মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রসীমা বিরোধে জাতিসংঘ ট্রাইব্যুনালের দেয়া রায়ে বাংলাদেশ দাবি অনুযায়ী অধিকাংশ ক্ষেত্রে উপকূল থেকে ২০০ নটিকাল মাইল পর্যন্ত ‘বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল’র অধিকার পেয়েছে বুধবার। এক্ষেত্রে মিয়ানমারের বলা ১৩০ নটিকাল মাইলের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের ২০০ নটিকাল মাইল দূরত্বের পক্ষে অধিকাংশ ক্ষেত্রে রায় এলেও এটা বলা যাচ্ছে না যে, বাংলাদেশ পুরোপুরি ‘জয়’ পেয়েছে। জয় হয়েছে আসলে দুই দেশেরই। ইংরেজিতে যাকে বলে উইন-উইন সিচুয়েশন।
জার্মানির হামবুর্গে অবস্থিত ইন্টারন্যাশনাল ট্রাইব্যুনাল ফর দি ল অফ দি সি (আইটিএলওএস) এর প্রধান জোসে লুই জেসাসের নেতৃত্বে বুধবার দেয়া রায়ে ঘোষণা করা হয়, ১৯৮২ সালের ইউএন কনভেনশন অন দি ল অফ দি সি (আনক্লজ) অনুযায়ি বাংলাদেশের বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের ২০০ নটিকাল মাইলেরও দক্ষিণে মহাদেশীয় ঢাল বিস্তৃত হবে।
বাংলাদেশের প্রথম দাবি খারিজ
ট্রাইব্যুনালে বাংলাদেশের প্রথম দাবি ছিল, ১৯৭৪ সালের দুই দেশের ঘোষিত সমুদ্রসীমা অনুযায়ী দুই দেশের মধ্যে সমুদ্রসীমা নির্ধারণ করে দেয়া হোক, যাতে ২০০৮ সালেও দুই দেশ সম্মত ছিল বলে উল্লেখ করেছে বাংলাদেশ।
এ দাবির পক্ষে বাংলাদেশের দাখিল করা দলিলপত্র ও উপস্থাপিত যুক্তি-তর্ক এবং বিপক্ষে মিয়ানমারের যুক্তি খণ্ডন বিচার করে ট্রাইব্যুনাল বাংলাদেশের দাবি খারিজ করে দিয়েছেন। ট্রাইব্যুনাল সাব্যস্ত করেছেন যে, ১৯৭৪ সালে দুই দেশের প্রতিনিধিদলের সভার পর স্বাক্ষরিত ‘সভার কার্যবিবরণী’টি ভিয়েনা কনভেনশন অনুযায়ী কোনো দিক থেকেই কোনো ‘আন্তর্জাতিক চুক্তি’ নয়। এবং সংশ্লিষ্ট আনক্লজ এর ১৫তম অনুচ্ছেদ অনুসারেও তা কোনো ‘চুক্তি’ নয়। ফলে তা ২০০৮ সালে মিয়ানমার কর্তৃক অনুমোদনের প্রশ্নই আসে না।
রায়ের ১২৬ অনুচ্ছেদে ট্রাইব্যুনাল স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছে যে, দুই দেশের মধ্যে কোনো ‘ঘোষিত’ বা ‘সম্মত’ সার্বভৌম সমুদ্রসীমা (টেরিটোরিয়াল সি) নেই, ফলে বাংলাদেশের দাবি অনুযায়ী তার ভিত্তিতে বিরোধ নিষ্পত্তি করা হয়নি।
ন্যায্যদূরত্ব নয়, সমদূরত্বের ভিত্তিতে সীমানা নির্ধারণ
সবমিলিয়ে এ মামলায় সমুদ্রসীমা নির্ধারণে মিয়ানমারের যুক্তি অনুযায়ী ‘সমদূরত্ব’কেই নীতি হিসেবে গ্রহণ করেছে ট্রাইব্যুনাল। ফলে ‘বিশেষ অর্থনৈতিক সমুদ্রসীমা’র পরে আরো গভীর সমুদ্রে ‘মহাদেশীয় ঢাল’ অংশে বাংলাদেশ দাবি অনুযায়ী সীমানা পায়নি।
