বিদেশিনী চলে গেলো। কিন্তু খোকাভাই ফিরলো না। এই আট আটটা দিন ঐ বিদেশিনী বউকে ঘিরে সারাবাড়ি জুড়ে ছিলো এক গমগমে ভাব। সারা বাড়িতেই বইছিলো উৎসবের হাওয়া। বাঁদরওয়ালাকে ডেকে বাঁদরনাচ দেখানো, জোনাকী বেঁদেনীর সাপের খেলা, ফুলমিয়ার বায়োস্কোপ যা আমাদের তেমন দেখার অনুমতী ছিলো না কিন্তু সবই ঐ বিদেশিনীকে চমক লাগাবার জন্য বাড়িতে অনুমোদন পেয়ে গেলো।
আমাদের ছোটবেলার এবং গ্রাম বাংলার বিশেষ ঐতিহ্য হাওয়াই মিঠা এবং শনপাপড়ি এসবও তাকে তাক লাগাবার জন্য বাড়ি্তে আনা হলো। হাওয়াই মিঠা খাবার পর ঐ কালো কুচকুচে বউটার জীব ম্যাজেন্টা কালার ধারণ করলো। তাকে দেখতে তখন ভয়ংকর লাগছিলো। ছোটচাচার ছেলে পিংকু পিচ্চিটা এমনই বিচ্ছু ছিলো যে আমার কানে কানে ফিসফিস বললো, দেখ নীরুআপু এক্কেবারে মা কালীর মত লাগছে। আমি ভয়ে কাঁটা হয়ে উঠলাম যদি বউটা শুনে ফেলে। যদিও সে বাংলা বুঝেনা তবুও ভয় পেয়ে ওকে ধমক দিয়ে উঠলাম, চুপ! এসব বলতে হয়? পিংকু বাঁদরটা কি আর ভয় পাবার পাত্র? আমার বকা খেয়েও তার কিছুই হলো না, সে ফিক ফিক হাসতেই লাগলো।
ঐ বিদেশিনীকে পান, পান্তাভাত থেকে শুরু করে মোরগ মুসাল্লাম, ইলিশ পাতুরী সবই খাওয়ানো হয়েছিলো। দেখিয়ে আনা হলো মাইকেল মধুসুধন দত্তের বাড়ি। ওকে উপহার দেওয়া হলো যশোরের বিখ্যাত শিল্প যশোর স্টিচের একটা শাড়ি এবং একটা বেডশিট। সেই শাড়ি পরিয়ে তার সাথে ছবিও তুললাম আমরা ক্যামেরাম্যান ডেকে। সেই ছবিটা বড় করে বাঁধাই করা আছে আমাদের যোশরের বাড়ির অন্দরের বারান্দায়। সব আয়োজন উৎসব শেষে ফিরে গেলো বিদেশিনী বউ আর তার হাসব্যান্ড। আবারও পুরো বাড়িতে এত লোকজনের মাঝেও শ্রান্তি নেমে এলো।
বড় চাচীমা শুধুই কাঁদেন। সেই নিশব্দ কান্নায় বুক ফেটে যায় আমার। খোকাভায়ের সাথে সাথে বড়চাচীর জন্যও খুব কান্না পায় আমার। বড়চাচীমা নিশব্দে হলেও কাঁদতে পারে কিন্তু আমার বুক ফেটে যায় তবুও সেই কান্না বুকে চেপে রাখতে হয়। আমার তো খোকাভাইয়ের জন্য কান্নার কোনো অধিকারই নেই। কেউ জানতে পেলে কেটে দু টুকরো করে ফেলবে। আর তাই আমার ভেতরে ভেতরে গুমরে কাঁদে। খুব কষ্ট হয় আমার তবুও কাউকেই বলতে পারিনা সেই কষ্টের কথা।
বাড়িতে যতক্ষন থাকি একটু টুক করে শব্দ হলেও চমকে উঠি। খোকাভাই কি ফিরে আসলো! যখন স্কুলে যাই সারাটা পথে আমার দুচোখ খোকাভাইকেই খুঁজে ফেরে। কিন্তু খোকাভাই কোথাও নেই। যেন ভোজবাঁজির মত উধাও হয়ে গেছে হঠাৎ এ শহর থেকে! সামনে আমার তখন এস এস সি পরীক্ষা। অথচ মন নেই আমার পড়ালেখায় এক ফোটাও। নিজেকেই মনে মনে দোষারোপ করি আমি। আমার মন বলে খোকাভায়ের প্রতি আমার এই কদিনের অবহেলা সইতে পারেনি আমার খোকাভাই। নিজেকেই প্রশ্ন করি, কেনো আমি এই কদিনের উৎসবের ডামাডোলে খোকাভাইকে ভুলে ঐ বিদেশিনীর দিকেই হা করে তাকিয়ে রইলাম। মোটেও তা উচিৎ হয়নি আমার।
