somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

অবশেষে

১৭ ই মার্চ, ২০১১ সকাল ৯:৪২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

অনেক মানুষের ভীড়ে সমুদ্র সৈকতে দাঁড়িয়ে সূর্যাস্ত দেখছিলেন এক ভদ্রলোক আত্মবিস্মৃত হয়ে। একসময় টুক করে লাফিয়ে অদৃশ্য হলো লালরঙা সূর্যটা সমুদ্রের বুকে। আর সেই সঙ্গে আবছা অন্ধকার ছড়িয়ে পড়লো সারা সমুদ্র সৈকতে। কিছুক্ষণ আবছা অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থেকে হোটেলে ফেরার জন্য পা বাড়ালেন ভদ্রলোক। কিছুদুর হেঁটে আসতেই থমকে দাঁড়ালেন। আবছা অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থাকা এক ধ্যানস্থ নারী মূর্তী দেখলেন। বিস্মৃতির কোন অতলে হারিয়ে গেছে কে জানে। বাতাসে উড়ছে তার শাড়ির আঁচল। একরাশ চুল বাতাসে উড়ে বার বার ঢেকে দিচ্ছে তার মুখ। কোন দিকেই তার খেয়াল নেই এমন কী অন্ধকার নেমেছে চারিদিকে এবং ইতিমধ্যেই যে জনমানব শূন্য হয়ে গিয়েছে সমুদ্র সৈকত সেটাও খেলা করেনি।
পায়ে, পায়ে সেই নারী মূর্তিটির ঠিক পাশটিতে গিয়ে দাঁড়ালেন ভদ্রলোক কিছুক্ষণ নিরব থেকে অস্ফুটে ডাকলেন, শুনছেন ---।
আবারো ডাকেন, কই শুনছেন ----। চমকে তাকায় নারীমূর্তি। আমাকে বলছেন ---?
-হ্যাঁ, রাত হয়ে গেছে। চেয়ে দেখুন একদম ফাঁকা হয়ে গেছে চারিদিক। অন্ধকারে একা এখানে দাঁড়িয়ে থাকা নিরাপদ নয়।
ও, হ্যাঁ
চলুন, আপনি তো হোটেলেই ফিরবেন, তাই না?
হ্যাঁ
অন্ধকারে দু’জনে পাশাপািশ নিরবে হাঁটতে থাকেন।
নিরবতা ভাঙ্গেন ভদ্রলোক, কয়েকদিন ধরে বিকেলে আপনাকে সমুদ্র সৈকতে দেখছি; সূর্যাস্ত দেখতে আসেন। আবার সূর্যাস্ত দেখে ফিরে যান অথচ সঙ্গে কাউকে দেখিনি! একা এসেছেন?
হ্যাঁ,
একেবারেই একা। ভদ্রলোকের কণ্ঠে বিষ্ময়।
হেসে ফেলেন ভদ্রমহিলা। একা কথাটির আর কোন সংজ্ঞা আমার জানা নেই।
আসলে আমাদের দেশে আজ পর্যন্ত একা, কোন মহিলা ঘরের বাহিরে বেরিয়ে পড়তে সাহস করেন না কিনা তাই অবাক হয়েছি।
তা ঠিক। কিন্তু কাউকে যদি সারাজীবন একাই কাটাতে হয় তাহলে কি সে ঘরর বাইরে বের হবে না। নাকি তার বেরোতে ইচ্ছে করবে না। আপনিও তো একা এসেছেন তাই না।
কি করে জানলেন?
যতবার আপনাকে দেখেছি একাই দেখেছি, সঙ্গে কেউ থাকলে নিশ্চই দেখতে পেতাম!
আশ্চর্য তো --- আপনি এতকিছু খেয়াল করেছেন। অথচ আপনাকে সবসময় আত্মমগ্নই দেখেছি। যেন জগত সংসার সম্পর্কে বিমুখ এক মানুষ। কোথা থেকে এসেছেন?
ঢাকা থেকে। আপনি?
আমিও ঢাকা থেকে। ভদ্রলোক একটু হেসে বলেন আমাদের কিন্তু এখনো ফর্মালি পরিচয় হয়নি। আমি সোহানুর রহমান শুভ। ঢাকা ইউনিভার্সিটির টিচার।
