রজনীকান্ত সেন (২৬ জুলাই, ১৮৬৫ - ১৩ সেপ্টেম্বর, ১৯১০) প্রখ্যাত কবি, গীতিকার এবং সুরকার হিসেবে বাঙালি শিক্ষা-সংস্কৃতিতে চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন। বাংলা ভাষায় যে পাঁচজন কবি কবিতার পাশাপাশি সঙ্গীত রচনায় উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছেন, তাদের বলা হয় ‘পঞ্চকবি’। রজনীকান্ত সেন সেই ‘পঞ্চকবি’দেরই একজন। অন্যরা হলেন- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, অতুল প্রসাদ সেন। রজনীকান্তের অসংখ্য গান ও কবিতা এখনও রয়ে গেছে অশ্রুত কিংবা স্বল্পশ্রুত। অথচ রজনীকান্তের গানে বাণী ও ছন্দের যে মেলবন্ধন, সুরের যে অপূর্ব লয়, সর্বোপরি ভাবের যে গভীরতা, তা এককথায় অতুলনীয়। রজনীকান্তের জীবদ্দশায় তাঁর তিনটি বই প্রকাশিত হয়: 'বাণি', 'কল্যাণী', 'অমৃত'। আর মৃত্যুর পর প্রকাশিত হয় পাঁচটি গ্রন্থ: 'অভয়া', 'আনন্দময়ী', 'বিশ্রাম', সদ্ভাবকুসুম ও শেষদান। এসব গ্রন্থে প্রকাশিত তাঁর গানগুলোকে চারটি শ্রেণিতে ভাগ করা যায়- দেশাত্মবোধক, ভক্তিমূলক, প্রীতিমূলক ও হাস্যরসাত্মক গান। তাঁর মোট গানের সংখ্যা ২৯০টি। তবে তাঁর অসংখ্য গান হারিয়ে গেছে বলেই জানা যায়। গীতিকবি রজনী কান্ত সেনের জন্ম তৎকালীন পাবনা জেলার সিরাজগঞ্জ মহকুমার ভাঙ্গাবাড়ী গ্রামে। মাত্র ৪৫ বছর বয়সে কলকাতা মেডিকেল কলেজের কটেজ ওয়ার্ডে এই মহান কবি পরলোক গমন করেন। আজ কবির ১৫৪তম জন্মবার্ষিকীতে তাঁর উল্লেখযোগ্য কিছু কবিতা ও গান এখানে তুলে ধরলাম। (বহিঃসংযোগ: রজনীকান্ত সেনের জীবনী - উইকিপিডিয়া)
স্বাধীনতার সুখ
বাবুই পাখিরে ডাকি, বলিছে চড়াই,
"কুঁড়ে ঘরে থাকি কর শিল্পের বড়াই,
আমি থাকি মহাসুখে অট্টালিকা পড়ে
তুমি কত কষ্ট পাও রোদ, বৃষ্টি, ঝড়ে।"
বাবুই হাসিয়া কহে, "সন্দেহ কি তায়?
কষ্ট পাই, তবু থাকি নিজের বাসায়।
পাকা হোক, তবু ভাই, পরের ও বাসা,
নিজ হাতে গড়া মোর কাঁচা ঘর, খাসা।"
মায়ের দেওয়া মোটা কাপড়
মায়ের দেওয়া মোটা কাপড়
মাথায় তুলে নে রে ভাই;
দীন-দুঃখিনী মা য়ে তোদের
তার বেশী আর সাধ্য নাই।
ঐ মোটা সূতোর সঙ্গে, মায়ের
অপার স্নেহ দেখতে পাই ;
আমরা, এমনি পাষাণ, তাই ফেলে ঐ
পরের দোরে ভিক্ষা চাই |
ঐ দুঃখী মায়ের ঘরে, তোদের
সবার প্রচুর অন্ন নাই ;
তবু, তাই বেচে কাচ, সাবান মোজা,
কিনে কল্লি ঘর বোঝাই |
আয়রে আমরা মায়ের নামে
এই প্রতিজ্ঞা ক’রব ভাই ;
পরের জিনিষ কিনবো না, যদি
মায়ের ঘরের জিনিষ পাই |
তুমি নির্মল কর মঙ্গল করে
তুমি, নির্মল কর, মঙ্গল করে মলিন মর্ম মুছায়ে ।।
তব, পূণ্য-কিরণ দিয়ে যাক্, মোর
মোহ-কালিমা ঘুচায়ে।
মলিন মর্ম মুছায়ে ।
তুমি, নির্মল কর, মঙ্গল করে মলিন মর্ম মুছায়ে ।
লক্ষ্য-শূন্য লক্ষ বাসনা ছুটিছে গভীর আঁধারে,
জানি না কখন ডুবে যাবে কোন্
অকুল-গরল-পাথারে!
