somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ব্লাইন্ডফোল্ডেড থেমিস, বৈশাখী কালচার, উগ্রবাদ: কে কার দুশমন

১৩ ই এপ্রিল, ২০১৭ দুপুর ১:৪১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



গ্রীক রূপকথার কাছে শুধু আমাদের মজার শৈশবটাই ঋণী তা নয়, গ্রীক সভ্যতা ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের কাছেও আধুনিক সভ্যতার দায় অনেক। আধুনিক চিন্তা-ভাবনা বা দর্শনের উৎস সেই গ্রীস। স্থাপত্যবিদ্যার ক্ষেত্রেও পথ দেখিয়েছে তারাই। পৃথিবীর নামকরা সব বিশ্ববিদ্যালয় আজকের দিনে স্থাপত্যবিদ্যায় পাঠ দান করা হয়। ভাস্করগণ মনের সকল সৃজনীশক্তি একসাথে করে জড়ের মধ্যে ফুটিয়ে তোলেন প্রাণ, তুলে ধরেন জীবন-জীবিকার গল্প, আন্দোলন-সংগ্রামের ইতিহাস। পৃথিবীর প্রায় প্রত্যেকটি দেশ তাদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে প্রাণ দান করেছে ভাস্কর্যের মাধ্যমে। পৃথিবীর প্রত্যেকটি বড় বড় শহরে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে অপরূপ সুন্দর সব জড়ভাস্কর্য। না জানলে অবাক হওয়া স্বাভাবিক- মধ্যপ্রাচ্যে ভাস্কর্যের যেন ছড়াছড়ি, অর্থাৎ মুসলিম দেশগুলোতে ভাস্কর্য হারাম- এইসব ছলচাতুরি পৃথিবীর কোথাও চলে না। আমরা আজকের দিনেও অবাক হয়ে দেখি, সেই ছলচাতুরিগুলো চলে বাংলাদেশে। আর সেদেশের প্রধানমন্ত্রী সমর্থন জানান কিছু বুদ্ধিহীনের অন্যায় আবদারে। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘এটা কেন করা হলো, কারা করল, কীভাবে—আমি জানি না। ইতিমধ্যেই আমাদের প্রধান বিচারপতিকে আমি এই খবরটা দিয়েছি এবং খুব শিগগির আমি ওনার সঙ্গে এ বিষয় নিয়ে বসব। আলোচনা করব এবং আমি নিজেও ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, এটা এখানে থাকা উচিত নয়।’(সূত্র: প্রথম আলো)

হাইকোর্টে থেমিসের ভাস্কর্য কারা কবে করেছে তা আমি জানিনা। তবে কেন করেছে তার উত্তর খোঁজার চেষ্টা আমি করেছি। থেমিস গ্রীক দেবী, যিনি ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারতেন। মৃত্যুর পর মানুষ স্বর্গ পাবে না নরকে যাবে- তার বিচার করতেন। প্রতিটি মানুষকে যেন তিনি সমান ভেবে এই বিচারটুকু করতে পারেন- সেই জন্যই চোখে কালোকাপড় বাঁধা, যেন মুখ না চিনে বিচার করা। তাঁর ডান হাতে তলোয়াড়- যা শক্তির প্রতীক। বাম হাতে নিক্তি। সেই দৃঢ়চেতা দেবীর প্রতিমূর্তিটি আমাদের সর্বোচ্চ বিচারালয়ে স্থাপিত- যা বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থার পক্ষপাতহীনতা ও শক্তিমত্তার প্রকাশক। এখন প্রশ্ন হল- কেন গ্রীক দেবী। অন্য কিছু ছিল না? হ্যা ছিল। তবে জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রায় প্রত্যেকটি শাখায় গ্রীকদের এতবেশি অবদান যে তাঁদের সম্মানার্থেই আমরা অনেক স্থানেই তাঁদেরকে তুলে ধরি- জেনে অথবা না জেনে। এই থেমিসের মূর্তি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে স্থাপিত আছে ন্যায়ের প্রতীক হিসাবে। সুইজারল্যান্ডের বার্নে, ব্রাজিলের সুপ্রিম কোর্টে, ইটালির রোমের ‘প্যালেস অব জাস্টিস’ এ, জর্মানির ফ্রাঙ্কফুর্টে, কানাডার সুপ্রিম কোর্টে, লন্ডনের ’সেন্ট্রাল ক্রিমিনাল কোর্ট’ এ, জাপানের শিবুয়া-কু তে, চেকরিপাব্লিকে, জাপানের চৌ ইউনিভার্সিটিতে, যুক্তরাষ্ট্রের টেনিসি তে, ইরানের তেহরানে, অস্ট্রেলিয়ার কুইন্সল্যান্ড সহ আরও অনেক দেশের গুরুত্বপূর্ণ সব ভবনে থেমিসের ভাস্কর্য চোখে পড়ে। তাই, এই লেখাটি পড়ার পর এই ভাস্কর্যের গুরুত্ব বা তাৎপর্য নিয়ে কথা বলার আগে অনেকবার করে ভাবতে বসুন। এবার বোঝা সহজ- কেন আমাদের হাইকোর্টের সামনে এই ভাস্কর্যটি স্থাপিত হয়েছে।


