somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

Jallikattu(জাল্লিকাট্টু)- মানুষের চিরায়ত আদিমতার গল্প।

২৫ শে মার্চ, ২০২১ রাত ৯:২১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


ছবি- অফিসিয়াল মুভি পোস্টার। (wikipedia.org)

জাল্লিকাট্টু ছবিটি মালায়লাম লেখক এস হরিশের লেখা ছোট গল্প মাওবাদী অবলম্বনে রচিত। এর চিত্রনাট্য রচনা করেছেন এস হরিশ এবং আর জয়কুমার। লিজো জোস পেলিসির পরিচালিত ছবিটি ২০১৯ সালে মালায়ালাম ভাষায় মুক্তি পায়। ছবির গল্পটি একটি মহিষকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়েছে যা একটি প্রত্যন্ত গ্রামের কসাইখানা থেকে পালিয়ে যায়।

জাল্লিকাট্টু ভারতের দক্ষিণাঞ্চলীয় রাজ্য কেরালার একটি ঐতিহ্যবাহী ও জনপ্রিয় খেলা।এই খেলার মূল উপজীব্য মানুষ ও তেজী ষাড়ের লড়াই। একটি তেজী ষাড়কে ছেড়ে দেয়ার পর পুরুষেরা ষাড়টিকে নিয়ন্ত্রণ করার প্রয়াস চালায়। যে ষাড়কে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে তাকে পুরষ্কৃত করা হয়। এই খেলাকে পুরুষের শৌর্য-বীর্য প্রদর্শনের খেলা হিসেবে দেখা হয়। এই খেলার বিপজ্জনক পরিণতি অনুধাবন করে কেরালার হাইকোর্ট খেলাটিকে নিষিদ্ধ করেছিলো।কিন্তু জনরোষ এবং ক্রমাগত আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে নিষিদ্ধ করার প্রায় তিন বছর পর এর নিষেধাজ্ঞা বাতিল করে খেলাটিকে আবার চালু করা হয়।

ছবিটি শুরু হয় কেরালার একটি প্রত্যন্ত গ্রামের মানুষগুলোর প্রাত্যহিক জীবনকে তুলে ধরার মাধ্যমে।গ্রামে একটিমাত্র কসাইখানা বিদ্যমান, যেখানে প্রতিদিন ভোরে মহিষের মাংস বিক্রি করা হয় এবং গ্রামবাসী সেখান থেকে মাংস সংগ্রহ করে। গ্রামবাসীর মাংস সংগ্রহের মধ্যেই পরিচালক গ্রামের পরিবেশ ও মানুষের জীবন সম্পর্কে ধারণা দিয়ে দেন পরিচালক। যেখানে দেখা যায় মানুষের লোভ, নারীর অমর্যাদা, নারীর প্রতি সহিংসতা,লালসা, নৈতিকতার অবক্ষয়। অশিক্ষা ও কুসংস্কারের একটি চিত্র খুব সুন্দর করে ফুঁটিয়ে তোলা হয়েছে একটি দৃশ্যে। গ্রামটি খৃষ্টান ধর্মাবলম্বী দ্বারা অধ্যুষিত। আর তাই গ্রামবাসীকে দেখা যায় নিজের টাকায় মহিষের মাংস কিনে সেই মাংস চার্চের একটি গাছে ঝুলিয়ে রেখে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থণা করতে। তখন চার্চের প্রধানের মুখে প্রসন্নের হাসি দেখা যায়। 

গ্রাম্য জীবনে ঝড় বয়ে যায় যখন সেই কসাইখানা থেকে একটি মহিষ পালিয়ে যায়। প্রাণীকে গুলি করে মারা আইনসম্মত নয় আর তাই মহিষটিকে জ্যান্ত ধরতে লোক জড়ো হয়। হাজার হাজার মানুষ মহিষটিকে ধরার প্র‍য়াস চালায়।কিন্তু মহিষটি প্রতিবারই পালাতে সক্ষম হয়। এতে আহত হয় বহু মানুষ। এ ব্যাপারটি আমাদের চোখের সামনে তুলে ধরে আদিম শিকারী সমাজকে। যারা সংঘবদ্ধ হয়ে বৃহৎ প্রাণী শিকারের মাধ্যমে নিজেদের খাদ্যের যোগান দিত। ছবির প্লটের কেন্দ্রিয় গ্রামের পাশের গ্রাম থেকেও লোক আসে মহিষটিকে ধরার জন্য। ফলে মানুষের সংগ্রাম শুধু মহিষকে ধরার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে না। এটি হয়ে ওঠে মর্যাদার লড়াই,প্রতিহিংসার লড়াই। এই লড়াই রূপ নেয় দলীয় কোন্দলে। যার ফলে এটি একসময় সংঘর্ষে রূপ নেয় এবং এক পর্যায়ে পুলিশের জিপ পুড়িয়ে দেয় দুষ্কৃতিকারীরা। রাতের বেলা দলমত নির্বিশেষে সবাই বের হয় মহিষকে ধরতে। মানুষের হাতের জলন্ত মশাল ও বল্লম আদিম শিকারী সমাজের প্রতিচ্ছবি।

