মুসলিম বিচারকের ন্যায়বিচারে বিস্ময়াভিভূত ইহুদির ইসলাম গ্রহণের অসাধারণ ঘটনা
হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু ছিলেন বহুমুখী জ্ঞান, প্রতিভা এবং গুণের অধিকারী। তাঁর জ্ঞানের বিশালতা সুবিদিত। তাঁর বীরত্ব, মহত্ত্ব ও ন্যায়বিচারের মাহাত্মও মানবজাতির কাছে অদ্যাবদি জীবন্ত দৃষ্টান্ত হয়ে আছে। তাঁরই জীবনে ঘটে যাওয়া চমৎকার একটি ঘটনা-
তখন মুসলিম জাহানের খলিফা অর্থাৎ, রাষ্ট্রপ্রধান তিনি। একবার তাঁর একটি বর্ম হারিয়ে যায়। বর্মটি ছিল অতি সুন্দর এবং তাঁর খুবই প্রিয়। তাই হারানো বর্মটি খুঁজে বের করার জন্য তিনি অনেক চেষ্টা করলেন। কিছু দিন পরে তিনি জানতে পারলেন যে, এক ইহুদির কাছে সেই বর্মটি রয়েছে। বর্মটির সন্ধান পেয়ে তিনি খুশি হলেন। তিনি উক্ত ইহুদি ভদ্রলোককে একান্তে ডেকে তার সাথে কথা বললেন। তাকে অনুরোধ করে বললেন যে, তোমার হাতে যে বর্মটি রয়েছে ওটা আমার। তাই বর্মটি আমাকে ফিরিয়ে দাও।
ইহুদি ভদ্রলোক খলিফার কথা উড়িয়ে দিয়ে বললেন যে, না এটা ঠিক নয়, এটি আমার নিজের বর্ম। এই বর্ম আপনি দাবি করতে পারেন না। ইহুদির এই আচরণে খলিফা অবাক হলেন কিন্তু তিনি প্রতিশোধপরায়ন না হয়ে ধৈর্য্যধারণ করলেন এবং শেষমেষ নিরুপায় হয়ে বর্মটি উদ্ধারের জন্য ন্যায়বিচার পাওয়ার আশায় আদালতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন।
তখনকার সময়ে রাষ্ট্র নিযুক্ত বিচারক ছিলেন কাজী শুরাইহ রহ.। খলিফা কাজীর কাছে গেলেন এবং কাজী শুরাইহ এর আদালতে অভিযোগ পেশ করলেন। বর্মটি উদ্ধারের জন্য ন্যায়বিচার চেয়ে বিচারপ্রার্থী হলেন।
বলা বাহুল্য, কাজী শুরাইহ ছিলেন প্রকৃতই একজন ন্যায়বিচারক। তিনি ঘটনা বিস্তারিত জেনে অভিযুক্ত ইহুদি লোকটিকে আদালতে তলব করলেন। সমন অনুযায়ী ইহুদি আদালতের কাঠগড়ায় এসে দাঁড়ালেন।
কাজী সাহেব বললেন, আপনার বিরুদ্ধে মহামান্য খলিফার অভিযোগ কি সত্য?
ইহুদি লোকটি প্রতিবাদ করে বললেন, জ্বি,না, মহামান্য বিচারক। এই অভিযোগ সত্য নয়। আমি খলিফার বর্ম চুরি করিনি। এটা আমারই বর্ম।
কাজী শুরাইহ বললেন, তা হলে যে বর্মটি খলিফা তাঁর নিজের বলে দাবি করছেন, সেটি আপনার?
ইহুদি জবাব দিলেন, নিশ্চয়ই আমার। বর্মটি এখনো আমার কাছেই আছে।
কাজী প্রশ্ন করলেন, মহামান্য খলিফা! অভিযুক্তের কাছে যে বর্মটি রয়েছে সেটিই যে আপনার তার কি কোনো প্রমাণ আপনি দাখিল করতে পারবেন?
খলিফা বললেন, অবশ্যই পারবো। ঐ বর্মটিই যে আমার তার সাক্ষী আছে। এ জন্য আমি দু'জনকে সাক্ষী হিসেবে আদালতে উপস্থিত করার বিষয়ে আপনার অনুমতি প্রার্থনা করছি।
কাজী শুরাইহ বললেন, তা বেশ। কিন্তু সাক্ষীগণের পরিচয় কি?
খলিফা বললেন, প্রথম সাক্ষী হাসান। আমার পুত্র। আর দ্বিতীয় সাক্ষী কুম্বার। সে আমার ভৃত্য। আমার বিশ্বাস, ওরা সত্য সাক্ষ্য দিবে এবং সঠিকভাবে বিষয়টি আদালতে প্রকাশ করবে।
কাজী বললেন, মহামান্য খলিফা! আমি দুঃখিত এ জন্য যে, এদের দু’জনের কারও সাক্ষ্যই আদালতে গ্রহণযোগ্য নয়। আপনাকে সত্য প্রমাণ করার জন্য অন্য সাক্ষীর ব্যবস্থা করতে হবে।
কাজীর কথা শুনে খলিফা বিব্রত হলেন। তবে তিনি মোটেও রাগান্বিত হলেন না। শুধু বিস্ময় প্রকাশ করে বললেন, আপনি কি মনে করেন, এরা আমার হয়ে আদালতে মিথ্যে কথা বলবে?