অবশ্য জার্মানির হামবুর্গস্থ ইন্টারন্যাশনাল ট্রাইব্যুনাল ফর দি ল অব দি সি বুধবার স্থানীয় সময় দুপুর বারোটায় রায় পড়া শেষ করলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি দেশে পাঠানো এক বার্তায় বিভ্রান্তিকর বক্তব্য দিয়েছেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, “আদালত সমদূরত্বের ভিত্তিতে ন্যায্যতাভিত্তিক সমাধান দিয়েছে।”
কিন্তু রায়ের ১৫৩ নম্বর অনুচ্ছেদে আদালত স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন যে, আনক্লজের ১৫তম অনুচ্ছেদ অনুযায়ী পক্ষদ্বয়ের মধ্যকার সার্বভৌম সমুদ্রসীমা নির্ধারণ করা হবে সমদূরত্ব রেখার ভিত্তিতে।
গুরত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে সেন্টমার্টিন দ্বীপ
মিয়ানমারের দাবি অনুযায়ী ‘সমদূরত্বে’র ভিত্তিতে সীমানা বণ্টন করা হলেও বাংলাদেশের দাবি অনুযায়ী ‘সেন্টমার্টিন দ্বীপ’কে বাংলাদেশের উপকূল রেখায় অবস্থিত সাব্যস্ত করে এর থেকে ১২ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত এলাকাকে বাংলাদেশের সার্বভৌম সমুদ্রসীমা হিসেবে ঘোষণা করেছে ট্রাইব্যুনাল।
মিয়ানমারের যুক্তি ছিল, উপকূলরেখার গঠনের ভৌগোলিক দিক থেকে সেন্টমার্টিন দ্বীপটি মিয়ানমারের উপকূলে অবস্থিত, বাংলাদেশের উপকূলে নয়। কাজেই এ দ্বীপের থেকে ১২ নটিক্যাল মাইল বাংলাদেশের সার্বভৌম সমুদ্রসীমা নির্ধারণ করা যাবে না। মিয়ানমারের এ যুক্তি ট্রাইব্যুনাল গ্রহণ করেননি। বাংলাদেশের আইনজীবীদের উপস্থাপিত যুক্তি গ্রহণ করে সেন্টমার্টিন দ্বীপকে বাংলাদেশের উপকূল রেখার অংশ ধার্য করে এর ভিত্তিবিন্দু থেকে সার্বভৌম সমুদ্রসীমা ধার্য করেছেন।
প্রসঙ্গত, সাধারণত উপকূল রেখার ভিত্তিবিন্দু থেকে ১২ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত সার্বভৌম সমুদ্রসীমা, তার পরের ২০০ নটিক্যাল মাইল বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল (এক্সক্লুসিভ ইকনমিক জোন) ও পরের ২০০ নটিক্যাল মাইলকে মহাদেশীয় ঢাল (কন্টিনেন্টাল শেলফ) হিসেবে ধার্য করা হয়।
ফলে সার্বভৌম সমুদ্রসীমা নির্ধারণ হচ্ছে সমুদ্রসীমা নির্ধারণে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ।
১৫১ পৃষ্ঠার দীর্ঘ রায় বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, বাংলাদেশের দাবি অনুযায়ী ‘ন্যায্যদূরত্বে’র ভিত্তিতে সীমানা নির্ধারিত না হওয়ায় দেশের উপকূলের সব অংশ থেকে ২০০ কিলোমিটার দূরত্বে বিশেষ অর্থনৈতিক সীমার অধিকার পায়নি বাংলাদেশ। যেমন সেন্টমার্টিন দ্বীপ উপকূল থেকে দক্ষিণে এ সীমানা নির্ধারণে মিয়ানমারের সমদূরত্বের দাবির গ্রহণ করে দক্ষিণ-পশ্চিমে ২১৫ ডিগ্রি কোণে সীমানা নির্ধারণ করেছে ট্রাইব্যুনাল।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



