somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বেলা যে যায় : ০৫

২৬ শে জানুয়ারি, ২০১৮ রাত ১০:৩৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

হু হু করে ঠান্ডা বাতাস বইছে। কাঁপছে শরীর। তবু বসে আছি বাড়ির উঠোনে, পূর্ণিমা দেখছি। কী যে ভালো লাগছে!

জীবন আসলে চমৎকার, কথা হচ্ছে মানুষ সেটাকে কীভাবে উপভোগ করছে। কেউ যদি দশটা-ছ’টা চাকরি করে শান্তি খুঁজে কিংবা পয়সার পেছনে ছোটাকেই একমাত্র লক্ষ্য ভাবে, তাহলে তার উপভোগ আর জীবনকে জীবনের মতো উপভোগে পার্থক্য তো থাকবেই। মহান সৃষ্টিকর্তা পৃথিবীটাকে কত সুন্দর আর মনোরম করে সাজিয়েছেন। কার জন্য? আমাদের জন্য, মানুষের জন্য! এখন মানুষ যদি পৃথিবীর এই সমস্ত সৌন্দর্য্যের দিকে লক্ষ্য না করে, তাহলে জীবন তার কাছে তেতো কিংবা বিতৃষ্ণার হতেই পারে। সেটা জীবন কিংবা পৃথিবীর দোষ নয়, বরং যাপন আর দৃষ্টিভঙ্গীর দোষ!

সকালে মনে হচ্ছিল প্রায় মরেই গেছি। সেখান থেকে কোন দৈববলে বেঁচে উঠলাম, সে একমাত্র মহান ক্ষমতাধরই জানেন। সারাদিন শুয়েই কেটে গেল। আজ মসজিদেও যাওয়া হয়নি। বহুদিন পর ঘরে নামায আদায় করেছি। তাও শুয়ে শুয়ে, ইশারায়। আরিফের বউ নড়তেই দেবে না যেন! মেয়েটা আসলেই আমার মা। পুনর্জন্মে বিশ্বাস নেই, নইলে বলতাম আমার মা-ই আবার ওর রুপ ধরে ফিরে এসেছে।

রাতের খাবারের পর মশারী, বিছানা ঠিকঠাক করে দিচ্ছিল। কি কারণে জানালা খুলেছিল জানি না, তবে তাতে আমি বুঝে গেলাম এমন রাতে এভাবে শুয়ে থাকা অন্যায়! আরিফের বউ এই কনকনে ঠান্ডায় কিছুতেই বসতে দেবে না। অনেক অনুরোধের পর রাজী হলো। “পঞ্চান্ন বছর পার করে ফেললাম। জীবনে কত কারণে-অকারণে রাত জেগেছি। অথচ কখনো এমন সৌন্দর্য্য উপভোগের জন্য রাত জাগতে ইচ্ছে হয়নি। আজ ইচ্ছে হচ্ছে মা, তুই না করিস না!”
সে ‘হ্যাঁ’ বলার পর যে কান্ড শুরু করলো, তা আগে জানলে অবশ্য কিছুতেই এই আবদার করতাম না। মহা হুলস্থুল ফেলে দিল। উঠোনে চেয়ার পাতল। চেয়ারে একটা কম্বল রাখল। আমার সোয়েটার পরতে হলো, তার উপর শাল জড়াতে হলো। কোত্থেকে হাত মৌজা, পা মৌজা নিয়ে এসেছে, সেসবও পরতে হলো। কানটুপি পরার পর চোখ বাদে শরীরে আর কোনো জায়গা দেখি খালি নেই। এত কান্ডের পরও তার তৃপ্তি নেই, বসার পর বিশাল এক কম্বল দিয়ে ঢেকে দিল আপাদমস্তক!

ইচ্ছে হলো চিৎকার করে কেঁদে উঠি! এত ভালোবাসা, শ্রদ্ধা, মায়া-মমতা আমার মতো অধমের কপালে ছিল! সত্যি, কপাল বটে আমার!

