View this link
অফিস থেকে স্পষ্ট নির্দেশ ছিল, ম্যারাডোনাকে আর ছাড়া চলবে না। সুতরাং তিনি যেখানে, আমিও সেখানে। শুধু আমি নই। একদল সমর্থক ছিলেন আর্জেন্টিনার। স্বাভাবিকভাবেই তাঁরা অনুসরণ করছিলেন আর্জেন্টিনাকে। যে হোটেলে আর্জেন্টিনার ফুটবল দল উঠেছিল তার বাইরে সারা রাত ধরে তাঁরা হাসতেন-গাইতেন-কাঁদতেন-ঝগড়া করতেন। আরো একবার ম্যারাডোনা তাঁদের বিশ্বসেরা করে তুলবেন, নিশ্চিত ছিলেন তাঁরা। তাই এক মুহূর্তের জন্যও যেন কাছছাড়া করতে চাইছিলেন না তাঁদের প্রিয় 'ডিয়েগো'-কে।
এমন উৎসবের পরিবেশেই এসেছিল সবচেয়ে বিচ্ছিরি খবরটা। ডোপ টেস্টে ধরা পড়েছেন, আর খেলতে পারবেন না বিশ্বকাপে। বিশ্বাসই করতে পারিনি। আমরা, এত দূর থেকে যাওয়া ভারতীয়রাই যখন পারিনি, আর্জেন্টিনীয়রা কি করে পারবেন? ওদের তো যেন জীবন থেমেই গিয়েছিল। আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ জয় দেখতে এসেছিলেন ওঁরা, শুধুই ম্যারাডোনার জন্য। সেই ম্যারাডোনাই যখন থাকবেন না, বিশ্বকাপ আকর্ষণ হারিয়েছিল তাঁদের কাছে। একেকজনের মুখের দিকে তাকালে মনে হচ্ছিল, নিকটাত্দীয়কে হারিয়েছেন। কেউ কোনো কথা বলছেন না। সবাই মিলে দাঁড়িয়ে আছেন হোটেলের সামনে, নিশ্চুপ। শোকে পাথর হয়ে যাওয়া কাকে বলে, বুঝেছিলাম আরো ভালো করে। শোকে মুহ্যমান, শান্ত। মুখের কথাও যেন কেড়ে নিয়েছে সেই ঘটনা। কারও কোনো দাবি নেই, মুখে কথা নেই, শুধু দাঁড়িয়ে থাকা হোটেলের সামনে, যদি একবার আসেন ম্যারাডোনা। তখনো ৯/১১ হয়নি, তাই ম্যারাডোনা এলেনও। এসে হাত নাড়লেন সমবেত সমর্থকদের দিকে। প্রত্যুত্তর এল। সঙ্গে, কাতর প্রার্থনাও, যেন ম্যারাডোনা থাকেন আমেরিকাতেই, সমর্থন করে যেন আর্জেন্টিনীয়দের। তাহলে বাকি ফুটবলাররা বাড়তি মনোবল পাবেন।
ক্রমশ সমবেত সমর্থকদের মুখে কথা ফিরল, ফিরল 'ওলে ওলে' গান। সেবারই প্রথম শোনা, ওই আর্জেন্টিনীয় সমর্থকদের মুখে। অদ্ভুত লাগছিল দেখতে। ম্যারাডোনা আর খেলবেন না, সবাই জেনে গেছেন। ওঁরা কিন্তু বাতিস্তুতাদের সমর্থন জানাতে আর্জেন্টিনার হোটেলের সামনে জড়ো হননি। সারা রাত জেগে রয়েছেন সবাই, হোটেলের ঘরে হয়তো বিনিদ্র রজনী কাটছিল ম্যারাডোনারও। যে আশা নিয়ে এসেছিলেন আমেরিকায়, যে স্বপ্ন আবার দেখাতে শুরু করেছিলেন দেশবাসী, বিশ্ববাসীকে, তার এমন মর্মান্তিক পরিণতি হবে, কে জানত?
