somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

জাদুর গল্প, জাদুকরের গল্প

১৬ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৯ বিকাল ৪:১১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

(ছবি: ক্রিকইনফো)


কাল ছিল তাঁর জন্মদিন। হারাতে বসা এক শিল্পকে শুধু জাগিয়েই তোলেননি। স্পিন বোলিংও যে হাল আমলের ট্রেন্ড হতে পারে, গ্ল্যামারের অংশ হতে পারে, সেটা দেখিয়েছিলেন আবদুল কাদির। ১০ দিন আগে বিদায় নেওয়া জাদুকরের কাল ৬৪ পূর্ণ হতো।তাঁকে নিয়ে কাল সংবাদমাধ্যমে লেখাটি প্রকাশ হয়েছে

সব জাদুরই তিনটি পর্যায় থাকে। প্রতিজ্ঞা, রূপান্তর ও মর্যাদা। শুরুতে জাদুকর খুব সাধারণ কিছু দেখান। কবুতর, কার্ড কিংবা বল। চোখের সামনে থাকে। আর জাদুকর রহস্য করে বুঝিয়ে দেন, কিছু একটা হতে চলেছে। এটুকু প্রতিজ্ঞা।

এরপর জাদুকর তা পাল্টে দেন বা উধাও করে দেন। এটুকু রূপান্তর। কঠিন কাজটুকু সবশেষে। ফিরিয়ে আনা মানে আগে যা ছিল। তা করতে পারলেই জাদুকর মর্যাদাবান। যেমনটা করেন একজন লেগ স্পিনার, একজন শেন ওয়ার্ন কিংবা আবদুল কাদির।

ওয়ার্নের ‘প্রতিজ্ঞা’ (অ্যাকশন) ছিল খোলামেলা। গ্রিপ লুকোতেন কমই। কিন্তু কাদির রহস্যপ্রিয়। দৌড় শুরুর একটা প্রস্তুতি ছিল। বলটা শূন্যে কয়েকবার স্পিন করাতেন। ব্যাটসম্যান থেকে দর্শক বুঝছে, ওটা দিয়েই হবে। চূড়ান্ত গ্রিপটা হতো দৌড় শুরুর ঠিক আগমুহূর্তে বাঁ হাতে ঢেকে, মুখ থেকে লালা নিয়ে ডান হাতে, যেন ওটুকু জাদুর আগের ছুঁ মন্তর ছুঁ!

বাইশ গজে সেই মন্ত্রপুত বলের রূপান্তর ঘটে শেষ মোচড়ে, না হলে আঙুলের ভেলকি। বাকিটা ব্যাটসম্যান ও দর্শকের জন্য। কেউ বোকামি করে দুখী, কেউ বোকা বনে সুখী, রোমাঞ্চিত। এটা কী হলো! উত্তেজিত ধারাভাষ্যকার ধরিয়ে দেন, গুগলি!

আসলে চাতুরী। জাদুকরদের মতো আরকি। চোখে দেখেও ভাবতে হয়, কীভাবে সম্ভব! কাদির এ ভাবনা নিয়ে খেলেছেন প্রতি ম্যাচেই। বড় বড় বাঁকের ওপর দুরকম গুগলি, ইচ্ছেমতো ফিরিয়ে এনে—দর্শকেরা ভেবেছে, সাধু! সাধু!

সাধকই সাধকের পথ করে দেয়। দানিশ কানেরিয়াকে কাদির বলতেন, ‘মাই প্রোডাক্ট।’ দুজনের অ্যাকশন কার্বন কপি না হলেও কাছাকাছি। বাঁকটাও জোরের ওপর। ইমরান তাহির কিংবা মুশতাক আহমেদ—তাঁদের অ্যাকশন-কলার ভিত কাদির। তাঁর কাছে স্টুয়ার্ট ম্যাকগিলকে নিয়ে গিয়েছিলেন স্টিভ ওয়াহ। পলস্ট্রাংকে শেখানোর অনুরোধ করেছিলেন এন্ডি ফ্লাওয়ার। ১৯৯৪ সালে পাকিস্তান সফরে তাঁর বাসায় গিয়ে গুগলির তালিম নিয়ে এসেছিলেন শেন ওয়ার্ন। রাতে আপেল দিয়ে কসরত করে ওয়ার্ন উইকেটও তুলে নেন পরদিন টেস্টে। তারপর ফোন করে কাদিরকে বলেছিলেন—‘ডিড ইউ সি দ্যাট?’