আমি ইসমত জামান তরী। ঢাকার একটি কলেজে পড়াই।
তরী - - - অন্ধকারে চমকে তাকান ভদ্রলোক। আর এমনভাবে চমকে তাকালো যে তরী নিজেই কৌতুহল বোধ করে।
আমার নাম শুনে চমকে উঠলেন যে। নামটা কি খুব চেনা - - - - ?
সরি। ব্যক্তিগত প্রশ্ন হয়ে গেল।
আপনি খুব বুদ্ধিমতি। ঠিকই ধরতে পেরেছেন। আসলে আপনার নামটা যেন অনেকদিন পর হঠাৎ করে বিস্মৃতির অতল থেকে উঠে এলো।
তাই নাকি - - - -!
কথা বলতে বলতে ওরা হোটেলের ভেতরে আসে। রিশিপসন থেকে কক্ষের চাবি নেয় দু’জনে। শুভ বলে,
আপনার কত bv¤^vi রুম?
পঁচিশ, আপনার?
আন লাকি থারটিন। হাসে শুভ। আচ্ছা শুভ রাত্রি।
পরের দিন বিকেলে আবারও দেখা হয়ে যায় তরীর শুভর সঙ্গে। দুপুরের রোদ একটু কমে আসতেই বেরিয়ে পড়েছিল তরী হোটেল থেকে। জুতো জোড়া খুলে নগ্ন পায়ে কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করে ও বালুকা বেলায়। ছোট বড় অজস্র ঢেউ আছড়ে পড়ে ওর পায়ের পাতা ভিজিয়ে দিচ্ছিল বার বার। ভারী ভালো লাগছিল ওর। কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করে এক সময় ক্লান্ত হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ছিল এক জায়গায়। মুখ ফিরিয়ে তাকাতেই দেখতে পায় এক ভদ্রলোক হেঁটে আসছে ওর দিকে।
পরনে সাদা পায়জামা-পাঞ্জাবী। মেদহীন, দীর্ঘ শরীর। মাথায় ঝাকড়া কালো কোঁকড়ানো চুল। চোখে রিমলেসের চশমা। চিনতে পারে তরী উনি কালকের সেই ভদ্রলোক, শুভ - - -
তরীর পাশে এসে দাঁড়িয়ে হাসি মুখে বলেন, কি ব্যাপার চুপচাপ দাঁড়িয়ে যে?
কথা না বলে নিরবে হাসে তরী।
থেমে থাকার নাম কিন্তু জীবন নয়, চলার নামই জীবন। চলুন হেঁটে আসি। হাঁটতে শুরু করে শুভ। কখন এসেছেন? প্রশ্ন করে শুভ।
অ-নে-ক ক্ষণ। কেন যেন ঘরের মধ্যে ভালো লাগছিলনা।
কথা বলার সময় তরী খেয়াল করলো শুভ বার, বার ওর মুখের দিকে হাসি মুখে তাকাচ্ছে। আর সেটা উপলব্ধি করে বিব্রত হচ্ছিল তরী। সেটা বুঝতে পেরে শুভ’র হাসি প্রশস্ত হলো আরও।
হাসি মুখেই বলে শুভ, আচ্ছা আপনি তো জানতে চাইলেন না আপনাকে দেখে কেন হাসছি।
কেন বলুন তো?
আপনাকে তো কাল রাতেই বলেছি তরী নামটি হঠাৎ করেই আমার বিস্মৃতির অতল থেকে উঠে এসে আমাকে চমকে দিয়েছে। তাই আপনার মুখের দিকে তাকিয়ে বার বার আপনার মাঝে তরীকে খুঁজছিলাম।
আমি বুঝি আপনার তরীর মত - - - !
