প্রচণ্ড জ্যাম! ভয়াবহ অবস্থা!
আমি রিকশায় বসে দরদর করে ঘামছি। গরমে অতিষ্ঠ। এক চাকা এগুনোর মত ফাঁকা জায়গাও নেই সামনে। পুরো রাস্তা যেন একটি স্থীরচিত্র। স্টিল ফটোগ্রাফি। নো মুভমেন্ট। কিন্তু কান ফাটানো তীব্র শব্দ। গাড়ীর ক্রমাগত হর্ন। পাশে তাকালাম, সাদা ধবধবে এক গাড়ী। নাম জানি না। গাড়ির ভেতরে উচ্চশব্দে ইংরেজী গান বাজছে। কাঁচের ভেতর থেকেও তার সামান্য শব্দ আসছে বাইরে। সানগ্লাস পড়া এক ছেলে মাথা দোলাচ্ছে ছন্দে ছন্দে। তার পাশে এক তরুণী। ছেলেটার আঙুল ক্রমাগত হর্ন চেপে যাচ্ছে। সামনে একটা স্কুল ভ্যান, ৬ টা বাচ্চা বসা। তারা কানে আঙুল চেপে বসে আছে, অসহায় চোখে তাকিয়ে আছে। ভয়ার্ত চোখ। আমি রিকশা থেকে নেমে তার গাড়ির বন্ধ কাঁচে নক করলাম। সে নির্বিকার ভঙ্গীতে মাথা ঘুরিয়ে তাকাল। আমি আঙুলের উল্টোপিঠে আবারও নক করলাম। এবার সে কাঁচ নামাল, 'কি সমস্যা?'
আমি বললাম, 'সমস্যা আমার? না, আপনার?'
সে বলল, 'হোয়াট?'
আমি বললাম, 'আপনি যে কনটিনুয়াসলি হর্ন বাজাচ্ছেন, সামনের গাড়িটা আপনাকে জায়গা দিবে কিভাবে?'
সে বলল, 'সো?'
আমি বললাম, 'সামনে এক চাকা যাওয়ার জায়গা নেই, আপনি যতবারই হর্ন দেন কোন লাভ আছে? নাই। শুধু শুধু হর্ন দিচ্ছেন কেন?
ছেলেটা স্টিয়ারিং হুইল থেকে হাত সরাল, তারপর ঠাণ্ডা গলায় বলল, 'জীবনে গাড়ি চালাইছস?'
আমি বললাম, 'না'।
সে বলল, 'তাইলে এইসব বুঝবি না'।
আমি বললাম, 'সেটা ঠিক আছে, আমি না হয়, বুঝলাম না, কিন্তু সামনে তাকান, ওই স্কুল ভ্যানের বাচ্চাগুলোর দিকে দেখেন, আপনার হর্নের কারণে কানে আঙুল চেপে বসে আছে'।
সে বলল, 'তা তুই যা, গিয়া কানে তুলা চেপে ধর'।
আমি আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলাম, কিন্তু সে এবার মারমুখী হয়ে গেল, বলল, 'গেলি এইখান থেইকা? না কি দিমু বাম দিকে চাপ, হারামজাদা'।
এর সাথে আরও কতগুলো গালি ছিল। সেগুলো এখানে বর্ণনাযোগ্য না। আমি কিছু বলতে পারি নি। হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলাম। ঘটনা কলেজগেট থেকে মোহাম্মদপুর ঢোকার রাস্তায়, রেসিডেনশিয়াল মডেল কলেজের পাশে। আমি চুপচাপ হেঁটে গিয়ে রিকশায় বসে ছিলাম। প্রচণ্ড অপমানিত, লজ্জিত, ক্ষুদ্ধ, হতাশাগ্রস্ত লাগছিল। তারচেয়েও বেশি লাগছিল অসহায়। যতক্ষণ জ্যাম লেগে ছিল, ছেলেটি হর্ন চেপে যাচ্ছিল, গানের ছন্দে ছন্দে মাথা নাচাচ্ছিল। আর আমি বসেছিলাম লজ্জায়, অপমানে, অসহায়ত্বে মাথা নিচু করে। আর ভাছিলাম, কখন জ্যাম ছাড়বে, কখন পালাব? কখন?'
গুলশানে প্রকাশ্যে জনবহুল রাস্তায় গাড়ির রেস করছে দুই কিশোর। সেই রেস করতে গিয়ে রিকশাযাত্রী মা আর তার কোলের শিশুপুত্রকে চাপা দিয়েছে গাড়ি। শিশুপুত্র মারা গিয়েছে। রেস করা কিশোররা আটক হয় নি, গাড়ি কাদের তাও জানা যায় নি। পুলিশ এইসব জানে না। কি করে জানবে, এতবড় শহর, এত এত গাড়ি। কোন গাড়ি কে চালায়, পুলিশ কি করে জানবে! আর জেনেই কি হবে?
আসলেই জেনে কি হবে? সেই মা, সেই মা'টা তার সন্তান হারিয়ে কি করছে? কি করছে? ধুর, এসব জেনে কি হবে? তারপরও খুব জানতে ইচ্ছে করছে, মৃত শিশুপুত্রের মায়ের কথা জানতে ইচ্ছে করছে। তিনি নিশ্চয়ই মাথা নিচু করে বসে আছেন। প্রচণ্ড কষ্টে, অসহায়ত্বে,যন্ত্রণায়। লজ্জায়ও কি নয়? এই সমাজে জন্ম নেয়ার লজ্জায়, বেঁচে থাকার লজ্জায়, মা হবার লজ্জায়! নিশ্চয়ই। এখানে কিছু কিছু জন্মই আজন্ম পাপ। আজন্ম লজ্জা। ওই মাও হয়তো সেই লজ্জায় পালিয়ে যাওয়ার অপেক্ষায় আছেন। জীবন থেকে পালিয়ে যাওয়ার অপেক্ষায়... বসে আছেন লজ্জায়, অপমানে, অসহায়ত্বে মাথা নিচু করে। আর ভাবছেন, কখন জীবনের জ্যাম ছাড়বে, কখন পালাবেন? কখন?'
আর খুনী ছেলেটার মা? তিনি কি করছেন? হিন্দি সিরিয়াল দেখে কেঁদে কেঁদে বুক ভাসাচ্ছেন? আহারে মা! মা, মাগো...
(ফেসবুক থেকে শেয়ার করা)
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই অক্টোবর, ২০১৫ দুপুর ১:৪৭