১ : দুই হাজার সালে যখন আমরা সুইডেন আসি তখন এখনকার মত রাস্তায় বের হলেই বাংলাদেশী মানুষ দেখা যেত না। হঠাৎ একটা বাংলাদেশী মানুষের দেখা পেলে খুব ভাল লাগত, যদিও চেনা জানা নেই তবু কত যে আপন মনে হত শুধু একই দেশী হবার কারনে।
একদিন ভাবীর সাথে মেট্টোতে যাচ্ছি। একজন বাংলাদেশী ভদ্রমহিলা বসে আছে দেখে আমার ভাবী যেয়ে উনার পাশেই বসে আমি অপজিট পাশে বসি। আমার ভাবী উনাকে সালাম দিয়ে কথা শুরু করেন, কথায় কথায় দেখা উনারা আমরা খুব কাছাকাছি ই থাকি, আমাদের দুই বিল্ডিং পরেই উনাদের বিল্ডিং।
আরো অনেক কথা বলার পর আমার ভাবী উনাকে বলেন , ভাবী আমাদের বাসায় আসবেন।
ভদ্র মহিলা - “আমি কুকের বউ আমি যার তার সাথে মিশি না”।
আমি “কুক” কি তখন জানতাম না, উনার কথা বলার ষ্টাইলে মনে করেছিলাম হয়ত উনার হ্যাজব্যান্ড মস্ত বড় অফিসার উনারা অনেক বড়লোক তাই হয়ত উনারা কারো সাথে মিশেন না । আমার ভাবী মুচকি হেসেই বলেন “ ও তাই” !
রাতে খেতে বসে ভাবী যখন ভাইয়ার সাথে এই ব্যাপারটা নিয়ে কথা বল্লেন তখন বুঝতে পারলাম কুক মানে কি? কোক মানে রেষ্টুরেন্টের হেড বাবুর্চি ।
এর কিছুদিন পর আমি যখন স্কুল শুরু করলাম ভদ্র মহিলার দুই নাম্বার ছেলেকে পেলাম আমার ক্লাসমেট হিসাবে, নাম আশিক অবশ্য বয়সে সে আমার চেয়ে ছোট। সিক্স থেকে নাইন পর্যন্ত একই স্কুলে পড়েছি “হেই” “হ্যালো” ছাড়া তেমন কথা হয়নি। আর একই এলাকায় থাকা সত্বেও তেমন যোগাযোগও উনাদের সাথে আমাদের ছিল না ।
এক সময় উনারা বাড়ি কিনে এই এলাকা ছেড়ে চলে যান কিছুদিন পর আমরাও চলে এসেছি। সেই ভদ্রমহিলা এই বছর হঠাৎ করেই দুইবার আমাদের বাসায় এসেছেন। প্রথমদিন আমি বাসায় ছিলাম না ভাবীর কাছে শুনেছি উনি এসেছিলেন, এর কিছুদিন পর আবার হঠাৎ ভদ্র মহিলা এসেছেন সেদিন আমি বাসায়ই ছিলাম । ভাবী, উনার সাথে কথা বলতে ছিলেন, আমি চা নাস্তা নিয়ে গিয়েছি ।
আমাকে দেখেই , আরে আরে তুমি কত বড় হয়ে গিয়েছ ! তোমাকে কত ছোট দেখেছিলাম ।
- আচ্ছা , আশিক কি এখনো ছোট আছে ?
- না তা থাকবে কেন !! তুমি জানো না আশিক তো এবার গ্রাজুয়েশন নিবে সিভিল ইঞ্জিনিয়ার থেকে তোমার সাথে ওর যোগাযোগ নেই ?
- যদিও ওর সাথে আমার কোন কন্ট্রাক নেই কিন্ত জানি ও সিভিল ইঞ্জিনিয়ার পড়ছে।
- কেন নেই ! এটা তো খুব খারাপ কথা , তোমরা একই সাথে পড়তে একই দেশের মানুষ অথচ যোগাযোগ নেই!
