আগের পর্ব: নতুন জীবন- দশ
(বারো)
আমার পিচ্চি বোন পেট্রা দেখতে এত মিষ্টি ছিল যে ওকে ভালো না বেসে কারো উপায় ছিল না। আমার এখনও মনে পড়ে টলমলে পায়ে বাড়িময় ওর ছুটে বেড়ানো, ছুটতে ছুটতে হঠাৎ পড়ে যাওয়া, কান্না, খিলখিলিয়ে হাসি... একটা পুতুল ওর খুব প্রিয় ছিল, সারাক্ষণ পুতুলটাকে হাতে ঝুলিয়ে রাখত। আমি ওকে খুব ভালবাসতাম, বাড়ির সবাই, এমনকি আমার কঠোর স্বভাব বাবা পর্যন্ত ওকে খুব প্রশ্রয় দিতেন। এই জীবন্ত পুতুল বোনটা যে অন্যরকম হতে পারে এটা সেদিনের আগে কখনোই ভাবিনি...
আমি সেদিন চল্লিশ বিঘা নামের ফসলী জমিতে আরো পাঁচ জনের সাথে ফসল কাটতে গিয়েছিলাম। আমার কাটার পালা শেষ করে আমি আরেকজনের হাতে কাস্তে ধরিয়ে দিয়ে ফসল স্তুপ করে রাখছিলাম। হঠাৎ মনে হল মাথায় কিছু বাড়ি মারলো প্রচন্ড জোরে, এতটাই জোরে যে আমার পা টলমল করে উঠলো। পর মূহুর্তে মাথায় ব্যথা করে উঠল; মাছকে যেমন বরশিতে গেঁথে টেনে নেয়, আমার মনে হলো আমার মাথায় তেমনি কেউ বরশি গেঁথে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। কোথায় যাচ্ছি, কেন যাচ্ছি সেসব মাথাতেই এল না, শুধু বুঝতে পারছিলাম এই প্রচন্ড টান এড়াবার কোন সাধ্য আমার নেই। হাতের ফসলের বোঝা ফেলে দিয়ে আমি মাঠের মাঝখান দিয়ে দৌড়াতে লাগলাম, আমার সঙ্গীদের অবাক দৃষ্টি উপেক্ষা করে দৌড়ে গিয়ে আমি ক্ষেতের আইলে উঠলাম, একটা বেড়া ডিঙ্গিয়ে আরেক ক্ষেতে ঢুকে দৌড়াতে লাগলাম। মনে হচ্ছিল আমাকে আরো তাড়াতাড়ি যেতে হবে... দৌড়াতে দৌড়াতেই এ্যানগাস মর্টনের খামারের দিকে চোখ গেল, দেখি রোজালিন যেন বাতাসে ভেসে এদিকে আসছে!!
আমি দৌড়ে একটা ঢালু জমি বেয়ে নামলাম, তারপর একটা পুকুর পেরিয়ে আরেকটা পুকুরের কাছে দৌড়ে গিয়ে ঝাঁপ দিতেই দেখতে পেলাম পেট্রাকে, পুকুর পাড়ের একটা ঝোপ ধরে পানিতে হাবুডুবু খাচ্ছে! জোরে সাঁতার কেটে আমি পেট্রার কাছে পৌঁছে যেই ওকে ধরলাম, সাথে সাথে মাথার মধ্যে থেকে সেই টানের অনুভূতি চলে গেল! পেট্রাকে উদ্ধার করে আমি যখন কোমর পানিতে দাঁড়িয়েছি তখন দেখলাম পুকুর পাড়ে রোজালিন দাঁড়িয়ে আছে, ওর হতভম্ব চেহারায় উদ্বেগের ছাপ স্পষ্ট। ও যখন মুখে কথা বলল ওর গলা কাঁপছিল।
- এ-এটা কে করল? এত প্রচণ্ড শক্তি কার?
আমি বললাম। আঙ্গুল দিয়ে কপাল চেপে ধরে চোখে অবিশ্বাস নিয়ে রোজালিন বলল,
- পেট্রা!!
