এই এভাবে চালাচ্ছো কেনো?
'আরে ভয় পেয়ো না, দেখছোনা একদোম ফাঁকা রোড, মাঝে মাঝে হাতটা ঠিক করেনিতে হয়।'
'হাত ঠিক করার দুনিয়ায় আর কোন মানুষ নেই? তোমাকেই শুধু হাত ঠিক করতে হবে? তা হাত ঠিক করে করবেটা কি শুনি?'
'তোমার না যতসব উদ্ভট কথাবার্তা। হাত ঠিক করে আবার কি করবো। এমনিই।'
এ সময় শিমুর পাশে বসে থাকা অন্তু বলে ওঠে, মামনী আমি হিসু করব। হার্ডব্রেক কষে হিমেল। পেছনে বসা মা ছেলে দুজনেই চমকে ওঠে।
'এ্যাই তোমার সেন্স নাই' চিৎকার করে বলে ওঠে শিমু। ' আরে ভয় পাও কেনো, আমি আছি না! হেসে উত্তর দেয় হিমেল।' আমার ছেলে মুখ দিয়ে বলে ফেলেছে হিসু করবে, গাড়ী চলে কি করে।' বলেই অন্তুর দিকে হাসি মুখে তাকিয়ে বলে, 'কিরে ব্যাটা কি বলিস?' হেসে ওঠে অন্তু।
'আচ্ছা, এখানে খাবার দাবার খুব সমস্যা হয়ে যাবে মনে হচ্ছে।'
'তোমাকে আগেই বলেছিলাম, খাবার কিনে নাও। আমার কথা তো শুনোনা। যখন ধরা খাও, বিড়ালের মতো মুখটা করে বসে থাকো।'
'তাহলে কি ব্যাক করবো?'
শিমু কিছু বলার আগেই অন্তু বলে ওঠে, 'না বাপি আমি ঘুরবো, আমি ঘুরবো।' ওকে ধমকে ওঠে শিমু, 'এ্যাই, হয়েছিস তো একদম বাপের মতো, সময় অসময় বুঝে না।ঘুরবো।'
'তুমি আমার আব্বুকে বকছো কেনো? বাবার দোষে তুমি তার ছেলে কে বকবে এটা কোন দেশের নিয়ম?'
খুনসুটি চলতে থাকে, চলতেই থাকে।
পর পর কয়েকটা হোটেল পেরিয়ে একটা হোটেলে ঢুকে ওরা। ' নাহ্, আগেরটাই বোধ হয় ভালো ছিল। ব্যাক করবে?' শিমুকে জিজ্ঞেস করে হিমেল। শিমু কিছু বলার আগে নিজেই উত্তর দেয়, থাক নাহয়, কি বলো? একবার ই তো খাব।'
'এখন আমাকে কেনো জিজ্ঞেস করছো? তোমার মনে যা চায় করো। আমি কিছু বলবনা।' ঘটিতব্য ভবিষ্যত চিন্তা করে বেড়িয়ে যাচ্ছিল হিমেল। শিমুর বুঝি একটু মায়া হলো। বলল, 'ঠিক আছে বসো এখানেই।'
খাবার দেখে নিজের উপর মেজাজ খারাপ হচ্ছিল শিমুর। হিমেল চুপচাপ অন্তুকে খাওয়াচ্ছিল। শিমুকে খাবার নাড়া চারা করতে দেখে হিমেল বলল, কতো বার করে বললাম চলো চলে যাই। আগের হোটেলটাই ভালো ছিল। তখন মনে ছিল না, উনি এই হোটেলেই খাবে। এক বেলার খাবারইতো! ভয়ে শিমুর দিকে তাকাচ্ছিল না হিমেল।
বাজপাখির মতো ওর দিকে তাকিয়ে ছিল শিমু,যে কোন মুহূর্তে ঠোকর দিবে। এটা ওদের পুরোনো ব্যাপার। নিজে দোষ করে সেটা শিমুর উপর চাপানো হিমেলের অনেক আগের স্বভাব। শিমুর বিষয়টা অনেক ভালো লাগে। অথচ এমন ভাব করে যেনো অনেক রেগে যাচ্ছে। তার ধারনা হিমেল এটা বুঝতে পারেনা। কিন্তু হিমেল ঠিকই বুঝতে পারে।
একটা অল্প বয়স্ক তরুন হোটেলে ঢুকতেই ওয়েটার এগিয়ে যায়। 'কি খাবেন মামা?' বলে খাবারের নাম বলতে থাকে। ছেলেটা কিছুক্ষন চিন্তা করে বলে, 'ডিম নাই?'
'না মামা এখানে ডিম পাবেন না।'
'সবজি নাই?'
