মহামারী প্রতিরোধে 'Quarantine' 'সঙ্গরোধ', বা 'Lock down' 'বিচ্ছিন্নকরণ পদ্ধতি' হাদিসেরই প্রেসক্রিপশন এবং আজানের ভেতরে বাক্য পরিবর্তন ও জুমুআ বন্ধের বিষয়ে ইসলাম কী বলে?
বিশ্বব্যাপী মহামারী আকারে করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার পরে পৃথিবীর দেশে দেশে অনেক শহরের অধিবাসীদের সুরক্ষার লক্ষ্যে লকডাউন 'Lock down' বা বিচ্ছিন্নকরণ পদ্ধতি অবলম্বন করতে দেখা যাচ্ছে। এই লকডাউন 'Lock down' বা বিচ্ছিন্নকরণ ব্যবস্থা মূলত: এ ধরণের জটিল, কঠিন ও মানব বিপর্যয় সৃষ্টিকারী ভয়াবহ মহামারী প্রতিরোধের ক্ষে্ত্রে মহানবী হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নির্দেশিত অন্যতম পদ্ধতি।
Dictionary তে Quarantine এর অর্থ করা হয়েছে- a state, period, or place of isolation in which people or animals that have arrived from elsewhere or been exposed to infectious or contagious disease are placed. 'একটি অঞ্চল, কাল, বা লোকালয়কে বিচ্ছিন্ন করে রাখা, যেখানে মানুষ বা প্রাণী যারা অন্য কোথাও থেকে এসেছিল বা সংক্রমিত হয়েছিল কিংবা সংক্রামক রোগের সংস্পর্শে এসেছিল।'
Bangla Academy Dictionary তে Quarantine এর অর্থ করা হয়েছে- 'যে সময় পর্যন্ত সংক্রামণ আশঙ্কায় পৃথক রাখা হয়, সঙ্গরোধ'।
cambridge dictionary তে quarantine সম্পর্কে বলা হয়েছে- 'a period of time during which an animal or person that might have a disease is kept away from other people or animals so that the disease cannot spread'. 'কোনও প্রাণী বা ব্যক্তি যার একটি রোগ হয়ে থাকতে পারে বলে ধারণা করা যায়, তাকে অন্যান্য ব্যক্তি বা প্রাণী থেকে একটি সময়কালের জন্য দূরে রাখা- যাতে রোগটি অন্যদের ভেতরে ছড়াতে না পারে।'
লকডাউন 'Lock down' বা বিচ্ছিন্নকরণ পদ্ধতি কি?
ক্যামব্রিজ ডিকশনারিতে 'Lock down' এর অর্থ করা হয়েছে- a situation in which people are not allowed to enter or leave a building or area freely because of an emergency। উদাহরণত বলা যায়-
The Secret Service is imposing a virtual lockdown on the city.
The school has been placed on lockdown this morning while authorities investigate a bomb threat.
রোগ সংক্রমণ ও মহামারী নিয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নির্দেশনাঃ
ছোঁয়াচে রোগ বা রোগের সংক্রমণ নিয়ে বাড়াবাড়ি করতে হাদিসে নিষেধ করা হয়েছে। আমরা বাস্তবেও দেখতে পাই যে, রোগীর কাছে, বা চারপাশে থেকেও অনেক মানুষ সুস্থ রয়েছেন।
আবার অনেক সতর্কতার পরেও মানুষ আক্রান্ত হচ্ছেন বিভিন্ন রোগে। বস্তুত শুধু রোগজীবাণুর সংক্রমনেই যদি রোগ হতো তাহলে আমরা সকলেই অসুস্থ হয়ে যেতাম; কারণ প্রতিনিয়ত বিভিন্ন প্রকারের রোগজীবাণু আমাদের দেহে প্রবেশ করছে।
রোগজীবাণুর পাশাপাশি মানুষের দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা, রোগ জীবাণুর কর্মক্ষমতা ইত্যাদি অনেক কিছুর সমন্বয়ে মানুষের দেহে রোগের প্রকাশ ঘটে।