আমার তরী - - - - প্রাণ খোলা হাসি হেসে ওঠে শুভ। তারপর বলে, বেশ ভালই বলেছেন। আসলে কি জানেন, আপনার সঙ্গে তার অদ্ভুত মিল, আর সব থেকে মিল হচ্ছে ঠোঁটের ওপর ছোট কাল তিলটি।আর অমিল কি জানেন, সে ছিল খুব দাম্ভিক, অহংকারী, উদ্ধত ছিল ওর ব্যবহার। আর আপনি শান্ত, সংযত। প্রদীপের আলোর মত নরম আর স্নিগ্ধ আচরণ। কিছু মনে না করলে ব্যক্তিগত প্রশ্ন করতে পারি?
বেশ তো করেন না - -
আপনার দেশ কোথায়?
দিনাজপুর - - -
দিনাজপুর - - - চমকে তাকায় শুভ। দিনাজপুর কোথায়?
মিশনরোড।
ওখানে একটি বড় মাঠ আছে তাই না?
মাথা নেড়ে সম্মতি জানায় তরী।
মাঠের অপজিটের রোডটাই তো মিশন রোড তাই না?
আপনি চিনলেন কী করে! গিয়েছেন কখনো, দিনাজপুরে?
আশ্চর্য হয়ে জানতে চায় তরী।
আপনার বাবার নাম কি আমজাদ হোসেন?
হ্যাঁ - - - আশ্চর্য তো!
আমার বাবা ট্রান্সফার হয়ে গিয়েছিলেন একবার দিনাজপুর। তখন প্রায় তিন বছর ছিলাম ওখানে।
তাই নাকি। কোথায় থাকতেন?
সার্কিট হাউজ রোড। সেখানে সরকারী কোয়ার্টারে থাকতাম।
একটা গল্প শুনবেন। হঠাৎ বলে ওঠে শুভ।
গল্প - - - শুভর কথায় চমকে তাকায় শুভর মুখের দিকে তরী। বলে হ্যাঁ।
শুনুন তাহলে - - - একটি ছেলে প্রতিদিন তার লাল বাই সাইকেলটি চালিয়ে কলেজে যেত। যাওয়ার পথে প্রতিদিন দেখা হতো একটি মেয়ের সঙ্গে। স্কুল ড্রেসপরা, j¤^v চুলের দুটি বেণী দুলিয়ে স্কুল যাচ্ছে মেয়েটি। ফর্সা, পুতুল, পুতুল চেহারা। বড়, বড় দুটো কাজল কালো চোখ। ছেলেটির ভারী ইচ্ছে হতো মেয়েটির সঙ্গে কথা বলার। কিন্তু মেয়েটি এত গম্ভীর আর অহংকারী ছিল যে ছেলেটির সাহসে কুলাতোনা।
একদিন সকালে মর্নিং ওয়ার্কে বের হয়ে ছেলেটি দেখতে পেলো মেয়েটি তার কয়েকজন বান্ধবীর সঙ্গে শিউলী ফুল কুড়োতে বের হয়েছে। পরের দিন খুব ভোরে ছেলেটি একটি লাল গোলাপ মেয়েটির দরজার সামনে রেখে এলো। এমনি করে প্রতিদিন খুব ভোরে ছেলেটি একটি করে লাল গোলাপ মেয়েটির বাড়ির বন্ধ দরজার সামনে রেখে আসতো। একদিন ছেলেটি যখন ফুল রাখতে যাবে ঠিক সেইসময় খুলে গেল বাড়ির দরজা, বেরিয়ে এল মেয়েটি। রেগে লাল হওয়া মুখে ভীষন বকলো ছেলেটিকে। মাথা নিচু করে সব তিরস্কার শুনলো ছেলেটি। কিন্তু কোন প্রতিবাদ করলো না।
শুধু অপমানিত মুখে চলে গেল মেয়েটির সামনে থেকে। গল্প শেষ হলে একরাশ কৌতুহল নিয়ে প্রশ্ন করে তরী।
আশ্চর্য আপনি জানলেন কি করে?
হাসে শুভ। এই জন্যই তো বিস্মৃতির অতল থেকে উঠে এসেছিল তরী নামটি। সময়ের স্রোতে ভাসিয়ে নিয়ে এসেছে জীবনের কোন প্রান্তে! কিন্তু তরী নামটি মনের কোনে লেখা রয়েছে ঠিকই। জীবনের প্রথম ভালোলাগার মৃত্যু বুঝি কোন দিন হয় না। বুক চিরে বেরিয়ে আসে শুভর দীর্ঘ এক শ্বাস।