কাজী শুরাইহ গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, আমাকে ভুল বুঝবেন না মহামান্য খলিফা। আমি জানি, আপনি সত্যবাদী। আপনার পুত্র হাসানও সত্যবাদী। তিনি প্রিয় নবীজী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম -এর দৌহিত্র। আমি এ-ও বিশ্বাস করি যে, মিথ্যে আপনারা বলতে পারেন না। কিন্তু পিতার পক্ষে পুত্রের সাক্ষ্য এবং মনিবের পক্ষে ভৃত্যের সাক্ষ্য গ্রহণযোগ্য নয়। মহানবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তো আমাদেরকে এই শিক্ষাই প্রদান করেছেন। এটাই তো তাঁর আদর্শ। কাজেই আপনি যদি পুত্র হাসান ও ভৃত্য কুম্বারের বিপরীতে নতুন কোনো সাক্ষীকে আদালতে উপস্থিত করতে না পারেন, তাহলে বর্মটি যে সত্যিই আপনার এটা নিশ্চিত করা কোনপ্রকারেই সম্ভব নয়। মহামান্য খলিফা, এটাই ন্যায়বিচার।
এবার খলিফা আলী রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু অত্যন্ত বিনীতভাবে বললেন, সম্মানীয় কাজী সাহেব! বর্মটি যে আমার সে ব্যাপারে আমি পুরোপুরি নিশ্চিত। কিন্তু এ সত্যকে প্রমাণ করার জন্য হাসান এবং কুম্বার ব্যতীত তৃতীয় কোনো সাক্ষী আমার নেই। তাই ন্যায়বিচারের প্রতি সম্মান দেখিয়ে আমি আপনার রায়কেই মেনে নিচ্ছি। উপযুক্ত সাক্ষীর অভাবে বর্মটির ওপর থেকে আমি আমার দাবি তুলে নিচ্ছি।
অকুতোভয় কাজী শুরাইহ দ্বিধাহীন চিত্তে ইহুদির অনুকূলে মামলার রায় ঘোষণা করলেন এবং এর ফলে বর্মটির মালিকানা তারই থেকে গেল।
মামলায় নিজে জিতে গিয়েও ন্যায়বিচারের এই তুলনাহীন দৃষ্টান্ত দেখে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলেন ইহুদি। বাকরুদ্ধ হয়ে পড়লেন তিনি। কয়েক মুহূর্ত তার মুখে কোন কথা ফুটছিল না। সম্বিত ফিরে পেয়ে পরক্ষণেই তিনি ছুটে গেলেন বিচারকের আসনে আসীন কাজী শুরাইহর একেবারে সম্মুখে। আবেগ, উচ্ছ্বাস আর আনন্দে দিশেহারা তিনি। বললেন, অপূর্ব! অভূতপূর্ব! অতুলনীয়! অসাধারণ! অনন্য এই দৃষ্টান্ত! যে ধর্মে এমন নিরপেক্ষ বিচারের বিধান রয়েছে, সে ধর্ম সত্যিই মহান। যে ধর্মের বিচারে সাক্ষীর অভাবে খলিফার দাবিও অগ্রাহ্য হয়, সে ধর্ম অবশ্যই সর্বশ্রেষ্ঠ।
আবেগে আপ্লুত ইহুদি এবার কাজী শুরাইহকে লক্ষ্য করে বললেন, হে ন্যায়বিচারক! আমি সৃষ্টিকর্তার নামে শপথ করে বলছি, মহামান্য খলিফার দাবি ছিল ন্যায়সঙ্গত। এই বর্মটি আমিই চুরি করেছিলাম। সুতরাং, আমি তা প্রকৃত মালিককে এখন আপনার সম্মুখেই ফিরিয়ে দিচ্ছি। সেই সঙ্গে ইসলামের প্রতি আমার আনুগত্য পেশ করছি। আজ থেকে আমার পরিচয়, আমি একজন মুসলিম। এ কথা বলে তিনি তখনই পড়ে নিলেন কালিমা। শাহাদতের অমিয় বানী উচ্চারণ করে তিনি আশ্রয় নিলেন ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে।
বিস্ময়াভিভূত ইহুদীর ততোধিক বিস্ময়কর কান্ড দেখে হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুরও তখন খুশি যেন আর ধরে না। তিনিও খুশির দমকে আবেগাপ্লুত হয়ে সদ্য ফেরত পাওয়া তাঁর প্রিয় বর্মটি উপহার হিসেবে দিয়ে দিলেন তাকে।
এভাবেই কালে কালে, যুগে যুগে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে সত্য দীন ইসলাম। সমাজ সংসারে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ন্যায়বিচারের সুমহান আদর্শ। সেই আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়েই বিশ্বময় অগণিত মানুষ লাভ করেছে ভ্রাতৃত্যের, সাম্যের আর মুক্তির আলোকিত পথের সঠিক দিশা।
তথ্যসূত্র: মাওলানা ইমরান রাইহান রচিত ‘সালাফের জীবন থেকে’ গ্রন্থ এবং অনলাইন অন্যান্য মাধ্যম অবলম্বনে।
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে সেপ্টেম্বর, ২০২১ দুপুর ১:৫৬