somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ভোলার ডায়েরি থেকে

০৫ ই জানুয়ারি, ২০২১ বিকাল ৪:০২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

সে বছর আমরা ম্যাট্রিক দেবো। বিদায় অনুষ্ঠানের দিন। স্যারেরা একে একে আমাদের কান ভর্তি করা 'বকবক' করে যাচ্ছেন। ইংরেজির ইদ্রিস স্যার আমাদের স্কুলে যোগ দিয়েছিলেন শেষের দিকে। আমরা কম ক্লাস পেয়েছিলাম। বড়জোর সাত/আট মাস!

বয়স্ক লোক। তখন উনার চাকরির বোধ হয় আর বছর দুয়েক ছিল।
যাইহোক, বুঝাতেন খুব সুন্দর। কিন্তু ছাত্রদের 'বকা দেয়া'র বিপরীতে তিনি 'বুঝানো'র নীতিতে চলতেন। তার তত্ত্ব ছিল, 'যারা শেখার তারা এমনিতেই শিখবে। ধানের মধ্যে কিছু চিটে থাকা ভালো! চাষের ক্ষুধা বাড়ায়।'
ফলাফল... তার কথা আমরা কেউ তেমন একটা শুনতাম না। গল্প করতাম পেছনের দিকে বসে বসে।

কিছু বলার জন্য উনার নাম ঘোষণা হল।
বক্তৃতার পরিবর্তে উঠে গিয়ে স্টেজের পেছনের দেয়ালে কালো বোর্ডে সাদা চকে নামতা লিখতে শুরু করলেন তিনি।
৯×১= ১
৯×২= ১৮

ছেলেমেয়ে শিক্ষক সবাই একটু অবাক হলাম। উনি একটু আলাদা নিয়মে পড়ান। সবাই জানে; তাই চুপ মেরে গেলাম। কিন্তু উনি যেই "৯×৪= ৩৬ না লিখে ৩৪ লিখলেন, পেছনের দিকে আমরা ক'জন হাসাহাসি শুরু করলাম। আমি অংকের মকবুল স্যারের দিকে চেয়ে দেখি উনি স্টেজের হেড স্যারের দিকে তাকিয়ে আছেন। চোখে তার 'সুধরে দেবার নিরব অনুমতি'র প্রার্থনা।
কিন্তু হেড স্যার কোন 'রা' করলেন না। শুধু দেখছেন।
স্টেজে হেড স্যারের পাশে ইউএনও বসা। প্রধান অতিথি।

৯×৩= ২৭
৯×৪= ৩৪

এর দু' ঘর পরে গিয়ে আবারো স্যার আরেকটা ভুল করলেন। ছয় ন'য়ে ৫৪'র পরে সাত ন'য়ের পরিবর্তে লিখেছেন ৯×৬= ৬৩..!
এবার আমাদের দলেরি লোক বেশি। অধিকাংশই হেসে উঠলাম। হেড স্যারের লাল চোখে হাসির ধমক যা একটু কমলো তবে তাকে ঠিক 'চুপ করা' বলা যাবে না।

৯×৫= ৪৫
৯×৬= ৫৪
৯×৬= ৬৩
৯×৮= ৭২
৯×৯= ৮১
৯×১০= ৯০

লেখা শেষ করে মুচকি হাসতে হাসতে চলে গেলেন বক্তৃতা দেবার নির্ধারিত স্থানে। আমরা পাজিরা তখনো মিটিমিটি হেসে চলেছি!

"দেখো, আমি মাত্র দুটো ভুল করেছি।"___সম্মুখের সবার ওপর একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে শুরু করলেন।

"তাতেই তোমরা সবাই হাসতেছ।"____আমাদের দুষ্টুমিকে পাত্তা না-দেয়া চিরচেনা সেই হাসি দেখা গেল। "কিন্তু আটবার সঠিক লিখেছি আমি। আটবার...! তার মানে আমি ৮০% ঠিক...তাই তো মকবুল সাহেব?"_____বা'পাশে দাঁড়ানো অংক স্যারের দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করলেন। স্যার যেন উদ্ভ্রান্তভাবে শুধু ঘাড় নেড়ে সায় দিলেন।

"হ্যাঁ, ৮০ শতাংশ সফল আমি।"___ স্বগোতোক্তির মতো করে নিজেকে স্বীকৃতি দেবার মতো বললেন। "কিন্তু আমি মাত্র দু'টো ভুল করেছি আর তাতেই তোমরা হেসে খুন!" এখন একদম নিরব সবাই।

"আজ তোমরা আরো বড় লক্ষ্যে অন্যত্র যাবে। বাইরের দুনিয়া সম্পর্কে এটা থেকে শিক্ষা নিয়ে যাও। বাইরের দুনিয়া অনেকাংশে এমনি পাবে।"____স্বভাবগত তার সেই ব‍্যাখ‍্যা প্রথম খেয়াল হল আমার। "তোমরা যদি ৮০ টা ঠিক কাজ করার পরে মাত্র দু'-একটা ভুল করো তো সবাই তোমাদের ওই ভুলটা নিয়েই কথা বলবে। সাফল্য দিয়ে বিচার করার লোক পৃথিবীতে কমই পাবে।"

"আবার কেউ কেউ বলবে 'ন'য়ে ছ'য়ে তেষট্টি' করো।" ______বোর্ডে ইশারা করলেন। "মানে তারা শুধু ফলটাই চাইবে। তাদের কাছে ফলটাই আসল; কী উপায়ে করেছো, কার ক্ষতি করে করেছো, সেটা তারা দেখবে না! ...দেখতে চাইবে না!"

