আবুল মনসুর আহমদকে আমরা চিনি। খ্যাতিমান লেখক, বুদ্ধিজীবী ও আওয়ামী লীগ নেতা। ডেইলি স্টার পত্রিকার সম্পাদক মাহফুজ আনামের বাবা। তাঁর লেখা আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাস বিষয়ক একটি অনবদ্য গ্রন্থ। এই বইয়ে অত্যন্ত সাবলিল ও প্রানবন্ত ভাষায় বাংলাদেশের রাজনীতির তিনকাল বৃটিশ, পাকিস্তান ও স্বাধীন বাংলাদেশের শুরুর দিকের ইতিহাস বর্ণনা করা হয়েছে। বইটি থেকে এই উপমহাদেশের রাজনীতির ইতিহাস সম্পর্কে একটি স্বচ্ছ ও প্রায় নিরপেক্ষ মূল্যায়ন পাওয়া সম্ভব।
এছাড়া বর্তমান রাজনৈতিক বিতর্কের ব্যাপারে স্বচ্ছ দৃষ্টিভঙ্গি তৈরীতে বইটি সাহায্য করবে বলে আশা করা যায়।
আমি ধারাবাহিক ভাবে এই বই থেকে কিছু প্রাসঙ্গিক তথ্য এই ব্লগে উপস্থাপন করব ইনশাল্লাহ।
আজকের প্রসঙ্গ দালাল আইন।
বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত আবুল মনসুর আহমদ রচনাবলীর তৃতীয় খন্ডে আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর বইটি সংযাজিত হয়েছে।
এই খন্ডের ৪৬৮ পৃষ্ঠায় শেখ মুজিবুর রহমানের পাকিস্তান থেকে দেশে ফিরে আসা, সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, দেশের মানুষের জন্য ভাবনা ইত্যাদি ইতিবাচক বর্ণনার পাশাপাশি চাঁদে কলঙ্ক শিরোনামে বলা হয়েছে-
অকস্মাৎ ২৪ জানুয়ারি আমাদের রাজনৈতিক চাঁদে কলঙ্ক দেখা দিল। কলঙ্ক তো নয়, একবারে রাহু। সে রাহুতে চাঁদ দ্বিখন্ডিত হইল। রাহু দুইটি। প্রেসিডেনশিয়াল অর্ডার নম্বর ৮ ও ৯। একটার নাম দালাল আইন। আরেকটার নাম সরকারী চাকুরী আইন। উভয়টাই সর্বগ্রাসী ও মারাত্নক। একটা জাতিকে, অপরটা গোটা প্রশাসনকে দ্বিখন্ডিত করিয়াছে। সে সবের প্রতিকার দুঃসাধ্য ও সময়সাপেক্ষ। অথচ এ দুইটা পদক্ষেপই ছিল সম্পূর্ণ অনাবশ্যক।
সব দমননীতিমূলক আইনের মতই দালাল আইনেরও ফাঁক ছিল নির্বিচারে অপপ্রয়োগের। হইয়াও ছিল দেদার অপপ্রয়োগ। ফলে নির্যাতন চলিয়াছে বেএন্তেহা। যে আওয়ামী লীগ নীতিতঃই নিবর্তনমূলক আইনের বিরোধী, একজন লোককেও বিনা-বিচারে একদিনও আটক না রাখিয়া দেশ শাসন যে আওয়ামী লীগের ঐতিহ্য, সেই আওয়ামী লীগেরই স্বাধীন আমলে অল্পদিনের মধ্যেই ত্রিশ-চল্লিশ হাজার নাগরিক গ্রেফতার হইয়াছেন এবং বিনা-বিচারে প্রায় দুই বছর কাল আটক আছেন। বেশী না হইলেও প্রায় সম-সংখ্যক লোক বাড়ী-ঘর ছাড়িয়া ভিন্ন-ভিন্ন জায়গায় আত্নগোপন করিয়া বেড়াইতেছেন। গ্রেফতারিত ব্যক্তিরা জামিনাদি ব্যাপারে আদালতী সুবিধা পাইতেছেন না। অতি অল্প সংখ্যক লোক ছাড়া কারো বিরুদ্ধে চার্জশীট হইতেছে না। এমনকি, তদন্তও শেষ হয় নাই। এ সবই সর্বাত্নক দমন আইনের উলঙ্গ রুপ ও চরম অপপ্রয়োগ।