এই বিশ্ব অনেক শোকের মুহূর্ত দেখেছে। সত্যি কথায়, মানুষকে তো বড়ই হতে হয় বিভিন্ন শোকের মুহূর্ত পেরিয়ে। এই লেখার কিছু দিন আগেই মারা গিয়েছিলেন মাইকেল জ্যাকসন। তখনো টেলিভিশনের পর্দায় দেখা গিয়েছিল হাজার হাজার মানুষ কী করে কেঁদে ভাসাচ্ছেন। কিন্তু ম্যারাডোনা ডোপ টেস্টে ধরা পড়ার পর যে দৃশ্য দেখেছিলাম সেই আমেরিকাতেই, কাছাকাছি আর কিছু দেখেছি বলে মনে পড়ে না।
সংবাদ সম্মেলনে দুঃখ প্রকাশ করেছিলেন, সেই আর্জেন্টিনীয় সমর্থকদের কাছে। তাঁদের আশা পূরণ করতে পারেননি বলে। নিজের স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে যাওয়ার কথাও বলেছিলেন। উঠে এসেছিল অবশ্যম্ভাবী যা, ফিফার চক্রান্তের কথা। অনুগামীরা তখনো বিশ্বাস করেছিলেন, এখনো বিশ্বাস করেন তাঁকেই। ফিফাকে সে জন্যই দেখা হয় সন্দেহের চোখেও। ম্যারাডোনাকে ইচ্ছে করেই ফিফা সেবার বিশ্বকাপ খেলতে দেয়নি, বদ্ধমূল ধারণা অনুগামীদের।
জার্মানিতে বিশ্বকাপে দেখেছিলাম মেসিকে। কী অসম্ভব শ্রদ্ধা করেন মারাদোনাকে, বলে বোঝানো যাবে না। নিজের বুটে সোনার অক্ষরে 'ডিয়েগো' লিখে রেখেছেন। এখন আরো কাছে পাচ্ছেন কোচ হিসেবে। কে জানে, হয়তো ম্যারাডোনা-মেসি জুটি আবার ফুল ফোটাবে, আর্জেন্টিনাকে এনে দেবে তাদের সাধের বিশ্বকাপ আবার, ২৪ বছর পর, দক্ষিণ আফ্রিকায়। গোটা বিশ্বই অধীর আগ্রহে তাকিয়ে আছে সেদিকে, ২০১০-এর জুন মাসে। ফুটবলার ম্যারাডোনাকে তো অনেকবারই দেখা গেছে, কোচ ম্যারাডোনাকে দেখতেও সমান উৎসাহী আমরা সবাই।
সেই ম্যারাডোনাকেই আবার দেখেছিলাম, ১৫ বছর পর, দমদম বিমানবন্দরের বাইলে অল্প অল্প ঠাণ্ডা পড়েছে। কে তার পরোয়া করে? রাতের বিমানবন্দরে কোথা থেকে হাজির হাজারে হাজারে ম্যারাডোনাপ্রেমী। প্রয়াত ক্রীড়ামন্ত্রী সুভাস চক্রবর্তী তখনো জীবিত। রাতকে দিন করে দেওয়ার অঙ্গীকার করেছিলেন, গভীর রাতেও অত লোক এসেছিলেন শুধুই ম্যারাডোনাকে দেখতে। বিমানবন্দর থেকে হোটেলে আসার পথের দুই ধারে রাজারহাটের তাপস চ্যাটার্জির মতো আরো অনেকেই বিরাট সংবর্ধনার আয়োজন রেখেছিলেন। শুধু তাঁকে একবার চোখের দেখা দেখতে এত মানুষ তাঁর নিজের দেশ থেকে এত দূরের কোনো দেশে, আবেগে ভেসে গিয়েছিলেন ফুটবলের রাজপুত্রও। আগেই বুঝতে পেরেছিলাম, বিমানবন্দরে দাঁড়িয়ে থাকলে হবে না। আমাদের অফিসের গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে এসে বিমানবন্দর থেকে বেরোনোর মুখটায় অপেক্ষায় দাঁড়িয়েছিলাম, ওঁর গাড়ি 'ফলো' করব বলে। সঙ্গে ছিল কাশীনাথ ভট্টাচার্য ও আলোকচিত্রী অঙ্কন সেনগুপ্ত। ওই দূরত্ব থেকেই আবার দেখা। কাচের বাসে দাঁড়িয়ে বিহ্বল ম্যারাডোনা দুই হাত নেড়ে বলছেন যেন, 'তোমাদের এই ভালোবাসায় আমি মুগ্ধ।' গোটা রাস্তাটাই ওঁর সেই বিশেষ বাসের পাশে পাশে এসেছিলাম আমরা। পরের দিন সংবাদ সম্মেলনেও কাছে যাওয়ার সুযোগ পাইনি, যেমন পাইনি মাঠে। ওখানে তো আবার ভিড় ক্রীড়া মন্ত্রকের কাছের আমলাদের। সাধারণ মানুষ কাছে যাওয়ার সুযোগ পেলেন কই? ইচ্ছে ছিল, কাছাকাছি যেতে পারলে আরো একবার মনে করিয়ে দেব সেই 'গোলাজো-কাহিনী', সুযোগ পাইনি। দূর থেকেই দেখেছি আর মনে করেছি, ১৫ বছর আগের সেই দিনগুলো।
