ভালবাসার উৎপত্তি হৃদয়ে না মস্তিস্কে? বিজ্ঞান যদিও বলে মস্তিস্কে তারপরও মানুষ সেটা মানতে নারাজ। কারণ সাধারণ মানুষ (তরুণ-তরুণীরা) মনে করে এসব বিষয় হৃদয় ঘটিত না হয়ে উপায় নেই। আর আমার কাছে ভালবাসাটা একটা আপেক্ষিক ব্যাপার মাত্র। যা দীর্ঘ স্থায়ী হয় না। যাই হোক ভালবাসা নিয়ে এত বেশি ভাষা না লিখে আমার জীবনের অন্য রকম একটা ভালবাসার অনুভুতি অতি সংক্ষেপে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করছিঃ
বাউন্ডুলে স্বভাবের কারণে অনেক আগে থেকেই এখানে সেখানে ঘুরতে যেতাম। একবার ট্রেনে করে অজানা গমত্মব্যে যাচ্ছিলাম। ট্রেনে চড়ে সীটে বসার পর কানে ভেসে এল একটা অল্প বয়সী কন্ঠের গান ও মন্দিরার টুং টাং শব্দ। চোখ তুলে তাকাতেই দেখলাম একটা ছোট্ট মেয়ে গান গাইছে। হাছন রাজার গান- ‘‘মাটিরও পিঞ্জিরার মাঝে বন্দী হইয়ারে, কান্দে হাছন রাজার...........’’। খুব মিষ্টি কন্ঠ মেয়েটার। গান শুনে কেউবা দু’এক টাকা হাতে গুজে দিচ্ছে আবার কেউবা রাজ্যের সমস্ত বিরক্তি মুখে ফুটে তোলার চেষ্টা করছে। গান শেষ হবার পর ডাকলাম মেয়েটাকে।
বললাম- কী নাম তোর? বলল, সানাই।
‘‘খুব সুন্দর নামতো তোর, কে কে আছে তোর, কোথায় থাকিস?’’
বলল, শুধু মা আছে ভাইজান। সামনের ষ্টেশনে নাইমা যামু। আমরা ঐহানেই থাকি। কিন্তু আইজকা মায়ের জ্বর তাই আর কাম করমু না।’’
বুঝলাম আমরা যেটাকে ভিক্ষা বলি সেটা ওদের কাছে কাজ।
তোর মা কী করে?’’ বলল- মা ষ্টেশনে ভিক্ষা করে।
আমি বললাম, তুই দিনে কত টাকা আয় করিসরে সানাই?
ভাইজানযে কী কন! এখন আর গান শুনে কেউ টাকা দিতে চায় না ভাইজান। তারপরও ৫০/৬০ টাকা কামাই।
আমি একটা হিসেব করলাম মনে মনে। দেখলাম সানাই যদি একেকটা কামরায় দুইটা করে গান গায় তাইলে সারাদিনে সে কমপক্ষে ৫০ টা গান গায়। আর সাধারণত যারা গান গেয়ে ভিক্ষা করে তারা ভাটিয়ালী, লালন ফকির কিংবা ভক্তিমূলক গান গায়। তাতে দিন শেষে তাদের কন্ঠের অবস্থা কেমন হয় তা আল্লাহ্ মালুম।
বললাম, আমাকে তোর বাড়ী নিয়ে যাবি?
সে অবাক হয়ে বলল, সত্যিই আমাগো বাড়ী যাইবেন ভাইজান?
কেন আমায় নিয়ে যাবি না?
আপনারা এত ভদ্র মানুষ আমাগো ঝোপেরম ত ঘরে কেমনে যাইবেন?