তরী ওর মুখের দিকে তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নেয়। শুভর বুক থেকে বেরিয়ে আসা দীর্ঘ শ্বাস যেন ওর সে দিনের দেয়া অপমান হয়ে ওর বুকে ফিরে আসে।
কিন্তু একটা জিনিস বুঝতে পারলাম না - - -। শুভর কথায় চমকে মুখ তোলে তরী, কি?
সেদিনের সেই তরী কি, আজকের এই তরী। কি করে এত পরিবর্তন হলো বলুন তো?
হাঁসে তরী। বাহ্ এর মাঝে কত সময় গড়িয়ে গেছে না। জীবনের উপর দিয়ে কত কিছু বয়ে গেল। পৃথিবীর সব কিছুর পরিবর্তন হয়, আর মানুষের হবে না?
তা ঠিক।
অনেকক্ষণ দু’জনে নিরবে হাঁটে। একসময় শুভ ডাকে তরী - - -
সে ডাকে চমকে তাকায় তরী।
রাগ করলে? হাসে শুভ। জান, তোমাকে চিনতে পারার পর থেকে তোমাকে আর আপনি করে বলতে ইচ্ছে করছে না। আমার চোখে যেন এখনো সেই বিনুনী দোলানো মেয়েটির ছবিই ভাসছে। কি, তোমার আপত্তি নেই তো?
না - - - মাথা নাড়ে তরী। সৈকতে দাঁড়িয়ে দু’জনে সূর্যাস্ত দেখে তারপর হোটেলে ফেরে।
দুই দিন ধরে শুভ একাই সৈকতে সারাটা বিকেল কাটায়। তরীর সাথে দেখা হয় না। সূর্যাস্ত পর্যন্ত অপেক্ষা করে শুভ ফিরে যায় আবার নিজের রুমে। তরীর হঠাৎ কি হলো যে ও সৈকতে যাওয়া বন্ধ করলো এই চিন্তা ব্যাকুল করে শুভকে। রিশিপসনে খবর নিয়ে জানতে পারলো তরী চলে যায়নি ওর রুমেই আছে। তরীর রুমে গিয়ে খোঁজ নেবে কিনা এই দ্বিধা, দ্বন্দ্বে কাটালো ও কিছু সময়। অবশেষে সব দ্বিধা সরিয়ে বিকেলে তরীর রুমের সামনে এসে দাঁড়ালো। তারপর নক্ করলো।
কাম-ইন। ভেতর থেকে ভেসে এলো নারী কণ্ঠ।
দরজা ঠেলে ঘরে ঢোকে শুভ। ঘরের ভেতরে কাউকে দেখতে না পেয়ে ঘর সংলগ্ন ব্যালকনির দিকে তাকায় শুভ। চোখে পড়ে ব্যালকনিতে একটি বেতের রকিং চেয়ারে বসে আছে তরী। হাতে খোলা সঞ্চয়িতা।
মুখ ফিরিয়ে শুভকে দেখতে পেয়ে ব্যস্ত হয়ে উঠে দাঁড়ায় তরী।
আরে আপনি? আসুন - - - আসুন। তরীকে ব্যস্ত হতে দেখে বলে শুভ, তোমাকে ব্যস্ত হতে হবে না, তুমি বসো। আমিও এখানে বসছি।
রকিং চেয়ারের পাশে একটি বেতের চেয়ারে বসতে, বসতে বলে শুভ, দুইদন ধরে তোমাকে সৈকতে দেখিনি তাই ভাবলাম অসুখ বিসুখ কিছু করেনি তো। কি ব্যাপার, হোটেলেই আছ অথচ ডুব দিয়ে আছ?
মৃদু হেসে জবাব দেয় তরী, ঠিক বলেছেন ডুবই দিয়েছিলাম তবে আর কোথাও নয় নিজের মধ্যেই।
তা, ডুব দিয়ে কি পেলে - - - শুভর চোখে কৌতুক।
জীবনের যে প্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছি সেখানে নতুন করে পাওয়ার আর কিইবা আছে শুধু চাওয়া পাওয়ার হিসেব করা ছাড়া। আপনি বসুন আমি রুম সার্ভিসকে চায়ের কথা বলে আসি। ব্যস্ত ভঙ্গিতে ব্যালকনি ছেড়ে ঘরে যায় তরী।