পাকিস্তানের এক টিভি চ্যানেলে সে কথা বলতে গিয়ে আরেকটি ঘটনাও বলেছিলেন কাদির, তাঁর বাসায় গিয়ে ওয়ার্নের সিগারেট ফোঁকার ইচ্ছে হয়েছিল। কিন্তু ওয়ার্ন তা করেননি, ওটা যে কাদিরের বাসা তাই। সেই কাদির, যার বোলিংয়ের গাদা গাদা ভিডিও থাকত ওয়ার্নের দেরাজে। এমন গল্পও প্রচলিত আছে সেবার কাদিরের বাসায় গিয়ে দুই কিংবদন্তি কমলা দিয়ে গালিচার ওপর লেগ স্পিন নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছিলেন। যদি নতুন কোনো ভেলকি বের করা যায়! আসলে আশির দশকের কাদিরকে দেখেই নিজেকে গড়ার প্রেরণা পেয়েছিলেন ওয়ার্ন। আর কাদির? তাঁকে বর্ণনা করতে জাদুকরদের প্রসঙ্গে ফিরতেই হচ্ছে।

জাদুতে কৌশলটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। ঝুলিতে যত বেশি কৌশল তিনি তত ভালো। এ জন্য অনুশীলন করতে হয় দিনের পর দিন। লেগ স্পিনও তাই। ভেলকির প্রাচুর্য থাকতে হয়। আর তা করতে গিয়ে কাদিরের দর্শন ছিল জাদুকরদের মতোই, ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বোলিং করে বাড়ি ফেরার সময়ও তার ঝুলিতে কিছু ভেলকি থেকে যাওয়া উচিত। সে একজন লেগ স্পিনার। কোনো কিছু অবশিষ্ট না থাকলে লেগ স্পিনার না।

(ছবি: ‍টুইটার/ক্রিকইনফো)

মানেটা হলো বৈচিত্র্য—কাদিরের স্পিন শব্দটার ধারক। তবে শুরুটা এমন ছিল না। ১৯৫৫ সালে লাহোরে খুব সাধারণ ঘরে জন্ম নেওয়া কাদির শৈশবে রাস্তাঘাটে খেলাধুলায় মত্ত থাকতেন। সেটি হকি থেকে মার্বেল কিংবা ক্রিকেট। একদিন রাস্তায় মার্বেল খেলার সময় এক বন্ধুর অনুরোধ ফেলতে না পেরে যোগ দেন ক্রিকেট খেলায়। কাদিরের ভাষায়, সবচেয়ে বাজে খেলোয়াড়কে ওরা ওপেন করতে পাঠাত। প্রথম বলেই বোল্ড হই। বলা হলো, যেও না, ওটা ট্রাই বলছিল। পরের বলে আবারও বোল্ড।

শুরু থেকেই ব্যাট তাঁকে অতটা টানেনি যতটা ‘রেড চেরি’ লাল বলটা। শিয়রে বল রেখে ঘুমোনোর অভ্যাস ছিল। বলের যত ছলচাতুরী আবিষ্কার করতেন অনুশীলনে। সেসব মাঠে ফলানো গল্পগাথা হয়ে আছে।

কাদিরের বিশ্বাস ছিল, যে উইকেটে কোনো কিছুতেই কাজ হয় না সেখানে লেগ স্পিন সফল হবে। এটাই এ ঘরানার সৌন্দর্য। যেখানে বলে বাঁক নেই, সেখানে লেগ স্পিন পেতে পারে। এনে দিতে পারে অবিশ্বাস্য সব বৈচিত্র্য। আর এ ঘরানায় বৈচিত্র্যে কাদির যেন বিশ্বকোষ! তাঁর নিজের কথা, ‘এক বল (ডেলিভারি) দশভাবে করতে পারি। দশ লেগব্রেক, দশ গুগলি ও দশ ফ্লিপার।’ যোগ করুন গতি বৈচিত্র্য ও অ্যাঙ্গেল মানে উইকেটে কোণের ব্যবহার।

