কেবল সাম্প্রতিক গণহত্যা নয়, গত ১৫ বছরে আওয়ামী শাসনামলে অসংখ্য হত্যাকান্ড হয়েছে, বছরের পর বছর ধরে যার বিচার বিলম্বিত হয়ে আসছে। কালানুক্রমিক ভাবে কয়েকটি হত্যাকাণ্ডের উল্লেখ করলাম এখানে।
১) পিলখানা হত্যাকাণ্ড: ফেব্রুয়ারি ২৫-২৬, ২০০৯
পিলখানা হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় শেখ হাসিনার ফাঁসি দাবি।
২০০৯ সালের ২৫ এবং ২৬ ফেব্রুয়ারি পিলখানায় এক নারকীয় হত্যাযজ্ঞ হয়, যেখানে ৫৭জন অফিসারসহ মোট ৭৪ জন কে হত্যা করা হয়। বলা হয়, এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে ছিল ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের হাত, অথচ তাঁরা এই হত্যাকাণ্ডকে বিডিআর বিদ্রোহ নাম দিয়ে অন্য খাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা করে, এবং বিচারের একটা প্রহসন করে।
উপরে দেয়া লিংকের খবর থেকে উদ্ধৃতি:
তিনি বলেন, সেদিনের মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের নাটের গুরু ছিলেন শেখ হাসিনাসহ তার প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা তারেক সিদ্দিকী। সরকার নিজেই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে নিরপরাধ অফিসার ও জোয়ানদের ফাঁসিয়ে শত শত বিডিআর সদস্যকে মৃত্যুদণ্ডসহ বিভিন্ন মেয়াদে সাজা ও প্রায় সাড়ে ১৮ হাজার জোয়ানকে চাকরিচ্যুত করেছিল।
২) সাগর রুনি হত্যা: ফেব্রুয়ারি ১১,২০১২
সাগর রুনি হত্যার পর কেটে গেছে ১২ বছর
২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি হত্যা করা হয় সাংবাদিক দম্পতি সাগর সারওয়ার আর মেহেরুন রুনিকে। ধারণা করা হয়, তারা এমন কোন সংবাদ জেনে ফেলেছিলেন যা প্রকাশ পেলে খুবই প্রভাবশালী কেউ বিব্রত হতে পারেন। সেই সংবাদ প্রকাশ বন্ধ করার জন্য তাদের খুন করা হয়। সাগর সারওয়ার ছিলেন সামুর ব্লগার। আমার মনে আছে, এই হত্যাকাণ্ডের পর দীর্ঘদিন ধরে সামুর প্রথম পাতায় কালো বর্ডার দেওয়া একটা ব্যানার থাকতো, যেখানে সাংবাদিক দম্পতির ছবির নিচে লেখা থাকতো, "আজ হত্যাকাণ্ডের অমুকতম দিন।" প্রতিদিন দিনের সংখ্যা বদলে যেত। মনে হচ্ছে হত্যাকাণ্ডের ১০০০ দিন পরেও সামুতে এই ব্যানার দেখেছি, দেখে বুঝতে পেরেছি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর উল্লেখিত ৪৮ ঘণ্টার পরেও কতদিন কেটে গেছে কিন্তু খুনি ধরা পড়েনি!! তারপর কেটে গেছে আরো নয় বছর, বিচার হয়নি, তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেবার তারিখ পিছিয়েছে ১১১ বার!
উপরের লিংকে দেয়া খবর থেকে কিছুটা উদ্ধৃত করছি:
ভুক্তভোগী পরিবারগুলো হতাশা প্রকাশ করে একে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের ১২ বছরের ব্যর্থতা বলে উল্লেখ করেছে।
গত সপ্তাহে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক জাতীয় সংসদকে জানিয়েছিলেন, সাংবাদিক দম্পতি হত্যার তদন্ত শেষ করার কোনো সময়সীমা বেঁধে দেওয়া সম্ভব নয়।
এর আগে গত ২ ফেব্রুয়ারি আনিসুল হক বলেছিলেন, সাগর-রুনির খুনিদের খুঁজে বের করতে যদি তদন্ত ৫০ বছর লেগে যায়, তাহলে দিতে হবে।
৩) ইলিয়াস আলী হত্যা: এপ্রিল, ২০১২
ইলিয়াস আলী হত্যার রোমহর্ষক বর্ণনা ্যাবের কর্মকর্তার
বিএনপির সাবেক এমপি নিখোঁজ হন ২০১২ সালের এপ্রিল মাসে। তাঁকে ফিরে পেতে তাঁর পরিবার চেষ্টা চালায়, একপর্যায়ে প্রধানমন্ত্রীর কাছে আবেদন জানায় যেন তিনি সাহায্য করেন তাঁদের। প্রধানমন্ত্রী হাসিনা, কথিত মাদার ওফ হিউম্যানেটি তাঁদের দুঃখে বিগলিত হন এবং আশ্বাস দেন ইলিয়াস আলীর সন্ধান পেতে সাহায্য করবেন বলে। তারপর ১২ বছর পর জানা গেল যে ইলিয়াস আলীকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে!! মানবতার মায়ের কী চমৎকার মানবতা!!
