আমরা ছোট সময়ে এলাকায় শুধু বাহাদুরপুর পীর ছাহেবের নাম শুনতাম। বাহাদুরপুর হল মাদারিপুর জেলার উত্তরের উপজেলা শিবচরে। তারা হাজী শরিয়তুল্লাহর বংশধর। আগে তাদের কেউ কেউ এলাকায় আসতেন, মুরিদদের সাথে যোগাযোগও রাখতেন। সাম্প্রতিক সময়ে তাদের প্রভাব চোখে পড়ছে না। নিজের চোখে তাদের কোন কর্মকাণ্ডও দেখিনি শুধু শুনেছি। স্কুলে পড়ার সময় হঠাৎই দেখলাম চন্দ্রপাড়া পীরের প্রভাব। ফরিদপুরের সদরপুর উপজেলার চন্দ্রপাড়া গ্রামের পীর বলেই তাকে চন্দ্রপাড়া পাকদরবার শরীফের পীর-ছাহেব বলা হতো। হযরত মাওলানা শাহ সুফি সৈয়দ আবুল ফজল সুলতান আহমদ শাহ চন্দ্রপুরী সাহেব খুবই প্রভাবশালী ছিলেন। আজ গদ্দিনশীন পীর সৈয়দ কামরুজ্জামান ছাহেব প্রভাব হারিয়ে ফেলেছেন। আমাদের বাড়ির সামনা দিয়ে শত শত গোরু যেতো। মানে পীরের মুরিদরাই পীরকে উপহার দেয়ার জন্য গোরু নিয়ে যেতো। তারা যত গোরু নিতো তার অনেকগুলোই বাড়তি থেকে যেতো। পরে তা বিক্রি করে দিত পীর সাহেব। টাকা নিলে কেমন দেখায়? এজন্যই হয়তো পীর সাহেব গোরু নিতেন। বর্তমানে চন্দ্রপাড়া পীরের জামাতা- দেওয়ানবাগী পীর মাহবুবে খোদার প্রভাব দেখা যায়। তিনি দাবি করেন- আল্লাহ স্বয়ং দেওয়ানবাগে এসে জিকির করেন। তাঁর স্ত্রী নাকি নবী(সা.)র কন্যা মা ফাতেমা(রা.)র বর্তমান জন্ম। চন্দ্রপাড়ার প্রভাব থাকতে থাকতেই উত্থান ঘটে আটরশির পীরের। পীর সাহেব হাশমত উল্লাহ ছাহেব সদরপুরের আটরশি গ্রামে এসে জাকের ক্যাম্প প্রতিষ্ঠা করে নাম দেন ‘বিশ্ব জাকের মঞ্জিল’। তিনি এনায়েতপুরীর পীরের নির্দেশে শেরপুর থেকে ফরিদপুরে আসেন। এসেই জাকিয়ে বসলেন। আমরা তখন আটরশির কাফেলা দেখতাম। আমাদের ভাগ্যকুল ঘাট ও মাওয়া ঘাট থেকে প্রচুর লোক যেতো আটরশিতে। এরশাদ জামানায় তার বিস্ময়কর উত্থান ঘটে। এরশাদসহ হিন্দু-মুসলমান সবধর্মের মানুষই তার মুরিদ। আগে গোরু যেতে দেখেছি। এখন শুনি নগদেই কাজ হয়। কিছুদিন আগে আমাদের এলাকার একজন ক্যান্সার রোগীকেও শেষ চিকিৎসার জন্য নেয়া হয়েছিল আটরশিতে। ৫০ হাজার টাকা দিয়ে বিশেষ দোয়া আনার তিনদিন পরেই মারা গেছেন। আমাদের বাড়ির সামনেও একটি জাকের পার্টির অফিস ছিল, হয়তো এখনো আছে কিন্তু টের পাই না আর। এরপরে প্রভাববিস্তার করতেন টেকের হাটের পীর ছাহেব- দেলোয়ার হোসেন আনসারী। ওয়াজ করতে এসে এক মুরিদের শিশুকন্যাকেও বিয়ে করে নিয়ে যান। তার মৃত্যুর পরে এখন আর টেকের হাটের পীরের প্রভাব দেখি না।
স্বাধীনতার আগে নাকি জনিপ্রিয় ছিল শর্ষিনা/ছারছীনার পীর ছাহেব। মুক্তিযুদ্ধের সময় সরাসরি মানবতাবিরোধী পরাধেরর সাথে তিনি জড়িত থাকার অভিযোগের পরেও তাকে স্বাধীনতা পুরস্কার দেয়া হয়। তিনি পিরোজপুরের স্বরূপকাঠীর ছারছীনা (আগের নাম মাগুরা) গ্রামের পীর। পীরে কামেল শাহ সূফী নেছারুদ্দিীন আহমদ (রা.) এর নামে এখন স্বরূপকাঠীর নেছারাবাদ! সেই প্রতাপশালী শর্ষিনার পীরের নামও আজ তেমন শুনি না। এখনতো চরমোনাই পীরের