পেট্রাকে ঘাসের উপর শুইয়ে দিয়ে পরীক্ষা করলাম। ভয়ে বা ক্লান্তিতে ও একেবারে নেতিয়ে গেছে। রোজালিনও পেট্রার পাশে বসে পরীক্ষা করল ও ঠিক আছে কিনা, তারপর আমার দিকে জিজ্ঞাসু চোখে তাকাল।
- আমি জানতাম না, কখনো ভাবতেই পারিনি পেট্রা আমাদেরই মত, আমি বলে উঠলাম।
কপাল ডলতে ডলতে রোজালিন বিচলিত চোখে আমার দিকে তাকাল, তারপর মাথা নাড়ল।
- ও আমাদের মত না। অন্যকে নিয়ন্ত্রণ করার যে প্রচন্ড ক্ষমতা ওর আছে, তা আমাদের কারো নেই...
রোজালিন থেমে গেল, আমাদের চারপাশে কিছু উৎসুক মানুষ ভিড়। আমার পেছনে পেছন কয়েকজন এসেছেন, রোজালিনের পেছন পেছনও কয়েকজন এসেছেন, কারণ বাড়ি থেকে বের হবার সময় ওর দৌড় দেখে সবাই ভেবেছে ওর বাড়িতে আগুন লেগেছে!! আমি পেট্রাকে কোলে নিয়ে বাড়ির দিকে রওয়ানা হতেই আমাদের ক্ষেত থেকে আসা একজন জিজ্ঞেস করলেন,
- কিন্তু তুমি জানলে কী করে? আমি তো কোন চিৎকার শুনিনি!
রোজালিন খুবই অবাক হয়ে বলল,
- বলছ কী তুমি? ও যেভাবে চিৎকার করছিল, আমি তো ভাবছিলাম কেন্টাক পর্যন্ত ওর চিৎকার পৌঁছে গেছে!
লোকটা চিন্তিত ভাবে মাথা নাড়ল। আমরা দুজন শুনতে পেয়েছি, ওরা কেন শুনল না তাই ভাবতে ভাবতে ওরা ফিরে গেল। আমি কিছু বললাম না, মনে মনে বাকি ছ'জনকে বলছিলাম ঘটনাটা, সবাই জানতে চাচ্ছিল কি ঘটেছে।
সেদিন রাতে আমি কয়েক বছর পর আবার পাপাত্মা ধ্বংসের সেই পুরনো দুঃস্বপ্ন দেখলাম। এবারেও বাবার ডান হাতে ছুরি রোদে ঝলমল করছে, কিন্তু বাঁহাতে ভেড়ার বাচ্চা বা সোফি না, উনি ধরে রেখেছেন পেট্রাকে! প্রচন্ড ভয়ে ঘুম ভেঙ্গে দেখি ঘেমে জুবজুবে হয়ে গেছি...
পরদিন অনেকবার চেষ্টা করলাম পেট্রার কাছে ভাবনা- চিত্র পাঠাবার, কিন্তু ওর কাছে পৌঁছাতে পারলাম না। অন্যরাও চেষ্টা করে পৌঁছাতে পারল না। ভাবলাম ওর সাথে কথা বলে ওকে বুঝিয়ে বলি, এভাবে হঠাৎ তীব্র সঙ্কেত পাঠালে বিপদ হতে পারে। কিন্তু রোজালিন নিষেধ করল।
- সম্ভবত ভয়ানক আতঙ্ক থেকে পেট্রা এটা করেছে, হয়তো বুঝতেই পারেনি কী করছে... এখন ওকে এটা নিয়ে কিছু বললে ও কিছুই বুঝতে পারবে না। ও তো একটা ছয় বছরের বাচ্চা! আমার মনে হয় এখন ওকে কিছু বোঝাতে গেলে ও তালগোল পাকিয়ে ফেলবে।
ভেবে দেখলাম রোজালিন ঠিকই বলেছে। এত বছর অভ্যাস করার পর এখনও আমরা সতর্ক থাকি যেন আমাদের কোন কথা বা কাজে কেউ সন্দেহ না করে, পেট্রা কী করে এটা করবে!! আমরা সবাই মিলে আলোচনা করে ঠিক করলাম আমরা অপেক্ষা করব, ও যতদিন আমাদের সতর্কবার্তা বোঝার মত বড় না হচ্ছে ততদিন, অথবা আবার কোন ঘটনা না ঘটা পর্যন্ত! এরমধ্যে আমরা মাঝে মাঝেই পরীক্ষা করে দেখব মনে মনে ওর সাথে যোগাযোগ করা যায় কিনা!!