নাগরিকদের ব্যক্তিগত ভোগান্তি ছাড়াও এ আইনের একটা জাতীয় মারাত্নক দিক আছে। এই আইন গোটা জাতিকে দেশপ্রেমিক ও দেশদ্রোহী এই দুই ভাগে বিভক্ত করিয়াছে? অথচ দেশবাসীর চরিত্র তা নয়। ১০ জানুয়ারি শেখ মুজিব যখন দেশে ফিরেন, তখন তিনি কোনও দলের নেতা ছিলেন না। নেতা ছিলেন তিনি গোটা জাতির। তাঁর নেতৃত্বে অনুপ্রাণিত হইয়া মুক্তিযোদ্ধারা বাংলাদেশের যে স্বাধীনতা আনিয়াছিলেন সেটা কোন দল বা শ্রেণীর স্বাধীনতা ছিল না। সে স্বাধীনতা ছিল দেশবাসীর সকলের ও প্রত্যেকের। এমন কি, যাঁরা স্বাধীনতার বিরোধিতা করিয়াছিলেন তাঁদেরও। সব দেশের স্বাধীনতা লাভের ফল তাই। ভারতের স্বাধনিতা আনিয়াছিল কংগ্রেস: অনেকেই তার বিরোধিতা করিয়াছিলেন। পাকিস্তানের স্বাধীনতা আনিয়াছিলেন মুসলিম লীগ। অনেকেই তার বিরোধিতা করিয়াছিলেন। কিন্তু স্বাধীনতার পর সবাই সে স্বাধীনতার স্বাদ ভোগ করিতেছেন। স্বাধীনতার বিরোধিতা করার অপরাধে কাউকে শাস্তি ভোগ করিতে হয় নাই। কোনও দেশেই হয় না। সব স্বাধীনতা-সংগ্রামের বেলাই এটা সত্য। বাংলাদেশের ব্যাপারে এটা আরও বেশী সত্য। বাংলাদেশের সংগ্রাম শুরু হয় নিয়মতান্ত্রিক পন্থায়, নির্বাচনের মাধ্যমে। সে নির্বাচনে স্বাধীনতা নির্বাচনি ইশু ছিল না। আওয়ামী লীগও অন্যান্য পার্টির মতই পাকিস্তান-ভিত্তিক বিভিন্ন কর্মসূচীর ভিত্তিতে নির্বাচন লড়িয়াছিল। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ একক বিজয়ী হয়। পাকিস্তানের সামরিক সরকার সে নির্বাচন না মানিয়া তলওয়ারের জোরে পূর্ব পাকিস্তানীদের শিখাইতে চায়। তখনই সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু হয়। এ সংগ্রামের জন্য আওয়ামী লীগও প্রস্তুত ছিল না। অন্য সব দলত নয়-ই। এই সশস্ত্র সংগ্রাম অন্যান্য দেশের মত দীর্ঘস্থায়ী হয় নাই। ন মাসেরও কম সময়ে আমরা স্বাধীনতা লাভ করি। স্বাধীনতা-সংগ্রাম যদি দীর্ঘ হইত, তবে সংগ্রাম চলিতে থাকা অবস্থায় দলীয় স্তরেও আমাদের ঐক্য সাধিত হইয়া যাইত। মাত্র ন মাসের যুদ্ধেই আমাদের দেশবাসী জনগণের স্তরে ঐক্যবদ্ধ হইয়া গিয়াছিল। জনগণের সে ঐক্য নেতৃস্তরেও প্রসারিত হইত, তাতে কোনও সন্দেহ নাই। কিন্তু মুক্তি-যুদ্ধ হঠাৎ অল্পদিনেই শেষ হইয়া যাওয়ায় সকল দলের জাতীয় স্তরে সেটা দানা বাঁধতে পারে নাই।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।


