
সকালের চায়ের দোকানে বসে আছি। পাশের টেবিলে দুজন মধ্যবয়সী মানুষ তর্ক করছেন। একজন বলছেন, "ধর্ম শিক্ষা ছাড়া তো মানুষ মানুষ হয় না!" অন্যজন জবাব দিচ্ছেন, "কিন্তু চাকরি পাবে কীভাবে শুধু ধর্ম পড়ে?" এই তর্ক আসলে পুরো দেশের। এহসানুল হক মিলনের সাম্প্রতিক ঘোষণা আবারও সেই পুরনো বিতর্ককে সামনে নিয়ে এসেছে - শিক্ষায় আসলে কী দরকার? ধর্ম নাকি দক্ষতা?
বিএনপির সাবেক শিক্ষামন্ত্রী বলছেন প্রতিটি শ্রেণীতে ধর্মীয় শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হবে। মাধ্যমিক থেকে শুরু করে সব পর্যায়ে নৈতিক ও ধর্মীয় শিক্ষা চালু হবে। এমনকি মৌখিক পরীক্ষাও নেওয়া হবে সূরা আর দোয়া মুখস্থ করার জন্য। শুনতে ভালো লাগে। কিন্তু একটা প্রশ্ন মাথায় আসে - আমাদের স্কুলে তো ইতিমধ্যে ধর্মীয় শিক্ষক আছে, মাধ্যমিক পর্যন্ত ইসলাম শিক্ষার বই পড়ানো হয়। তাহলে নতুনত্ব কোথায়? নতুনত্ব হলো এটাকে আরও উপরের দিকে নিয়ে যাওয়া - উচ্চমাধ্যমিক, এমনকি বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত ।
মনে পড়ে যায় ভার্সিটির প্রথম সেমিস্টারের কথা। আওয়ামী লীগ সরকার তখন বাংলাদেশ ও গ্লোবাল স্টাডিজ বাধ্যতামূলক করেছিল। আমার মতো কারো কারো কাছে বিষয়টা প্রিয় ছিল, কিন্তু বেশিরভাগ শিক্ষার্থী বিরক্ত ছিল। তারা ভাবতো, "ভার্সিটিতে উঠে আবার বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয় পড়বো কেন?" এখন যদি ধর্মীয় শিক্ষা আসে, সেটাও কি একই পরিণতি পাবে না? নাকি ধর্ম বলে কথা, সবাই খুশি মনে পড়বে? বাস্তবতা হলো, বাধ্যতামূলক যেকোনো বিষয় যদি শিক্ষার্থীদের ক্যারিয়ারের সাথে সরাসরি সম্পর্কিত না হয়, তাতে তাদের আগ্রহ কম থাকে। এটা ধর্মীয় হোক বা রাজনৈতিক, ফলাফল একই।
আওয়ামী লীগ আমলে ইন্টারমিডিয়েট থেকে ধর্মীয় শিক্ষা বাদ দিয়ে তথ্য ও প্রযুক্তি ঢোকানো হয়েছিল। এই আইডিয়া নাকি এসেছিল সজীব ওয়াজেদের মাথা থেকে। শুনতে খুব আধুনিক লাগে - ডিজিটাল যুগে তথ্য প্রযুক্তি তো লাগবেই। ষষ্ঠ শ্রেণী থেকেই শুরু হয়ে গেল আইসিটি। ফলাফল? অনেকের চাকরি হলো - নতুন শিক্ষক নিয়োগ দিতে হলো। কিন্তু শিক্ষার্থীদের কী লাভ হলো? যে বিষয়ে ষাট ভাগ প্র্যাক্টিক্যাল জ্ঞান দরকার, সেখানে শতভাগ মুখস্থ বিদ্যা চাপিয়ে দেওয়া হলো। স্কুলের ল্যাব সচল নেই, কম্পিউটার নেই বা থাকলেও পুরনো। ফলে মাধ্যমিক পর্যন্ত শিক্ষার্থীরা তেমন কিছু শিখল না। উচ্চমাধ্যমিক আর বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে কিছুটা কাজে লাগল। বিশেষ করে বাণিজ্য বিভাগের শিক্ষার্থীদের জন্য এটা সত্যিই দরকারি ছিল, কারণ তাদের কারিকুলামে গাণিতিক দক্ষতামূলক কোনো বিষয়ই ছিল না।
বিএনপি এহসানুল হক মিলনকে নিয়ে গর্ব করে। তার আমলে নাকি কেউ নকল করে পাস করতে পারতো না, প্রশ্নপত্র ফাঁস হতো না। সাধারণ মানুষের মধ্যেও তার সম্পর্কে ইতিবাচক ধারণা আছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এই ইতিবাচক ইমেজকে কাজে লাগিয়ে তিনি কি আসল সমস্যাগুলো সমাধান করতে পারবেন? বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার সমস্যা শুধু নকল বা প্রশ্নপত্র ফাঁস নয়। সমস্যা হলো শিক্ষার মান, শিক্ষকদের দক্ষতা, পাঠ্যক্রমের প্রাসঙ্গিকতা।