"সব সময় মনে রাখবে, ভুল তো ভুল-ই। কেউ তা জানুক আর না-জানুক, কেউ তা মানুক আর না-মানুক; তুমি তো জানো। তুমি তো অস্বীকার করতে পারো না!____অন্তত নিজেকে ভুলিও না। নিজেকে ফাঁকি দিও না। কেউ না মানলেও ভুল কখনো ঠিক হয়ে যায় না। ঠিক যেমনে আমার 'ন'য়ে ছ'য়ে তেষট্টি'র ভুলকে তোমরা ঠিক মানলে না___ঠিক সেভাবে।"

একটু যেন থামলেন।
"ভালো থে...।" ____কথা শেষ করতে পারলেন না।

স্যারের চোখ অনুসরণ করে দেখি, আমার পরের সারিতে বসা ভোলা "হাত তুলে" আছে। সব কিছুতেই ওর একটা-না-একটা প্রশ্ন থাকবেই থাকবে! তাই বলে বিদায় অনুষ্ঠানেও...! ___বিরক্তি লাগলো।

"কে? রওসদ?"____হাসলে স‍্যারকে অসম্ভব সুন্দর লাগে! ওর প্রশ্ন বানের কথা স্যার এ ক'দিনেই জেনে গেছেন। পছন্দও করেন।

"বলো রওসদ। বলো..."

"স্যার! এমন পরিস্থিতিতে করণীয় কী, তা তো বললেন না।"

'ঠিক এমনটাই যেন আশা করেছিলেন'___এমনিভাবে মাথা দুলিয়ে মুচকি হেসে বললেন, "কী করছো' সেটা যদি তুমি পরিপূর্ণ সচেতনভাবে করতে পারো তাহলে কী করণীয় তা তোমাকে খুঁজতে হবে না। আশপাশের লোকজন যে যাই ভাবুক, যে যাই করুক না কেন, দিন শেষে এমনিতেই আসবে।" ___তিনি নিজের মুখের হাসির দিকে ইঙ্গিত করলেন।

"শুধু সচেতনভাবে কোরো।"
"ঠিকাছে। আই অ্যাম প্রাউড অল অফ ইউ, বয়েস! ভালো থেকো।"



স্যার সবার উদ্দেশ্যেই সেদিন ওই "প্রাউড অল অফ ইঊ" বলেছিলেন। কিন্তু জীবনের মধ্য গগণে এসে কাল বুঝলুম, স্যারের সেদিনের ওই "প্রাইডটা"র আসল উদ্দেশ্যটা ছিল ভোলা। আমরা ছিলেম মাত্র শুধুই শ্রোতা। কেন?___ সেটা না হয় অন্যদিনের জন্য তোলা রইলো।



পুনশ্চ: লেখাটি "ভোলার ডায়েরি" নামে একটা সিরিজ গল্পের অংশ। এই অংশে বর্ণিত "রওসদ" তার বন্ধুদের কাছে "ভোলা" নামে পরিচিত।
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে ফেব্রুয়ারি, ২০২১ দুপুর ২:১২
১০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। মুক্তিযোদ্ধা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১



মুক্তিযুদ্ধের সঠিক তালিকা প্রণয়ন ও ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা প্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেছেন, ‘দেশের প্রতিটি উপজেলা পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই কমিটি রয়েছে। তারা স্থানীয়ভাবে যাচাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতীয় রাজাকাররা বাংলাদেশর উৎসব গুলোকে সনাতানাইজেশনের চেষ্টা করছে কেন?

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:৪৯



সম্প্রতি প্রতিবছর ঈদ, ১লা বৈশাখ, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, শহীদ দিবস এলে জঙ্গি রাজাকাররা হাউকাউ করে কেন? শিরোনামে মোহাম্মদ গোফরানের একটি লেখা চোখে পড়েছে, যে পোস্টে তিনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

চুরি করাটা প্রফেসরদেরই ভালো মানায়

লিখেছেন হাসান মাহবুব, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৩


অত্র অঞ্চলে প্রতিটা সিভিতে আপনারা একটা কথা লেখা দেখবেন, যে আবেদনকারী ব্যক্তির বিশেষ গুণ হলো “সততা ও কঠোর পরিশ্রম”। এর মানে তারা বুঝাতে চায় যে তারা টাকা পয়সা চুরি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঘুষের ধর্ম নাই

লিখেছেন প্রামানিক, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৫৫


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

মুসলমানে শুকর খায় না
হিন্দু খায় না গাই
সবাই মিলেই সুদ, ঘুষ খায়
সেথায় বিভেদ নাই।

হিন্দু বলে জয় শ্র্রীরাম
মুসলিম আল্লাহ রসুল
হারাম খেয়েই ধর্ম করে
অন্যের ধরে ভুল।

পানি বললে জাত থাকে না
ঘুষ... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইরান-ইজরায়েল দ্বৈরথঃ পানি কতোদূর গড়াবে??

লিখেছেন ভুয়া মফিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:২৬



সারা বিশ্বের খবরাখবর যারা রাখে, তাদের সবাই মোটামুটি জানে যে গত পহেলা এপ্রিল ইজরায়েল ইরানকে ''এপ্রিল ফুল'' দিবসের উপহার দেয়ার নিমিত্তে সিরিয়ায় অবস্থিত ইরানের কনস্যুলেট ভবনে বিমান হামলা চালায়।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×