তরীর চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আনমনা হয়ে শুভ। নিজের মনেই ভাবে, কত বয়স হলো তরীর। মেয়েদের বয়স এমন একসময়ে এসে থমকে থেমে থাকে যখন তাকে দেখে তার সঠিক সময় বোঝা যায় না। একটি দিনের মধ্যাহ্ন পেরুনোর পর সূর্যাস্ত পর্যন্ত যে সময়টি থেমে থাকে ঠিক তেমনি। রোদের প্রখরতা থাকে না। কিন্তু মিষ্টি নরম আলোয় ভরে থাকে সারা পৃথিবী। মেয়েরাও ঠিক তেমনি। নির্দিষ্ট একটি সময়ে এসে থেমে থাকে সময়টি। যৌবনের তেজ, আর প্রখরতা থাকে না ঠিকই কিন্তু বিকেলের সোনালী আলোর মত নরম আর কোমনীয় রূপটি ধরে থাকে সারা অবয়ব জুড়ে।
যে রূপ আর কোন পুরুষের চোখ জ্বালায়না বরং গোধূলীর সূর্যের মত শুধু ভালোলাগার রেশ ছড়িয়ে দেয়। তরীর ঘরোয়া সাজ আর ওর মেদহীন নিটোল শরীরের সাবলীল যাওয়ার ভঙ্গিটুকু তেমনি ভাললাগায় ভরিয়ে দেয় শুভকে। চায়ের ট্রে হাতে নিয়ে ব্যালকনিতে ফিরে আসে তরী। টেবিলের উপর ট্রে টি নামিয়ে রেখে শুভকে ডাকে।
শুভ তখনো রেলিংয়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে আছে সামান্য দুরের বালুকা বেলার আছড়ে পড়া বিক্ষুব্ধ জলরাশীর দিকে। তরীর ডাকে চমকে মুখ ফিরিয়ে তাকায় শুভ। বলে, তোমার ব্যালকনি থেকেই তো চমৎকার সমুদ্র দেখা যায়।
হ্যাঁ সে জন্যই তো দুটো দিন এখানে বসেই সূর্যাস্ত দেখলাম। শুভর হাতে চায়ের কাপ তুলে দেয় তরী। আনমনে সেটাতে চুমুক দিয়ে জানতে চায় শুভ, আচ্ছা তরী আমি জানি একটি মানুষ নিজের জীবনের উপর কতবড় বিতশ্রদ্ধ হলে সমাজ, সংসার সব ফেলে একা বেরিয়ে পড়তে পারে কিন্তু তোমার জীবনে এমন কি ঘটলো যার জন্য তুমি সংসার ফেলে একা বেরিয়ে এসেছো। আমাকে কি সে কথা বলা যায় না?
অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে বলে তরী, সঙ্গহীন, নিঃসঙ্গতায় কাটে যার জীবন সে একা না বেরিয়ে কি করবে বলুন? কোথায় পাবে সে তার পথ চলার দোসর।
কী বলছো তুমি - - -? আর্তনাদের মত শোনায় শুভর কণ্ঠস্বর।
আমি ঠিকই বলেছি। আমার আজকের কথা জানতে হলে যে আপনাকে আমার জীবনের সব কিছুই জানতে হবে। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলতে শুরু করে তরী। ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা দিয়ে আমি রেজাল্টের অপেক্ষায়। এর মধ্যে আমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেল বাবার এক বন্ধুর ছেলের সঙ্গে। ইঞ্জিনিয়ার ছেলে, ভালো চাকুরী করে। স্বামী আমার থেকে বয়সে অনেক বড়। কাজেই সংসারে তার একছত্র আধিপত্য এবং স্বেচ্ছাচারিতা আমাকে মেনে চলতে হতো। তবুও সব কিছু মেনে চলতে চেষ্টা করেছিলাম। শুধুমাত্র তার অমত থাকা সত্ত্বেওI পড়াটা ছাড়িনি। সব প্রতিকুলতার সাথে যুদ্ধ করেও মাষ্টার্স কমপ্লিট করেছি।