ভাস্কর্য ভেঙ্গে ফেলার বর্বরতাগুলোও বেশ পুরোনো। কোন অন্যায় ভাস্কর্য ভেঙ্গে ফেলা নন্দিত ব্যাপার। সত্যজিৎ রায়ের ‘হিরক রাজার দেশে’ তে একেবারে শেষে সবাই দড়ি ধরে টেনে হিরক রাজার মূর্তি ভেঙ্গে ফেলে- এমনকি সে দলে ছিলেন মগজভ্রষ্ট হিরকরাজা নিজেও। পাকিস্তানি সৈন্যরাও পূণ্যকাজ মনে করে শহীদমিনারটা গুড়িয়ে দিয়েছিল। আমাদের কাছে সেটা অন্যায়, পাপকাজ। তাই আমরা আবারও সেটাকে স্বমহিমায় স্থাপন করেছিলাম। আজকের দিনে আবারও সেগুলো গুড়িয়ে দেয়ার মানসিকতার চাষ হচ্ছে- একেবারে সরকারী পৃষ্ঠপোষকতায়! ২০০৮ এ বিমানবন্দর সড়কের লালন ভাস্কর্যের উপর প্রথমে হামলা চালানো হয়। পরে প্রশাসন নিজে থেকেই সেটা সরিয়ে নেয়! উস্কানি পাওয়া উগ্রতা হয়ে যায় অনেক বেশি ভয়ঙ্কর। ওই বছরই নির্বোধেরা আক্রমন করে মতিঝিলের বলাকা ভাস্কর্য। সেই নির্বোধরা বেশ কিছুদিন চুপ ছিল। আবার মাথাচারা দিচ্ছে। এই নির্বোধরা যদি এরপরে বলে যে- শহীদ মিনার কেন, রাজু ভাস্কর্য কেন- ওগুলোও ভাঙতে হবে- তখনও কি প্রিয় প্রধানমন্ত্রী সেগুলো মেনে নেবেন? এরা এই দাবী করবেই, আজ অথবা কাল- থেমিসের মত ভবিষ্যৎদ্রষ্টা হয়ে বলে দিলাম!

১৯৯৬ তে আফগানিস্থানে তালেবানরা ক্ষমতা পায়। ক্ষমতা পাওয়ার পর থেকেই তারা সেদেশের গুরুত্বপূর্ণ সব ভাস্কর্য ধর্মের দোহাই দিয়ে ভেঙ্গে ফেলা শুরু করে। ২০০১ সালে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বৌদ্ধমূর্তি ‘বামিয়ান ভাস্কর্য’ তারা ভেঙ্গে ফেলে। ইরানের মসুল শহরে জঙ্গীগোষ্ঠী আইএস একটি যাদুঘরের সব ভাস্কর্য ভেঙ্গে ফেলে। আজকের দিনে বাংলাদেশে সেই একই মানসিকতার চাষ হচ্ছে। অতএব, যারা মনে করেন এইসব ভাস্কর্য ভেঙ্গে ফেলা উচিত- তারা কাদের মন-মানসিকতায় ডাল-ভাত খাচ্ছেন, বুঝে নেন। ভাস্কর্য একটি জাতির সভ্যতা ও সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। আামদের দেশের ভাস্কর্যগুলো কোনটা মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি ধারন করে, কোনটা দেশের জল-মাটি-কৃষির চিত্র বয়ে বেড়ায়। এগুলো ধ্বংস মানে দেশের সংস্কৃতির একটি ডানা কেটে ফেলা। দেশে ভাস্কর্য ধ্বংসলীলা শুরু হতে পারে ন্যায়ের দেবী থেমিসকে দিয়েই। আমরা প্রস্তুত তো?

