somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

কোচিং সেন্টার তো বন্ধ করতে চান, কিন্তু তারপর কী?

৩০ শে জানুয়ারি, ২০১৯ বিকাল ৪:৫২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


(১)
ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষার পর আমার জীবনে একটা বিষণ্ণতার আবহ নেমে এসেছিলো। আমি ছাত্র হিসেবে একদম খারাপ ছিলাম না। আমাকে নিয়ে বাবা-মা এবং আত্মীয় স্বজনের উচ্চাশাও ছিলো অনেক। কিন্তু সেই তুলনায় ফলাফল হলো একদম যাচ্ছে তাই! এখন কী হবে এই ছেলের! বায়োলজি নেই, ডাক্তার হতে পারবে না, তাহলে ভর্তি হবে কিসে? বিরস বদনে আমি একটি ইঞ্জিনিয়ারিং কোচিংয়ে ভর্তি হলাম। সেই আমার প্রথম মিরপুর থেকে একা একা বাসার বাইরে যাওয়া বাসে করে। বিশাল ব্যাপার! সেই সময়ে আমি ফার্মগেট থেকে টেম্পুতে করে নীলক্ষেত যাবার রুট চিনে যাই। নীলক্ষেত তখন আমার কাছে এক গুপ্ত সাম্রাজ্য! কতরকম বই, পত্রিকা কম দামে পাওয়া যায়! বিশাল ব্যাপার। কোচিং করতে গিয়েও বেশ অন্যরকম অভিজ্ঞতা হলো। বুয়েটের একজন ভাইয়ার কথা এখনও মনে পড়ে। খুবই ক্যাজুয়াল ভঙ্গিতে এসে নানাভাবে হাসিয়ে কেমিস্ট্রির মত নীরস একটা বিষয়কে উপভোগ্য করে তুললেন। আমার জীবনের সবচেয়ে উপভোগ্য কেমিস্ট্রি ক্লাস ছিলো নিঃসন্দেহে সেটাই। অত আগের কথ সবাইকে এত ভালোভাবে মনে নেই, তবে সেই সময় আমার বিপর্যস্ত অবস্থা কাটিয়ে উঠতে এরকম ঝকঝকে মেধাবী কিছু তরুণ আমাকে সাহায্য করেছিলেন এটা জীবনের স্বর্ণখচিত কোন স্মৃতি না হলেও গুরুত্বপূর্ণ তো বটেই!
এ্যাডমিশন পরীক্ষায় আমি খুব ভালো করলাম। ঢাবির ক ইউনিট, খুলনা ভার্সিটির দুই ইউনিট, কুয়েট (সেইসময় চারটি বিআইটির অখণ্ড পরীক্ষা হতো) সবখানেই চান্স, হুলুস্থুল ব্যাপার! উল্লেখ্য, আমার বুয়েটে পরীক্ষা দেয়ার নাম্বার ছিলো না।

(২)
একটু পেছনে ফেরা যাক। আমার ছোটবেলা কেটেছে মফস্বলে- মফস্বলে। সেখানে শিক্ষার মান কেমন ছিলো এ জাতীয় গুরুগম্ভীর আলোচনায় যাবো না, তবে ক্লাস ফোর পর্যন্ত আমি গরুর রচনা মুখস্থ করা, ছুটি চাহিয়া প্রধান শিক্ষকের কাছে আবেদন, এবং নামতা মুখস্থ করা ছাড়া কিছুই শিখি নি। ক্লাস ফাইভে একটু উন্নত মানের মফস্বলে আসার পর ভালো নামডাক থাকা একটি স্কুলে ভর্তি হলাম, খুব ঝকঝকে রেজাল্টও করলাম, কিন্তু পরের বছর স্কুলে পরিবর্তন করে আরো ভালো স্কুলে যাবার পর আমার এতদিনের অর্জিত সব সুনাম একদম ধুলোয় মিশে গেলো! আমি ইংরেজি প্রথম পত্রে পেলাম ৪৮, দ্বিতীয় পত্রে ৫৪। কেন এরকম হলো আমি কিছুই বুঝলাম না! পরীক্ষা তো ভালোই দিলাম, তাহলে এই অবস্থা কেন! আমার আব্বু খুব গম্ভীর হয়ে গেলেন। নামকরা একজন ইংরেজির শিক্ষক নিয়োগ দিলেন আমাকে পড়ানোর জন্যে। আমি বুঝতে পারলাম, এতদিন যা শিখে এসেছি, সব ভুল! ক্লাস ফাইভে আমাকে দু হাতে নাম্বার বিলিয়ে দেয়া হয়েছে, সে তুলনায় শিখি নি তেমন কিছুই! টেন্স বলে যে একটা জিনিস আছে, এটা যে খুব ভালোমত শিখতে হয়, তাই জানতাম না! এরপর থেকে আমি ইংরেজিতে ভালো করা শুরু করলাম।

ওপরের উদ্দীপকের আড়ালে নিম্নলিখিত সৃজনশীল প্রশ্নগুলির জবাব দিন-
১। কোচিং সেন্টারে ভালো ভালো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের যে ছেলে-মেয়েরা এসে পড়িয়ে যায়, তারা শিক্ষকতা পেশায় আসে না কেন?
২। মফস্বলের প্রত্যন্ত অঞ্চলের স্কুলগুলিতে শিক্ষকতা পেশায় যারা আসেন, তারা কতটুকু যোগ্য?
৩। স্কুলে ভালো মানের শিক্ষা না পেলে ভালো কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে কীভাবে ভর্তি হওয়া সম্ভব?