অ্যাঙ্গেলে ঝোঁক ছিল। স্টাম্পের কাছ থেকে বল করলে বেশি বাঁক, দূর থেকে করলে তুলনামূলক কম। ক্রিজের পেছন থেকে বল করলে ফ্লাইট বেশি। দৌড়ে আসার অ্যাঙ্গেল, কখনো ৪৫ ডিগ্রি কোণে কখনো তার বেশি কিংবা কম, এতেও সেই বলের বাঁকের তারতম্য। এক ডেলিভারিতেই কয়েকটি আঙুলের ব্যবহার ছিল। গতি বৈচিত্র্য আর বাঁকের তারতম্যের জন্য।

ওয়ার্ন বল গ্রিপ করেছেন পাঁচ আঙুলেই। বল ধরায় ‘কমফোর্ট ফিলিং’ প্রাধান্য পেত। কাদিরের সাধারণ গ্রিপ ছিল, মধ্যমা, অনামিকা ও কনিষ্ঠা আঙুল একসঙ্গে মাঝে ফাঁক রেখে ওপাশে তর্জনী। মধ্যমা পেছনে থাকায় বল ছাড়ায় জোর পেত। আর ছিল দুরকম গুগলি।

একটি কবজির মোচড়ে আরেকটি আঙুলের ব্যবহারে। প্রথমটি একটু কম গতির, পরেরটি উল্টো। সাই করে ঢুকত বড় বাঁক নিয়ে। হাত থেকে পড়তে না পারলে বিপদ। কাদির যে সময় এসব জাদু দেখাতেন তখন কিন্তু পেসারদের স্বর্ণযুগ ছিল। বাইশ গজ হয় পেসারদের নয় তো মারকুটে ব্যাটসম্যানদের। ওয়েস্ট ইন্ডিজের পেস চতুষ্টয়, অস্ট্রেলিয়ায় ডেনিস লিলি-জেফ থমসন জুটি, পরে ম্যাক্স ওয়াকার আর ম্যাকডারমট, ইংল্যান্ডে ইয়ান বোথাম-বব উইলস, নিউজিল্যান্ডে রিচার্ড হ্যাডলি। কাদির নিজেও একরকম পেসার ছিলেন। তাঁর আগ্রাসীভাবের জন্য অস্ট্রেলিয়ানরা বলে, পেসার মন নিয়ে চলা স্পিনার।

অথচ কাদিরের অ্যাকশনে নাচ দেখেছেন কেউ কেউ। মাঠ তাঁর মঞ্চ। একবার ইংল্যান্ডে লিফটের বাইরে এক ইংরেজ নারীর সঙ্গে দেখা। বললেন, আপনি কি সেই, আবদুল? আমার মেয়ের ক্রিকেট নিয়ে কোনো আগ্রহ নেই শুধু আপনার বোলিং ছাড়া। দেখবেই। আপনার বোলিং তাঁর কাছে মঞ্চে তরুণীর নাচ। ১৯৮৭ সালে ওভালের দর্শকেরা এ নাচ দেখেছেন টানা দুই ইনিংস। ফলোঅনে পড়েছিল ইংল্যান্ড। কাদির প্রায় কোনো বিরতি ছাড়াই ১০০ ওভারের কাছাকাছি বোলিং করেছিলেন। দেশের হয়ে খেলার প্রতি দরদ ছিল। ইংল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়ার ঘরোয়া ক্রিকেটে ব্লাঙ্ক চেকের প্রস্তাব ছিল। যাননি। বলতেন ‘আমি আজ যা পাকিস্তানের জন্য, আমার জন্য পাকিস্তান না।’

স্পিন নিয়ে তাঁর আবেগ কোথায় ছিল, সেই প্রমাণ তাঁর অবিশ্বাস্য বিজনেস কার্ড। সেখানে লেখা ‘কিং অব স্পিন’। প্রাইড অব পারফরম্যান্স (পাকিস্তান)। রাইডার মেডেল ফ্রম অস্ট্রেলিয়া। ৪৩ বছর বয়সে অস্ট্রেলিয়ার এ টুর্নামেন্টেই ভীষণ আলোচিত গুগলিটা ছেড়েছিলেন কাদির। পিচের প্রায় কোনায় পড়ে মাঝ স্টাম্প ছত্রখান!

