
গতকাল মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর মৃত্যুবার্ষিকীতে সমন্বয়ক উপদেষ্টা মাহফুজ আলম ' পালনবাদ ও রবুবিয়াত ' সম্পর্কে আলোচনা করেন। তার বক্তব্য থেকে জানা যায় পালনবাদ মূলত ইসলামের আরেকটি মতবাদ যা মজলুম জননেতা ভাসানী সাহেবের প্রতিষ্ঠিত মতবাদ।। ভাসানী কে নিয়ে একটি কথা প্রচলিত আছে তা হলো তিনি কি ইসলামিক খেলাফতের জন্য আন্দোলন করেছেন নাকি ইসলামিক সমাজ তন্ত্রের কায়েমের জন্য সংগ্রাম করেছেন? যাই হউক ভাসানীর পালনবাদ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করলে আশা করা যায় সবার বোধদয় হবে।
পালনবাদ : কি ও কেন’ শীর্ষক লেখায় মওলানা ভাসানী লিখেছেন :
ক. সাম্য ও ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠার যে নীতি ইসলামী বিপ্লবকে এক নতুন বৈশিষ্ট্যে বলীয়ান করিয়াছিল তাহা হইল ইসলামের পালনবাদ। ইসলামের মূলকথা হইল স্রষ্টার অস্তিত্বে বিশ্বাস এবং স্রষ্টাকে লালন-পালন ও বিবর্তনকর্তা হিসেবে গ্রহণ করা। সারা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সব কিছুকে স্রষ্টা যেমন লালন পালন করেন, তেমনি তিনি লালন পালন করেন সৃষ্টির অভিজাত মানুষকেও।’
খ. ‘মানুষ সৃষ্ট হইয়াছে স্রষ্টার প্রতিভূ হিসেবে। তাই মানুষ তাহার দৈনন্দিন জীবনযাপনেও হইবে পালনবাদের অনুসারী।’
গ. ‘রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় স্রষ্টার প্রতিভূ হিসেবে মানুষ পালনবাদের নীতিকে প্রবর্তন করিবে, শাসনবাদকে করিবে পরিহার।’
গ. ‘রবুবিয়াত অর্থাৎ- পালনবাদের প্রতিষ্ঠা ইসলামী বিপ্লবের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য।’
ঘ. ‘আমরা যদি ভুলিয়া যাইতে পারিতাম ব্যক্তিগত অথবা দেশগত স্বার্থকে, আমরা যদি গ্রহণ করিতে পারিতাম পালনবাদের স্বভাবসুন্দর নীতি, তাহা হইলে শান্তি সুদূর পরাহত হইতো না।
‘রবুবিয়াতের ভূমিকা’ শীর্ষক লেখায় মওলানা ভাসানী
ক. ‘আজ আমি পরিষ্কার ভঙ্গিমায় শুরু করিয়াছি হুকুমতে রব্বানিয়া কায়েমের প্রস্তুতি। তাই গত ৮ এপ্রিল ১৯৭৪ সন্তোষে হুকুমতে রব্বানিয়া সমিতি প্রতিষ্ঠা করিয়াছি।’
খ. ‘আমার বিশ্বাস একমাত্র রবুবিয়াতের দর্শনই জাতি, ধর্ম, মতবাদ নির্বিশেষে শান্তি দিতে পারে।’
গ. ‘এই সমিতি সমাজতন্ত্রবাদীদের মতো কেবল লা-ইলাহা-ই কায়েম করিবে না, সেখানে ইল্লাল্লøাহর বীজও বপন করিবে। তাহাদের কোনো কাজে আত্মতুষ্টি অর্থাৎ নফসানিয়াত যেমন থাকিবে না ঠিক তেমনি অহেতুক বৈরাগ্য অর্থাৎ রাহবানিয়াতও থাকিবে না। এই সমিতি যেমন হক্কুল্লøাহ আদায় করিবে ঠিক তেমনি হক্কুল এবাদও করিয়া যাইবে।’
ঘ. ‘রবুবিয়াত কোনো ধর্মের কথা নহে। উহা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের একটি স্বতঃসিদ্ধ বিধান।’
‘মওলানা ভাসানী : কাছ থেকে দেখা’ শীর্ষক স্মৃতিগ্রন্থে সৈয়দ ইরফানুল বারী জানাচ্ছেন, ১৯৭৪ সালের আগস্টের শেষ সপ্তাহ বা সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে একদিন মওলানা ভাসানী তার দরবার হলে কুরআনের তাফসির শোনান। তাফসিরের একপর্যায়ে তিনি বলেন :
ক. কুরআন শরিফের মূল আহ্বান কি? সূরা আল ইমরানে ৭৯ নম্বর আয়াতে আল্লাহ মানবজাতিকে আহ্বান জানিয়ে বলছেন, ‘তোমরা রব্বানি হয়ে যাও’। রবুবিয়াতের আদর্শে বিশ্বাসী নেতা এবং কর্মী আল্লাহর এই আহ্বানে জীবন ও কর্ম দিয়ে ‘তোমরা রব্বানি হয়ে যাও’ এই স্লোগান রাজনীতিতে-সংস্কৃতিতে প্রতিষ্ঠিত করবে। গভীর আদর্শবোধসম্পন্ন দৃঢ় চরিত্রবান এবং আপোষহীন সংগ্রামশীলতার অধিকারী রাজনৈতিক নেতা ও কর্মীরাই মানুষের সার্বিক কল্যাণের পথ প্রশস্ত করতে পারেন (পৃষ্ঠা-১৬২)।
