ছবিসূত্রঃ আনন্দবাজার পত্রিকা।
ছেলেপক্ষের লোকজন যখন পরস্পর এমনভাবে মুখ চাওয়া-চাওয়ি করতে লাগলো যে তাদের সকলেই সকলের সিদ্ধান্ত জেনে গেছে এবং তা সকাল বেলা পূর্ব দিকে সূর্য ওঠার মতোই অকাট্য,তখনই নানাজান আশংকা করেছিলেন যে তিনি এবারো আশাহত হতে যাচ্ছেন। শেষ পর্যন্ত তার আশংকাই সত্যি হলো যখন ছেলের খালু নানাজানের পরিস্কার গোবর দিয়ে লেপা উঠোনে ফুত করে একটা শব্দ করে পানের লাল রঙের পিক ফেলে বললো, “পরে জানাবো।“ রাগে পিত্তি জ্বলে গেল নানাজানের ভেতরে ভেতরে।কিন্তু তিনি নিজেকে যথাসম্ভব শান্ত রেখে মুখে অমায়িক হাসি বজায় রেখে “অনেক ভালো লাগলো।আবার আসবেন।“ বলে বিদায় দিলেন অতিথিদের। এমনি সময় হলে অতিথিদের রাস্তা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আসতেন তিনি।কিন্তু আজ বারান্দা থেকেই বিদায় দিলেন,মুখে অমায়িক হাসি রেখে।তাকে দেখে বোঝার উপায় নেই যে তিনি তার রাগ পেটের ভেতর জমা করে রেখেছেন। যেকোনো সময় হয়তো তা আগ্নেয়গিরির মতো বিস্ফোরিত হয়ে বের হয়ে আসবে তার পেট থেকে গলা হয়ে। অতিথিরা অদৃশ্য হয়ে যাবার পর তিনি রাগে গজগজ করতে লাগলেন। বলতে লাগলেন- “এই অভাবের মইদ্যে আমার এতগুলি ট্যাহা খসাইলো হুদাই।মাইয়া নিবি না যহন দুই-তিন দফা দ্যাকতে আইলি ক্যা?” কথাগুলো বলে ঘরে ঢুকতে যাবেন,এমন সময়ে তার চোখ গেল উঠোনের সেই পানের পিকের দিকে।প্রখর রোদে কালো রঙ ধারণ করেছে সেটা। “হারামির বাইচ্চা আমার উঠানডাও ময়লা কইরা থুইয়া গেছে।“ রাগ ঝড়ে পড়ে তার কণ্ঠ থেকে ।উঠোন পরিস্কার করার লক্ষ্যে তিনি ঝাটা হাতে নেবার চেষ্টা করলেন।কিন্তু বয়সের ভারে ন্যুজ নানাজান কোমরের ব্যাথায় “ও মা গো” বলে কঁকিয়ে উঠলেন।
নানাজানের আর্তনাদ শুনে ভেতর ঘর থেকে এক কিশোরী বের হয়ে এলো। নানাজানের মেয়ের ঘরের নাতনী। সামান্য সাজসজ্জা করেছে আজ।প্রতিবারই পাত্র দেখতে আসার সময় সাজসজ্জা করে থাকে। তাকে দেখতে সুন্দর লাগে। প্রতিবারই তাকে দেখেই পছন্দ করে ফেলে পাত্রপক্ষ।কিন্তু শেষ পর্যন্ত বলে “পরে জানাবো”।আর তাই এখন আর সে অত সাজসজ্জা করে না। কারণ সে জানে,সেজে লাভ নেই।উত্তর আসবে “পরে জানাবো”। যদিও সে কিশোরী।বয়স প্রায় সতেরো-আঠারো হবে।কিন্তু তাকে দেখে মনে হয় যেন এখনো হাইস্কুল পাশ করেনি। ছোটখাটো গড়ণ।গোলগাল মুখ।কিশোরী বের হয়ে এসেই নানাজানকে উদ্দেশ্য করে বলতে শুরু করলো-“যেইডা পারেন না হেইডা করতে যান ক্যা? কোমরের জোর নাই,ঝাড়ু দিতে আইছে!!” বলে খিলখিল করে হাসতে লাগলো।কিশোরীর হাসি দেখে নানার রাগ আরো বেড়ে গেল।