আমি জানি মেয়েটা এখনো জেগে আছে। আমি ঘুমুতে গেলে হয়তো ঘুমুবে। আরিফ আর বাচ্চাটা বোধহয় ঘুমিয়ে পড়েছে। বাচ্চাটার কোনো সাড়া শব্দ পাচ্ছি না।
কত সুন্দর এই গোলগাল চাঁদ! গাছের পাতার ফাঁকে ফাঁকে দেখলে অদ্ভুত এক মোহ জাগে! কেমন নৈসর্গিক মনে হচ্ছে এই পরিবেশ। চারপাশ কেমন শুনশান, চাঁদের আলোয় ভরে উঠেছে এই উঠোন।

এত কিছু গায়ে জড়ানোর পরও ঠান্ডা হাওয়ার ঝাপ্টা ভালোই অনুভূত হচ্ছে। মনের অলিন্দে মহা আনন্দের মহা সংগীত স্পষ্ট টের পাচ্ছি। ইশ, জীবন কত্ত সুন্দর! বয়সটা সাড়ে চার যুগ পেরোনের আগে যদি জানতাম!

“চাচা, ঠান্ডা লেগে যাবে, চলে আসেন না! অনেকক্ষণ হয়েছে তো।” ঘরের দাওয়ায় দাঁড়িয়ে ডাকছে আমার মা। হেসে জবাব দিই, “তুই ঘুমিয়ে যা, মা। আমার আরো অনেক সময় লাগবে।” মেয়েটা কিছু বলল না। খানিক ক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকল। তারপর চলে গেল। কেন যেন আমার মনে হলো মেয়েটা ভেতরে গিয়ে কান্না করবে।
আচ্ছা এটা কি ঠিক হচ্ছে? শুধু শুধু মেয়েটাকে কষ্ট দেয়া! জীবন কি কেবলমাত্র নিজের আনন্দের জন্য? উপভোগ-মন্ত্র মানে কি কেবল নিজে বাঁচা? নিজের মতো বাঁচা?

সকালে জ্ঞান হারানোর আগেই বুঝেছিলাম, মেয়েটা কান্না করছে। জ্ঞান ফেরার পরও দেখলাম তাই। চিৎকার করে, বাড়ি মাথায় তোলা কান্না না, সব হারানোর বেদনায় বহু কষ্টে চেপে রাখা বিষম কান্না। ডাক্তার এসেছিল, বলেছেন, উচ্চ চাপ থেকে নাকি হঠাৎ অমন হাঁসফাঁস অবস্থা। তাই চাপ মুক্ত থাকার কথা বলে গেছেন। আমি তো চাপ মুক্তই। আসলেই কি? সুরাইয়ার গ্রামে আসার ব্যাপারটাতে কোনো ভয়ের কারণ নেই?

মেয়েটাকে শুধু শুধু কষ্ট দেয়ার কোনো মানে হয় না। অনেক হয়েছে, এবার ভেতরে যাই।

বাবার সাথে নাকি ওর খুব ভাব ছিল। বিয়ের দু’দিনের মাথায় বাবা মারা গেলেন। এক ফোঁটা চোখের পানিও নাকি ফেলেনি মেয়েটা! কি পরিমাণ ব্যথা যে মেয়েটা চেপে রেখেছে সেটা আগে কখনো বুঝতে পারিনি। যখন থেকে তার ছেলে হয়েছি, মেয়েটার ব্যথা-আনন্দ, সুখ-দুখ বুঝতে পারছি খানিকটা। এই ব্যাপারটা কেন ঘটছে, কীভাবে ঘটছে, জানি না!
আমার মধ্যে নিজের বাবাকে খুঁজে পেতে চেষ্টা করছে সে, সাথে আমার কিছু হলে ওর বাবা হারানোর শোকটাও কি উথলে উঠছে? কে যেন গেয়েছিলেন, ‘যার চলে যায় সে-ই বোঝে হায়, বিচ্ছেদে কী যন্ত্রণা!’ আমি প্রথম বুঝেছিলাম, বাবাকে হারানোর পর!

বসে বসে এই বুড়ো বয়সে চাঁদের রুপ দেখে আর কাজ নেই। রাত অনেক হয়েছে। ভাবাভাবিও তো আর কম হলো না। তার চেয়ে তাহাজ্জুদ পড়া যায় কিনা দেখি! সেটা বরং কাজে দেবে।

“কই মা! একটু আয় তো। যেভাবে কম্বল দিয়ে চেয়ার সহ মুড়িয়ে দিয়েছিস, নিজেকে জালের ভেতর আটকে পড়া মাছ মনে হচ্ছে।”
কট করে দরজা খোলার আওয়াজ পেলাম। “আসছি চাচা!” নীরবে কম্বলের ঘের খুলছে। মুক্ত হয়ে আরেকবার আকাশটাকে দেখলাম। আহা, কী অদ্ভুত সৌন্দর্য্য! বুকটা কেমন যেন করে উঠল! এমন জোছনা কালেই কি ‘চাঁদের হাসি বাঁধ ভেঙ্গেছে’ গান লেখা হয়েছিল?