'শুধু সবজি দেয়া হয় না।'
'সিঙ্গারা বা পুড়ি?'
'এগুলো বিকেলে পাবেন। এখন আপনি সাদা ভাত আর গরুর মাংস খেতে পারেন।'
'গরুর মাংসের দাম কতো?'
ওয়েটার দাম বলার ছেলেটি বলল, 'এতো দাম!' চলে যাচ্ছিল ছেলেটি।
হিমেলরা সবই শুনছিল। শিমু বলল, 'কি আজব ছেলেরে বাবা! এভাবে দামাদামি করে কেউ খায়! এরকম ছেলে জীবনেও দেখি নি।'
হিমেল প্রথমে মজা পাচ্ছিল। শিমুর কথাটা শুনল। কিন্তু হঠাৎ ছেলেটিকে এভাবে চলে যেতে দেখে ওয়েটার কে ডাকল।
'ছেলেটিকে ডাক তো।'
'বাদ দেন সার। এরকম কত পাবলিক আহে।'
'তোমাকে যা করতে বলেছি করো।'
শিমু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে 'তোমার আবার কি হলো?'
হিমেল কোন জবাব দেয় না। ততোক্ষনে ছেলেটিকে ডেকে নিয়ে এসেছে ওয়েটার। হিমেল বলল, ও যা খেতে চায়, দাও। আমি বিল দেব।'
ছেলেটি কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল। ওকে থামিয়ে হিমেল বলল, 'ঠিক আছে বড় ভাই মনে করেই না হয় খাও।'
হিমেলের কথায় এমন কিছু একটা ছিল, আর কথা বাড়ালো না ছেলেটি।
হিমেলের কর্মকান্ডে লজ্জায় মরে যাচ্ছিল শিমু। মুখে কিছু বলল না। পরে ভালো ভাবে ধরতে হবে। হাজী মুহম্মদ মুহসিন হতে তাকে কে বলেছে!
খাচ্ছিল না হিমেল। ওর নাড়াচারা দেখে শিমু বলল, কি ব্যাপার খাচ্ছ না কেনো?'
শিমুর কথায় মাথা তুলতেই ভেঁজা চোখে জমে ওঠা জলের ফোটাটা পড়ে গেলো। অবাক হয়ে গেলো শিমু। রাগ টাগ বাদ দিয়ে আৎকে উঠল, 'কি হয়েছে তোমার? এমন করছ কেনো?'
'কিছু না।'
'বলো আমাকে?'
কিছু হয় নি, তাড়াতারি খাবার শেষ করো। অন্তুকে জিজ্ঞেস করে, 'আরো খাবে, বাবা?' অন্তু মাথা নাড়ে খাবে না। হাত ধোয়ার পানি দিতে ওয়েটার কে ডাকে।
আকাশটা মেঘলা। চাঁদ দেখে মনে হচ্ছে কয়েক দিন পরেই বুঝি পূর্নিমা। ব্যালকনিতে বসে আছে হিমেল। একটুকরো মেঘে চাঁদটা ঢেকে যায়।
অন্তু কে ঘুম পাড়িয়ে শিমু ওর পাশে এসে বসে। দুজনেই চুপচাপ।
হঠাৎ হিমেল বলে ওঠে, 'আমি যখন কলেজে পড়তাম তখন অনেক বার এমন হয়েছে আমি হোটেলের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। পকেটে কত টাকা আছে। খাবার বিল কত হবে, এসব দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভেবেছি। এমন অনেক সময় হয়েছে যে, না খেয়েই চলে এসেছি। আজ অনেক দিন পরে সেই ছেলেটিকে দেখে অতীতে ফিরে গিয়েছিলাম। সেই ছেলেটি যেনো শুধুই একটা ছেলে নয়, আমি নিজেই। ঐ ছেলেটির মধ্যে আমি আমার নিজেকেই দেখেছি।'
শিমু তখন অনেক দূরে। অনেক দিন মাস বছর আগের একটা মেসে, ঝুলে থাকা লোকাল বাসে, বিষন্নতায় ঘেরা কোন বিকেলে উদভ্রান্ত এলোমেলো কোন পথে তার মানুষটাকে খুঁজে ফিরছে। পরম মমতা নিয়ে একটা হাত সে রাখে হিমেলের পিঠে। হিমেল চমকে তাকায় তার দিকে।
মেঘ কেটে বেড়িয়ে এসেছে চাঁদ। চাঁদের আলোয় চকচক করে ওঠে শিমুর চোখের জল। আলতো হাতে চোখ মুছে দিয়ে হিমেল ওকে কাছে টেনে নেয়।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