একে তো তার ময়লা উঠোন,তারপর আবার কোমরের জোর নিয়ে ইয়ার্কি। এবার তীব্র রাগে তিনি একটা বেফাঁস কথা বলে ফেললেন। “সম্বন্ধ আরেকটা ভাগছে হেই খেয়াল আছে?? বেহায়ার মতো হাসে আবার!!” একথাটি বলার পরপরই তিনি নিজের জিহ্বায় কামড় দিলেন।নিজের নাতনীকে এরকম কথা বলা উচিৎ হয় নি তার। ধপাস করে আছাড় খেয়ে পড়ে যাওয়ার মতো করে তার রাগও পড়ে গেল। তীব্র একটা অনুশোচনাবোধ জাগ্রত হলো তার মধ্যে।তিনি একটা প্রতিউত্তরের অপেক্ষা করতে লাগলেন নাতনীর কাছ থেকে।ভেবে নিলেন কোনো জবাব দেবেন না আর।নাতনী যা বলে বলুক।তিনি মহা অন্যায় করে ফেলেছেন। কিন্তু তাকে অবাক করে দিয়ে কিশোরী বলে,”আপনে ঘরে যান।আমি দ্যাখতাছি।“ বলেই ঝাটা হাতে তুলে নিয়ে উঠোন ঝাড়ু দিতে উদ্যত হয়।গৃহকর্মনিপুণ নাতনীর হাতে উঠোন পরিষ্কারের ভার দিয়ে নানাজান ঘরের ভেতরে চলে গেলেন।
কিশোরী উঠোন পরিষ্কার করে ঘরে ফিরে এলো। এসে দেখে নানাজান গোমড়া মুখে বসে আছেন। সকাল বেলার ঘটনাটা নানাজানের জন্য নতুন না হলেও এসব ঘটনা নানাজানের মনের মধ্যে ভীষণ প্রভাব ফেলে। একই সাথে অপমানিত বোধ করেন আবার নাতনীটার জন্য মন খারাপ হয় তার।মেয়ের জামাই মারা যাওয়ার পর তার যুবতি মেয়েটিকে তিনি আবার বিয়ে দেন।নাতনী তখন শিশু।কিন্তু পরিস্থিতির কারনে তার মায়ের কাছে না থেকে সে নানাজানের কাছেই থেকেছে।তার বয়স হয়ে গেছে।নাতনীটার একটা ব্যবস্থা করে যেতে পারলে তিনি স্বস্তি পেতেন।সম্বন্ধ আসে ।কিন্তু পাকা হয় না। তার বড় মেয়ে তার নিজের ছেলের জন্য এই নাতনীটাকে নিতে চেয়েছিলো।নানাজানও রাজি ছিলেন।কিন্তু শেষ পর্যন্ত ভেঙে গেল এই বিয়ে।কারণটা অদ্ভূত। মেয়ে একদিন ফোন করে জানালো,”আমার একটা মাত্র ছেলে। আর মেয়ের মা-বাপ কেউ নেই।বিয়ে হলে তো ছেলেটা জামাই আদর পাবে না।এই বিয়ে হবে না।“ আকাশ থেকে পড়েছিলেন সেদিন নানাজান। পরের সম্বন্ধটাও একই কারণে হয় নি।ছেলে জামাই আদর পাবে না। শ্বশুর-শাশুড়ি নেই। পরেরজন তো বলেই বসলো,”মা-বাপ নাই,ছাড়া গরুর মতো বড়ো হইছে।এই মাইয়া ভালো হইবো না।“ সেদিন খুব চটে গিয়েছিলেন নানাজান।কথাটা সর্বৈব মিথ্যা। নাতনিকে বড়ো করার ক্ষেত্রে তিনি কোনো কমতি রাখেন নি।তার নাতনী গৃহকর্মে যেমন নিপূণ,তেমনি পড়াশোনায়ও ভালো।কষ্ট করে হলেও তিনি নাতনীকে পড়িয়েছেন।সে এখন কলেজে পড়ছে।কয়েকদিন পরে পরীক্ষা তার। সেই লোকটিকে রীতিমতো ঘাড় ধাক্কা দিয়েই বের করে দিয়েছিলেন নানাজান। তারা গ্রামের রাস্তা ধরে গালিগালাজ করতে করতে বাড়ি ফিরেছিলো।
দুপুরের খাবারের সময় হয়ে গেছে।নানাজানের সামনে ভাত বেড়ে দিতে দিতে কিশোরী বললো, “কাহিনি কী?এইডাও জামাই আদর?”
নানাজান বললেন,” জানি না।কইছে, পরে জানাইবো।“
“তাইলে জামাই আদরই হইবো?”