তেরো দিন কেঁটে যাবার পর চাচীমা আর সইতে না পেরে দাদুর পায়ে গিয়ে পড়লেন। দাদুর কাছে থেকে তার প্রানের নিধিকে খুঁজে দেবার কথা এক প্রকার আদায় করেই ছাড়লেন চাচীমা তার এক বুক চোখের জলে। দাদু শহরের সকল প্রান্তেই খোঁজ পাঠালেন। পরদিন ভর দুপুরে সেদিন এক ছুটির দুপুর ছিলো। আমরা সবাই খেতে বসেছি। এমন সময় সেজোচাচা কোথা থেকে সাথে করে নিয়ে আসলেন খোকাভাইকে। বাড়িতে পা দিয়েই বড় চাচীমাকে ডাকলেন। আমরা সবাই হুমড়ি খেয়ে পড়লাম সেখানে। উস্ক খুস্ক চুল, চোখের নীচে কালী, মলিন পোশাকের সেই খোকাভাইকে দেখে সবাই যেন সার্কাসের ক্লাউন দেখছিলো। আমার বুকের ভেতরটা হু হু করে উঠলো। এ কদিনে কি হাল হয়েছে খোকাভায়ের! সেজোচাচা বড় চাচীমাকে ডেকে বললেন, ওকে কিছু খেতে দাও। না জানি কতদিন না খেয়ে আছে। বড়চাচীমা খোকাভাইকে জড়িয়ে ধরে পাগলের মত কাঁদছিলেন।সেজোচাচী গিয়ে ধরে আনলো বড়চাচীমাকে আর ছোট চাচী খোকাভাইকে নিয়ে এলো আমাদের সাথে খেতে বসাবার জন্য।
জীবনে এই প্রথম খোকাভাই এই টেবিলে বাড়ির আর সব ছেলেমেয়েদের সাথে খেতে বসলো। আমি লম্বা টেবিলটার অন্য দিকে ছিলাম। ভয়ে ভয়ে সকলের চোখ ফাকি দিয়ে তাকাচ্ছিলাম ওর দিকে। কিন্তু খোকাভাই একটা বারের জন্যও আমার দিকে তাকালো না। মাথা নীচু করে বসে রইলো। ছোটচাচী ভাত বেড়ে দিলো খোকাভাইকে। হাত ধোবার জন্য সাবান আর জলের গামলাও নিয়ে আসলো। খোকাভাইকে খুব পরিশ্রান্ত লাগছিলো। এক কাপড়ে এতগুলো দিন। গোসলও করেনি মনে হয়। ছোটচাচী বললেন খাও, খোকাভাই বিনা প্রতিবাদে গোগ্রাসে খেতে শুরু করলেন। বড়চাচীমাকে দাদীমার ঘরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিলো। কাজেই খাওয়াবার দায়িত্বে ছিলেন ছোটচাচী। সবাই খাওয়া ফেলে হা করে খোকাভাইকে দেখছিলো। পিংকু হঠাৎ বলে উঠলো, তুমি বাড়ি থেকে পালিয়েছিলে কেনো? সবাই হেসে উঠলো। ছোটচাচী পিংকুকে ধমক দিলো। চুপ, খাও এখন। সে সব দিনে আমরা সকল ভাইবোনেরা কারণে অকারনে হাসতাম। সে মানুষের দুঃখই হোক আর সুখের ঘটনাই হোক। ঠিক এ কারনেই হয়তো খোকাভায়ের ওমন দুঃসময়েও পিংকুর কথা শুনে সবাই হেসে উঠেছিলো শুধু আমি ছাড়া।
খোকাভাই এরপর সারা দুপুর পড়ে পড়ে ঘুমালো। খোকাভাই চাচীমার ঘরে থাকায় একটা কথাও হলো না তার সাথে। এমনকি সন্ধ্যার পরেও ছাদের ঘরে ফিরলো না খোকাভাই। আমার মনটা খোকাভায়ের সাথে একটু কথা বলার জন্য আকুপাকু করছিলো। জানতে চাইছিলো, এতদিন কোথায় ছিলো খোকাভাই বা ঠিক কি কারণে সেদিন সে চলে গিয়েছিলো? রাতের খাবারের সময় খবর পেলাম খোকাভাই গোসল সেরে সন্ধ্যারাতেই রাতের খাবার সেরে ছাদের ঘরে গেছে। সবাই জানার জন্য উৎসুক ছিলো যে এতদিন কোথায় ছিলো খোকাভাই? কিন্তু সে সব কিছুই জানা যায়নি। সেজোচাচা কাউকেই কিছুই বলেননি বা কাউকেই জানাননি যে এতদিন কোথায় ছিলো খোকাভাই বা কোথা থেকে তাকে ধরে আনলেন তিনি।
মাঝরাতে ঘুম ভাঙ্গলো আমার। আমাদের বাসার পিছনের বাগান থেকে ঝি ঝি পোকার শব্দ আসছিলো। চারিদিকের শুনশান নীরবতার মাঝে সেই একটানা ঝি ঝি ডাকের মাঝে কি যেন এক ঘোর ছিলো। অনেকটাই সন্মোহনী বা ভূতগ্রস্ততা। আমি পা টিপে টিপে ঐ মধ্যরাত্রীতেও সিড়ি বেয়ে চলে গেলাম খোকাভয়ের ঘরে।খোকাভাই ঘরে ছিলো না। ছাদের কোনার দিকের ছোট পানির ট্যাংকটার উপর চুপচাপ বসে ছিলো। হাতে ছিলো জলন্ত সিগারেট। সিগারেটের আলোর ছোট্ট বিন্দুটা টানের সাথে সাথে জোরালো হয়ে উঠছিলো আবার কমে যাচ্ছিলো। কিন্তু সবচেয়ে অবাক হলাম এই প্রথম তাকে দেখলাম সিগারেট হাতে। এর আগে আমি খোকাভায়ের এমন কোনো অভ্যাস দেখিনি। আমি অতি সন্তর্পণে খোকাভায়ের পিছে গিয়ে আস্তে করে ডাকলাম, খোকাভাই?