জাদুকর বলেই ইংরেজরা ডেকেছে ‘উইজার্ড অব ইস্ট’। ইমরান খানের পরামর্শে ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি রেখে সেবার (১৯৮২) ইংল্যান্ডে গিয়েছিলেন। দাড়িতে বেশ রহস্যময়, জাদুকর জাদুকর একটা ভাব আসবে। কাজ হয়েছিল ভালোই। চন্দ্রশেখরের পর প্রায় হারিয়ে যেতে বসা চাতুরী (গুগলি) ফেরার স্থায়ী ভিত পেয়ে যায়। কিন্তু জীবনের গুগলিটা ঠেকাতে প্রস্তুত ছিলেন না। ৬৩—যে কেবল ইনিংস গড়ার সুবাস।

তবু যেতে হয়। শেন ওয়ার্ন থেকে সবাই তা জানে। ২৫ বছর আগে কাদিরের সঙ্গে সেই সাক্ষাতের পর তাঁকে একটি বার্তা পাঠিয়েছিলেন ওয়ার্ন, ‘সেরার প্রতি। ধন্যবাদ সবকিছুর জন্য। আবার দেখা হবে।’

হবে হয়তো, জাদুকরদের ব্যাপারস্যাপারে আমাদের মাথা না ঘামানোই ভালো।
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৯ বিকাল ৪:১৫
২টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা ও পদ্মশ্রী পুরস্কার

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৫৬



এ বছরের পদ্মশ্রী (ভারতের চতুর্থ সর্বোচ্চ অসামরিক সম্মাননা) পদকে ভূষিত করা হয়েছে, বাংলাদেশের রবীন্দ্র সংগীত এর কিংবদন্তি শিল্পী রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যাকে।

আমরা গর্বিত বন্যাকে নিয়ে । ...বাকিটুকু পড়ুন

কষ্ট থেকে আত্মরক্ষা করতে চাই

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৯



দেহটা মনের সাথে দৌড়ে পারে না
মন উড়ে চলে যায় বহু দূর স্থানে
ক্লান্ত দেহ পড়ে থাকে বিশ্রামে
একরাশ হতাশায় মন দেহে ফিরে।

সময়ের চাকা ঘুরতে থাকে অবিরত
কি অর্জন হলো হিসাব... ...বাকিটুকু পড়ুন

রম্য : মদ্যপান !

লিখেছেন গেছো দাদা, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৫৩

প্রখ্যাত শায়র মীর্জা গালিব একদিন তাঁর বোতল নিয়ে মসজিদে বসে মদ্যপান করছিলেন। বেশ মৌতাতে রয়েছেন তিনি। এদিকে মুসল্লিদের নজরে পড়েছে এই ঘটনা। তখন মুসল্লীরা রে রে করে এসে তাকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

= নিরস জীবনের প্রতিচ্ছবি=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৪১



এখন সময় নেই আর ভালোবাসার
ব্যস্ততার ঘাড়ে পা ঝুলিয়ে নিথর বসেছি,
চাইলেও ফেরত আসা যাবে না এখানে
সময় অল্প, গুছাতে হবে জমে যাওয়া কাজ।

বাতাসে সময় কুঁড়িয়েছি মুঠো ভরে
অবসরের বুকে শুয়ে বসে... ...বাকিটুকু পড়ুন

Instrumentation & Control (INC) সাবজেক্ট বাংলাদেশে নেই

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৫




শিক্ষা ব্যবস্থার মান যে বাংলাদেশে এক্কেবারেই খারাপ তা বলার কোনো সুযোগ নেই। সারাদিন শিক্ষার মান নিয়ে চেঁচামেচি করলেও বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরাই বিশ্বের অনেক উন্নত দেশে সার্ভিস দিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×