এর মাঝে দুই বছরের মাথায় মেয়ে আঁকার জন্ম হয়েছে। মেয়ে নিয়ে অনেক কষ্টের মধ্যেও জীবন কেটে যাচ্ছিল। কিন্তু ভাগ্যে নেমে এলো আবার বিপর্যয়। মেয়ের যখন পাঁচ বছর বয়স ঠিক সে সময় আঁকার বাবা হার্ট এ্যাটাকে মারা গেলেন।
আমি আর মা, বাবার কাছে দেশে ফিরে যাইনি। ঢাকার সে বাড়িতেই আমি মেয়েকে নিয়ে থেকে গেলাম। এর মাঝে একটা প্রাইভেট কলেজে চাকরীও জোগাড় করে নিলাম। চাকরী আর মেয়ে এই নিয়েই কাটতে লাগলো আমার সময়। মেয়েকে মানুষ করার স্বপ্নে মগ্ন হয়ে জীবনের সব দুঃখ কষ্ট ভূলে গেলাম আমি।
কিন্তু সে স্বপ্ন একদিন ভেঙ্গে গেল আমার। মেয়ে ইন্টার পড়ার সময় ওর কলেজেরই এক ছেলেকে গোপনে বিয়ে করলো। আমার স্বপ্ন, সব সাধ ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেল। বেঁচে থাকাই যেন অর্থহীন হয়ে গেল আমার কাছে। বিশ্বাস করেন আমার চেনা ঐ শহরটি যেন কারাগার মনে হতে লাগলো। আর তাই কাউকে কিছু না জানিয়ে পালিয়ে এলাম সেখান থেকে, কিন্তু নিজের কাছে কি পালাতে পেরেছি? নিজের অজান্তে দু'চোখ জলে ভরে তরীর।
সত্যি কি বিচিত্র এই মানুষের জীবন। ম্লান হেসে বলে শুভ, কিন্তু তরী এই পৃথিবীতে তুমি একাই শুধু একা নও। তোমার মত কত মানুষ একাকী জীবন যান করছে। আমার কথাই ধরো না, আমিও তো আপ্রাণ চেষ্টায় আমার সংসারটাকে ধরে রাখতেই পারিনি। তারপর থেকেই চলছে আমার একাকী জীবন। কথা শেষ করে চুপ করে থাকে শুভ। দু’জনে পাশাপাশি বসে থাকে নিরব হয়ে। দু’জনের দৃষ্টি তখন দূরের আকাশে নিবন্ধ। সূর্য তখন পশ্চিম আকাশের শেষ দিগন্তে নেমে এসেছে। গোধূলীর লাল রংয়ে সারা পৃথিবী লাল। একা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ডাকে শুভ, তরী - - -
হুঁ।
আচ্ছা তরী সময়ের স্রোতে ভেসে, ভেসে আমরা অনেক দূরে এসে পড়েছি সত্যি যেখান থেকে আবার শুরুতে পৌঁছানো যায় না। কিন্তু এখান থেকেই কি আবার আমরা নতুন করে শুরু করতে পারিনা?
তা আর হয় না - ম্লান মুখে বলে তরী।
কেন হয় না? কোন ডুবন্ত মানুষ যদি বাঁচার জন্য সামান্য ভাসমান ঘর, কুটো যা পায় তাই আঁকড়ে বাঁচতে চায় তবে কি সেটা অপরাধ।
হয়তো অপরাধ নয়, কিন্তু কি প্রয়োজন। জীবনের শেষ প্রান্তে তো এসেই পড়েছি কতটুকুই বা আর পথ বাকী। সামনে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে শুধুই অন্ধকার রাত্রি।