তারেক রহমান বলছেন ইংরেজির পাশাপাশি আরও কয়েকটি ভাষা চালু করা হবে। কিন্তু সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো প্রাথমিক থেকে উচ্চতর শিক্ষা পর্যন্ত মান উন্নয়ন করা। দক্ষ শিক্ষক তৈরি করতে হবে, আর নিয়োগ দিতে হবে যোগ্যতার ভিত্তিতে, রাজনৈতিক পরিচয়ের ভিত্তিতে নয়। যদি রাজনৈতিক দলের লোকজনদের শিক্ষক বানানো হয়, তাহলে "যেই লাউ সেই কদু" - কিছুই বদলাবে না। শিক্ষক নিয়োগে লিখিত পরীক্ষা নিতে হবে, মেধার মূল্যায়ন করতে হবে।
ধর্মীয় শিক্ষা উচ্চতর পর্যায় পর্যন্ত চালু করলে শুধু লাভ হবে - এই ধারণা ভুল। যারা রাষ্ট্র পরিচালনা করবে, তাদের দক্ষ হতে হবে, সৃজনশীল হতে হবে, আর সবচেয়ে বড় কথা সৎ হতে হবে। আমাদের দেশের সরকারগুলো জনগণকে সততার শিক্ষা নিতে বলে, কিন্তু নিজেরা অসৎ উপায়ে দেশ চালায়। এই দ্বৈত নীতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। ধর্মীয় শিক্ষক নিয়োগ একটি জনপ্রিয়তাবাদী (পপুলিস্ট) ভাবনা। মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিকে কাজে লাগিয়ে ভোট পাওয়ার চেষ্টা। কিন্তু প্রকৃত শিক্ষা সংস্কারের জন্য এর চেয়ে আরও গভীরে যেতে হবে।
আরেকটা বিষয় ভাবার। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সংগীত শিক্ষা চালু করা উচিত। শিশুদের সৃজনশীলতা বিকাশের জন্য, তাদের মানসিক বিকাশের জন্য সংগীত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে ধর্ম শিক্ষক নাকি সংগীত শিক্ষক প্রাথমিকে নিয়োগ দেওয়া হবে - এই নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। এহসানুল হক মিলন এ বিষয়ে তার মতামত জানালে শিক্ষা নিয়ে বিএনপির আসল মনোভাব জাতির কাছে পরিষ্কার হতো। তিনি কি মনে করেন যে শিক্ষা মানে শুধু ধর্মীয় জ্ঞান? নাকি তিনি বিশ্বাস করেন যে একজন পূর্ণাঙ্গ মানুষ হতে হলে ধর্ম, বিজ্ঞান, শিল্পকলা সবকিছুর সমন্বয় দরকার?
শিক্ষা হলো একটা জাতির মেরুদণ্ড। এই মেরুদণ্ডকে মজবুত করতে হলে চাই সুচিন্তিত পরিকল্পনা, রাজনৈতিক স্লোগান নয়। আমরা চাই এমন শিক্ষাব্যবস্থা যা আমাদের সন্তানদের মুক্তচিন্তা শেখাবে, তাদের দক্ষ করে তুলবে, তাদের নৈতিক করবে। ধর্মীয় শিক্ষা অবশ্যই দরকার, কিন্তু সেটা যেন জোর করে চাপিয়ে দেওয়া না হয়, বরং সামগ্রিক শিক্ষার একটি অংশ হয়।
চায়ের কাপে শেষ চুমুক দিতে দিতে ভাবি, আগামীর বাংলাদেশ কেমন হবে? আমাদের ভাই-বোনেরা কি শুধু সূরা মুখস্থ করবে নাকি স্বপ্ন দেখতে শিখবে? তারা কি শুধু পরীক্ষায় পাস করবে নাকি জীবনে সফল হবে? উত্তর নির্ভর করছে আজকের সিদ্ধান্তের উপর। এহসানুল হক মিলন এবং তার দল যদি সত্যিই দেশের কল্যাণ চান, তাহলে তাদের জনপ্রিয়তাবাদী ভাবনা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। শিক্ষা নিয়ে রাজনীতি নয়, চাই আন্তরিক প্রচেষ্টা এবং দূরদর্শী পরিকল্পনা।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।