(৩)
পৃথিবীতে শিক্ষাদানের পদ্ধতির ওপর বিচার করে শিক্ষা ব্যবস্থাকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়। ম্যাসকুলিন, এবং ফেমিনিন। ফিনল্যান্ড, নেদারল্যান্ডের মত দেশগুলিকে বলা যেতে পারে ফেমিনিন। যেখানে অনেক ক্লাস পর্যন্ত হোমওয়ার্ক দেয়া হয় না, শিক্ষার্থীদের ওপর চাপ কম, আবার জাপান, দক্ষিণ কোরিয়ার মত চাপ বেশি। সেখানে স্কুলের পড়ার পাশাপাশি শ্যাডো এডুকেশন বা ছায়াশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতেও প্রচণ্ড চাপ, আমাদের দেশে যাকে কোচিং বলে অবিহিত করা হয়। ফিনল্যান্ডে শিক্ষকতা পেশায় যে কেউ চাইলেই যেতে পারে না। কঠিন মান নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে একজন শিক্ষককে গড়ে তোলা হয়, এবং তাদের বেতনও অত্যন্ত আকর্ষণীয়।
বাংলাদেশে একজন শিক্ষক কত বেতন পান? শিক্ষকতা পেশায় কারা আসেন? শিক্ষকতা পেশা কি খুব আকর্ষণীয়?
প্রথম প্রশ্নের উত্তর- খুবই অল্প বেতন পান। দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তর- কারা আসে সুনির্দিষ্ট করে বলা মুশকিল, তবে আমার কেমিস্ট্রির ক্লাসকে উপভোগ্য করে তোলা বুয়েটের সেই ভাইয়া যে আসেন না, তা নিশ্চিত করে বলতে পারি। এখন শিক্ষকদের বেতন বাড়িয়ে দিলেই কি তারা দক্ষ হয়ে উঠবেন? মোটেও না। একটা বিশাল অংশের শিক্ষকেরা দক্ষ না, আর দক্ষতা থাকলেও তারা ক্লাসরুমে সবার প্রতি সমান মনোযোগ দিতে পারছেন না। এদিকে আপনি চাইছেন আপনার সন্তান ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হোক। যদিও আপনার চাওয়াটা সন্তানের ওপর চাপিয়ে দেয়াটা অন্যায়, তবে ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ারের দরকার আছে বৈকি!
তাহলে আপনাদের এই ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার-সায়েন্টিস্ট-নাসার চাকুরি এই চাহিদাগুলো পূরণ হবে কীভাবে?
উত্তরটা এক কথায় খুব সহজ। শিক্ষার মান ভালো হতে হবে, শিক্ষককে দক্ষ হতে হবে। কিন্তু আপনি সেই মানের শিক্ষক কোথায় পাবেন?

(৪)
আমরা চাই, আমাদের বাচ্চাদের ওপর অযথা চাপ প্রয়োগ করা হবে না, কিন্তু তাকে বড় হয়ে ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হতেই হবে।
আমরা চাই উচ্চমানের শিক্ষা, কিন্তু শিক্ষকতা পেশায় আমরা কেউ যেতে চাই না।
আমরা চাই দ্রুত সমাধান। একটা সুইচ টিপে দিলেই হয়ে গেলো! প্রশ্নফাঁস ঠেকাতে হবে? ঠিক আছে মাল্টিপল চয়েজ বন্ধ করে দেখা যাক! না না, ওতে কাজ হবে না, কোচিং সেন্টার বন্ধ রাখো কিছুদিন। সে কী, তারপরেও প্রশ্নফাঁস হচ্ছে আচ্ছা, দেখা যাক পরের কোপ কার ঘাড়ে ফেলা যায়!

