ছোটোবেলা থেকেই আমার মা কে দেখতাম আর সব মায়ের থেকে খুব আলাদা। আমার ছোটো দুই ভাইবোনের সাথে আমার বয়সের পার্থক্যটা বেশি হলেও ওরা দুইজন একেবারেই পিঠাপিঠি। স্কুলে তাই মা আমাকে আনা নেওয়া করতে পারত না। খুব সকালে উঠে মা আমার জন্য টিফিন বানিয়ে দিত। কলেজের শেষ দিন পর্যন্ত এর ব্যতিক্রম হয়নি। এরই সুফলস্বরূপ আমি ছোটোবেলা থেকেই ফাস্টফুড তেমন একটা খেতে পারতাম না। কলেজে ফ্রেন্ডদের পাল্লায় পড়েই এটা খাওয়া শিখেছিলাম। অথচ ছোটোবেলায় ভ্যানের বাকি সব মেয়েদের মুখে শুনতাম তাদের মায়েরা অনেকে ঘুম থেকেই উঠেনা তাদের বিদায় দিতে, আর টিফিনও তাই কালে ভদ্রে পেত তারা। ক্লাস শেষে বাড়ি ফিরে দেখতাম মা বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। আমি ছোটোবেলা থেকেই খুব বেশি অসুখে ভুগতাম। আমি অসুখে ভুগে রাত জাগতাম আর সারারাত আমার মা ও আমার সাথে জেগে থাকত। আমার জন্মের আগে আমার একটা ভাই জন্মেছিল। কিন্তু খুব ছোটোবেলাতেই তার অকালমৃত্যু ঘটে। তাই আমাকে মা মনে হয় সবার থেকে একটু বেশিই ভালোবাসেন সবসময়। মা'র সব থেকে বেশি ভালো দিক উনি কখনোই ছেলে মেয়ের মাঝে তফাৎ করেন না। মাকে কখনও বাবার কাছে কোনো ভালো শাড়ি অথবা ঘনার দাবী করতে শুনিনি এখনও পর্যন্ত। শাড়ি পরে একটা মানুষ এত কমফোর্টেবল কিভাবে থাকে তা মাকে না দেখলে বুঝতামই না। মা'র অপারেশনের পর অনেক জোর করলাম আমরা দুই বোন মিলে যে মা এইবার তো সালোয়ার কামিজ পড়। তোমার হাটা চলাতে কত কষ্ট হয়। মা হাসে খালি। বলে,"যদি আমিও কামিজ পড়ি তাহলে মা আর মেয়ের মাঝে তফাৎটা থাকবে কোথায়?"
খুব জেদী আর অভিমানী আমার মা। আমার নানা- নানীর ১১ সন্তানের মধ্যে সবার ছোটো তিনি। বংশগতসূত্রে রাগটা ভালোই পেয়েছেন। বাবার কোনো একবারের কথার জের ধরে মা প্রতিজ্ঞা করেন যে কখনও মোবাইল ব্যবহার করবেন না। এখনও পর্যন্ত তার ব্যতিক্রম হয়নি। কতবার টিএনটি লাইন নষ্ট হয়ে অথবা বোনের সাথে রাগের জের ধরে তার মোবাইলে কল দিব না বলে মার সাথে রাগ করেছি, ঝগড়া করেছি। মা তবুও অনড়। দিনের মধ্যে তাই মাঝেমাঝেই আমার মরহুম নানাকে পর্যন্ত বকেছি," গনি মিয়া রেখে গেছেন একেকটা জেদের পোটলা !!!" জেদের জন্য ডাক্তার পর্যন্ত দেখাতে যেতেন না। মা যখন অসুস্থ হল খুব বকেছিলাম মাকে। খালাদের ফোন করে বলেছিলাম সব দোষ আপনার বোনের। খালি রাগ আর জেদ।