“চাচা, ফ্লাস্কে পানি রাখা আছে। অযু করতে চাইলে ওই পানি দিয়ে করতে পারবেন।” চেয়ারের উপর রেখে কম্বল ভাঁজ করতে করতে বলল আরিফের বউ। “ঠিক আছে, মা।” বলতে বলতে বুকের ভেতর তোলপাড় টের পাই। এত যত্ন, এত মায়া!
আহা, জীবন! মায়ার কাঙাল হলেও চেয়েছিলাম মায়ার চাদর থেকে পালাতে। কিন্তু তা আর হলো কই? মায়া ঠিক চাদর বাড়িয়ে দিয়ে আমাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ফেললো! এই মেয়ে এমনই এক মায়াবতী যে, ইহলোকে এই বন্ধন থেকে মুক্তি পাবো বলে আর মনে হয় না।

বেলা যে যায়... : ০৪
বেলা যে যায়... : ০৩
বেলা যে যায়... : ০২
বেলা যে যায়... : ০১
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে জানুয়ারি, ২০১৮ রাত ১০:৩৮
১টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

পানির অপচয় রোধ: ইসলামের চিরন্তন শিক্ষা এবং সমকালীন বিশ্বের গভীর সংকট

লিখেছেন নতুন নকিব, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৮:৪৬

পানির অপচয় রোধ: ইসলামের চিরন্তন শিক্ষা এবং সমকালীন বিশ্বের গভীর সংকট



পানি জীবনের মূল উৎস। এটি ছাড়া কোনো প্রাণের অস্তিত্ব সম্ভব নয়। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তা'আলা ইরশাদ করেন:

وَجَعَلۡنَا... ...বাকিটুকু পড়ুন

মায়াময় স্মৃতি, পবিত্র হজ্জ্ব- ২০২৫….(৭)

লিখেছেন খায়রুল আহসান, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৭

ষষ্ঠ পর্বের লিঙ্কঃ মায়াময় স্মৃতি, পবিত্র হজ্জ্ব- ২০২৫-….(৬)

০৬ জুন ২০২৫ তারিখে সূর্যোদয়ের পরে পরেই আমাদেরকে বাসে করে আরাফাতের ময়দানে নিয়ে আসা হলো। এই দিনটি বছরের পবিত্রতম দিন।... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাদিকে shoot করে লাভবান হলো কে?

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৩:২৪


শরিফ ওসমান হাদি যিনি সাধারণত ওসমান হাদি নামে পরিচিত একজন বাংলাদেশি রাজনৈতিক কর্মী ও বক্তা, যিনি জুলাই গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে গঠিত রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র হিসেবে পরিচিত। তিনি ত্রয়োদশ... ...বাকিটুকু পড়ুন

আধা রাজাকারি পোষ্ট ......

লিখেছেন কলিমুদ্দি দফাদার, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৩:৫৬


আমি স্বাধীন বাংলাদেশে জন্মগ্রহণ করেছি। আমার কাছে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা, বা পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে আজকের বাংলাদেশের তুলনা—এসব নিয়ে কোনো আবেগ বা নস্টালজিয়া নেই। আমি জন্মগতভাবেই স্বাধীন দেশের নাগরিক, কিন্তু... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইন্দিরা কেন ভারতীয় বাহিনীকে বাংলাদেশে দীর্ঘদিন রাখেনি?

লিখেছেন জেন একাত্তর, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৫:২০



কারণ, কোল্ডওয়ারের সেই যুগে (১৯৭১সাল ), আমেরিকা ও চীন পাকিস্তানের পক্ষে ছিলো; ইন্দিরা বাংলাদেশে সৈন্য রেখে বিশ্বের বড় শক্তিগুলোর সাথে বিতন্ডায় জড়াতে চাহেনি।

ব্লগে নতুন পাগলের উদ্ভব ঘটেছে;... ...বাকিটুকু পড়ুন

×