
বৈচিত্রময় ডিজিটাল লেখালেখির এই সময়ে, যখন সামহোয়্যারইন-এর মতো প্ল্যাটফর্মে পড়ন্ত বেলা, অনাকাঙ্খিত ঝিমুনি স্মরণ করিয়ে দেয় গোধুলিলগ্নের কথা, তখন লেখক-পাঠকের সম্পর্ক নিয়ে কথা বলতে গিয়ে সঙ্কোচ হয়। লেখক আর পাঠকের সংখ্যা যেখানে দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে, সেখানে এমন কিছু লিখতে মন চায় না, যাতে কেউ নিরুৎসাহিত বোধ করেন। তবু, একটা দায়বোধ আর মর্মপীড়া থেকে কিছু কথা না লিখে পারছি না। "মন্তব্য" হলো লেখক আর পাঠকের মাঝে একটা সেতুবন্ধন, মজার লুকোচুরি খেলা। লেখক কিছু লিখলেন, পাঠক পড়লেন। এরপর যদি কোনো উদারমনা পাঠক তার অতি মূল্যবান সময় বের করে একটা মন্তব্য ঝেড়ে দেন, তাহলে লেখকের মনে লটারির টিকিট জেতার মতো আনন্দ হওয়ার কথা। কিন্তু আরে, এ কী বিপত্তি! কিছু লেখকের কাছে পাঠকের মন্তব্য যেন চায়ের কাপে মাছি পড়ে গেছে। খেতে হবে বটে, তবে মুখ বেঁকিয়ে, নাক কুঁচকে। তবে আশার কথা, এমন লেখকের সংখ্যা আসলে খুবই কম।
এই মুষ্টিমেয় মহাপণ্ডিতরা ভাবেন, আমার লেখা ব্লগে পোস্ট হয়ে গেছে, ব্যাস, আমার দায়িত্ব শেষ। কে কী বলল, কে কী মন্তব্য করল, সেসব পড়ার সময় আমার মতো মহামানবের কোথায়? কেউ কেউ তো নিজেকে এতটাই গভীর জ্ঞানী ভাবেন যে, মন্তব্য দেখলেও তাঁদের চোখে ধরা পড়ে না। কেন? কারণ তাঁদের চোখ নাকি সারাক্ষণ মহাবিশ্বের গভীর রহস্যে ডুবে থাকে। পাঠকের মন্তব্য তাঁদের কাছে বাচ্চাদের আঁকিবুঁকির মতো। যেন পাঠক কোনো কিন্ডারগার্টেনের শিশু শিক্ষার্থী, আর তিনি আইনস্টাইনের দশম পুরুষ! এই পাণ্ডিত্যের রোগে ভুগে তাঁরা মনে করেন, মন্তব্যের উত্তর না দিলেও তাঁদের লেখার মহিমা এতটুকু মাত্র কমবে না। কিন্তু এটা কি শুধুই অহংকার? নাকি পাঠকের প্রতি অবজ্ঞা? নাকি একটা বিমূর্ত তামাশা, যেখানে লেখক নিজেকে অলিক মহান ভেবে মজা পান?