- আমাদের ফ্যামেলির কেউ এখনো কুক হতে পারে নাই তো, আপনারা তো আবার যার তার সাথে মিশেন না তাই কখনো কন্ট্রাক করি নাই, বলে আমি চলে এসেছি ।
ভদ্র মহিলা আরো কিছুক্ষণ ভাবীর সাথে কথা বলে যাওয়ার সময় আমার ভাবীকে বলেছে আপনার ননদটা খুব বেয়াদব আর অহংকারী । এবারও ভাবী হাসতে হাসতেই বলেছে আপনি যা বল্লেন, আমার ননদ মোটেও তা নয় ।
২ : মানুষ যখন প্রবাসে আসে তাকে নানা ধরনের সমস্যার সন্মুখীন হতে হয়। আপনজনকে ছেড়ে আসার কষ্ট তো আছেই আবার অচেনা দেশ,অজানা ভাষা, রাস্তা ঘাট, আইন কানুন সব কিছুই অজানা, কষ্ট, শোকে চোখে পানি তখন এমনিতেই চলে আসে ।
এই সময়ে একজন মানুষের অনেক ধরনের হেল্পের প্রয়োজন হয়, এখানে অনেকেই আসে যাদের কোন আপনজন নেই, কিন্ত দেশী কিছু লোকজন আছে। নতুন আসা লোকটা তখন এখানে যে সব দেশী ভাই বোনেরা এখানে সেটেল্ড , বা অনেক দিন ধরেই আছেন তাদের কাছে কিছু হেল্প পাবার আশা করেন। এই সময়ের একটু হেল্প বা সহানুভূতিপূর্ণ একটু কথাও নতুনদের অনেক উপকার হয়, মনটা ভালো লাগে । কিন্ত পুরনোরা এখানে সেটেল্ড হয়ে নিজের প্রাথমিক অবস্থার কথা ভুলে যায় । হেল্প তো পরের কথা এরা নতুনদের দেখলে এড়িয়ে যান, এমন ভাব করেন দেখলে মনে হয় তাঁরা ভি আই পি , সাধারন মানুষের সাথে কথা বল্লে তাদের মান যাবে।(তবে সবাই না কেউ কেউ অবশ্যই ব্যতিক্রম আছে) কেউ হেল্প করুন বা না করুক এক সময় সবাই তার সমস্যা কাটিয়ে উঠে, মনে থেকে যায় মানুষের ব্যবহার ।
আমি তো এসবের মধ্যেই পরি না,আমার ভাবীও অনেকটাই বদলে গিয়েছে, আমার ভাইয়া এখনো বাঙালিই আছেন। এখনো কোন বাঙালি দেখলেই এগিয়ে যেয়ে কথা বলবেন কোন প্রয়োজন থাকলে সামর্থ অনুযায়ী হেল্প করার চেষ্টা করেন, যদিও এর জন্য ভাবীর কাছে প্রায়ই বকা খান। কয়েক দিন আগে ভাইয়া মেট্রোতে কোথাও যাচ্ছিলেন এক বাংলাদেশী দেখে কাছে গিয়ে বসে কথা বলেন তার সম্পর্কে খোঁজ খবর নেন, লোকটা এত বেশী খুশী হয়েছে আবেগে বলেছে,”আল্লাহ আপনাকে দুইশ বছর হায়াত দান করুক”।
ভাইয়া হেসে, এমন দোওয়া তো আল্লাহ কবুল করবে না । কবুল না করুন তবু আমি আপনার জন্য এই দোওয়াই করলাম দুই সপ্তাহ হল এখানে এসেছি যত বাংলাদেশির সাথে দেখা হয়েছে কেউ কথা বলতে চায় না এমন ভাব করে দেখলে মনে হয় আমার সাথে কথা বল্লে তাদের মান যাবে, আমি মিসকিন তারা রাজা বাদশা, আপনি নিজে থেকে আমার সাথে কথা বলেছেন আমার খোঁজ খবর নিলেন, নিজের ভাষায় একটু কথা বলতে পেরে আমার খুব ভাল লাগছে। আমার অন্তর থেকেই আপনার জন্য এই দোয়া বের হয়েছে।