বলতে চাইলাম ‘‘ভদ্রতা শিখতেহ হলে দরিদ্রের কুঠীরেই যাওয়া উচিত’’। বললাম- চল যাব।
ষ্টেশন আসতেই নেমে পড়লাম। সানাই আগে আগে হাটছে আর আমি পেছনে। মেয়েটার বয়স বড়জোর ১২/১৩ হবে। শ্যামলা বর্ণের গোল মুখখানার সবচেয়ে সুন্দর জিনিসটা হল বড় বড় দু’টো চোখ। চুল গুলো ঘাড় পর্যমত্ম এসে কোকড়া হতে শুরম্ন করেছে। আমরা ষ্টেশনের পেছনে চলে এলাম। দেখি ছোট ছোট কয়েকটা ঝুপড়ি। এর মধ্যে একটা সানাইদের। ঘরের দরজা বলতে ঝাপের মত একটা কিছু আর চাল বলতে পলিথিন। এক কথায় যাযাবরদের থাকার স্থান যেমন হয় ঠিক তেমনি যেন। সানাই তার মাকে ডাকতে লাগল। জ্বরের কারণে সানাইয়ের মা হয়ত শুয়ে ছিল। কিন্তু সানাইয়ের ডাক শুনে ব্যসত্ম হয়ে বাইরে এল। আমায় দেখে মাথায় ঘোমটা দিয়ে চুপচাপ সানাইয়ের দিকে তাকিয়ে রইল। বুঝলাম ভিক্ষার সময় যতই পর্দাহীন থাকুক না কেন, ঘরে এল সবাই বাংলার বধু। খুব বেশি বয়স হবে না তার। ৩০/৩২ এই রকম আরকি। কিন্তু দেহের গঠন এখনও অটুট। সানাইয়ের মায়ের শরীরের কোথাও একটা ঘা আছে যে তা শরীরের বোটকা একটা গন্ধেই টের পাওয়া যাচ্ছিল। সানাই আমায় ছোট্ট একটা মোড়া এনে বসতে দিল। আমি সরাসরি মহিলাকে প্রশ্ন করলাম- আপনার স্বামী নেই? উত্তরে যা বলল তা শুনে অবাক না হয়ে উপায় নেই। বলল- আমি বিয়ে করিনি।
বুঝলাম- সানাই মহাকালের ফসল। বললাম- কিভাবে সংসার চলে?
এই মানুষের কাছে হাত পেতে।
আমি প্রশ্ন করলাম- আপনি কি অসুস্থ? বলল- সেই রকম কিছু না। তবে.....। বলে শাড়ীটা হাটু পর্যন্ত তুলল। দেখলাম পা ভর্তি ঘা। বুঝলাম এটাই ভিক্ষা করার মুলধন। বললাম- চিকিৎসা করলেই তো এটা সেরে যাবে। পুষে রেখেছেন কেন?
বলল- জানি সাহেব। কিন্তু আমাগো মত স্বামীহীন মেয়েদের একা থাকা অনেক কঠিন। আজ যদি আমার পায়ে ঘা না থাকেতা হলে কাল থেকেই মানুষরুপের কিছু নেকড়ে আমায় খেতে আসবে।
একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়া আর কিছু বলার ছিল না। কারণ সে একেবারেই সত্যি কথা বলেছে। আমি বললাম- সানাই চল আমার ট্রেনের সময় হয়ে এল।
চলেন ভাইজান।
আমরা এগিয়ে চললাম। বললাম- সানাই একটা গান করতো। সানাই ছোট্ট হাতে মন্দিরা বাজাতে বাজাতে গাইতে লাগল ‘‘এই দুনিয়া এখনতো আর সেই দুনিয়া নাই, মানুষ নামের মানুষ আছে দুনিয়া বোঝাই’’। গানটার অর্থ মেয়েটা জানে কিনা তা বলতে পারব না তবে গানটা যে আমার মনে ভীষণ ভাবে ভর করল তা ঠিক বুঝতে পারলাম। আমার ট্রেন এসে গেল, পকেট থেকে কিছু টাকা বের করে সানাইয়ের হাতে ধরিয়ে দিয়ে ট্রেনে উঠলাম। ট্রেন ছেড়ে দিল। আমার বুকের ভিতর একটা রষ্ট অনুভুত হতে লাগল। অতি আপন কিছু ফেলে যাবার কষ্ট। এটাই বোধহয় মানুষের প্রতি মানুষের ভালবাসার কষ্ট?