খ. ‘হুজুরের আলোচনায় অর্থাৎ তাফসিরে প্রবলভাবে রাজনৈতিক বিষয় আশয় এসেছিল। যার সার কথা ছিল রবুবিয়াতের আদর্শকে সমুন্নত করে তুলে ধর। হুজুর বললেন, রব থেকে রবুবিয়াত। রব বললে আমরা শুধু বুঝি রব মানে হলো স্রষ্টা। ‘স্রষ্টা’তেই কথা শেষ হবার নয়। স্রষ্টা মানতে হবেই। পাশাপাশি মানতে হবে স্রষ্টা একই সাথে লালন-পালনকারী এবং বিবর্তনকারী। রব যে অর্থে লালন-পালনকারী সে অর্থেই তাঁর লালন পালন বৈষম্যবিহীন, শোষণবিহীন। তিনি মানুষে মানুষে ভেদাভেদ করেন না। লালন-পালনে ধর্ম, জাতি, বর্ণ, গোত্র, সম্প্রদায় এসবের বিচার করেন না। সব এবং সবাই তাঁর কাছে সমান। ধ্বংসের দিক ধাবিত হয় এমন কোনো সিস্টেম রবুবিয়াতে নাই। ‘পালনবাদের’ রাজনীতিতে কোনো কারণেই ভেদাভেদ হবে না। বৈষম্য হবে না। এ হলো খোদায়ী লালন পালন’ (পৃষ্ঠা-১৬৩)।
দীর্ঘ জীবন পাওয়া সত্ত্বেও একেবারে শেষ বছরগুলোতে তিনি যে বিপ্লব করার স্বপ্ন দেখেছিলেন, সে বিপ্লবের মানুষ গড়ে তুলতে পারেননি। সময়ও পাননি। তাই শুনতে পাই জীবনের সর্বশেষে ভাষণে, মৃত্যুর মাত্র চার দিন আগে (১৩ নভেম্বর ১৯৭৬-বর্তমান নিবন্ধকার) সন্তোষ দরবার হলে খোদায়ী খিদমতগার সম্মেলনে তিনি বলেছেন, ‘...আমার সংগ্রামের শেষ নাই’ (পৃষ্ঠা-১৬৭)।
গ. এর প্রায় আড়াই বছর আগে, ৭ এপ্রিল ১৯৭৪, ঈদে মিলাদুন্নবী উদযাপনের এক অনুষ্ঠানে তিনি ভাষণ দেন। ‘ভাষণে হুজুর রবুবিয়াত ব্যাখ্যা করলেন। আমরা জন্ম থেকেই, মাতৃগর্ভে থাকাকাল থেকে রবুবিয়াতের বিধান অনুযায়ী লালিত-পালিত হচ্ছি। এই বিধান পরিবারে ও সমাজে প্রতিষ্ঠিত থাকলে কোনো প্রকার শোষণ বঞ্চনা থাকবে না। রাব্বুল আলামিন বৈষম্য করেন না। তাঁর নিকট কোনো ভেদাভেদ নাই। ধর্ম-বর্ণ-গোত্র বা সম্প্রদায় নির্বিশেষে তিনি লালন-পালন করেন। এই আদর্শ রাষ্ট্রীয়ভাবে সমগ্র দেশে কায়েম করতে হবে।’ (পৃ. ১৪৬)।
কুরআনের রব শব্দ থেকে ‘রব্বানি’ আকারে ব্যবহার আছে তিন স্থানে। রবের অস্তিত্বগত বৈশিষ্ট্য হচ্ছে রবুবিয়াত। অর্থ হতে পারে পালনবাদ।
এই বাংলাকৃত পালনবাদ সম্ভবত প্রথম ব্যবহার করেন মওলানা ভাসানী।
মানুষের মূল অস্তিত্ব বা পরিচয় : সে রবের খলিফা বা প্রতিনিধি। কুরআনের সূরা বাকারার ৩০ নম্বর আয়াতে এ কথা সুনির্দিষ্টভাবে রয়েছে, এভাবে- ‘ওইজ কালা রব্বুকা’ লিল মালাইকাতি ‘ইন্নি জাইলুন ফিল আরদি খলিফা’ (স্মরণ করুন সে সময়ের/ঘটনার/বৈঠক-সভার কথা, যখন ‘আপনার রব (রব্বুকা)’ ফেরেশতাদের বললেন, ‘অবশ্যই আমি (ইন্নি)’ আরদে-জমিনে ‘খলিফা স্থাপন করব-পাঠাব’। বাকারার এই আয়াত-বাক্যের মধ্যে বা কাছাকাছি আল্লাহ শব্দের ব্যবহার-প্রয়োগ নেই এবং এ আয়াতে-বাক্যে নির্দিষ্টভাবেই ‘রব’-এর ব্যবহার করা হয়েছে। এর সহজ অর্থ বোঝার কথা ‘এ দুনিয়ায় মানুষ রবের খলিফা’। মানে, নির্বিশেষে মানুষের মূল অস্তিত্ব বা পরিচয় ‘সে রবের খলিফা’।
রবের খলিফা বা প্রতিনিধি হিসেবে মানুষ এই ইহজীবনে রুবুবিয়্যাতের আদর্শ মেনে চলবে, মানে, নির্বিশেষে সব মানুষের জন্য উপকারী-কল্যাণকর হবে। এটিই রুবুবিয়্যাতের মূল কথা।
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই নভেম্বর, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:১৯

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