কিন্তু তরী, রাত্রী কি শুধু একটি দিনের পূর্ন অবসান। একটি রাত কি আর একটি সূর্যোদয়ের প্রতিশ্রুতি বয়ে আনে না। প্রিয়জনের সঙ্গ মুখর একটি রাত কি মানুষের জীবনের সব ক্লান্তি মুছিয়ে দিয়ে আর একটি কর্মমুখর দিনের জন্য প্রেরণা জোগায় না। বল তরী, জবাব দাও? স্যরি তরী - - - বিব্রত কণ্ঠে বলে ওঠে শুভ। তোমাকে আঘাত করার জন্য কথাগুলো আসলে আমি বলিনি। আমাকে ক্ষমা করো। মাথা নীচু করে ব্যালকনি ছেড়ে ধীরে পায়ে চলে যায় শুভ।
ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও দুটো দিন শুভ এড়িয়ে গেছে তরীকে। তারপর দ্বিধা দ্বন্দ্ব সরিয়ে একসময় আবার হাজির হয়েছে তরীর কাছে।
বালিশে হেলান দিয়ে আধশোয়া হয়ে চোখ বুঁজে শুয়ে ছিল তরী। এমনসময় একগুচ্ছ রজনীগন্ধা হাতে ঘরে আসে শুভ। কেমন আছ তরী?
ভালো।
তাহলে বাইরে বেরুচ্ছোনা কেন? আমি ভাবলাম - - -
ফুলগুলো তুলে দেয় শুভ তরীর হাতে। তারপর চোখে মুখে কৌতুকের হাসি ফুটিয়ে বলে, ফুল দেবার অপরাধে আজও বকা থেকে হবে না তো?
হাসে তরী। বেশ তো বকা যদি খেতেই হয় তাহলে সেদিনের না বলা কথা গুলো আজ না হয় বলে ফেলো।
ম্লান মুখে বলে শুভ, তাই কি হয় তরী, সময়ের কথা সময়ে বলতে না পারলে যে কি হয় নিজের জীবনেই তো উপলব্ধি করেছি।
ও তোমাকে তো বলাই হয়নি, কাল সকালে আমি চলে যাচ্ছি।
চলে যাচ্ছ - - ! অবাক হয়ে জানতে চায় তরী, কই চলে যাবে সে কথা আগে বলনি তো?
না গিয়ে কি করবো বলো, ছুটি ফুরিয়ে গেছে যে, কিন্তু তুমি - - - তুমি কি করবে? তোমাকে এভাবে একা ফেলে রেখে যেতে মন চাইছে না।
তরী - - ইংরেজীতে একটা প্রবাদ আছে ‘ব্যাচেলর লিভ লাইক এ কিং ব্যাচেলর ডাই লাইক এ ডগ্। একটি মানুষ সঙ্গী ছাড়া চলতে পারে ঠিকই কিন্তু শুধু মৃত্যুর সময়টুকু সুন্দর হওয়ার জন্যই তার সঙ্গী সাথীর প্রয়োজন হয়। কথাটা বলে নিরব হয়ে যায় শুভ।
তরীও নত মুখে নিরব থাকে। অনেকক্ষণ পর শুভ বলে, তুমি তাহলে কি ঠিক করলে?
আমি ঠিক বুঝতে পারছিনা শুভ, কি করবো - - -।
বেশ তো - - - আজ সারাদিন ভাব। কাল সকালের মধ্যে আমাকে জানালেই হবে। তারপর হেসে বলে, তরী আমার নিরব নিবেদন আজও পড়ে রয়েছে পথের ধূলোয়, ইচ্ছে হলে মাড়িয়ে যেতে পারো আবার তুলে গলায় পরতেও পারো।
উঠে দাঁড়ায় শুভ, আমি তাহলে আসি। যদি যেতে চাও জানিও নইলে আজই শেষ দেখা। শুভ রাত্রি - - - চলে যায় শুভ।
স্তব্ধ হয়ে বসে থাকে তরী। তারপর দু'চোখের জলের ধারাকে আঁচলে মুছে উঠে দাঁড়ায় তরী।
সমাপ্ত
২টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