প্রভু, বিশ্ব-বিপদহন্তা,
তুমি দাঁড়াও, রুধিয়া পন্থা;
তব, শ্রীচরণ তলে নিয়ে এস, মোর
মত্ত-বাসনা গুছায়ে !
মলিন মর্ম মুছায়ে ।
তুমি, নির্মল কর, মঙ্গল করে মলিন মর্ম মুছায়ে ।
আছ, অনল-অনিলে, চিরনভোনীলে, ভূধরসলিলে, গহনে;
আছ, বিটপীলতায়, জলদের গায়, শশীতারকায় তপনে।
আমি, নয়নে বসন বাঁধিয়া,
ব’সে, আঁধারে মরিগো কাঁদিয়া;
আমি, দেখি নাই কিছু, বুঝি নাই কিছু,
দাও হে দেখায়ে বুঝায়ে।
মলিন মর্ম মুছায়ে ।
তুমি, নির্মল কর, মঙ্গল করে মলিন মর্ম মুছায়ে ।
তব, পূণ্য-কিরণ দিয়ে যাক্, মোর
মোহ-কালিমা ঘুচায়ে।
মলিন মর্ম মুছায়ে ।
তুমি, নির্মল কর, মঙ্গল করে মলিন মর্ম মুছায়ে ।
পরোপকার
নদী কভু পান নাহি করে নিজ জল,
তরুগণ নাহি খায় নিজ নিজ ফল,
গাভী কভু নাহি করে নিজ দুগ্ধ পান,
কাষ্ঠ, দগ্ধ হয়ে, করে পরে অন্নদান,
স্বর্ণ করে নিজরূপে অপরে শোভিত,
বংশী করে নিজস্বরে অপরে মোহিত,
শস্য জন্মাইয়া, নাহি খায় জলধরে,
সাধুর ঐশ্বর্য শুধু পরহিত-তরে।
নমো নমো নমো জননি বঙ্গ !
উত্তরে ঐ অভ্রভেদী,
অতুল, বিপুল, গিরি অলঙ্ঘ্য।
দক্ষিণে সুবিশাল জলধি,
চুম্বে চরণ তল নিরবধি,
মধ্যে পূত-জাহ্নবী-জল-ধৌত
শ্যাম-ক্ষেত্র-সঙ্ঘ।
বনে বনে ছুটে ফুল পরিমল,
প্রতি সরোবরে লক্ষ কমল,
অমৃতবারি সিঞ্চে, কোটি
তটিনী, মত্ত, খর-তরঙ্গ,
কোটি কুঞ্জে মধুপ গুঞ্জে,
নবকিশলয় পুঞ্জে পুঞ্জে,
ফল-ভার নত শাখি-বৃন্দে
নিত্য শোভিত অমল অঙ্গ !
যারে মন দিলে আর ফিরে আসে না
যারে মন দিলে আর ফিরে আসে না,
এ মন তারে ভালবাসে না!
যাদের মন দিতে হয় সেধে সেধে,
প্রেম দিতে হয় ধরে বেঁধে,
তাদের মন দিয়ে, মন মরে কেঁদে,
আর, জন্মের মত হাসে না!
ফেলে দে মন প্রেম-সাগরে,
হারিয়ে যাক্ রে চির-তরে,
একবার, পড়লে সে আনন্দ-নীরে,
ডুবে যায়, আর ভাসে না।
শ্যামল-শস্য ভরা
শ্যামল-শস্য ভরা
চির শান্তিবিরাজিত, পুন্যময়ী;
ফল-ফুল-পূরিত; নিত্য সুশোভিত;
যমুনা সরস্বতী গঙ্গা বিরাজিত।
ধূর্জটি বাঞ্ছিত হিমাদ্রি মন্ডিত;
সিন্ধু গোদাবরী-মাল্য-বিলম্বিত;
অলিকুল গুঞ্জিত-সরসিজ-রঞ্জিত।
রাম-যধিষ্ঠিত ভুপ-অলকৃত
অর্জুন ভীষ্ম শরাসন টঙ্কত;
বীর প্রতাপে চরাচর শঙ্কিত।
সামগানরত আর্য্য তপোধন,
শান্তি সুখান্বিত কোটি তপোবন;
রোগ-শোক দুখ পাপবিমোচন।
শুনাও তোমার অমৃত বাণী
শুনাও তোমার অমৃত বাণী,
অধমে ডাকি, চরণে আনি।
সতত নিষ্ফল শত কোলাহলে,
ক্লিষ্ট শ্রুতি যুগ কত হলাহলে
শুনাও হে-
শুনাও শীতল মনোরসায়ন
প্রেম-সুমধুর মন্ত্রখানি।
হউক সে ধ্বনি দিক প্রসারিত
মিশ্র কলরব ছাপিয়া,
উঠুক সে ধবনি শিহরি’ পুলকে
কাঁপিয়া, সুখে কাঁপিয়া,
বিতরি’এ ভবে শুভ বরাভয় ;
রুগ্মে করি’;হরি চির নিরাময়,
শুনাও হে-
শুনাও দুর্বল চিত্ত, হে হরি!