প্রভাব দেখি। বর্তমান পীর সাহেবের দাদা বরিশালের চরমোনাই গ্রামের সাইয়েদ মুহাম্মদ ইসহাক এই পীরশালার প্রবর্তক। সম্ভবত ইসহাক সাহেবের পুত্র সৈয়দ মুহাম্মাদ ফজলুল করীম ছাহেবই অধিক পরিচিত ছিলেন। তিনিই রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠা করেন। তার মৃত্যুর পরে পুত্র সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করিম ছাহেব গদ্দিনশীন হলেও পিতার মতো কুশলী ও প্রভাবশালী হয়ে উঠতে পারেননি। তবুও এখনো আমাদের এলাকাতে চরমোনাইর ভক্ত মুরিদানই বেশি মনে হচ্ছে। চরমোনাই গ্রামের এক মেয়ের সাথে চাকরিসূত্রে পরিচয় হয়েছিল বরিশালে। একটা এনজিওতে চাকরি করতো। তাঁকে পীর ছাহেব নাকি চাকরি ছাড়ার হুমকি দিয়েছিল। তাই সে বাধ্য হয়ে চরমোনাই ছেড়ে বরিশালে আশ্রয় নিয়েছিল। তাঁর বাসায় গিয়েছিলাম। ছোট দুই ভাই বোন নিয়ে থাকে। সে বলেছিল, ‘আমি চাকরি না করলে, আমার ভাই-বোনদের পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যাবে’। এখনো মনে আছে, মেয়েটি আমাকে আপেল কেটে খাওয়াতে গিয়ে হাত কেটে ফেলেছিল।
বর্তমানে চাঁদপুরের কচুয়া থানার উজানি গ্রামের পীর ছাহেব দ্বয় আমাদের এলাকায় কিছুটা জনপ্রিয়। ক্বারী ইব্রাহীম (র.) ছাহেবের হাতে প্রতিষ্ঠিত হয়। ফরিদপুর ও বরিশালের চরাঞ্চলের পীরদের মতো অতোটা দাপুটে না হলেও পীর হিসেবে তাদেরও অনেক মুরিদ রয়েছে। তবে ২০১৩ সালে হযরত মাওলানা মোবারক করিম রহ. ছাহেব ইন্তেকাল ফরমাইলে তার বড় সাহিবজাদা ও খলিফা হযরত মাও. ফজলে এলাহী দা.বা. ও মেঝো সাহিবজাদা পীরে কামেল শাইখুল হাদিস মাওলানা আশেক এলাহি দা.বা.কে তরিকার কাজ পরিচালনার জন্য খেলাফত দিয়ে যান। তারা ইসলামি রাজনীতিতে বেশি ভূমিকা রাখতে পারছেন না। ছোট বেলায় ফুরফুরা শরীফ খুব নামডাক শুনতাম। এখন পাসপোর্ট ছাড়া পশ্চিমবঙ্গে যাওয়া যায় না বলেই হয়তো এলাকায় ফুরফুরা মুরিদদের দেখা যায় না। উত্তর প্রদেশের জৌনপুরী পীরসাহেবদের প্রভাবও বাংলাদেশে এখন খুবই কম। দেশে এতো পীর থাকতে বিদেশি পীরের ভাত থাকার কথা নয়।
ঢাকার দক্ষিণ ও পদ্মার নদীর উত্তরের জনপদের (বিক্রমপুর-দোহার)একমাত্র প্রভাবশালী পীর হলেন দোহারের নুরুল্লাপুরের পীর ছাহেবগণ। এই পীরদের কোন মুরিদই আমাদের এলাকাতে দেখি না। তবে দূরদূরান্ত থেকে প্রচুর মুরিদরা এখানে আসে এতে রাস্তা-ঘাটে যানবাহনে প্রচুর লোক দেখা যায়- তাতে তাদের প্রভাব সম্পর্কে উপলব্ধি হয়। তারা একটু সুফিবাদী ঘরানার। নাচ-গান চলে। শোনা যায় নর্তকী নাচে, জুয়ার আসরও বসে পীরের মেলায়। প্রশাসনকে হস্তক্ষেপ করতে হয়। সাতদিন জমজমাট মেলা হয়। চলে পুতুল নাচ, ভ্যারাইটি শো, মদ্যপান, গঞ্জিকা সেবন। আমাদের বিক্রমপুরে জন্ম নেয়া সবচেয়ে বড় আলেম সম্ভবত সায়খুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হক ছাহেব অর্থাৎ বর্তমানে ভাস্কর্য ভাঙ্গা আন্দোলনে ব্যর্থ হওয়া মমিনুল হক ছাহেবের পিতা তিনি। অবশ্য আজিজুল হক ছাহেব শৈশবেই ব্রাহ্মণবাড়িয়া চলে যান এবং সেখানেই মমিনুল হকের জন্ম হয়।