আমার মাকে আমি দেখতাম অনেক কাজ করতে । একা হাতে বাসা পাল্টানোর প্রায় সব কাজ তিনি করতেন। কখনও একমুহুর্ত কাজ ছাড়া বসে থাকতে দেখিনি। মনে হত মা একাই একশো। একমাস আগে যখন বাসা পাল্টানোর সময় মা পা ফেলে হাঁটতেই পারছিলেন না, নিজেকে মনে হয় খুব অসহায় ভাবছিলেন মা। আমার ফোন পেয়েই কান্না থামাতে পারেননি। মায়ের কান্না শুনে মনে হচ্ছিল আমি কত অসহায়, মায়ের কোনো সাহায্যই করতে পারছি না।
গত একমাসে আমার পৃথিবীটা ওলটপালট হয়ে গেছে। মা'র হেপাটাইটিস সি ধরা পড়েছে সাথে লিভারের সমস্যা। সারাদিন নেটে বসে তাই হাজারো প্রশ্ন লিখে সার্চ দেই আমি গুগলে। ডাক্তার ধারণা করছেন যে আমার ছোটোভাই হওয়ার সময় মাকে যে রক্ত দেওয়া হয়েছিল তার মাধ্যমেই এই ভাইরাসটা ঢুকে মার শরীরে। এখনও পর্যন্ত এর কোনো ভ্যাকসিন পাওয়া যায় না। এর থেকে বাঁচার উপায় হল সাবধানতা, সচেতনতা। জানিনা আমার মায়ের ভাগ্যে কি আছে। এই ভাইরাসটা কতখানি আমার মাকে ভিতর থেকে খেয়েছে তাও আমার এখনও অজানা। সারাদিন ক্লাশের ফাঁকে, হলে নিজের রুমে বসে, বারান্দায় দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে খালি চোখের জল ফেলি। কেনো আমার মা'রই এই রোগ হল? কেন ঐদিন একটা সি ভাইরাসে আক্রান্ত মানুষের রক্তই দেওয়া হল আমার মাকে? কোনো উত্তর পাইনা। খুব ইচ্ছা করে ছুটে যাই মা'র কাছে। কিন্তু ভার্সিটির ছুটি হয়নি তাই যেতে পারিনা। আর ছুটি ছাড়া চলে গেলে মা ভয় পাবেন । আরো বেশি কষ্টে ভুগবেন। মাঝে মাঝে মনে হয় নিজের ইন্জিনিয়ার হওয়ার ইচ্ছাটাকে পানিতে ফেলে চলে যাই একেবারে মায়ের কাছে। গত তিন বছরে মা'র কাছে ছিলামই বা কতদিন? খুব বড়জোড় ১০ মাস। কিন্তু পারিনা। কারণ আমার মায়েরও তো সেই একই স্বপ্ন , মেয়ে তার বড় মানুষ হবে। তার সমস্ত অপূর্ণতাকে পূরণ করবে। তাই বুকের মধ্যে ১০ টনের ভারী একটা বোঝা নিয়ে প্রতিদিন সকাল আট টায় ক্লাশে হাজির হই।
বাংলাদেশে প্রতিদিন হাজারো মেয়ে মা হচ্ছে। জানিনা তারা কি নিরাপদ রক্ত পাচ্ছে? না কি আমার মতই কোনোদিন একটা মেয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে হুহু করে কাঁদবে আর বলবে," কেন আমার মা'রই এমন অসুখ হল?"
** শুনতেছি রোযার মধ্যেও আমাদের একটা পরীক্ষা হবে। যদি তাই হয় তবে আমার বাসায় যাওয়া আরো পিছিয়ে যাবে। মা'র কথা খুব মনে পড়ছিল। কান্না করতে পারতেছি না। মাথাব্যথা করে। তাই এটা লিখলাম। মনের বোঝা হালকা করা আর কি। পারসোনাল লেখা। কারো মনোরঞ্জনের জন্য না। তাই কারো ভালো না লাগলে নাই।**