৪) ত্বকী হত্যা: ৬ মার্চ, ২০১৩
১১ বছর পেরিয়ে গেলেও তদন্ত শেষ হয়নি।
১১ বছর পেরিয়ে গেলেও তদন্ত শেষ হয়নি।
পিতা রফিউর রাব্বিকে শাস্তি দেবার জন্য হত্যা করা হয় ১৭ বছরের কিশোর তানভীর মহম্মদ ত্বকীকে ২০১৩ সালের ৬ মার্চ। এই ঘটনায় মামলা করেন রবিউর রাব্বি।
গত ১১ বছরে তদন্তের জন্য সময় বাড়ানো হয়েছে ৭০ বার। অথচ হত্যার প্রথম বছরের মধ্যেই একটি তদন্ত প্রতিবেদন তৈরি হয়। সেটা প্রকাশ করা হয়নি, কিন্তু ফাঁস হয়ে যায়।
উপরে দেয়া লিংকের কিছু অংশ উদ্ধৃত করলাম:
র্যাবের ফাঁস হওয়া তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী, নারায়ণগঞ্জের মেধাবী কিশোর ত্বকী হত্যার কেবল পরিকল্পনাই না, বরং এই হত্যাকাণ্ডে সরাসরি অংশ নিয়েছিলেন আজমেরী। তার নির্দেশে, ২০১৩ সালের ৬ মার্চ তার সহযোগীরা ত্বকীকে অনুসরণ করে এবং তাকে অপহরণ করে শহরের আল্লামা ইকবাল রোডে উইনার ফ্যাশনে তার 'টর্চার সেলে' নিয়ে যায়।
পরে ওই রাতে, আজমেরী এবং তার সহযোগীরা ১৭ বছর বয়সী ত্বকীকে পিটিয়ে এবং শ্বাসরোধ করে হত্যা করে। এরপর তার লাশ বস্তায় ভরে আজমেরীর গাড়িতে করে চারারগোপ এলাকায় নিয়ে যায়।
র্যাবের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনের আগে রফিউর রাব্বি তার সমর্থকদের নিয়ে সেলিনা হায়াৎ আইভীর পক্ষে সক্রিয়ভাবে প্রচারণা চালায়। ওই নির্বাচনে বিপুল ভোটের ব্যবধানে হারেন শামীম ওসমান।
আজমেরী ওসমান শামীম ওসমানের ভাইয়ের ছেলে। প্রভাবশালী শামীম ওসমানের কর্তৃত্বের কারণে এতদিন ত্বকী হত্যার বিচার হয়নি। শামীম ওসমান পালিয়ে গেছেন, তাই আশা করা যায় এবার বিচার হবে।
৫) নারায়ণগঞ্জের সাত খুন: ২৬ এপ্রিল, ২০১৪
নারায়ণগঞ্জে সাত খুন: এক দশক ধরে বিচারের অপেক্ষায় স্বজনেরা
২০১৪ সালে নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের কাউন্সিলর নজরুল ইসলামকে হত্যার জন্য কয়েকজন কর্মকর্তাকে ভাড়া করেন আরেকজন কাউন্সিলর নূর হোসেন। নজরুল ইসলামকে অপহরণের সাক্ষী লোপাট করতে প্রত্যক্ষদর্শী কয়েকজনকেও অপহরণ এবং পরে হত্যা করা হয়। আইনজীবী চন্দন সরকারসহ মোট সাতজনকে হত্যা করে শীতলক্ষ্যা নদীতে লাশ ডুবিয়ে হত্যার ঘটনা ধামাচাপা দেবার চেষ্টা করে র্যাবের কয়েকজন সদস্য। পরে শীতলক্ষ্যা নদীতে সাতটি লাশ ভেসে ওঠার পর হত্যাকাণ্ডের তদন্ত হয়, মামলা হয়। নারায়ণগঞ্জ জেলা ও দায়রা জজ নূর হোসেন এবং র্যাবের সাবেক তিন কর্মকর্তা সহ ২৬ আসামিকে মৃত্যুদণ্ড দেয় ২০১৭ সালের ১৬ জানুয়ারি।
ওই রায়ের বিরুদ্ধে আসামিরা উচ্চ আদালতে যান। বলা হয়ে থাকে প্রভাবশালী আসামিদের কারণে রায় কার্যকর করা হয়নি এখন পর্যন্ত।
৬) তনু হত্যা: মার্চ, ২০১৬
তনু হত্যার আট বছর, বিচারের আশা ছেড়ে দিয়েছেন মা-বাবা
সোহাগী জাহান তনুকে কুমিল্লা সেনানিবাস এলাকায় ধর্ষণের পরে হত্যা করা হয় ২০১৬ সালের মার্চ মাসে। তদন্ত শেষে ধর্ষণ ও হত্যাকান্ডের জন্য দায়ী সন্দেহভাজন তিনজনকে জিজ্ঞাসাবাদের নামে দীর্ঘ সময় পার করা হয়েছে, কিন্তু কোন প্রতিবেদন দেয়া হয়নি, বিচার তো বহুদূর!! সেই সময়, এই ধর্ষণ ও হত্যাকান্ডের বিচারের দাবি তোলা হয় সমাজের সব জায়গা থেকে। আমার মনে আছে, বেশ কিছুদিন ধরে স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এই হত্যাকান্ডের বিচারের দাবিতে দীর্ঘ মানববন্ধন করত, কিন্তু বিচার হয়নি।