ফ্রয়েডের লিবিডো তত্ত্বের সফল প্রয়োগ দেখা যায় ছবিতে। নারীর প্রতি আদিম লালসা মানুষের পশু প্রবৃত্তিকে জাগ্রত করে। সাবপ্লটের মাধ্যমে আমরা জানতে পারি একজন নারীকে কেন্দ্র করে দুই বন্ধুর মধ্যে জন্ম নেয়া হিংসা-বিদ্বেষ সম্পর্কে। যে হিংসা জাগ্রত থাকে ছবির শেষ পর্যন্ত। ছবির একটি চরিত্র কুট্টানকে তাই দেখা যায় ছবির মূল চরিত্র অ্যান্টনির ওপর প্রাণঘাতী আক্রমণ চালাতে। অথচ এই কুট্টান এসেছিলো মহিষ ধরতে এবং তা ছিলো অ্যান্টনির পূর্ববর্তী হিংসাত্মক কর্মকাণ্ডের প্রতিশোধ নেয়ার একটি অজুহাত। তাছাড়া ছবিতে দেখা যায় একজন মেয়েকে, যে কি না তার এনগেজমেন্ট এর আগের রাতে প্রেমিকের সাথে পালিয়ে যাওয়ার সময় ধরা পড়ে যায়। 

ছবিটির শেষ দৃশ্যে আদিম শিকারী সমাজের মানুষের হিংস্রতা, আদিমতা,পশুপ্রবৃত্তি চরম আকার ধারণ করে। গল্পের মূল চরিত্র অ্যান্টনি মহিষটিকে ধরতে সক্ষম হয়।কিন্তু সে একা ভোগ করতে চায় মহিষটিকে। ফলে মহিষের ভাগ নেবার জন্য অন্যেরা তাকে আক্রমণ করে। সেই আক্রমণ প্রলয়ঙ্করী আকার ধারণ করে যখন হাজার হাজার মানুষ একে অপরকে আক্রমণ করতে শুরু করে অ্যান্টনিকে আক্রমণের প্রতিক্রিয়ায়। যে যাকে পারছে তাকেই মারছে। মারামারি শেষ পর্যন্ত আর মহিষ অধিকারে কেন্দ্রীভূত থাকে না। তা পরিণত হয় হিংস্র মানুষের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে, আদিম মানুষের পাশবিকতায়। দৃশ্যপট থেকে একসময় হারিয়ে যায় মহিষ। জেগে থাকে মানুষের অস্তিত্বের সংগ্রাম ও আদিমতা। সেখান থেকে দূরীভূত হয়েছে মনুষ্যত্ব। এই ব্যাপারটি খুব সুন্দর করে ফুঁটিয়ে তোলা হয়েছে ছবিতে, যেখানে দেখা যায় গ্রামের একজন মুমূর্ষু ব্যক্তিকে, যাকে সাহায্য করার কেউ নেই। সবাই সংঘর্ষে ব্যস্ত। মানুষের আদিমতা ও মনুষ্যত্বহীনতাকে প্রতিকায়িত করার উদ্দ্যশ্যে ছবির শেষে খুব অল্প সময়ের একটি দৃশ্য সংযোজিত করেছেন পরিচালক,যেখানে দেখানে দেখা যায় পশুর চামড়া পরিহিত আদিম মানুষদের, যারা শিকারের পশুর দখল নেয়ার জন্য মশাল ও পাথুরে অস্ত্র হাতে মরণপণ সংঘর্ষে লিপ্ত হয়।

জাল্লিকাট্টু ছবিটিতে পরিচালক আধুনিক যুগে মানব সমাজ থেকে অন্তর্হিত মানবতা,সভ্যতার সন্ধান করতে চেয়েছেন। একটি প্রাণীকে কেন্দ্র করে তিনি মানব সমাজের চিরন্তন আদিমতা, লালসা, যৌনতা, হিংসা-বিদ্বেষ, হিংস্রতাকে তুলে এনেছেন সেলুলয়েডের ফিতায়। 

সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে মার্চ, ২০২১ রাত ১২:০৩
১১টি মন্তব্য ১১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

তালগোল

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৩৫


তু‌মি যাও চ‌লে
আ‌মি যাই গ‌লে
চ‌লে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফু‌রা‌লেই দি‌নের আ‌লোয় ফর্সা
ঘু‌রেঘু‌রে ফি‌রে‌তো আ‌সে, আ‌সে‌তো ফি‌রে
তু‌মি চ‌লে যাও, তু‌মি চ‌লে যাও, আমা‌কে ঘি‌রে
জড়ায়ে মোহ বাতা‌সে ম‌দির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

মা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৩


মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।

অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:১৮



একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। গানডুদের গল্প

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:২৮




তীব্র দাবদাহের কারণে দুবছর আগে আকাশে ড্রোন পাঠিয়ে চীন কৃত্রিম বৃষ্টি নামিয়েছিলো। চীনের খরা কবলিত শিচুয়ান প্রদেশে এই বৃষ্টিপাত চলেছিলো টানা ৪ ঘন্টাব্যাপী। চীনে কৃত্রিম বৃষ্টি নামানোর প্রক্রিয়া সেবারই প্রথম... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতকে জানতে হবে কোথায় তার থামতে হবে

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৪৫


ইন্ডিয়াকে স্বপ্ন দেখানো ব্যাক্তিটি একজন মুসলমান এবং উদার চিন্তার ব্যাক্তি তিনি হলেন এপিজে আবুল কালাম। সেই স্বপ্নের উপর ভর করে দেশটি এত বেপরোয়া হবে কেউ চিন্তা করেনি। উনি দেখিয়েছেন ভারত... ...বাকিটুকু পড়ুন

×