আবূ হুরাইরা রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহু বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, 'সংক্রমনের অস্তিত্ব নেই। তখন এক বেদুঈন বলল, হে আল্লাহর রাসূল, আমার উটগুলো হরিনীর ন্যায় সুস্থ থাকে। এরপর চর্মরোগে আক্রান্ত একটি উট এগুলোর মধ্যে প্রবেশ করার পরে অন্যান্য উটও আক্রান্ত হয়ে যায়। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, তাহলে প্রথম উটটিকে কে সংক্রমিত করল?' (বুখারী, আস-সহীহ ৫/২১৬১, ২১৭৭; মুসলিম, আস-সহীহ ৪/১৭৪২।
পাশাপাশি সংক্রমনের বিষয়ে সতর্ক হতেও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নির্দেশ দিয়েছেন।
তিনি বলেন, 'অসুস্থকে সুস্থের মধ্যে নেয়া হবে না (রুগ্ন উট সুস্থ উটের কাছে নেবে না)।' (বুখারী, আস-সহীহ ৫/২১৭৭; মুসলিম, আস-সহীহ ৪/১৭৪২-১৭৪৩)
মহামারী প্রতিরোধে লকডাউন বা বিচ্ছিন্নকরণ পদ্ধতি হাদিসেরই প্রেসক্রিপশনঃ
অন্য এক হাদিসে বর্ণিত হয়েছে- ‘যদি তোমরা শুনতে পাও যে, কোনো জনপদে প্লেগ বা অনুরূপ মহামারীর প্রাদুর্ভাব ঘটেছে তবে তোমরা তথায় গমন করবে না। আর যদি তোমরা যে জনপদে অবস্থান করছো তথায় তার প্রাদুর্ভাব ঘটে তবে তোমরা সেখান থেকে বের হবে না।' (বুখারী, আস-সহীহ ৫/২১৬৩; মুসলিম, আস-সহীহ ৪/১৭৩৮, ১৭৩৯)
এভাবে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রায় দেড় হাজার বছর পূর্বে সংক্রমন প্রতিরোধে বিচ্ছিন্নকরণ (quarantine) ব্যবস্থার নির্দেশনা প্রদান করেন।
তবে সর্বোপরি কথা হচ্ছে, মুমিন মাত্রেরই এই বিশ্বাস রয়েছে যে, সকল বিষয়ের ন্যায় রোগের ক্ষেত্রেও আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ'লার সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। এজন্য সংক্রমনের ভয়ে অস্থির বা দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হওয়ার কোনো কারণ নেই।
পাশাপাশি যে সমস্ত রোগ পরিবিস্তারের ক্ষেত্রে সংক্রমন একটি উপায় বলে নিশ্চিতভাবে জানা যায় সে সকল রোগের বিস্তার রোধের এবং সংক্রমন নিয়ন্ত্রনের জন্য যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
আজানের ভেতরে বাক্য পরিবর্তন ও জুমুআ বন্ধের বিষয়ে ইসলাম কী বলে?
বর্তমান ভয়াবহ করোনা পরিস্থিতিতে জুমুআর নামাজ বন্ধ করা নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যের কোনো কোনো স্থানে জুমুআর নামাজ বন্ধ করার সংবাদ পাওয়া গেছে। আসলে এই ধরণের আতঙ্কগ্রস্থ সময়ে ধর্মীয় বিধি বিধান নিয়ে এমন বিতর্ক খুবই হাস্যকর। আমাদের মনে রাখতে হবে, এটা হাসি-তামাশা বিভেদ-বিতর্কের সময় নয়। পুরো বিশ্ব পরিস্থিতির প্রতি নজর রেখেই আমাদের সামনে এগুতে হবে। কারণ, পরিস্থিতি কোন দিকে মোড় নিবে আদৌ বলা যায় না। কল্পনার চেয়েও দ্রুত গতিতে যদি করোনা ভাইরাস আরও ভয়ানক থাবা বিস্তার করে তাহলেই বা কি করা যাবে! সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। অহেতুক বিতর্কে না জড়িয়ে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষনে রেখে সামগ্রিক মানবকল্যান চিন্তা করেই আমাদের সিদ্ধান্ত গ্রহন ও তা কার্যকর করার প্রয়াস নিতে হবে।
এই ধরণের ভয়াবহ মহামারীর সময়ে শরিয়তের কিছু কিছু বিষয় লাঘব করার দৃষ্টান্ত রয়েছে। আসুন, এ বিষয়ে দেখে নেয়া যাক কয়েকটি মাসআলা-
শুরুতেই আজানের বাক্য পরিবর্তনের কথা ধরুন। সম্প্রতি কুয়েতের কোনো একটি মসজিদের আজান সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়েছে। সেই ভিডিওতে দেখা গেছে, এক মুআজ্জিন তার আজানে 'হাইয়া আলাস সালাহ' -এর স্থানে 'আলা সাল্লু ফি বুয়ুতিকুম' বলে কান্নায় ভেঙে পড়েছেন।
