হে প্রিয় বাইতুল্লাহর মালিক! আমি তো আমার দুঃখ ও অস্থিরতা আপনার সমীপেই নিবেদন করছি
বিগত প্রায় দেড় হাজার বছরে প্রিয় ঘর বাইতুল্লাহ জনশুন্য হয়নি। দিনরাত চব্বিশ ঘন্টা মধুমক্ষিকার মত হাজারো লাখো আবেগঘন যিয়ারতে সিক্ত থেকেছে প্রিয় বাইতুল্লাহ। কি শীত, কি গ্রীস্ম, কি বর্ষা- ঋতুর পরিবর্তন পবিত্র কাবা প্রাঙ্গনকে জনমানবহীন করতে পারেনি। গ্রীষ্মের দাবদাহে মক্কার অলিগলি যখন রোদে তাতিয়ে ওঠে, দুপুরের অমিততেজ সূর্য যখন মাথার উপরে তখনও মুহূর্তের জন্য বাইতুল্লাহ তার যিয়ারতকারীদের দূরে সরিয়ে দেয়নি। যিয়ারত চলেছে। লোকে লোকারণ্য বাইতুল্লাহকে ঘিরে অজস্র, অসংখ্য মানুষের ভালোবাসার বহিপ্রকাশ ঘটছে। গুনগুন সুরে লাব্বাইক ধ্বনিতে অবিরাম তাওয়াফ চলেছে। দিনের আলোয় লোকের ভীড় ঠেলে বাইতুল্লাহর কাছে যেতে কষ্ট, বাইতুল্লাহর পরশ নিতে তাই রাত দুপুরে গিয়েছি, রাত দু'টোয় গিয়েছি, তিনটায় গিয়েছি, তখনও সেই একই দৃশ্য। বাইতুল্লাহর প্রেমে, বাইতুল্লাহর মালিকের প্রেমে পাগলপারা অগনিত মানুষের উপছে পড়া ভীড়। মৌমাছির মত গুঞ্জনে মুখরিত গোটা মাতাফ! বাইতুল্লাহর মেহমানদের মুখে ধ্বনিত হচ্ছে মহামহিয়ান প্রতিপালকের বড়ত্বের আওয়াজ। ফজরের পূর্বে গিয়েছি একটু নিরিবিলি সময় হয়তো পেয়ে যাব, কিন্তু মাতাফে ঢুকতেই চোখ ছানাবড়া! প্রিয় বাইতুল্লাহকে ঘিরে রেখেছে অগনিত মানুষের ভালোবাসা। লাখো কন্ঠে উচ্চারিত আবেগঘন দুআয় সিক্ত বাইতুল্লাহর প্রাঙ্গন! তখনও!
কিন্তু আজ কি হল! আজ বাইতুল্লাহ শুন্য! প্রিয় বাইতুল্লাহ জনমানবহীন! বাইতুল্লাহর গিলাফ ছুঁয়ে থেমে গেছে অগনন মানুষের কান্না! বাইতুল্লাহর দীঘল প্রাঙ্গনজুড়ে লক্ষ লক্ষ মানুষের রোনাজারিতে পাঁচওয়াক্ত নামাজের জামাআতের সেই বিরল দৃশ্য আজ কোথায়! সব যেন থেমে গেছে! হৃদয়ের স্পন্দন যেন ছন্দ হারিয়ে ফেলেছে! যেন নিষ্প্রাণ অবয়বে দাঁড়িয়ে আছে প্রিয় কাবা! আমার রবের ঘর! আমার মালিকের ঘর! আমার মালিকের ইবাদতের উদ্দেশ্যে তৈরি পৃথিবীর প্রথম ঘর! শ্রেষ্ঠ ইবাদতগাহ!
প্রিয় বাইতুল্লাহর দিকে আজ আর চোখ মেলে তাকাতে পারি না। বাইতুল্লাহ, তুমি আমাদের ক্ষমা করো। তোমার মালিকের কাছে আমাদের বিরুদ্ধে স্বাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ো না। তোমার মালিকের কাছে আমাদের আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে দিও না। তোমার মালিকের কাছে আমাদের বিরুদ্ধে নালিশ করো না। অপরাধ তো আমরাই করেছি। তোমার এই জনশুন্য ম্লান অবয়বের জন্য তুমি দায়ী নও। এ নিশ্চিত আমাদেরই পাপের ফল। আমাদেরই কৃতকর্মের কারণে আজ তুমিও বুঝি নিরবে অশ্রু ঝরাও মহান মালিকের দরবারে! তুমি আমাদের পাপমোচনের ফরিয়াদ তোলো প্রিয় বাইতুল্লাহ!
