somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সানাইয়ের করুণ সুর (মুক্তাঙ্গণ সাহিত্য পরিষদের প্রকাশিত অগ্নিধ্বণীর শারদীয় সংখ্যাতে লেখা)

০১ লা জুলাই, ২০১২ সন্ধ্যা ৭:০৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ভালবাসার উৎপত্তি হৃদয়ে না মস্তিস্কে? বিজ্ঞান যদিও বলে মস্তিস্কে তারপরও মানুষ সেটা মানতে নারাজ। কারণ সাধারণ মানুষ (তরুণ-তরুণীরা) মনে করে এসব বিষয় হৃদয় ঘটিত না হয়ে উপায় নেই। আর আমার কাছে ভালবাসাটা একটা আপেক্ষিক ব্যাপার মাত্র। যা দীর্ঘ স্থায়ী হয় না। যাই হোক ভালবাসা নিয়ে এত বেশি ভাষা না লিখে আমার জীবনের অন্য রকম একটা ভালবাসার অনুভুতি অতি সংক্ষেপে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করছিঃ

বাউন্ডুলে স্বভাবের কারণে অনেক আগে থেকেই এখানে সেখানে ঘুরতে যেতাম। একবার ট্রেনে করে অজানা গমত্মব্যে যাচ্ছিলাম। ট্রেনে চড়ে সীটে বসার পর কানে ভেসে এল একটা অল্প বয়সী কন্ঠের গান ও মন্দিরার টুং টাং শব্দ। চোখ তুলে তাকাতেই দেখলাম একটা ছোট্ট মেয়ে গান গাইছে। হাছন রাজার গান- ‘‘মাটিরও পিঞ্জিরার মাঝে বন্দী হইয়ারে, কান্দে হাছন রাজার...........’’। খুব মিষ্টি কন্ঠ মেয়েটার। গান শুনে কেউবা দু’এক টাকা হাতে গুজে দিচ্ছে আবার কেউবা রাজ্যের সমস্ত বিরক্তি মুখে ফুটে তোলার চেষ্টা করছে। গান শেষ হবার পর ডাকলাম মেয়েটাকে।
বললাম- কী নাম তোর? বলল, সানাই।
‘‘খুব সুন্দর নামতো তোর, কে কে আছে তোর, কোথায় থাকিস?’’

বলল, শুধু মা আছে ভাইজান। সামনের ষ্টেশনে নাইমা যামু। আমরা ঐহানেই থাকি। কিন্তু আইজকা মায়ের জ্বর তাই আর কাম করমু না।’’
বুঝলাম আমরা যেটাকে ভিক্ষা বলি সেটা ওদের কাছে কাজ।
তোর মা কী করে?’’ বলল- মা ষ্টেশনে ভিক্ষা করে।
আমি বললাম, তুই দিনে কত টাকা আয় করিসরে সানাই?
ভাইজানযে কী কন! এখন আর গান শুনে কেউ টাকা দিতে চায় না ভাইজান। তারপরও ৫০/৬০ টাকা কামাই।
আমি একটা হিসেব করলাম মনে মনে। দেখলাম সানাই যদি একেকটা কামরায় দুইটা করে গান গায় তাইলে সারাদিনে সে কমপক্ষে ৫০ টা গান গায়। আর সাধারণত যারা গান গেয়ে ভিক্ষা করে তারা ভাটিয়ালী, লালন ফকির কিংবা ভক্তিমূলক গান গায়। তাতে দিন শেষে তাদের কন্ঠের অবস্থা কেমন হয় তা আল্লাহ্ মালুম।
বললাম, আমাকে তোর বাড়ী নিয়ে যাবি?
সে অবাক হয়ে বলল, সত্যিই আমাগো বাড়ী যাইবেন ভাইজান?
কেন আমায় নিয়ে যাবি না?
আপনারা এত ভদ্র মানুষ আমাগো ঝোপেরম ত ঘরে কেমনে যাইবেন?
বলতে চাইলাম ‘‘ভদ্রতা শিখতেহ হলে দরিদ্রের কুঠীরেই যাওয়া উচিত’’। বললাম- চল যাব।
ষ্টেশন আসতেই নেমে পড়লাম। সানাই আগে আগে হাটছে আর আমি পেছনে। মেয়েটার বয়স বড়জোর ১২/১৩ হবে। শ্যামলা বর্ণের গোল মুখখানার সবচেয়ে সুন্দর জিনিসটা হল বড় বড় দু’টো চোখ। চুল গুলো ঘাড় পর্যমত্ম এসে কোকড়া হতে শুরম্ন করেছে। আমরা ষ্টেশনের পেছনে চলে এলাম। দেখি ছোট ছোট কয়েকটা ঝুপড়ি। এর মধ্যে একটা সানাইদের। ঘরের দরজা বলতে ঝাপের মত একটা কিছু আর চাল বলতে পলিথিন। এক কথায় যাযাবরদের থাকার স্থান যেমন হয় ঠিক তেমনি যেন। সানাই তার মাকে ডাকতে লাগল। জ্বরের কারণে সানাইয়ের মা হয়ত শুয়ে ছিল। কিন্তু সানাইয়ের ডাক শুনে ব্যসত্ম হয়ে বাইরে এল। আমায় দেখে মাথায় ঘোমটা দিয়ে চুপচাপ সানাইয়ের দিকে তাকিয়ে রইল। বুঝলাম ভিক্ষার সময় যতই পর্দাহীন থাকুক না কেন, ঘরে এল সবাই বাংলার বধু। খুব বেশি বয়স হবে না তার। ৩০/৩২ এই রকম আরকি। কিন্তু দেহের গঠন এখনও অটুট। সানাইয়ের মায়ের শরীরের কোথাও একটা ঘা আছে যে তা শরীরের বোটকা একটা গন্ধেই টের পাওয়া যাচ্ছিল। সানাই আমায় ছোট্ট একটা মোড়া এনে বসতে দিল। আমি সরাসরি মহিলাকে প্রশ্ন করলাম- আপনার স্বামী নেই? উত্তরে যা বলল তা শুনে অবাক না হয়ে উপায় নেই। বলল- আমি বিয়ে করিনি।
বুঝলাম- সানাই মহাকালের ফসল। বললাম- কিভাবে সংসার চলে?
এই মানুষের কাছে হাত পেতে।
আমি প্রশ্ন করলাম- আপনি কি অসুস্থ? বলল- সেই রকম কিছু না। তবে.....। বলে শাড়ীটা হাটু পর্যন্ত তুলল। দেখলাম পা ভর্তি ঘা। বুঝলাম এটাই ভিক্ষা করার মুলধন। বললাম- চিকিৎসা করলেই তো এটা সেরে যাবে। পুষে রেখেছেন কেন?
বলল- জানি সাহেব। কিন্তু আমাগো মত স্বামীহীন মেয়েদের একা থাকা অনেক কঠিন। আজ যদি আমার পায়ে ঘা না থাকেতা হলে কাল থেকেই মানুষরুপের কিছু নেকড়ে আমায় খেতে আসবে।
একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়া আর কিছু বলার ছিল না। কারণ সে একেবারেই সত্যি কথা বলেছে। আমি বললাম- সানাই চল আমার ট্রেনের সময় হয়ে এল।
চলেন ভাইজান।
আমরা এগিয়ে চললাম। বললাম- সানাই একটা গান করতো। সানাই ছোট্ট হাতে মন্দিরা বাজাতে বাজাতে গাইতে লাগল ‘‘এই দুনিয়া এখনতো আর সেই দুনিয়া নাই, মানুষ নামের মানুষ আছে দুনিয়া বোঝাই’’। গানটার অর্থ মেয়েটা জানে কিনা তা বলতে পারব না তবে গানটা যে আমার মনে ভীষণ ভাবে ভর করল তা ঠিক বুঝতে পারলাম। আমার ট্রেন এসে গেল, পকেট থেকে কিছু টাকা বের করে সানাইয়ের হাতে ধরিয়ে দিয়ে ট্রেনে উঠলাম। ট্রেন ছেড়ে দিল। আমার বুকের ভিতর একটা রষ্ট অনুভুত হতে লাগল। অতি আপন কিছু ফেলে যাবার কষ্ট। এটাই বোধহয় মানুষের প্রতি মানুষের ভালবাসার কষ্ট?
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