খোকাভাই চমকালো না। তাকালো একটু। আবার মুখ ফিরিয়ে নিলো। কষ্টে আমার বুক ফেটে যাচ্ছিলো। বললাম, খোকাভাই কোথায় চলে গিয়েছিলে? খোকাভাই কোনো উত্তর দিলো না। আমি ওর পাশে বসে হাত ধরে ঝাঁকি দিলাম।আবারও বললাম, কোথায় চলে গিয়েছিলে তুমি? বলো আমাকে? খোকাভাই সিগারেট নীচে ফেলে পায়ের তলে পিষে ফেললো। তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। আমার বুকের ভেতরটা ব্যাথায় মুচড়ে যাচ্ছিলো। আমি বুঝতে পারছিলাম খোকাভায়ের অনেক কষ্ট! কিন্তু ঠিক কিসের কষ্ট জানতাম না আমি। সেই কষ্টের পরিমান বা কারনটা আসলে কতখানি বুঝতেই পারছিলাম না আমি। আমি বললাম, বলবেনা? খোকাভাই বললো, বলবো। উঠে দাঁড়ালো খোকাভাই। তারপরও কিছু না বলেই রেলিং এর ধারে গিয়ে দুহাতে আলসে ধরে চুপ করে নীচে তাকিয়ে রইলো। আমি পানির ট্যাংকের উপর বসেই ছিলাম। হঠাৎ খোকাভাই আমার সামনে এসে আমার মুখটা দুহাতে ধরে হাউ মাউ কেঁদে উঠলো। বললো, আমাকে ছেড়ে কখনও যাবি না নীরু। বল বল কখনও যাবি না। আমি বোকার মত হা করে তাকিয়ে রইলাম এত বড় ছেলের এমন হাউ মাউ কান্না দেখে। সব সময় শুনেছি ছেলেদের কাঁদতে নেই। কাঁদে শুধু মেয়েরা। খোকাভাই আমার সকল ভাবনা ভুল করে দিলো।
ভোর হয়ে আসছিলো তখন। একটু পরেই আজান দেবে। হাউমাউ করে কাঁদছিলো খোকাভাই। হাঁটুগেড়ে আমার পায়ের কাছে বসে দুহাতে আমার দুই পা জড়িয়ে বসে রইলো অপ্রকৃতস্থের মত। ফুঁপিয়ে কাঁদছিলো খোকাভাই, বারবার বলছিলো, তুই আমাকে কথা দে, কখনও আমাকে ছেড়ে যাবি না। কথা দে নীরু। খোকাভায়ের মত ওমন অতো বড় একটা ছেলে এমন করে কাঁদতে পারে বিশ্বাসই হচ্ছিলো না আমার। আমার কোলের উপর খোকাভায়ের মুখ। আমার জামা ভিজে যাচ্ছিলো তার চোখের জলে। আমি তখন তার এ হেন কান্ডে এতটাই অবাক ছিলাম যে আমার বোধ বুদ্ধি জ্ঞান সবই লোপ পেয়েছিলো। হঠাৎ উঠে দাঁড়ায় খোকাভাই। এক ঝটকায় টেনে তোলে আমাকে। ঐ আধো আলো ফোটা ভোরের আলোয় জ্বলজ্বল করছিলো খোকাভায়ের কান্নাভেজা দুই চোখের তারা। ভীষন ভয় লাগছিলো আমার। চোখ মুঁদে ফেললাম আমি। হঠাৎ উষ্ণ গভীর চুম্বনে বোধহীন আমি কাঁপতে থাকি ঘোরগ্রস্থা হরিনীর মত। এক ছুটে পালিয়ে আসি ওখান থেকে।
এরপর সারাদিনমান জড়িয়ে থাকে আমাকে সেই ঘোর, ভোরের আধো আলো ছায়া, তপ্ত নিশ্বাস আর সাথে সিগারেটের হৃদয়পোড়া গন্ধ।
আগের পর্ব
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই সেপ্টেম্বর, ২০২২ সন্ধ্যা ৬:৪১