বাইতুল্লাহর প্রিয়তম মালিকের নিকট আরজি, হে আকাশের মালিক, হে জমিনের মালিক, হে চন্দ্র-সূর্য্য-গ্রহ-তারা-ভূলোক-দুলোক জগতসমূহের মালিক, আপনার অপরিমেয় সম্মান এবং ইজ্জতের খাতিরে আপনি আমাদের ক্ষমা করুন। সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়া ভয়াবহ ভাইরাস বিদূরিত করে মানুষের মনের ভয়, ত্রাস এবং অসুস্থতা কাটিয়ে দিন। আপনার কাছেই তো ফিরে আসি হে মালিক! দুঃখ বলার আর তো কেউ নেই মালিক, আপনি দুঃখ দূর করে দিন। প্রিয় বাইতুল্লাহকে যিয়ারতকারীদের দ্বারা আবার ভরে দিন। মুখর, মাতোয়ারা করে দিন। মদিনাতুল মুনাওওয়ারায় থেমে যাওয়া যিয়ারত আবার সচল করে দিন। আবার প্রতিনিয়ত, প্রতি দিন, প্রতিক্ষন রওযায়ে আতহারের কিনারে দাঁড়িয়ে বিনয়াবনত মস্তকে সালাম আরজ করার তাওফিক দিন লক্ষ লক্ষ মুহিব্বিনকে।
إِنَّمَا أَشْكُو بَثِّي وَحُزْنِي إِلَى اللّهِ
আমি তো আমার দুঃখ ও অস্থিরতা আল্লাহর সমীপেই নিবেদন করছি। সূরাহ ইউসূফ, আয়াত ৮৬
আজ ফরিয়াদ জানাচ্ছি আপনার দরবারে, অন্তরের ব্যথা-কষ্ট-দুঃখগুলো নিবেদন করছি আপনার কাছে, হে কুল কায়েনাতের মালিক!
আয় আল্লাহ! আপনার নিকট ফরিয়াদ, আজ আমরা বাইতুল্লাহ থেকে বিচ্ছিন্ন। দুই হারাম থেকে দূরে। হারামাইন শরিফাইন আজ জনমানবহীন। বাইতুল্লাহর তাওয়াফ থেমে গেছে। আয় আল্লাহ, আপনি আমাদের প্রতি সদয় হোন। আমাদেরকে আপনার ঘর থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েন না। আমাদের পাপের কারণে আমাদেরকে জামাআতে নামাজ থেকে বঞ্চিত করবেন না। আমাদেরকে আপনার কাছে আবার ফিরিয়ে নিন। আপনার ঘরের সান্নিধ্যে আবার থাকার তাওফিক দিন। আমাদের তাওবা কবুল করুন। আমাদেরকে এবং সকল মুসলমানকে সর্বপ্রকার মহামারি ও দূরারোগ্য ব্যাধি থেকে হেফাজত করুন। অন্যান্য জাতির ভাইদেরকেও আপনি দুনিয়া এবং আখিরাতে শান্তি ও নিরাপত্তার ব্যব্স্থা করুন। তাদেরকে আপনার সঠিক পথপ্রদর্শন করুন।
হে প্রিয় রব! মুসিবত কঠিন থেকে কঠিনতর হচ্ছে! চতুর্দিক অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে! একের পর এক দেশ ও জনপদ আক্রান্ত হচ্ছে! ভয়ার্ত মানুষের আহাজারিতে আকাশ-বাতাস ভারী হচ্ছে! ক্ষুধার্ত-অনাহারী মানুষের সংখ্যা গাণিতিকহারে বৃদ্ধির উপক্রম হচ্ছে! দেশে দেশে অভাব-অনটন, দারিদ্র্য ও দুর্ভিক্ষ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা করছি!
