স্কুলে সে সময় বন্ধুরা কেউ বাড়ি থেকে টিফিন নিয়ে আসাতো দূরের কথা, বইখাতা রাখার জন্য কেউ ব্যাগ নিয়ে আসলে সবাই এমন ভাবে তাকাতো যেন আপনি বানর নিয়ে এসেছেন এখন খেলা দেখাবেন বলে। কেউ আবার ডাক দিয়ে বলেই ফেলতো, কিরে ঝুইল্লা লইয়া কই যাস?
তখনকার মর্ডাণ বা শহুরে স্কুলগুলোর কথা বাদ দিলে হয়তো আপনিও কল্পনা করতে পারবেন_ রাস্তায় একদল ছেলেমেয়ে হাঁটছে যাদের একজনের হাতেও স্কুলব্যাগ বা টিফিন বক্স নেই। ক্ষুধাটা কি জিনিশ তখন হয়তো সত্যিই বুঝতাম না।
আমাদের গ্রামের স্কুল, মেঠোপথ আর বৃষ্টির দিনে হাঁটুপর্যন্ত কাঁদা নিয়ে তখনকার বন্ধুত্বপূর্ণ সময়গুলো হ্যমিলিওনের বাঁশিওয়ালার পিছু ছাড়েনি আর সে জন্যই আজ অভাবনীয় এক ক্ষুধার্থ দৃষ্টিতে অতীত খুজে ফিরি .....
ছোটবেলায় স্কুল ছুটির আগে আগে একটা চিনচিনে ক্ষুধা পেটের ভিতর মোচড় দিয়ে উঠত, ঝালমুড়ি আর সাদামিঠা আইসক্রিমের ঝাপটায় যেন দুপুরের পর পেটের অবস্থাটা আগুনে পেট্টোল ঢালার মতো। ছুটির পর চোখ বন্ধ করে ভূ দৌড় বাড়ির পথে, কে কার আগে স্কুলের বাইরে আসতে পারে। এক একজন একেকটা জেটপ্লেনের মতো আগুনজ্বলা রোদেই ছুটে যেতাম বাসার দিকে, ছাতাটা পরে থাকত স্কুলের অফিসরুমের দরজার আড়ালে।
বাসায় ফেরার পরে দেখতাম ছোট কাকা, অথবা পাড়াতো ভাই পুকুরে জাল ফেলছে। বুকের ভিতরটা আবার মোচড়াতে শুরু করত, মাছ ধরি গিয়ে। বই খাতা ফেলেই ছুট, এক দৌড়ে পুকুরের মাঝ বরাবর। এদিকে আম্মার বকাবকি, না খাইয়া দিঘীত নামছস_ জ্বর আনলে রাস্তাত ফালায়ে রাখবাম কিন্তু।
শুনেও শুনতাম না, তখন পেটের ক্ষুধাটা মনে চলে যেত, মাছ ধরবো।
এগুলো তখনকার ক্ষুধার ধরণ, তা পাল্টাতে শুরু হলো_ যখন কলেজে পা পরে।
লাল টুকটুকে গ্ল্যাডিয়েটর সাইকেল, রঙিন মনিটরের একটা মোবাইল। টিপটপ পকেট আর কলেজে তিন ব্যাচ সিনিয়র ভাইয়ার গার্লফ্রেণ্ডের মতো কারো অপেক্ষার ক্ষুধাগুলো তখন যে আমার মতো অন্য কাউকে জাপটে ধরেনি, তা সহসাই আমি মানার পাত্র নই।
সেটাও যায়, ধরণ আবার পাল্টে_ এবার ভালো একটা রেজাল্ট আর গুড গুড স্যুট_টাই পড়তে পারা একটা চাকরির ক্ষুধা। জীবন তামা তামা হয়ে আসা এমন মুহুর্তে কারো সহসা সাক্ষাৎ_ সামনের শুক্রবার ছেলেপক্ষ আমায় দেখতে আসছে_ যতটুকো শুনেছি সবার পছন্দ ঠিক_ বাসায় শুধু আমার হ্যা বলার অপেক্ষা, আমি আর পারছিনা। প্লিজ এবার একটু ভাবো, যা করার করো।
তখনকার সময় দিন পেড়িয়ে বাসর যখন স্বপ্ন সাজায়, ক্ষুধারা আবার লেজ নাড়ায়। বলে চলো বন্ধু গো এহেড__
আমার মনে হয় ক্ষুধারা অক্টোপাসের মতো, সময়ের আষ্টেপৃষ্ঠে হাত পা গুলো জড়িয়ে রেখে আমার চোখে আপনার চোখে রঙ বদলায়। একচ্ছত্র ক্ষমাতার অধীকারি সেজে সময়কে গুনিতকে ভাগ করে সে সিংহভাগটার দখলদারি নেয়, আর মালিকের মতো চাবুক পেটায় যেন আমি তার ইচ্ছায় কামলাখাটা এক শিক্ষিত গাধা।
চলছে, চলছি আমি আর আমরা_ যেন ক্ষুধাতুর সময়ের এক ক্ষুধার্ত মানুষের বেশে ইচ্ছে নামের এক রাক্ষস মালিক রুপে। এই ক্ষুধার্ত জীবনপথে এক ক্ষুধার্ত রাক্ষসবংশ এইডসের মতো ছড়িয়ে দিয়ে, বেঁচে থাকি আমরা পেটে ক্ষুধা নিয়ে বুকে ক্ষুধা নিয়ে, তবুও মনের ক্ষুধাটা ঠিকই জিইয়ে রাখি_ প্রত্যেকের মনের ফ্রিজে। যার গন্ধটা ছুঁয়েযায় মন, এর থেকে ওর, ওর থেকে তার।
হয়তবা এটাই জীবন,
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা নভেম্বর, ২০১৫ ভোর ৫:৪৮