বিষয়টি নিয়ে আমাদের দেশের কিছু ব্যক্তি তাদের অভিমত ব্যক্ত করেছেন। মাসআলা প্রদান করার চেষ্টা করেছেন। তারা 'আজান বিকৃত করা হয়েছে' মর্মে অভিযোগ উত্থাপন করছেন। কিন্তু তারা হয়তো জানেন না, কিংবা জানার চেষ্টাও করেননি যে, বুখারী, মুসনাদে আহমাদ এবং সুনানে নাসায়ী প্রভৃতি গ্রন্থে সহি হাদীসেই এভাবে আজান দেয়ার কথা বর্ণিত হয়েছে।
হযরত নাফে’ থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, যাজনান নামক স্থানে এক শীতের রাতে ইবনে ওমর রা. আজান দিলেন। এরপর তিনি ঘোষণা করলেন, 'আলা সাল্লু ফি বুয়ুতিকুম' অর্থাৎ ‘তোমরা আবাসস্থলেই নামায আদায় করে নাও!’ পরে তিনি আমাদের জানালেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সফরে বৃষ্টি বা শীতের রাতে মুয়াযযিনকে আজান দিতে বলতেন এবং সঙ্গে সঙ্গে একথাও ঘোষণা করতে বলতেন যে, 'আলা সাল্লু ফি বুয়ুতিকুম' অর্থাৎ, ‘তোমরা আবাসস্থলেই নামায আদায় করে নাও!’ (সহিহ বুখারী, মুসলিম)
অঝোর বৃষ্টি ও প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বেলালকে নির্দেশ দিতেন এভাবে আজান দিতে। অবশ্য 'সাল্লু ফি রিহালিকুম কিংবা বুয়ূতিকুম' বাক্যটি আজানের কোথায় উচ্চারণ করবে এ নিয়ে চার ইমামের মাঝে মতানৈক্য থাকলেও ইমাম আবু হানীফা রহ.-এর মতে সবভাবেই বলার অবকাশ রয়েছে। মোটকথা, আজানের শেষে বা মাঝে যেমন বলা যায়, তেমনই পরিবর্তিত আজানে বলারও অবকাশ রয়েছে বিভিন্ন মাজহাবে।
পাশাপাশি আমাদের স্মরণ রাখা প্রয়োজন যে, দুর্যোগের কারণে জামাআতে নামাজ ত্যাগের অবকাশ যেমন রয়েছে, একইভাবে প্রয়োজনে মসজিদে জুমুআ বন্ধ করার মত পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটলে এবং তখন সেই ধরণের পদক্ষেপ গ্রহন করা হলে সেটাও শরীয়তের দৃষ্টিতে অসম্ভব নয়।
ধর্ষনের মহামারীর সংবাদ এখন আর চোখে পড়ে নাঃ
গত কিছু দিন যাবত দেশের সংবাদপত্রগুলো থেকে একটি জিনিষ বোধ করি হারিয়ে গেছে। আল্লাহ তাআ'লার অশেষ শুকরিয়া। ধর্ষনের মহামারীর সংবাদ এখন আর চোখে পড়ে না। পত্রিকার পাতার অনেকটা অংশ জুড়ে এখন আর এসব বিভৎসতা লেপ্টে থাকে না। আজকাল তাই পেপার পত্রিকা হাতে নিয়ে এই দৃশ্য চিন্তা করে মনটায় অন্যরকম একটা প্রশান্তি চলে আসে। খুশিতে প্রাণটা ভরে ওঠে। যদিও করোনার দুঃসংবাদ দিনকে দিন ব্যথিত করে চলেছে আমাদের। অবচেতন মন বলে ওঠে, ধর্ষনের আর একটি সংবাদও যদি আমাদের পড়তে না হত! আল্লাহ পাক ধর্ষকদের মানুষ হওয়ার তাওফিক দান করুন।
আমাদের অবশ্যই আল্লাহমুখি হতে হবেঃ
কোভিড-১৯ এর ভয়াবহ অবস্থা থেকে উত্তোরণের লক্ষ্যে আমাদের অবশ্যই আল্লাহমুখি হতে হবে। এখনও আমাদের পাপাচার কি বন্ধ হয়েছে? এখনও কি আমরা আল্লাহ তাআ'লার দিকে ফিরতে পেরেছি? আমরা কি তাওবা করতে পেরেছি? আমরা কি গুনাহ করার অভ্যাস ছেড়ে দিয়েছি? আমরা কি নিজেদের পরিশুদ্ধ করতে পেরেছি? এগুলো করার এখনই সময়। ধার্মিক ও মানবিক বোধে উজ্জীবিত হওয়ার এটাই উত্তম সময়। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ'লা আমাদের সবাইকেই তাওফিক দান করুন। আমীন।
ছবি: সংগৃহীত।
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে মার্চ, ২০২০ দুপুর ১২:০২