স্মৃতিপুড়া ঘরে

লিখেছেন আলমগীর সরকার লিটন, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৩০



বাড়ির সামনে লম্বা বাঁধ
তবু চোখের কান্না থামেনি
বালিশ ভেজা নীরব রাত;
ওরা বুঝতেই পারেনি-
মা গো তোমার কথা, মনে পরেছে
এই কাঠফাটা বৈশাখে।

দাবদাহে পুড়ে যাচ্ছে
মা গো এই সময়ের ঘরে
তালপাতার পাখাটাও আজ ভিন্নসুর
খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে... ...বাকিটুকু পড়ুন

গরমান্ত দুপুরের আলাপ

লিখেছেন কালো যাদুকর, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৫৯




মাঝে মাঝে মনে হয় ব্লগে কেন আসি? সোজা উত্তর- আড্ডা দেয়ার জন্য। এই যে ২০/২৫ জন ব্লগারদের নাম দেখা যাচ্ছে, অথচ একজন আরেক জনের সাথে সরাসরি কথা... ...বাকিটুকু পড়ুন

রাজীব নূর কোথায়?

লিখেছেন অধীতি, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৩:২৪

আমি ব্লগে আসার পর প্রথম যাদের মন্তব্য পাই এবং যাদেরকে ব্লগে নিয়মিত দেখি তাদের মধ্যে রাজীব নূর অন্যতম। ব্যস্ততার মধ্যে ব্লগে কম আসা হয় তাই খোঁজ-খবর জানিনা। হঠাৎ দু'একদিন ধরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বৃষ্টির জন্য নামাজ পড়তে চায়।

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৩৮



ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থী গত বুধবার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে বৃষ্টি নামানোর জন্য ইসতিসকার নামাজ পড়বে তার অনুমতি নিতে গিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এটির অনুমতি দেয়নি, যার জন্য তারা সোশ্যাল... ...বাকিটুকু পড়ুন

=তুমি সুলতান সুলেমান-আমি হুররাম=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:৩৬



©কাজী ফাতেমা ছবি

মন প্রাসাদের রাজা তুমি, রাণী তোমার আমি
সোনার প্রাসাদ নাই বা গড়লে, প্রেমের প্রাসাদ দামী।

হও সুলেমান তুমি আমার , হুররাম আমি হবো
মন হেরেমে সংগোপনে, তুমি আমি রবো।

ছোট্ট প্রাসাদ দেবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×