৭) ফারদিন নূর হত্যা: নভেম্বর ২০২২
বুয়েট ছাত্র ফারদিন হত্যা: ফের পেছাল তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের তারিখ
বুয়েট ছাত্র ফারদিন হত্যা: ফের পেছাল তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের তারিখ
আবরারকে হত্যা করার পরে বুয়েটে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হয়, যদিও ছাত্রলীগ বারবার চেষ্টা করেছে বুয়েটে ফিরে আসতে। ২০২২ সালের আগস্ট মাসে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ বুয়েটের ক্যাফেটেরিয়ায় এক সভা করে, উদ্দেশ্য ১৫ই আগস্ট বুয়েটে শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যু দিবস উপলক্ষে অনুষ্ঠান করা। সাধারণ ছাত্রদের পক্ষ থেকে ফারদিন এই অনুষ্ঠানের বিরোধিতা করে বক্তব্য দেয় এবং এই কারণে সেই অনুষ্ঠান করতে পারেনি ছাত্রলীগ। সেই বছরের ৫ নভেম্বর ফারদিন নিখোঁজ হয়, ৭ই নভেম্বর তাঁর লাশ পাওয়া যায় শীতলক্ষ্যা নদীতে হাত বাঁধা অবস্থায়। প্রথমে হত্যাকাণ্ড বলা হলেও পরবর্তীতে তদন্তে বলা হয় ফারদিন আত্মহত্যা করেছে। বুয়েটের সাধারণ ছাত্ররা তদন্তের এই ফলাফলের প্রতিবাদ করে আন্দোলন করে। বরাবরের মতো তাদের আন্দোলন বন্ধ করে দেয় আওয়ামী সরকার।
আওয়ামী সরকার আর নেই! বুয়েটের ছাত্ররা আশা করছে এবার ফারদিন হত্যার সঠিক তদন্ত ও বিচার হবে।
তবে এই সব হত্যাকাণ্ডকে ছাড়িয়ে গেছে ২০২৪ সালের জুলাই - আগস্ট মাসে চালানো আওয়ামী লীগের গণহত্যা। আন্দোলন চলাকালীন গুলিবিদ্ধ কয়েকশত মানুষ মারা যান। সেই সময় গুলিবিদ্ধ অনেকে চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে গেলে তাদের ফিরিয়ে দেয়া হয় চিকিৎসা না করেই। জানা যায়, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ ছিল কোন সরকারি হাসপাতালে যেন আন্দোলনকারীদের চিকিৎসা করা না হয়! অসংখ্য তরুণ আর শিশুদের হাসিমুখের ছবি দেখেছি, বুলেট বিদ্ধ হয়ে যারা মারা গেছে। নিহতদের সবার কথা এখানে লেখা সম্ভব না, আমি শুধু আজকের (১২ আগস্ট ২০২৪) পত্রিকায় প্রকাশিত Click This Link নাফিজের একটি ছবি দিলাম যেখানে সে রিক্সা থেকে পড়ে না যাবার জন্য হাত দিয়ে রিকশা ধরে রেখেছিল, কিন্তু আওয়ামী নেতারা তাকে হাসপাতালে চিকিৎসা না নিতে দেওয়ায় তার মৃত্যু হয়।
নাফিজের মৃত্যুর খবর থেকে কিছুটা উদ্ধৃত করলাম:
গুলিবিদ্ধ গোলাম নাফিজকে পুলিশ যখন রিকশার পাদানিতে তুলে দেয়, তখনো সে রিকশার রডটি হাত দিয়ে ধরে রেখেছিল। রিকশাচালক নূর মোহাম্মদ তাকে নিয়ে রাজধানীর ফার্মগেটের একটি হাসপাতালে ঢুকতে গেলে আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতা বাধা দেন বলে জানান প্রত্যক্ষদর্শী সাংবাদিক। পরে ১৭ বছরের গোলাম নাফিজকে নিয়ে রিকশাচালক খামারবাড়ির দিকে চলে যান।
এখন মা–বাবা আর ওই ফটোসাংবাদিকের আক্ষেপ, যদি দ্রুত হাসপাতালে নেওয়া যেত আর প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া যেত, তাহলে হয়তো ছেলেটিকে বাঁচানো সম্ভব হতো।
আরো অনেক এমন হত্যা হয়েছে, সব লেখা সময়সাপেক্ষ। তাই শেষ করি নাহিদ ইসলামের মতো সব হত্যার বিচার চেয়ে।
শেখ হাসিনার অধীনে সংঘটিত সব হত্যার বিচার চাই: উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম।
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই আগস্ট, ২০২৪ রাত ১০:২৯