কিছু উদ্ভট তথ্য যোগ করি। পৃথিবীর সবথেকে বড় মুসলিম অধ্যুষিত দেশ ইন্দোনেশিয়া। সেখানে রয়েছে অসংখ্য বৌদ্ধমূর্তি, ভাস্কর্য। ইন্দোনেশিয়ার জাতীয় আকাশ পরিবহন সংস্থার নাম Garuda Indonesia. এই গরুড় পাখিটির বর্ণনা পাওয়া যায় রামায়ণে। তিনি বিষ্ণুদেবের বাহন এবং সেখানে থেকেই এর নামকরণ। কবিগুরু লিখেছিলেন- “গরুড়ের পাখা রক্ত রবির রাগে যেন গো অস্ত-আকাশে/ সুন্দরবটে তব অঙ্গদখানি তারায় তারায় খচিত”। অবাক লাগছে কি? আর পহেলা বৈশাখে বর্ষবরণ র‌্যালী হিন্দুয়ানী কালচার- এমন মতবাদের চাষ এ বাংলায় একেবারেই নতুন নয়। বাঙালি বর্ষবরণ করবেই- এটাই সত্য। সম্রাট আকবর খাজনা আদায়ের জন্য যে নতুন বাংলাসাল গণনাপদ্ধতি শুরু করেন- কালের ব্যাবধানে সেটাই হয়ে গেছে বিধর্মী কালচার! এই চেতনার গোড়া এক, অভিন্ন নয় কোনভাবেই। যে চেতনা বর্ষবরণ বানচাল করে, সেই একই চেতনা ভাস্কর্য ধ্বংস করে। মমতা ব্যাণার্জী পানি দেবেন কি দেবেন না- সেটা ভবিষ্যতের হাতে। তবে প্রধানমন্ত্রীর প্রচেষ্টা এবং প্রধানমন্ত্রী দেশে ফেরার পর জনদুর্ভোগের কথা চিন্তা করে তাঁকে সংবর্ধনা না জানানোর সিদ্ধান্ত- দুটোই আমার মন ছুঁয়ে গেছে। হঠাৎ মনে পড়ে নব্বই-এর দশকের একটা ভয়ার্ত কথা। সেসময় আওয়ামীলীগ একটি দেশদ্রোহী দলের সাথে এক টেবিলে বসেছিল। ভুল করেছিল। ভয় হয়, আজকের দিনে এসেও সেই একই ভুলটা আবারও হচ্ছে না তো? ভয়গুলো তোলা থাক। সময়ের কাঁধে অনেক ভার। সে ভার নামলেই সব উত্তর ফিরে ফিরে ঠেকবে। শাস্তি হবে পাপের ও পাপীর।।

সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই এপ্রিল, ২০১৭ দুপুর ১:৪২
৯টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আপনি কি বেদ, উপনিষদ, পুরাণ, ঋগ্বেদ এর তত্ত্ব বিশ্বাস করেন?

লিখেছেন শেরজা তপন, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৫২


ব্লগে কেন বারবার কোরআন ও ইসলামকে টেনে আনা হয়? আর এই ধর্ম বিশ্বাসকে নিয়েই তর্ক বিতর্কে জড়িয়ে পড়ে সবাই? অন্য ধর্ম কেন ব্লগে তেমন আলোচনা হয় না? আমাদের ভারত... ...বাকিটুকু পড়ুন

দুলে উঠে

লিখেছেন সাইফুলসাইফসাই, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:৫৬

দুলে উঠে
সাইফুল ইসলাম সাঈফ

মন খুশিতে দুলে দুলে ‍উঠে
যখনই শুনতে পাই ঈদ শীঘ্রই
আসছে সুখকর করতে দিন, মুহূর্ত
তা প্রায় সবাকে করে আনন্দিত!
নতুন রঙিন পোশাক আনে কিনে
তখন ঐশী বাণী সবাই শুনে।
যদি কারো মনে... ...বাকিটুকু পড়ুন

তরে নিয়ে এ ভাবনা

লিখেছেন মৌন পাঠক, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১০:৩০

তরে নিয়ে এ ভাবনা,
এর শুরু ঠিক আজ না

সেই কৈশোরে পা দেয়ার দিন
যখন পুরো দুনিয়া রঙীন
দিকে দিকে ফোটে ফুল বসন্ত বিহীন
চেনা সব মানুষগুলো, হয়ে ওঠে অচিন
জীবনের আবর্তে, জীবন নবীন

তোকে দেখেছিলাম,... ...বাকিটুকু পড়ুন

আপনি কি পথখাবার খান? তাহলে এই লেখাটি আপনার জন্য

লিখেছেন মিশু মিলন, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১০:৩৪

আগে যখন মাঝে মাঝে বিকেল-সন্ধ্যায় বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতাম, তখন খাবার নিয়ে আমার জন্য ওরা বেশ বিড়ম্বনায় পড়ত। আমি পথখাবার খাই না। ফলে সোরওয়ার্দী উদ্যানে আড্ডা দিতে দিতে ক্ষিধে পেলে... ...বাকিটুকু পড়ুন

কষ্ট থেকে আত্মরক্ষা করতে চাই

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৯



দেহটা মনের সাথে দৌড়ে পারে না
মন উড়ে চলে যায় বহু দূর স্থানে
ক্লান্ত দেহ পড়ে থাকে বিশ্রামে
একরাশ হতাশায় মন দেহে ফিরে।

সময়ের চাকা ঘুরতে থাকে অবিরত
কি অর্জন হলো হিসাব... ...বাকিটুকু পড়ুন

×