তবে ন্যায্যতার খাতিরে বলতেই হয়, সবাই তো একরকম নন। কেউ হয়তো একটি পোস্ট লিখেছেন ঠিকই কিন্তু তারপরেই অফিসের ফাইলের তলায় চাপা পড়ে হাঁপাচ্ছেন। কেউ হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে ফেসবুকের বদলে ডাক্তারের ওষুধের তালিকা পড়ছেন। কারও জীবনে হয়তো হঠাৎ নেমে এসেছে কোনো দুর্ভাগ্য। এমন নানাবিধ প্রতিকূল অবস্থায় তাৎক্ষনিকভাবে মন্তব্যের উত্তর দিতে না পারলে, পাঠকরাও তো মানুষ। তাদেরও বুকে একটু মায়া-দয়া অবশ্যই আছে। তারা তখন মনে মনে বলেন, ঠিক আছে, মানুষের জীবন, এমন হতেই পারে। এই ধরণের বাস্তবধর্মী অজুহাতগুলো অবশ্যই বিবেচনাযোগ্য, কারণ জীবনের বাস্তবতা কখনো কখনো কলমের চেয়ে ভারী হয়ে ওঠে।
কিন্তু আসল সমস্যা তাঁদের নিয়ে, যাঁরা সবসময় অহংকারের ভঙ্গিতে মন্তব্য এড়িয়ে যান। পাঠকের মন্তব্য যেন কোনো চাকরের হাতে লেখা চিঠি- পড়বেন না, উত্তর দেবেন না, মুখে শুধু প্যাঁচার মতো একটা বাকা হাসি ঝুলিয়ে সিংহাসনে বসে থাকবেন। মন্তব্যের উত্তর দেওয়া মানে যেন তাঁদের মান-মর্যাদায় আঁচড় পড়া। এটা কি নিছকই অহংকার? নাকি পাঠকের প্রতি তুচ্ছ তাচ্ছিল্যপূর্ণ অবজ্ঞা? নাকি এটা নিছকই একটা তামাশা, যেখানে লেখক নিজেকে কল্পিত মঞ্চের রাজা ভেবে মজা পান? আরে ভাই, পাঠক ছাড়া লেখক তো তেমন রাজ্যেরই রাজা, যে রাজ্যে প্রজা নেই একজনও! প্রাসাদ ঝকঝকে ঠিকই, কিন্তু ভেতরে শুধুই হাহাকার! একা একা লিখে, একা একা পড়ে, শেষে নিজের লেখা নিজেই লাইক করে ঘুমিয়ে পড়া- এটাই কি লেখকের জীবন?
তাহলে উপায়টা কী? উপায় বেশ সোজা। যাঁরা পাঠকের মন্তব্যকে পাত্তা দেন না, তাঁদের লেখা পড়ুন। মজা পেলে হাসতে পারেন, মন খারাপ হলে কাঁদতেও নিষেধ নেই, মোটকথা, উপভোগ করুন তার লেখা। কিন্তু মন্তব্য করার খায়েশ জাগলে মনটাকে বোঝান যে, ইনি মহামানব গোষ্ঠীর! ইহার পোস্টে মন্তব্য করা তোমার মত সাধারণ লোকের কাজ নয়। ব্যস, মন্তব্য করার ফাঁদে পা দেবেন না। কারণ, সেটা হবে মরুভূমিতে গোলাপ ফোটানোর বৃথা চেষ্টা। তার চেয়ে বরং আপনার মূল্যবান মন্তব্যটা দিন তাঁদের পোস্টে, যাঁরা অন্তত একটা “ধন্যবাদ” বা “ভালো লাগলো” লিখে আপনাকে মানুষ হিসেবে গণ্য করেন। আপনাকে মূল্যায়ন করতে জানেন। সম্মান সম্প্রীতি আর ভালোবাসা আদান-প্রদানে বিশ্বাস করেন।
শেষে একটা কথা। পাঠকের মন্তব্যের উত্তর প্রদানে অনাগ্রহী এই মহাপণ্ডিতরা আসলে নিজেদেরই ঠকান। পাঠকের মন্তব্যই তো লেখকের আসল অক্সিজেন। সেই অক্সিজেন না পেলে, যতই তাঁরা দার্শনিক সেজে সিংহাসনে বসে থাকুন, তাঁদের কলমের কালি একদিন শুকিয়ে যায়, মরুভূমি হয়ে যায়। তখন ফেসবুক বা সামহোয়্যারইন-এর নোটিফিকেশন বারে শুধু ধুলোবালিরই স্তুপ জমতে থাকে। আর লেখক বসে বসে ভাবেন, আমার লেখা কেউ পড়লো না কেন? আরে মশাই, আপনার অহংকার তো পাঠকের ভালোবাসা, প্রীতি সব পুড়িয়ে ছাই করে দিয়েছে! পড়লেও মন্তব্য করতে গেলে পাঠকের কলম ভয়ে কেঁপে ওঠে, কাঁপন ধরে যায় তার অন্তরাত্মাতেও!

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।


