ভোর রাতের দিকে ঘুম পেয়েছিল লীনার । উঠে পড়ল বিছানা ছেড়ে । গতকাল ক্লাস শেষে মুন্নী মেয়েটা এত সময় ধরে তাকে যেটা বোঝাতে চাইল , রাজী করাতে চাইল সে বিষয়ে লীনা কতখানি অপারগ মুন্নী বুঝল বলে বাঁচা গেল । কিন্তু লীনা নিজে ? সে কি পারছে নিজের সাথে বোঝাপড়া শেষ করতে? সে কি পারছে দীপুর কথা না ভেবে থাকতে ? কেন পারছে না ? পারতে তাকে হবে ।
ডলি মেয়েটার জন্য মায়া হয় । দিপুকে পাবার জন্য মরিয়া হয়ে গিয়েছে । কতভাবে কত কি করছে । ডলির সাথে দিপুকে মানাবে কি মানাবে না সেটা নিয়ে বিস্তর আলাপ চলে বন্ধুদের মধ্যে । দীপু যে ডলিদের গ্রুপটাকে তেমন পছন্দ করে না , দিপুর বন্ধুরাও না সে কথা মিথ্যে নয় । এতসব এলোমেলো ভাবনা রাত পার করে দিল তার , কোন সমাধান দিতে পারল না ।
লীনা এগিয়ে যেতে চায় । পরিবারের সন্মান আত্মসন্মান স্বনির্ভরতা এ শব্দগুলো নাড়াচাড়া করে মাথার কোষগুলো ভেদ করে । বড় চাচীর নির্মল আকাঙ্খা লীনাকে নিয়ে , বড় চাচী নিজের জীবনে যা পারেন নি তার সাথর্করূপ দেখতে চান লীনাকে দিয়ে । লীনার মমতাময়ী আদর্শময়ী মা তার মেয়েকে সুখী সৎ মানুষ হিসেবে আশা করেন , বড় চাচী স্বপ্ন দেখেন অনেক উঁচু । জানেনা লীনা সে কি পারবে আর পারবে না । তবে এসব মানুষের নি:স্বার্থ চাওয়ার কাছে প্রনতি জানায় সে ।
বিবাদহীন , নির্ঝঞ্ঝাট জীবন কাম্য লীনার । তার পর্যবেক্ষন ক্ষমতা, চেনা জানা অনেকের চেয়ে বেশী ; ভুল করবার ব্যাপারে সাবধান হতে চায় সে । তবু বার বার এত সব যুক্তির ছিদ্রদ্পথে ঢুকে পড়ে দিপু , দীপুর দুই চোখ । ওই দু'চোখে কত কথা ! কেমন আকুলতা ! লীনার মত শক্ত, বুদ্ধিমতী মেয়েও পারে না তাকাতে দীপুর চোখে । হারিয়ে যাবার , হেরে যাবার ভয় তার । একটা কিছু বিহিত হওয়া দরকার । যত তাড়াতাড়ি পারা যায় সবার মঙ্গল , কানাঘুষা থামবে ।
নাহ্ , আজ সে কথা বলবে দীপুর সাথে । ডলি তাকে এত ভালবাসে , সে কেন ডলিকে উপেক্ষা করবে । ডলি স্মার্ট , আধুনিক , লেখা-পড়ায় ভাল । কেন তাকে দীপু এড়িয়ে যাবে । ডলি লীনারও সহপাঠি বন্ধু ।
ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসে এলে মনে হয় এক অন্য জগৎ । নাগরিক জীবনের যন্ত্র , যন্ত্রনারা এখানে পরিভাষা পায় নির্জনতার । শহুরে কোলাহল এখানে স্তব্ধ হয়ে থাকে তরুন -তরুনীদের জটলায় জটহীন জীবনের শুরু উপভোগের জন্য । কান পেতে থাকে তাদের নিষ্পাপ অঙ্গীকার শুনতে । গাছ-পালা , লতা-পাতা সবাই স্বাক্ষী দেবে বলে পাখী আর ফুলেদের দলে ভিড়িয়ে নেয় -- তারা যুগ যুগ ধরে অটল যেন ; যেন মানুষ গড়ার বিশাল এ কারখানার বিশুদ্ধ বাতাস তাদের আয়ু বাড়িয়ে দেয় । এখানে এলে মন খারাপ উড়ে যায় লীনার । আজ মন খারাপ নেই তার , তবে মন শক্ত করে এসেছে সে সেটা ধরে রাখার শক্তি নিয়ে দ্বিধাগ্রস্থ হয়ে পড়ে এক একবার ।
সকালের ক্লাসে না গিয়ে ক্যান্টিনে অপেক্ষা করে সে । জানে ১১টায় চা খেতে আসবে সব ক্লাস শেষে । দীপুর সাথে কথা বলতে হবে তার আজ ।সকল দ্বিধা ঝেড়ে ফেলে , নিজেকে প্রস্তুত করে নেয় । দীপু আজ ক্লাসে এসেছে কিনা , চা খেতে আসবে কিনা ভাবতে ভাবতে কোণার টেবিলে গিয়ে জানালার পাশে চেয়ার টেনে নিয়ে বসল সে ।
জানালা দিয়ে দূরে রাস্তার লোক চলাচল দেখল খানিক ক্ষন । নিজেকে সহজ স্বাভবিক করবার জন্য এদিক ওদিক বিষয় খুঁজছিল । কেন স্পঞ্জ স্যান্ডেল পরেও জোরে জোরে হাটে কিন্তু পিছলে পড়ে না স্যাঁতসেঁতে ফ্লোরে ক্যান্টিনের ছেলেরা , কেন ক্যান্টিন ম্যানেজারের ভুড়ি ফুটবলের মত মোটা , কেন ছোট ছোট ছেলেরা সারাক্ষন ফরমায়েস খাটে এখানে -- যাবতীয় ইস্যু আজকে মাথায় আনছে যেচে ।
মাঝে মাঝে ঘাড় ঘুরিয়ে ক্যান্টিনের দরজার দিকে তাকানো ছাড়া আর কিছু কাজ পাচ্ছিল না । ঘনিষ্ট বান্ধবী মিতা আর রুমাকে দেখে ডেকে নিল । ওদেরকে বলে দিল তার আজকের পরিকল্পনা , মানে দীপুর সাথে কথা বলবার বিষয়টা । হঠাৎ দরজায় চোখ পড়তে দেখে দীপু ঢুকছে সাথে যথারীতি রবি , মিজান আর শান্ত । দূর থেকে খেয়াল করলো দীপুর চোখ ওর দিকে পড়তেই কেমন থমকে গেল মূহুর্ত । কি জানি লীনার ভুলও হতে পারে !