এছাড়া আমাদের আর কী করার ছিল!! গত কয়েক বছরে আমরা চেনাজানা সকল মানুষের মানসিকতা নিয়ে ভেবেছি, বুঝতে পেরেছি আমাদের ভাবনার ধরণ তাদের ভাবনা থেকে আলাদা, একথা জানতে পারলে এই মানুষগুলো কতটা নির্মম হয়ে উঠতে পারে! পাঁচ ছয় বছর আগেও এভাবে মনে মনে কথা বলাটা আমাদের কাছে ছিল একটা খেলার মত, আস্তে আস্তে বুঝতে পেরেছি এটা একটা বিপজ্জনক খেলা। প্রকৃতির দেয়া এই বিশেষ উপহার হয়ে গেছে আমাদের জন্য অভিশাপ! এটা আমাদের বন্দী করে ফেলেছে নিষেধের বেড়াজালে; কারো কাছে নিজেকে প্রকাশ করা যাবে না, কথা বলতে হবে হিসাব করে, জানা বিষয় না জানার ভান করতে হবে। নিজেকে লুকিয়ে রাখার জন্য আমাদের প্রতি মূহুর্ত প্রতারণা, মিথ্যা আর গোপনীয়তার আশ্রয় নিতে হয়...
আমাদের মধ্যে মাইকেল এসব নিয়ে খুব ভাবত, মাঝে মাঝেই এসব নিয়ে ভাবতে ভাবতে ও এত হতাশ, ক্ষুব্ধ আর ক্রুদ্ধ হয়ে উঠত যে ভয় পেতাম, ও না আবার সব প্রকাশ করে দেয়। অবশ্য আমার ভয় শুরু হয় পেট্রার এই ঘটনার একবছর আগে থেকে। সে বছর ফসল আর গবাদি পশুর বিকৃতি এত বেড়ে গিয়েছিল যে আমাদের এলাকায় পঁয়ত্রিশটা ক্ষেত পুরোপুরি জ্বালিয়ে দিতে হয়, তারমধ্যে ছিল আমার বাবার আর এ্যানগাস মর্টনের তিনটা করে ক্ষেত। প্রায় প্রতিদিনই দেখা যেত কারো না কারো বিচার হচ্ছে বিকৃতি গোপনীয়তার অভিযোগে, কেউ হয়ত বিকৃত ফসল লুকিয়েছে আবার কেউ বিকৃত পশু খেয়ে ফেলেছে। এরমধ্যে একদিন দেখা বুড়ো জেকবের সাথে। সে অতি বিরক্ত হয়ে বলেছিল,
- এই সবকিছু হচ্ছে পাপের ফলস্বরূপ। এখন বিকৃতি গোপন করার দায়ে কেউ ধরা পড়লে কিছু জরিমানা দিলেই মুক্তি পায়। টাকা দিয়ে পাপ থেকে মুক্তি !! আমাদের প্রশাসন পাপীকে শাস্তি দিচ্ছে না বলেই পাপ আর বিচ্যুতি বেড়ে চলেছে। শুনেছি আমার বাবার আমলে কোন মহিলা পরপর তিনবার পাপাত্মা জন্ম দিলে তাকে পোড়ানো হত। অথচ এখন কী হচ্ছে? প্রশাসনের এই লোকগুলো বলছে পাপাত্মা হলেও যেহেতু দেখতে মানুষের মত, তাই তাদের মেরে না ফেলে প্রান্তভূমিতে যেতে দেয়া হোক, ফলে তারা বেঁচে থাকছে! ধর্মগুরুরাও মুখে কুলুপ এঁটে আছে।
- একেবারে মেরেই ফেলতে হবে?
- পাপাত্মাকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করতে হবে বিশুদ্ধতা রক্ষার জন্য... আমি বলে রাখছি, এই বেলা যদি আমরা পাপাত্মা মারার ব্যবস্থা না করি তবে শিগগিরই ঈশ্বরের অভিশাপ আবার নেমে আসবে আমাদের উপর...
আমি এক্সেল খালুকে জিজ্ঞেস করলাম সবাই কি বুড়ো জেকবের মতো এমন কট্টরপন্থী কিনা। খালু বললেন যে, সকলে এমন না, কিন্তু যদি আরো দুয়েক বছর ফসল আর গবাদি পশুর এমন জন্ম অব্যাহত থাকে, তবে ক্রমাগত লোকসানের মুখে পড়ে বেশিরভাগ মানুষ কট্টরপন্থী হয়ে যেতে পারে!