(৫)
শিক্ষা মানুষের মৌলিক অধিকার। এটা নিয়ে বাণিজ্য চলবে না, খুবই চমৎকার সংলাপ, তেজোদ্দীপ্তও বটে। আমার ভালো লেগেছে লাইনটা। আগেকার দিনে পণ্ডিতমশাইয়েরা গাছতলায় টোল খুলে শিক্ষাদান করতেন, বিনিময়ে কলাটা-মূলোটা নিতেন, এমন চমৎকার যুগে তো ফিরে যাওয়া সম্ভব না, এখন হচ্ছে ওপেন মার্কেটের যুগ। যে ভালো সেবা দিবে, সেই টিকে থাকবে এটাই নিয়ম। যে ভালো সেবা দিবে না, তাকে মার্কেটই টিকে থাকতে দিবে না। খুব কর্কশ লাগছে শুনতে কথাগুলি?
আমি আমার ছেলেমেয়েদের ওপর ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার-বিসিএস ক্যাডার হবার দায়ভার চাপিয়ে দেবো না, কিন্তু এটা চাইবো, তারা যেন যা শিখছে, ভালোভাবে শেখে। তারা যেখান থেকে ভালোভাবে শিখতে পারবে, সেখানেই পাঠাবো।
শিক্ষা পবিত্র, এ নিয়ে ব্যবসা চলবে না, এরকম জ্বালাময়ী বক্তৃতায় আসলে আর বিশ্বাস করি না এখন। ব্যবসা দুইরকম হয়, প্রোডাক্ট ওরিয়েন্টেড, আর সার্ভিস ওরিয়েন্টেড। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, এগুলো নিয়ে ব্যবসা হলো সার্ভিস ওরিয়েন্টেড, আর খাদ্য পোষাক, এগুলো নিয়ে ব্যবসা হলো প্রোডাক্ট ওরিয়েন্টেড। খাদ্য আমাদের মৌলিক অধিকার, খাদ্য নিয়ে যারা ব্যবসা করে, তাদের কাছ থেকে বেশি দামে ভালো খাদ্যটিই নিতে চাইবো, বস্ত্র মৌলিক অধিকার হলেও আমি বেশি দামে ভালো বস্ত্র কেনার প্রয়োজন অনুভব করি না। স্বাস্থ্য মৌলিক অধিকার, এক্ষেত্রে কোন ছাড় নেই, এদিকে বাসস্থানের ক্ষেত্রে আমি মোটামুটি মাথা গোঁজা যায়, এমন জায়গা হলেই সন্তুষ্ট।

(৬)
ব্যাপারটা হচ্ছে প্রায়োরিটির। আপনি কোনটাকে কেমন প্রায়োরিটি দেন। শিক্ষা আমার কাছে হাই প্রায়োরিটির ব্যাপার। অনেক জায়গাতেই শিক্ষা ব্যাপারটা আর সার্ভিস ওরিয়েন্টেড নেই, প্রোডাক্ট ওরিয়েন্টেড হয়ে গেছে। সেটা স্কুল বা কোচিং সেন্টার দুই ক্ষেত্রেই। আমি চাই সার্ভিস। আমি চাই, যিনি শেখাবেন, তার সর্বোচ্চ পর্যায়ের দক্ষতা থাকবে, এবং ভালোভাবে, আনন্দের সাথে শেখাবেন। ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত এই আনন্দ আমি পাই নি কোথাও, যেটা ইন্টারমিডিয়েটের পরে কোচিংয়ে সেই ভাইয়ার কেমিস্ট্রির ক্লাসে পেয়েছি, অথবা ক্লাস সিক্সে ইংরেজিতে ফল বিপর্যয়ের পর গৃহশিক্ষক হিসেবে যাকে পেয়েছিলাম। আমি এমন কারো কাছেই পাঠাতে চাই আমার বাচ্চাদের। কিন্তু কোথায় পাবো তাদের?

(৭)
এই ভিডিওটি মন দিয়ে দেখুন, অনেক কিছু স্পষ্ট হবে।

সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে জানুয়ারি, ২০১৯ সন্ধ্যা ৬:১২
২৩টি মন্তব্য ২১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ডালাসবাসীর নিউ ইয়র্ক ভ্রমণ

লিখেছেন মঞ্জুর চৌধুরী, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ২:৪৪

গত পাঁচ ছয় বছর ধরেই নানান কারণে প্রতিবছর আমার নিউইয়র্ক যাওয়া হয়। বিশ্ব অর্থনীতির রাজধানী, ব্রডওয়ে থিয়েটারের রাজধানী ইত্যাদি নানান পরিচয় থাকলেও আমার কাছে নিউইয়র্ককে আমার মত করেই ভাল ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

ধর্ম ও বিজ্ঞান

লিখেছেন এমএলজি, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:২৪

করোনার (COVID) শুরুর দিকে আমি দেশবাসীর কাছে উদাত্ত আহবান জানিয়ে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম, যা শেয়ার হয়েছিল প্রায় ৩ হাজারবার। জীবন বাঁচাতে মরিয়া পাঠকবৃন্দ আশা করেছিলেন এ পোস্ট শেয়ারে কেউ একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

তালগোল

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৩৫


তু‌মি যাও চ‌লে
আ‌মি যাই গ‌লে
চ‌লে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফু‌রা‌লেই দি‌নের আ‌লোয় ফর্সা
ঘু‌রেঘু‌রে ফি‌রে‌তো আ‌সে, আ‌সে‌তো ফি‌রে
তু‌মি চ‌লে যাও, তু‌মি চ‌লে যাও, আমা‌কে ঘি‌রে
জড়ায়ে মোহ বাতা‌সে ম‌দির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

মা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৩


মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।

অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:১৮



একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×