ক্যান্টিনের পিচ্চিটাকে ডেকে টেবিল দেখিয়ে সাদা শার্ট , কাল প্যন্ট পরা দীপুকে ডাকতে বলতেই সে নিজে থেকে বলে উঠল , দীপু ভাইজানরে ডাকব ? একটা মিষ্টি হাসি দিয়ে চলে যায় ডাকতে । ততক্ষনে মিতা আর রুমা উঠে দাড়ায় যাবার জন্য । এ সব শিখিয়ে দিতে হয় না । বড় হতে হতে চোখ কান কত কি শিখিয়ে দেয় ।
দীপু এসে উল্টো দিকে চেয়ার টেনে বসে । স্নিগ্ধ হাসি ছড়িয়ে আছে চোখে মুখে । লীনা জানে স্নিগ্ধ হাসির ব্যাপারটা মেয়েদের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয় । কিন্তু জানেনা , দীপুর এ মুখচ্ছবির বর্ননা আর কিভাবে দেয়া যায় । সিগারেটটা লুকিয়ে ধরা বা হাত পেছনে রেখে দীপু সোজা হয়ে বসে ।
বলে , কি খবর কেমন আছো ?
লীনা জবাবে ভাল আছি বলে থেমে থাকে ।
'মাষ্টার্সের ক্লাস শুরু হয়ে গিয়েছে এখন ক্লাসগুলো এত ইম্পর্ট্যান্ট , আসো নি কেন ক্লাসে ? আমি ভেবেছিলাম দেরী হলেও ঢুকবে । পরে দেখি আসলে না । ঠিক আছো তো ?' বলে দীপু ।
এক নি:শ্বাসে এতগুলো কথা বলতে বলতে খেয়াল করে লীনা কেমন মূর্তির মত তার দিকে তাকিয়ে আছে । কিছু শুনেছে কিনা বুঝতে পারে না । বলে , লীনা তোমার কি কিছু হয়েছে ? রাতে ঘুমাও নি , কেমন যেন লাগছে দেখতে । কেন ডেকেছো ?
দেরী না করে বলে লীনা , 'ডলি মেয়েটা আছে না আমাদের সাথে বেশ ভাল মেয়েটা । আমার তো ভালই মনে হয় ' ।
নড়ে চড়ে বসে দীপু , গম্ভীর হয়ে যায় ।
লীনা , 'শুনছো কি বলছি ? ডলিকে তোমার কেমন লাগে '?
দীপু , ' হু'
সিগারেট ধরা বা হাত তার সামনে চলে আসে । দুই হাত একসাথে করে রাখে টেবিলে ।
লীনা বলে, 'মেয়েটা তোমাকে অনেক পছন্দ করে '।
আরো কি কি বলার ছিল , দেখে দীপু ঘাড় ঘুরিয়ে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে এক রাশ বিরক্তি নিয়ে ।
লীনা হাল ছাড়বেনা ঠিক করে রেখেছে । বলে , 'তুমি ওর ব্যাপারে কিছু একটা সিদ্ধান্ত নাও' ।
দীপু , বাইরে দূরে তাকিয়ে বলে , ' কি রকম সিদ্ধান্ত নেব ?'
লীনা , 'বুঝতে পারছো না ? পজিটিভ একটা সিদ্ধান্ত নেবার কথা বলছি ওর ব্যাপারে ।'
দীপু সরাসরি তাকায় লীনার চোখে , এক রাশ ক্রোধ দু:খ মেশানো , বোবা চোখের অজস্র শব্দ অগ্নিস্ফুলিঙ্গ হয়ে পলকের মধ্যে লীনাকে শব্দহীন করে দেয় ! লীনা চোখ নামিয়ে নেয় ।
চেয়ার সশব্দে পেছনে ঠেলে উঠে পড়ে দীপু , গুরুগম্ভীর স্বরে বলে , ' আর
কিছু বলবে ? নাকি আরো বাকী আছে ' ।
তারপর উত্তরের অপেক্ষা না করে দ্রুত চলে যায় সেখান থেকে ।
চলবে....
পরের অধ্যায় Click This Link

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।