চট্টগ্রামের ফটিকছড়ির নানুপুর বা বাবুনগরেও বেশ কয়েকজন পীর ছাহেবের জন্ম। জুনায়েদ বাবুনগরী হেফাজতের প্রধান হলেও পীর হিসেবে অত প্রভাবশালী নন। লক্ষীপুরের পীর মোহাম্মদ উল্লাহ হাফেজ্জী হুজুরই পীর হিসেবে আলোড়ন তুলেছিলেন দু‘বার রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে। তখন শুনেছিলাম- তিনি বলেছেন যদি তাকে ভোট দেয়া হয় তবে তা হবে বেহেস্তের টিকিট। সেই বেহেস্তের টিকিটের লোভে পরে অনেকে তাকে ভোট দিয়েছেন বটগাছ মার্কায়। পোস্টারে হুজুরের ছবি ছিল না। সাদাকালো এক বটবৃক্ষের ছবি থাকতো। বিতর্কিত ওই দুটি নির্বাচনে তিনি দাঁড়িয়ে সরকারকে বৈধতা দিয়েছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে। তার জামাতা ফজলুল হক আমিনী ছাহেব। সুরেশ্বর পাক দরবার শরীফের নামডাকও শুনতাম। মাওয়া থেকে পদ্মা পার হয়ে নড়িয়া থেকে সুরেশ্বর যাওয়া যায়। আগে দেখতাম ওরসের সময় আমাদের এলাকা থেকেও লোকজন সুরশ্বেরে যেতো। শরীয়তপুরের নামই হয়েছে হাজী শরীয়তুল্লাহর নাম থেকে। তিনি ছিলেন চর শ্যামাইলের পীর। তবে তিনি সামন্তবাদ বিরোধী নেতা ও ফরায়েজি আন্দোলনের মুখপাত্র হিসেবেই সুপরিচিত দুইশত বছর ধরে। এখনো দেশের অধিকাংশ পীরই বৃহত্তম ফরিদপুর, বরিশাল, লক্ষীপুর ও চট্টগ্রামের। দেশের অধিকাংশ প্রভাবশালী পীরের জন্মেই চরাঞ্চলে। এর একটা কারণ অবশ্যই রয়েছে।
পীরের পুত্ররাই সাধারণত গদ্দিনশীন হয়ে পীর হন। একেক জনের একের তরিকা। পুত্ররাই তরিকা রক্ষা করে। কেউ চিশতিয়া তরিকার, কেউ কাদিরিয়া তরিকার, কেউ নকশোবন্দিয়া তরিকার, কেউ মোজাদেদ্দদিয়া তরিকার ইত্যাদি। বিভিন্ন মনজিল অতিক্রম করে উঁচ স্তুরে উন্নীত হওয়ার এসব রীতি পদ্ধতি তারা রক্ষা করে চলেন। আবার একই ছিলছিলাভূক্ত বিভিন্ন পীর থাকেন। পুত্ররা প্রায়শই পিতার মতো চৌকোশ হন না, ফলে পিতার প্রভাব ধরে রাখতে পারেন না। আবার নতুন আবির্ভূত পীরেরা নতুন ছিলছিলাও তৈরি করতে চান। ফলে পুরাতন ছিলছিলাভূক্তরা দুর্বল হয়ে পড়েন। বাংলাদেশে আমরা দেখছি একমাত্র চরমোনাই ছাড়া অন্য পীরবংশগুলো দুর্বল হয়েছে শুধুমাত্র যোগ্য উত্তরপুরুষের অভাবেই। তবুও পীরেরা তাদের বংশ টিকিয়ে রাখতে আপ্রাণ প্রচেষ্টা চালিয়ে যান। এরচেয়ে লাভজনক কিছু পৃথিবীতে আর হয় না। মুরিদগণ অলৌকিক কিছু পাওয়ার আশায় বা পরকালে নিষ্কৃতির আশায় পীরদের বাড়ি গিয়ে টাকা/সামগ্রী নজরানা দিয়ে আসে। পীরেরা এক সিজনের আয় দিয়েই তারা বছর ভরে আরাম আয়েশে পার করেন। বর্তমানে আবার ওয়াজ করতে এসেও বড় অংকের টাকা নেন। একেকজন পীর একেকটা কোম্পানীর মতো- বহুমুখী আয় করেন। আটরশির মোট সম্পদের মূল্য অনেক, সবই মুরিদদের দান। তাই দুর্বল হলেতো মুশকিল, তবুও দুর্বল হয়ে পড়েন।
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে ডিসেম্বর, ২০২০ রাত ৯:৫৮