- বিকৃতির হার কোন কোন বছর এভাবে বেড়ে যায় কেন?
- ঠিক বলতে পারছি না, কিন্তু দেখা গেছে কোন কোন বছর যদি দক্ষিণ- পশ্চিমের পোড়াভূমি থেকে প্রবল বাতাস বয়ে যায়, তৎক্ষণাৎ কিছু হয়না কিন্তু পরের মৌসুমেই দেখা যায় বিকৃতি বেড়ে গেছে। মানুষের ধারণা যে, পোড়াভূমির বাতাস এমন কিছু বয়ে আনে যার জন্য এমন ঘটে;যদিও কী থাকে বাতাসে সেটা কেউ জানেনা। সবাই মনে করে, এটা ঈশ্বরের তরফ থেকে সতর্ক বার্তা, যাতে তারা উদ্ভিদ ও প্রাণীর বিশুদ্ধতা রক্ষার ব্যাপারে ব্যবস্থা নেয়। আমার অভিজ্ঞতা বলছে, আগামী বছরও বিকৃত জন্মের এই ধারা অব্যাহত থাকবে। ফলে মানুষ খুঁজবে বলির পাঁঠা, সামান্যতম বিকৃতি ও পাপাত্মা দেখলেই তাকে ধ্বংস করে দেবে।
কথা শেষ করে খালু দীর্ঘ সময় ধরে চিন্তিত মুখে আমার দিকে তাকিয়ে থাকলেন। খালুর এই ইশারাই কাফী; আমি আমার বন্ধুদের খালুর বলা কথাগুলো জানালাম। সত্যিই পরের বছরেও অবস্থার কোন উন্নতি হল না, আর তাই লোকজন হন্যে হয়ে বিকৃতি খুঁজে বেড়াতে লাগল। এই সময়টাতেই আমরা আবিষ্কার করলাম, পেট্রাও আমাদেরই মতো, আর আমাদের দুশ্চিন্তা আরও বাড়ল! এক সপ্তাহ ধরে আমরা খুব সাবধানে লোকজনের কথাবার্তা আর আচরণ পর্যবেক্ষণ করলাম, কেউ আমাদের সন্দেহ করল কিনা জানার জন্য। কিন্তু দেখলাম কেউ সন্দেহ করছে না, সবাই ভেবেছে হয়তো তারা অন্যমনস্ক ছিল, তাই পেট্রার চিৎকার শুধু আমি আর রোজালিন শুনতে পেয়েছি। আমরা বেশ নিশ্চিন্ত বোধ করতে শুরু করলাম। কিন্তু মাসখানেক পরেই নতুন এক দুশ্চিন্তা শুরু হল, যখন এ্যান বিয়ে করবে বলে ঘোষণা দিল।
বিয়ে করার সঙ্কল্প স্থির করে তারপর এ্যান আমাদের জানিয়েছে, কিন্তু তবু আমরা কথাটাকে গুরুত্ব দিচ্ছিলাম না। আমরা বিশ্বাসই করতে পারছিলাম না যে এ্যান এ্যালান এরভিনকে বিয়ে করতে চাইবে! এ্যালান আমাদের মতো না, ও সাধারণ একটা ছেলে। এ সেই এ্যালান, যার সাথে আমি মারামারি করেছিলাম, যে সোফির কথা জানিয়ে দিয়েছিল। আমরা ভাবলাম, হয়তো এ্যানের মা-বাবা এ বিয়েতে রাজি হবেন না। কারণ এ্যানের বাবা বিত্তশালী, বিশাল খামারের মালিক; আর এ্যালান কামারের ছেলে, ভবিষ্যতে তারও কামারই হবার কথা। সুতরাং এ্যানের মা-বাবা হয়ত কামারের সাথে মেয়ের বিয়ে দিতে রাজি হবেন না...
কিন্তু আমাদের আশা পূরণ হলো না; এ্যান তার মা-বাবাকে রাজি করিয়ে ফেলল। যখন শুনলাম এ্যানের বাগদান হবে, তখন আমরা বাকি সাত জন শঙ্কিত হয়ে উঠলাম, এই বিয়ে হলে আমাদের বিপদ কতটা বেড়ে যাবে সেকথা ভেবে। মাইকেল এ্যানকে বোঝাতে চাইল যে, আমাদের মত নয় এমন কাউকে বিয়ে করা এ্যানের ঠিক হবে না।
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই মার্চ, ২০২০ সকাল ১০:২৯