স্বচ্ছনীল দরিয়ার বুকে জলযান সওয়ারী জুম্মন একটি গন্তব্যহীন যাত্রা করে।ক্ষণিক ব্যবধান অতিক্রম করার পর ১৮০ ডিগ্রী কোণে কোন কিছুই আর দৃশ্যমান নেই কেবল অথৈ জল ছাড়া।এখানে থেকে উপলোব্ধি করা যায় আমাদের পৃথিবীটা কি সুন্দর!আমাদের এই সুন্দর পৃথিবীতে আছে অনেক সুন্দর ও মনোরম দৃশ্য। কিন্তু সেসবগুলোই এই অথৈ দরিয়ার কাছে যেন মলিন।কতইনা মনোহর আমাদেরই এই দরিয়াটা!জলযান থেকে সুদূরে অথৈ দরিয়া আর স্বচ্ছনীল আকাশ মিলেমিশে একাকার! জলযান যত সামনে অগ্রসর হয় দরিয়ার জল দুদিকে সরে যায় আর জানান দেয় সলাজ অভিবাদন।এই দরিয়ায় জুম্মন যেন একজন অতিথি।
হঠাতই একটু দূরে অস্বচ্ছ কালো কিছু একটা দৃশ্যমান হতে শুরু করলো।ধীরে ধীরে সেটার অবয়ব গাড় হচ্ছে।সম্মুখে উপরিভাগ থেকে পানির ধারা আচমকা প্রচন্ড বেগে আকাশের দিকে ছুটে যায়।আরে!এটাতো একটা তিমি। জুম্মনের বুঝতে দেরী হল না।ন্যাশানাল জিওগ্রাফীতে এমন দৃশ্য সে সবসময়ই দেখে।কিন্তু জুম্মন একজন অনভিজ্ঞ মানুষ।আগে কখনও সে দরিয়া পথে যাত্রা করেনি। চোখের সম্মুখে ঘটতে থাকা প্রতিটি দৃশ্যই তার কাছে নবীন।জলযানের গতি ধীরে ধীরে বেড়ে যায়। জুম্মন উপলোব্ধি করলো বাতাস আগের তুলনায় অনেক জোরেই তার শরীর ছুঁয়ে দিচ্ছে।হঠাত সে তোরনে একটি ধাক্কা অনুভব করে!বাতাসের চাপও ধীর হয়ে যায়। পিছনে ঘাড় মুড়তেই দেখে জলযান ঘেঁষা ডলফিনদের সমাহার।ছোটবেলায় শুনেছে ডলফিন খুবই বন্ধু সুলভ প্রানী আর আজকে চোখের সামনে সেটার বাস্তব প্রতিফলন দেখছে সে।
এটা ভাবতেই জুম্মনের চোখে-মুখে খুশীর প্রবাহ যেন আরও কয়েকগুনে বেড়ে যায়।জুম্মন ডলফিনগুলোর হাস্যোজ্জ্বল চেহারের পানে তাকিয়ে নিজেও হাসছে।কিন্তু তার হাস্যোজ্জ্বল মনে ধীরে ধীরে স্থান করে নেয় গম্ভীরতা । তার আননখানি আবেগঘন হয়ে যায়।মুহূর্তেই চোখ ঝলসে জল বের হয়ে আসে জুম্মনের । জুম্মনের এই কাঁদো কাঁদো চেহারা বলছে, এমনও কিছু মানুষ আছে যারা মানবতার পদ্য শুনিয়ে বেড়ায় জায়গায় জায়গায় আর তাদের অনেকেই এই বন্ধুসুলভ প্রানীগুলোকে হত্যা করছে তুচ্ছ আনন্দ পাওয়ার জন্য। আসলে মানুষ এখন কেবল গঠনে কর্মে নয়।এই ভেবে জুম্মন নিজেকে সান্ত্বনা দেয়।