তোমারি শ্রীপদ নিকটে টানি।।
আমি তো তোমারে চাহিনি
আমি তো তোমারে চাহিনি জীবনে তুমি অভাগারে চেয়েছ;
আমি না ডাকিতে, হৃদয় মাঝারে নিজে এসে দেখা দিয়েছ।।
চির-আদরের বিনিময়ে সখা! চির অবহেলা পেয়েছ
আমি দূরে ছুটে যেতে দুহাত পসারি ধরে টেনে কোলে নিয়েছ।।
ও পথে যেও না ফিরে এস বলে কানে কানে কত কয়েছ
আমি তবু চলে গেছি ফিরায়ে আনিতে পাছে পাছে ছুটে গিয়েছ।।
এই চির অপরাধী পাতকীয় বোঝা হাসি মুখে তুমি বয়েছ,
আমার নিজ হাতে গড়া বিপদের মাঝে বুকে করে নিয়ে রয়েছ।।
বড় বিদ্যে করেছি জাহির
রাজা অশোকের কটা ছিল হাতি,
টোডরমল্লের কটা ছিল নাতি,
কালাপাহাড়ের কটা ছিল ছাতি,
এসব করিয়া বাহির, বড় বিদ্যে করেছি জাহির।
আকবর শাহ কাছা দিত কিনা,
নূরজাহানের কটা ছিল বীণা,
মন্থরা ছিলেন ক্ষীণা কিম্বা পীনা,
এসব করিয়া বাহির, বড় বিদ্যে করেছি জাহির।
আমি অকৃতী অধম বলেও তো কিছু
(আমি) অকৃতী অধম ব’লেও তো, কিছু
কম ক’রে মোরে দাও নি
যা’ দিয়েছ, তারি অযোগ্য ভাবিয়া
কেড়েও তো কিছু নাওনি।
(তব) আশীষ-কুসুম ধরি নাই শিরে
পায়ে দ’লে গেছি, চাহি নাই ফিরে
তবু দয়া ক’রে কেবলি দিয়েছ
প্রতিদান কিছু চাওনি।
(আমি) ছুটিয়া বেড়াই জানিনা কি আশে
সুধা-পান ক’রে, মরি গো পিয়াসে
তবু, যাহা চাই সকলি পেয়েছি
তুমি তো কিছুই পাওনি
(আমায়) রাখিতে চাও গো, বাঁধনে আঁটিয়া
শতবার যাই বাঁধন কাটিয়া
ভাবি, ছেড়ে গেছ, – ফিরে চেয়ে দেখি
এক পা-ও ছেড়ে যাওনি
ওরা চাহিতে জানে না
ওরা, চাহিতে জানে না, দয়াময়।
ওরা, চাহে ধন, জন, আয়ু, আরোগ্য বিজয়।
করুণার সিন্ধু কুলে তথাপি নিলাজ হিয়া,
বসিয়া, মনের ভুলে মহাব্যস্ত তাই নিয়া,
এক বিন্দু বারি তুলে ভাঙিতে গড়িতে, হ’য়ে
মুখে নাহি লয়, পড়ে অসময়।
তীরে করি ‘ছুটাছুটি, আহা!ওরা জানে না ত’,
ধুলি বাঁধে মুঠিমুঠি, করুণা নির্ঝর নাথ,
পিয়াসে আকুল হিয়া, না চাহিতে নিরন্তর,
আরো ক্লিষ্ট হয়। ঝর ঝর বয় ;
কি ছাই মাগিরে নিয়ে, চির তৃপ্তি আছে যাহে,
কি ছাই করে তা দিয়ে, তা যদি গো নাহি চাহে,
দু’দিনের মোহ, ভেঙে তাই দিও দীনে, যা’তে
চুরমার হয় ; পিপাসা না রয়।
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে জুলাই, ২০১৯ দুপুর ১:০১