বলে খেতে থাকে কিশোরী। কিছুক্ষণ পরে নানাজান জিজ্ঞাসা করলেন যে,আগের কথায় সে রাগ করেছে কি না। নির্লিপ্ত ভঙ্গীতে “সইয়া গেছে“ বলে খেতে থাকলো সে। যতটা সহজে “সইয়া গেছে” বলা হলো আসলে ততটা সহজ না সবকিছু।শুধু সম্বন্ধ ভেঙে যাওয়া হলে ঠিক ছিলো। কিন্তু তা না হয়ে এর প্রতিক্রিয়া হয় সুদূরপ্রসারী। মানুষের মুখের কথা ডালপালা মেলে মহীরুহ হয়ে ওঠে। নানাজান জানেন যে সম্বন্ধ চলে যাওয়ার পরে কিছুদিন পর্যন্ত শান্তিতে থাকতে পারে না তার নাতনী। এই নিয়ে চারটি সম্বন্ধ চলে গেল।তিনি তো কারো পায়ে ধরেননি।সবাই সব জেনেশুনে আসে।তাদের মেয়েও পছন্দ হয়।কিন্তু সবকথা জামাই আদরে গিয়ে আটকে যায়। সম্বন্ধ চলে যাওয়ার পরে আসে পাড়ার লোকেরা। ভালো পরামর্শের আড়ালে বলে যায় “মেয়ের হয়তো কোনো দোষ আছে। অমুক-তমুক এলাকার পীরের কাছ থেকে পানিপড়া এনে খাওয়ালে দোষ কেটে যাবে। সাত দিনের মধ্যে বিয়ে হয়ে যাবে। একেবারে ফুল গ্যারান্টি।“ উদাহরণস্বরূপ অন্য কোনো গ্রামের সদ্য বিবাহিত কোনো মেয়ের বিয়ের বর্ণনা দিতে শুরু করে তারা।নানাজান সব শোনেন।কিছু বলেন না। কিন্তু নাতনীটাকে সবচেয়ে বেশি যন্ত্রণা দেয় পাড়ার বখাটেগুলো। কলেজে যাওয়ার পথে তার নাতনীকে কুপ্রস্তাব দেয় তারা। অনেক সময় মধ্যরাতে টিনের চালে ঢিল মারে।মেয়েটাও মুখ বুজে সব সহ্য করে।কারন অল্প কিছুদিন পরই উপদ্রব কমে যায়।বখাটেরাও তাকে আর উত্যক্ত করার যোগ্য মনে করে না হয়তো।
বিকেলবেলা সময় কাটানোর জন্য একটু বাজারের দিকে গিয়েছিলেন নানাজান। তখনই এক জায়গায় আক্কাসের বাপের সাথে দেখা হলো তার। আক্কাসের বাপ হাসিমুখে বললো,”কাকা! নাতনীরে নাকি দ্যাখতে আইছিলো হুনলাম।খবর কী?এইবার পাক্কা তো?”
নানাজান বললেন ,“ নাহ! পরে জানাইবো কইছে।“
“ও আচ্ছা! মানে এইডাও গেছে। আপনে হুদাই ঝামেলা করেন। কতবার কইলাম আমার আক্কাসের লগে বিয়া ডা দিয়া দেন।আপনে কতাই হুনেন না।“ অনুযোগের সাথে বললো আক্কাসের বাপ।
“আমি আগে কইছি,এহনো কই, তোমার পোলার লগে বিয়া দিমু না। আক্কাসের স্বভাব-চরিত্র ভালা না।আগেই তো এক বউ আছে।“
একথা মেনে নিতে পারে না আক্কাসের বাপ। “ জোয়ান মরদেরা এমন একটু করেই।তাছাড়া সোনার আংটি ব্যাকাও ভালো। আর এই মাইয়া কেউই নিবো না। বাপ-মা নাই,সম্পত্তি নাই,দেখতেও খাটো।“
“কেউ না নিলে আবিয়াইত্তা রাখলাম।সমস্যা তো নাই।“ বলেই হনহন করে বাড়ির দিকে চললেন নানাজান।
রাতের বেলা খাওয়ার পরে একটু বিশ্রাম করছিলেন নানাজান। ঠিক তখনই সেই নানাজনের উঠোন ময়লা করা লোকটি ,যে কিনা পাত্রের খালু,সে ফোন করলো নানাজানের মোবাইলে। তারা বিয়েতে রাজি।শুনে প্রচণ্ড খুশি হলেন নানাজান।কিন্তু পরক্ষণেই নানাজান দমে গেলেন।তাদের কিছু শর্ত আছে। মেয়ের যেহেতু বাপ-মা কেউ নেই,শ্বশুড় বাড়িও বলতে গেলে নেই,ছেলেটা তো জামাই আদর এ জীবনে পাবে না। তাই এই মেয়ের বিয়ে দিতে হলে ছেলেকে নগদ টাকা আর নানাজানের ভিটেমাটি লিখে দিতে হবে।এছাড়া আর কোনো দাবি নেই তাদের। রেগে যাবার মতো ব্যাপার হলেও এটা আগেই অনুমান করায় নানাজান রাগলেন না। তিনি খুব মোলায়েম সুরে বললেন
“ থাক বাবা! লাগতো না তোমাগো পোলা। ট্যাহা-পয়সা,ভিটা দিলেই বা লাভ কী?মাইয়ার বাপ-মা তো ফেরত আইতাছে না।আর পোলাডাও তো জামাই আদর পাইতাছে না।“
বলেই ফোনটা রেখে দিলেন তিনি।
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই ডিসেম্বর, ২০২০ সন্ধ্যা ৬:২৯