জুম্মন তার ব্যাগ থেকে একটি নোটবুক বের করে।নোটবুকে সে প্রতিদিনের ঘটনাগুলো টুকে রাখে।এটা তার শখ।জুম্মন লিখতে শুরু করলো,আমাদের এই দরিয়াটা কত মহান!এতো বড় তার আকৃতি অথচ মনে কোন অহংকারবোধ নেই।হরেক রকম প্রানীকে স্থান দিয়ে রেখেছে কোন বিনিময়বোধ ছাড়াই। আহ! এটাই দরিয়া আর মানুষের মাঝে পার্থক্য।মানুষের মনের বিশালত্ব দরিয়া থেকে কোন অংশে কম নয় তারপরও সে পবিত্র মনটাতে নাপাককেই স্থান দিয়ে থাকে।জুম্মন আরও লিখলো, এই সুবিশাল দরিয়া নিজেকে নিয়ে তার কোন চিন্তা নেই,তার ভাবনাগুলোতো কেবল অন্যদেরকে ঘিরে।অথচ মানুষ সর্বদাই স্বার্থপরের মতো পরিচয় দেয়।কতই না নিকৃষ্ট তার মনোভাব! একটি দরিয়া যেমন অজস্র জীবের সমাহারে সুন্দর, মানুষও তেমনি এই পৃথিবীর কারণে এতো সুন্দর।কিন্তু যদি এই সুন্দর পৃথিবীকে পরিচর্যা না করা হয় তবে খুব শিঘ্রই এটা ধবংস হয়ে যাবে।তখন আমাদেরও বেঁচে থাকা হয়ে উঠবে দুর্বিষহ।
লিখনির মধ্য দিয়েই আচমকা, কতগুলো ভারী বস্তু জলযান থেকে সামান্যতম ব্যবধানে ধুস ধুস শব্দে দরিয়ার পানিতে ডুবে গেল।বিষয়টা বুঝে উঠতে না পেরে জুম্মন ভয় পেয়ে যায়।সে এখানে নতুন সামনে যা ঘটছে সেসবও তার কাছে রহস্যময়।ধীরে ধীরে তার হৃৎপিণ্ডের স্পন্দন বাড়তে শুরু করে।ভয়ার্ত অনুভবে ধীরে ধীরে সে বস্তুগুলো ভাসতে শুরু করে।জুম্মন বিস্ময়ের সাথে বলে উঠলো, আরে এগুলো তো পাখি! সে ব্যাগ থেকে দূরবীন বের করে বুঝলো, পাখিগুলো যেই সেই পাখি নয় এগুলো সামুদ্রিক পেট্রোল পাখি।গায়ে সাদা সাদা পালক,ওষ্ঠদ্বয় হলদে বাদামী রঙ্গের।সে দেখলো প্রতিটি পাখির ঠোটে একটি করে মাছ আটকে আছে।ধীরে ধীরে এক এক করে ফির আকাশের বুকে উড়াল দেয় নিজ নিজ গন্তব্যের উদ্দেশ্যে।বোধ হয় আজ তাদের ভালোই ভুড়িভোজ হতে যাচ্ছে।
অতঃপর জুম্মনের চোখজোড়া আকাশের দিকে কেন্দ্রীভূত হয়।সে দেখলো একটি স্বচ্ছ নীল আকাশ।রোজ বিকেলে মারিয়ার সাথে বাড়ির ছাদ থেকে তারা আকাশ উপভোগ করে।মারিয়া, জুম্মনের স্ত্রী।আজ বিকেলে মারিয়ার সাথে আকাশ উপভোগ করা হয়তো সম্ভব নয় তাই পকেট থেকে স্মার্ট ফোনটি বের করে মারিয়াকে ম্যাসেজ করে,” থাকো কাছে অথবা দূরে ওপরের দিকে তাকিয়ে দেখ আকাশ এখন স্বচ্ছনীল।জুম্মন মোবাইলটি আবার পকেটে রেখে দেয়।সে ফির লিখুনীতে মননিবেশ করে।সে লিখে, এমন আকাশ দেখতে পাওয়া যায় কেবল দরিয়ার বুক থেকেই।আজকাল কোথাও একটু খোলা জায়গা দেখা যায় না যেখানে দাঁড়িয়ে নয়নাভিরাম আকাশটাকে উপভোগ করা যাবে।সব কিছুই দখল করে রেখেছে মানুষ।বাসা থেকে বের হলেই চতুর্দিকে কেবল বিল্ডিং আর বিল্ডিং।মাথার ওপর যা একটু দেখা যায়।এটুকু দেখতে গেলে উপভোগ করার দূরে থাক, ঘাড় ব্যাথা হয়ে যায়।