তবে মানুষ ম্যারাডোনা পাল্টাননি। চেহারায় ভারিক্কি ভাব এসেছে। ভুবনমোহন হাসিটা আছে একই রকম। তবে কথাবার্তা শুনে মনে হলো, অনেক বেশি পরিণত হয়েছেন। কথাবার্তায় যে আক্রমণাত্দক মনোভাব দেখলাম বাইপাসের ধারের হোটেলের সংবাদ সম্মেলনে, তা শুনে মনে হলো, এমন মানুষের হাতে নিজেকে সঁপে দেওয়া যায়। কথা ছিল দুপুর ১২টার সময় হোটেলের প্রশস্ত লনে তিনি নিজেকে মেলে ধরবেন। প্রবল উত্তেজনায় ছটফট করতে করতে আমরা সাঁইত্রিশ মিনিট ধরে দেখলাম এক হৃদয়বান পুরুষকে।
ম্যারাডোনা কত বড় ফুটবলার, এটা যেমন জানা, তেমনি অনেকেই জানেন তাঁর ভেতরের মানুষটি। এই ৩৭ মিনিট ছোটবেলা থেকে ২০০৮_সংক্ষেপে সাফল্য এবং ব্যর্থতাকে ছুঁয়ে গেলেন। তাঁর অনায়াস ড্রিবলের মতো। কিন্তু কিছুতেই ভুলতে পারব না তাঁর অসংখ্য বক্তব্যের মধ্যে দুটি মতামত।
এক, পেলে বড়, না আমি বড় (সেই বিখ্যাত হাসি) এবং তার পরেই বললেন, 'আমার মা আমাকে দুনিয়ার সেরা ফুটবলারের স্বীকৃতি দিয়েছেন। রুমেনিগে এখানে এমন কথা বলে গেছে শুনলাম। ধন্যবাদ ওকে। তবে আমার কাছে মায়ের প্রশংসাই প্রথম এবং শেষ।'
'ওবামা! হ্যাঁ, আমি দারুণ পছন্দ করি। জর্জ বুশকে আমি খুনি হিসেবেই চিনি। কিন্তু ওবামা গ্রেট, গ্রেট।'
কে বলে ভালো মানুষ হওয়ার জন্য স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে হয়? কী অসাধারণ বক্তব্য পাওয়া গেল। হাজার কিচিরমিচিরের মধ্যে অনেকে বলাবলি করছেন, মহেশতলায় নিজেকে দারুণ মেলে ধরেছিলেন। জনতার সঙ্গে মিশে গেছেন। কেউ কেউ বললেন, 'পয়সা নিয়েছে, জনতাকে আনন্দ দেবে না।' যে পরিবেশে এমন আলোচনা হচ্ছিল, সেখানে এই ধরনের আলোচনা নেহাতই নীচতা। এবার দেখা যাক ম্যারাডোনা নিজেকে কিভাবে মেলে ধরলেন। সদ্য স্নান করা, কালো মিশমিশে চুল। মঞ্চে তোলেননি বান্ধবী ভেরোনিকাকে। ২০ ফুট দূরে লাগোয়া এক বেঞ্চে তিনি হাতে প্লাস্টার অবস্থায় বসে ছিলেন। চিত্র সাংবাদিকরা আবারও চেয়েছিল, যদি এক ফ্রেমে বান্ধবীর সঙ্গে ডিয়েগোকে আবার ধরতে পারেন। তিনি মঞ্চে এসে প্রথমেই বললেন, 'সি সরদালা'। স্প্যানিশ বাক্য। বুঝলাম না। হয়তো বলতে চেয়েছিলেন এবার শুরু করা যাক। '৯০-এর বোস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঠে প্রথম তাঁকে একলা পেয়েছিলাম, তখনো ইংরেজি জানতেন না। ১৪ বছর আগে বোস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ের খেলাধুলার শিক্ষক দোভাষীর কাজ করেছিলেন সেই সকালে। শনিবার ওই ভূমিকায় এক বঙ্গ সন্তান।
শুরুতে ম্যারাডোনা বললেন, 'কেমন আছেন আপনারা সবাই? আমি খুব খুশি কলাকাতায় এসে। আমাকে ঘিরে এত আবেগ, মধ্যরাতের পরেও, এতটা ভাবিনি। অসাধারণ আতিথেয়তা। বিস্ময়ের ঘোর কাটছে না আমার।' জীবনানন্দ দাশের সেই কবিতার সুরেই যে বললেন, 'আবার আসিব ফিরে আপনাদের এই শহরে। আপাতত আর্জেন্টিনাকে নিয়ে ব্যস্ত থাকব। আমি তো চুক্তিবদ্ধ। কিন্তু সময় পেলেই আসব ভারতে। আসতে চাইব। এই আতিথেয়তা, উন্মাদনা ভুলব না।' জানতে চাওয়া হয়েছিল কার্লোস বিলার্দো এ শহরে আসার পর '৮৬-তে বিশ্বকাপ জিতেছিল আর্জেন্টিনা। এবার আপনি এলেন। তাহলে কি ২০১০ বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনা আবার জিতবে? বিলার্দোর নাম শুনে মুখে শ্রদ্ধার হাসি, ভালোবাসার হাসি।
'বিশ্বকাপ? সবাই পরিশ্রম করছে। আমি শুধু বলব, এই মুহূর্তে আর্জেন্টিনা হলো দুনিয়ার সেরা চার দলের একটা।' (শেষ)

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