৩ : এখানকার জীবনটা অনেক ব্যস্ত। কিন্ত সপ্তাহে দুইদিন ছুটি থাকে একদিন ঘরের কাজ, ঘর পরিস্কার করা, বাজার করা, কাপড় ধোয়া আর একদিন দাওয়াত, হয় খাবেন, না হয় খাওয়াবেন। অনেকের এখানে আত্বীয় স্বজন আছে আবার যাদের আত্বীয় স্বজন নেই তাদেরও মেলামেশার একটা সার্কেল আছে, সবাই যার যার সার্কেলের ভিতরেই থাকে। এখানে দাওয়াতে সাধারনত খাবার জাতীয় জিনিস নিয়ে যায় না । বাচ্চাদের জন্য ড্রেস থেকে শুরু করে হোম ডেকোরেশনের অনেক ধরণের জিনিসই নেয়। তবে ডিপেন্ড করে কার সাথে কার কেমন সম্পর্ক সেটার ওপর ।
এতে দেখা যায় কয়েক বছর পর আর গিফ্ট কিনতে হয় না শুধু র্যাপিং পেপার কিনলেই হয়, বাসায় অনেক গিফ্ট জমা হয়ে যায়। এমন অনেক জিনিস আসে যেগুলো হয়ত বাসায় আছে আবার অনেক জিনিস পছন্দ হয় না সেগুলো জমা করে রাখা হয় অন্য বাসায় দাওয়াতে যাওয়ার সময় নিয়ে যাওয়া হয়।শুধু খেয়াল রাখতে হবে যার জিনিস আবার যেন তার বাসায়ই নেয়া নেয়া হয়।
এবার আমাদের বাসায় একটা মজার ঘটনা ঘটেছে। দুই বছর আগে এক বাসায় আমরা একটা flower vase নিয়ে গিয়েছিলাম। গত মাসে সেটা আবার আমাদের কাছে ফেরত এসেছে দুই বছরে মাত্র পাঁচ বাসা ঘুরে। বাজারে তো একই রকম জিনিস অনেকই আছে আমাদেরটা কেন হবে তাই তো!! সেটা আমাদেরটাই ছিল শুধু পাঁচবার র্যাপিংপেপার বদল হয়েছে কিন্ত প্যাকেট তো বদল করা হয়নি আর সেই প্যাকেটেই ছিল চিহ্ন। ভাবী এটা কিনে এনে আমাকে দিয়েছিল র্যাপিংপেপার র্যাপ করতে আমি সেটা রেখে শাওয়ারে গিয়েছিলাম এই সময়ে আমাদের বাসার পিচ্চিমনি ছিঁড়ে ফেলে ছিল আর আমি সেটা কষ্টেপ দিয়ে লাগিয়ে ছিলাম। flower vase দেখেই চিনেছিলাম আর শিউর হয়েছি প্যাকেটের চিহ্ন দেখে।পাঁচবাসা ঘুরার ব্যাপারটা আমার ভাবী, একের পর এক জনের সাথে কথা বলে বের করেছেন।
৪ : আমরা তখন খুবই নতুন বিকাল বেলা ভাবীর সাথে পার্কে গিয়েছি এক বাঙালী ভদ্র লোকের সাথে দেখা, ভাবী সালাম টালাম দিয়েছে। ভদ্রলোকও সালামের জবাব দেন। এরপর আরো কথা হয় দুজনের যাওয়ার সময় লোকটা আমার ভাবীকে , আপনারা তো নতুন এসেছেন একটা কথা বলে যাই, বাঙালীদের সাথে মিশবেন না, এখানকার বাঙালীরা খুব খারাপ———- এরা শুধু “আমি আর তুমি”এই নীতিতে চলে। তখন ছোট ছিলাম উনার কথার মিনিংটা না বুঝলেও উনার প্রতি খারাপ একটা ধারনা হয়েছিল। এখন উনার কথার মানেটা বুঝি তবু উনার প্রতি আমার ধারনা পাল্টায় নি।
আচ্ছা! আমি আর তুমি”এই নীতিতে চলে। আপনারা কি কিছু বুঝলেন ?
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২১ বিকাল ৪:২৩