আমাদের এই দরিয়াটা তার নীলাচলে কি যত্ন করে আমাদের আগলে রেখেছে!কিন্তু বড্ড আজব ব্যাপার, এতে তার ন্যূনতমও কষ্টবোধ হয় না।মানুষের মাঝে এমন অনেকেই আছেন যারা বলেন আমাদের এই সমুদ্র মাঝে মাঝে প্রতিশোধপ্রবনও হয়ে ওঠে।তারা আসলে বোকা লোক।প্রকৃতি কখনও প্রতিশোধ প্রবন হয়ে ওঠে না বরং প্রকৃতি থেকে যা ঘটে সেসব আমাদেরই কর্মের প্রতিফল বলে মেনে নিতে হবে।প্রকৃতিরও নিজস্ব স্বভাব আছে।আমরা যদি সেগুলোতে কোন ব্যতিক্রম কিছু আনার জন্য কাজ করি তার দরুন সেটা আমাদের ওপর চেপে বসে না আমরাই তাকে আমাদেরও ওপর চাপিয়ে আনি।আর এতে তার সৌন্দর্য বিনষ্ট হয়,ধবংস হই আমরা।প্রকৃতির ব্যাপারটা এমন যে,যদি তুমি নম্র হও তবে আমাকেও পাবে নম্র আর যদি তুমি হও কঠোর তারপরও আমাকে নম্রই পাবে কিন্তু তখন তুমি সেটা সহ্য করতে পারবে না।আর মহান আল্লাহ বলেন,আমরা যেন নিজেদেরকে ধবংসের দিকে ঠেলে না দেই। কিন্তু আল্লাহর কথা আজ মানে কয়জনে? দেহে যতক্ষন পর্যন্ত প্রান থাকে ততক্ষনে একজন মানুষ সহস্রাধিকবার বদলায়।।সে নিজেকে নিয়ে ভাবতে ভাবতে একসময় এসে উপলব্ধি করে স্বার্থ মানুষকে শূন্যতা ছাড়া আর কিছুই দেয় না।
লিখতে লিখতে কখন যে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এল জুম্মন টেরই পেল না।আজকের মতো নোটবুক বন্ধ করে দিলো সে।তার উদ্দেশ্য এখন যতদ্রুত সম্ভব বন্দরে পৌঁছানো।কিন্তু কোন দিকে যাবে সেটা নিয়ে একটা দুশ্চিন্তায় পড়ে গেল জুম্মন।তৎক্ষণাৎ মনে পড়লো স্মার্টফোনটি সে সাথে করেই নিয়ে এসেছে।আল্লাহর রহমত গুগল ম্যাপকে অনুসরন করার মাধ্যমে রাত হওয়ার আগেই সে বন্দরে পৌঁছে যাবে।স্মার্টফোনটি খুলতেই দেখলো মারিয়ার ম্যাসেজ ডিস্প্লেতে ভেসে আছে।সময় ৫ মিনিট।জুম্মন ম্যাসেজটি খুলে দেখলো,ফিরবে কখন? আকাশটা যে ধীরে ধীরে আঁধারের দিকে ধাবিত হচ্ছে!জুম্মন ফিরতি ম্যাসেজে পাঠিয়ে দিলো,ভয় নেই আল্লাহ আমার সাথেই আছে।এই লিখে জুম্মন বন্দরের দিকে রওয়ানা হয়।
_ডায়েরিতে লিখা ছিলো
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই এপ্রিল, ২০২০ রাত ৯:৩৬