পানির অপচয় রোধ: ইসলামের চিরন্তন শিক্ষা এবং সমকালীন বিশ্বের গভীর সংকট

লিখেছেন নতুন নকিব, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৮:৪৬

পানির অপচয় রোধ: ইসলামের চিরন্তন শিক্ষা এবং সমকালীন বিশ্বের গভীর সংকট



পানি জীবনের মূল উৎস। এটি ছাড়া কোনো প্রাণের অস্তিত্ব সম্ভব নয়। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তা'আলা ইরশাদ করেন:

وَجَعَلۡنَا... ...বাকিটুকু পড়ুন

মায়াময় স্মৃতি, পবিত্র হজ্জ্ব- ২০২৫….(৭)

লিখেছেন খায়রুল আহসান, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৭

ষষ্ঠ পর্বের লিঙ্কঃ মায়াময় স্মৃতি, পবিত্র হজ্জ্ব- ২০২৫-….(৬)

০৬ জুন ২০২৫ তারিখে সূর্যোদয়ের পরে পরেই আমাদেরকে বাসে করে আরাফাতের ময়দানে নিয়ে আসা হলো। এই দিনটি বছরের পবিত্রতম দিন।... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাদিকে shoot করে লাভবান হলো কে?

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৩:২৪


শরিফ ওসমান হাদি যিনি সাধারণত ওসমান হাদি নামে পরিচিত একজন বাংলাদেশি রাজনৈতিক কর্মী ও বক্তা, যিনি জুলাই গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে গঠিত রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র হিসেবে পরিচিত। তিনি ত্রয়োদশ... ...বাকিটুকু পড়ুন

আধা রাজাকারি পোষ্ট ......

লিখেছেন কলিমুদ্দি দফাদার, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৩:৫৬


আমি স্বাধীন বাংলাদেশে জন্মগ্রহণ করেছি। আমার কাছে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা, বা পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে আজকের বাংলাদেশের তুলনা—এসব নিয়ে কোনো আবেগ বা নস্টালজিয়া নেই। আমি জন্মগতভাবেই স্বাধীন দেশের নাগরিক, কিন্তু... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইন্দিরা কেন ভারতীয় বাহিনীকে বাংলাদেশে দীর্ঘদিন রাখেনি?

লিখেছেন জেন একাত্তর, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৫:২০



কারণ, কোল্ডওয়ারের সেই যুগে (১৯৭১সাল ), আমেরিকা ও চীন পাকিস্তানের পক্ষে ছিলো; ইন্দিরা বাংলাদেশে সৈন্য রেখে বিশ্বের বড় শক্তিগুলোর সাথে বিতন্ডায় জড়াতে চাহেনি।

ব্লগে নতুন পাগলের উদ্ভব ঘটেছে;... ...বাকিটুকু পড়ুন

×