণীর নেই। এটা হল তার "মন", যা দিয়ে সে চিন্তা করে। জন্মের পর থেকেই নিজের মনকে সে উন্নত চিন্তা দিয়ে সুন্দর করে গড়ে তুলতে পারে, মনের দক্ষতা বাড়াতে পারে। আমার দ্বিতীয় সমুদ্র অভিযানের সময় জাহাজে একজন ডাক্তার ছিলেন, তার কাছ থেকেই আমি এসব শিখেছি। এখন আমার মনে হয়, তোমার, রোজালিনের বা অন্যদের মনের এমন এক দক্ষতা আছে যা অন্যদের নেই। ঈশ্বরের কাছে এই যে তুমি স্বাভাবিক হবার প্রার্থনা করছ, এটা অনেকটা তোমার দেখার দক্ষতা বাদ দিয়ে অন্ধ করে দেবার, বা কথা বলার দক্ষতা বাদ দিয়ে বোবা করে দেবার মত জন্য প্রার্থনার মত। অথচ এই দক্ষতা তোমার একটা অস্ত্র, এটা একটা বিশেষ কিছু যা তুমি কাজে লাগাতে পারবে... কিন্তু কেউ যেন জানতে না পারে এমনভাবে এটাকে লুকিয়ে রাখতে হবে।
এই প্রথম আমি এক্সেল খালুর অনেক কথাই বুঝতে পারলাম না। অবশ্য পরে অনেক দিন ধরে ভেবে ভেবে আমি কথাগুলো বুঝতে পেরেছিলাম।
সেদিন সন্ধ্যায় আমি সবাইকে ওয়াল্টারের কথা বললাম। দুর্ঘটনার কথা শুনে সবাই ওয়াল্টারের জন্য দুঃখ পেল, কিন্তু নিজেদের নিয়ে সবার মনে যে ভয়টা ছিল সেটা দূর হল। এই ঘটনার পর আমাদের মনে হল, আমাদের প্রত্যেকের পরিচয় জেনে রাখা দরকার, যাতে ভবিষ্যতে কোনো কিছু ঘটলে পরষ্পরের খোঁজ নিতে পারি।
আমি আর রোজালিন বাদে বাকি ছয়জনের মধ্যে আছে মাইকেল, থাকে আমাদের থেকে ছয় মাইল উত্তরে, ওর থেকে আরো দুই মাইল দূরে থাকে স্যালি আর ক্যাথরিন, প্রায় নয় মাইল উত্তর- পশ্চিমে থাকে মার্ক, আর দুই বোন এ্যান ও রেচেল থাকে আমাদের থেকে মাত্র দেড় মাইল উত্তরে এক মস্ত খামারে। আমাদের মাঝে এ্যান সবার বড়, ওর বয়স তের বছর, মৃত ওয়াল্টার ব্রেন্ট ছিল সবচেয়ে ছোটো।
সকলের সাথে জানাশোনা হওয়ার পর আমাদের মনের জোর বেড়ে গেল। আগে আমাদের ঘরের দেয়ালে বিকৃতি ও ধর্মদ্রোহীতা নিয়ে লেখা বাণী পড়লেই ভয় পেতাম, আস্তে আস্তে সেই ভয় কমে আসতে লাগলো। হ্যারিয়েট খালা আর সোফির স্মৃতি মন থেকে মুছে যায় নি, কিন্তু তাদের কথা ভাবলেও আর আগের মত এত দুশ্চিন্তা হতো না!
এর অল্পদিনের মধ্যেই মাইকেল একটা নতুন স্কুলে পড়তে গেল, আর আমরা ভাবনা চিন্তা করার মত অনেক বিষয় পেয়ে গেলাম। মাইকেলের মা-বাবা তাকে কেন্টাকের একটা স্কুলে পাঠালেন, কারণ আমাদের এলাকায় ভালো পড়াশোনার ব্যবস্থা ছিল না। আগেই বলেছি, তিন-চার জন বয়স্ক মহিলা আমাদের একেবারে সহজ কিছু অঙ্ক আর কিছু লিখতে পড়তে শেখাতেন; এটাই ছিল আমাদের স্কুল। কিন্তু মাইকেল তার স্কুলে অনেক উন্নত মানের লেখাপড়া করতে লাগলো। সে প্রতিদিন স্কুলে যা শিখত তা আবার আমাদের জানাত। এতটা দূরত্বে ভাবনা- চিত্র দেয়া নেয়ার অভ্যাস আমাদের ছিল না। তাই প্রথম দিকে কিছুটা অসুবিধা হলেও কয়েক সপ্তাহ পর সেই অসুবিধা কেটে গেল, ওর সাথে আমাদের যোগাযোগ খুব ভালো ভাবে হতে লাগলো। স্কুলে যাই পড়ানো হত মাইকেল সেটা আমাদের বলত, এমনকি কিছু বুঝতে সমস্যা হলে সেটাও বলত। আমরা সেই সমস্যা নিয়ে সবাই মিলে ভাবতে বসতাম, আর একসময় সমাধান বের করে ফেলতাম!
আমাদের সম্মিলিত সহায়তায় মাইকেল স্কুলে উন্নতি করছিল, আমাদের খুব ভালো লাগতো মাইকেল তার ক্লাসের সেরা ছাত্র হয়েছে শুনে!!
এভাবে নতুন নতুন জিনিস শিখতে পারাটা একটা আনন্দদায়ক অভিজ্ঞতা ছিল, কিন্তু এর ফলে একটা অসুবিধাও দেখা দিল। আমাদের সবসময় মনে রাখতে হতো, আমরা যে অনেক বিষয়ে বেশি জানি এই ব্যাপারটা গোপন রাখতে হবে। তাই অনেক সময় কোন কিছু জানলেও না জানার ভান করতে হতো, কারো কোন ভুল হলেও ভুল শুধরে না দিয়ে চুপচুপ থাকতে হতো, কোন আলোচনায় কেউ হাস্যকর যুক্তিকে সত্যি বলে চালিয়ে দিলেও তা মেনে নিতে হতো, একটা কাজ করার ভালো উপায় জানা সত্ত্বেও সবাই যেভাবে করে সেভাবেই করতে হতো...
অবশ্য কখনো কখনো অসতর্ক হয়েছি, হঠাৎ হয়ত আমাদের কেউ এমন কিছু বলে বা করে বসেছি যাতে অন্যেরা কিছুটা বিরক্ত হলেও তেমনভাবে সন্দেহ করেননি। আমরা সদা সতর্ক থাকতাম বলে এমন ভুল খুব কমই করেছি। আমাদের এই সাবধানতায়, পরিস্থিতি সামাল দিতে পারায় আর ভাগ্যের জোরে পরবর্তী ছয় বছর কারো সন্দেহ উদ্রেক না করেই কাটিয়ে দিতে পেরেছি।
তারপর একদিন সন্দেহ উদ্রেক করার ঘটলো, আর আমরা পেলাম আমাদের নতুন, নয় নম্বর সঙ্গীকে।
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই মার্চ, ২০২০ সকাল ১০:১৪