হে আল্লাহ, এই অবস্থায় আপনি ছাড়া আমাদের ফরিয়াদ শোনার কেউ নেই! আপনি ছাড়া কে আছে, যার কাছে আমরা সাহায্য চাইতে পারি! আমাদের অবস্থার ওপর আপনি দয়া করুন। আমাদের অক্ষমতাগুলো আপনি ক্ষমা করুন। আপনিই আমাদের অভিভাবক। আল্লাহ! এই বিপদ-মহামারির কারণে আপনার হারামে যেতে না পারার ব্যথা আর সইতে পারছি না। হে মহান শক্তিমান, দয়া করে এই মহামারি আপনি দূর করে দিন।
ক'দিন থেকে আমরা শুনছি, বিশ্বের কোনো কোনো অঞ্চলের মসজিদ থেকে মুয়াজ্জিন আজানের ভেতরে ভারাক্রান্ত হৃদয়ে বলছেন- 'সল্লু ফি রিহালিকুম' অর্থাৎ, নিজ নিজ জায়গায় নামাজ পড়ে নিন।' হে মহান মালিক, এই ঘোষনার সময়ে মুআজ্জিনের কন্ঠ বাষ্পরুদ্ধ হতে দেখেছি! তার কন্ঠ আটকে যাচ্ছিল! কান্না বিজড়িত ছিল সে আওয়াজ! প্রিয় মালিক, সে আওয়াজ আমাদেরও অশ্রুসিক্ত করেছে! কান্নাভেজা আজানের সে কন্ঠ শুনে হৃদয়ে আমাদের রক্তক্ষরণ হয়েছে। আমরা মসজিদে যেতে পারবো না! হায় হায়! আমাদের থেকে মসজিদের দূরত্ব বেড়ে যাচ্ছে! প্রতি সিজদায় মসজিদের পবিত্র মাটির ঘ্রাণ নিতে পারবো না! জামাআতে নামাজ আদায় করতে পারবো না! আয় আল্লাহ!
হে আল্লাহ! যদি আমাদের পাপের কারণে আপনার ঘরে নামাজ পড়া থেকে বঞ্চিত হয়ে থাকি তাহলে আমরা তওবা করছি সকল গুনাহ থেকে। দয়া করে আপনি আমাদেরকে আপনার ঘরে আবার ফিরিয়ে নিন। আমাদের দেশ থেকে এবং সকল মুসলিম দেশ থেকে আপনি এই মহামারি দূর করে দিন।
আপনি থাকতে কার কাছে অভিযোগ করবো, হে আল্লাহ! আপনার দুয়ার থাকতে কার দুয়ারে হাত পাতবো হে মালিক! আপনিই তো একমাত্র মাবুদ। আপনাকে ছেড়ে আমরা কার ইবাদত করবো! আপনার ওপরই আমাদের সকল আশা ভরসা। হে আল্লাহ, আমাদেরকে সে সকল লোকদের অন্তর্ভুক্ত করুন যারা নিয়ামত পেলে শোকর করে। বিপদে সবর করে। গুনাহ হয়ে গেলে তওবা করে।
হে আল্লাহ, চলতে ফিরতে উঠতে বসতে শয়নে স্বপনে জাগরণে সর্বাবস্থায় আপনি আমাদেরকে ‘লা হাউলা ওয়া লা-কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহিল আলিয়িল আজিম’ পাঠের তাওফিক দিন। হে আল্লাহ! এই কালামের অবর্ণনীয় গুণের বরকতে আপনি দয়া করে মহামারি থেকে গোটা মানবজাতিকে হেফাজত করুন। আপনার কুদরতে আপনি করোনা ভাইরাস দূর করে দিন।
আয় আল্লাহ, আমরা বিশ্বাস করি, আমরা জানি, বিপদ যত বড় হোক তা চির দিনের নয়। বিপদ যত বড় হোক, হে আল্লাহ, আপনার রহমত তার চেয়ে বড়। আয় আল্লাহ, আমরা আশাবাদি, আমরা গভীর প্রত্যাশায় অধির প্রহর গুনছি, আমাদের মুক্তি অতি সন্নিকটে। অচিরেই আপনি করোনার বিপদ দূর করে দিবেন। মুক্তি পাবে গোটা পৃথিবীর শত শত কোটি মানুষ। আবার মুখরিত হবে প্রিয় হারামাইনের চিরচেনা আঙিনা। আবার অশ্রুসজল চোখে বাইতুল্লাহর তাওয়াফে রত হবেন লক্ষ লক্ষ মানুষ। আবার রুকু'কারীদের সাথে রুকু' করে প্রশান্তির পরশে সিক্ত হব আমরা।
ছবিঃ অন্তর্জাল।
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে মার্চ, ২০২০ বিকাল ৪:৫৪