শেষ বিকেল। এয়ারপোর্টের ঝামেলা মিটিয়ে শুভ পা রাখল ভ্যালেন্সিয়ায় । এই নিয়ে তৃতীয় বার। তাকে রিসিভ করার জন্য জেন এর আসার কথা ছিল। কী একটা ঝামেলায় শেষ পর্যন্ত আসতে পারেনি। তবে শুভর সাথে সে দেখা করবে হোটেলে। শুভর সাথে জেনের ব্যাক্তিগত কোন সম্পর্ক নেই। জেন একটা গাইড। টুরিস্ট গাইড। শুভ নিতান্তই ভদ্রতার কারনে ওকে আসতে বলেছিল। তা না হলে জেন কে তারও তেমন প্রয়োজন নেই।
রাত আটটা। শুভ রুম থেকে বের হলো। নিচে রিসিপশনে তার জন্য বসে আছে জেন। প্রাথমিক হাই হ্যালো শেষ করে ওরা বেরিয়ে এলো। উদ্দেশ্য টুকটাক ঘোরাঘুরি আর রাতের খাবারটা এক সাথে খাওয়া।
" তুমি কি সত্যিই কাল চলে যাবে?" জেন জানতে চাইল।
" সেরকমই তো প্লান করা।" শুভ জবাব দিল।
"আমাকে সব সময় নতুন নতুন মানুষের সাথে কাজ করতে হয়।আমি তোমার মত মানুষ জীবনেও দেখিনি।"
শুভ কিছু না বলে একটু হাসল।
"তুমি বলেছিলে সামিরার ব্যাপারটা আমাকে বলবে। তোমার এখানে আসার কারনটাও বলবে। আশা করি তোমার ইচ্ছে বদলায় নি।"
শুভ আবারো হাসল। মুখে কিছু বলল না।
শুভ এই শহরে প্রথম যখন আসে কাউকেই চিনত না। ট্যাক্সি ড্রাইভার কে দিয়ে সে একটা হোটেলে উঠেছিল। সেখান থেকেই শুভর সাথে ওর পরিচয়। গাইড হিসেবে জেন সেখানে কাজ করতো। শুভ জেন কে বলেছিল এমন জায়গায় নিয়ে যেতে যেখান থেকে পুরো শহরটা কে দেখা যায়। জেন ওকে শহরের সবচেয়ে উচু শপিং মলে নিয়ে গিয়েছিল। টপ ফ্লোরে ছিল একটা ফুড কোর্ট সেখান থেকে সত্যিই শহরটাকে দেখা যায়। সেখানে অনেকটা সময় বসে থাকার পর জেন যখন বলেছিল "তুমি কী এখানেই দিনটা কাটিয়ে দিবে নাকি?"
'জেন, আমি আসলেই দিনটা এখানে কাটিয়ে দিতে চাইছি। তোমাকে আমার আর দরকার পড়বে না। আমার মনে হয় তুমি চলে যেতে পারো।"
"একি বলছ তুমি!" জেনের কন্ঠে বিস্ময়। সে কথা শেষ করে না। শুভ ব্যাপারটা বুঝতে পারে। সে বলে, "জেন, আমি তোমাকে পুরো দিনের জন্যই পে করবো। আমি কাল চলে যাচ্ছি। তুমি সন্ধ্যার পর দেখা করো হোটেলে।"
বিকেল টা শুভ একাই শহরে হেটে কাটায়। রাতে লাঞ্চ করে জেনের সাথে।
পরের বছরও শুভ আসে এখানে। একই দিন, একই হোটেল, যদিও গাইডের দরকার ছিল না। তবুও সেই একই গাইড। জেন। সেবারও শুভ একই ফুড কোর্টে একটা লম্বা সময় কাটিয়ে ছিল। একই ভাবে উদ্দেশ্যহীন ভাবে ঘুরে কাটিয়েছিল ভ্যালেন্সিয়ার পথ। জেন কে শুধু জিজ্ঞেস করেছিল, "তুমি সামিরা নামের কাউকে চিন?"
"হ্যা, অনেক কেই। কেন বলোতো?"
"না। এমনি।"
জেনের অনেক রিকোয়েস্টে সে বলেছিল এর পরের বার এসে বলব।
মেইলে যোগাযোগের কারনে এবার কিছুটা সাবলিল সম্পর্কে গড়ে ওঠে ওদের। সকাল দশটার দিকে জেন আসে। শুভ চলে আসে সেই পুরোনো জায়গায়। সাথে জেন।
" তুমি বাংলাদেশ থেকে এখানে আস কী শুধু এখানে বসে থাকার কারনে? আমি জীবনে অনেক মানুষ দেখেছি তোমার মতো কাউকে দেখি নি।"
হালকা হাসে শুভ। "কেউ কারো মতো হয় না জেন। পৃথিবীর ছয়শ কোটি মানুষ ছয়শ কোটি রকম। এক জনের সাথে আরেক জনের কিছু কিছু মিল পাওয়া যায়। পুরোপুরি মিল হয় না।"
"তবুও, তোমার কী বিরক্তি লাগে না? তুমি প্রতি বছর একই জায়গায় এসে বসে থাক।"
"আমার জগতটা অনেক ছোট জেন। আর যাদের বাস্তব জগৎ ছোট তাদের মনের জগতটা অনেক বড় হয়। আমি বেশির ভাগ সময় এই মনের জগতে বাস করি।"
"আচ্ছাএবার সমিরার কথা বলো।"
শুভ হাসে।
"হেসে এবার পার পাবে না।"
"তুমি আমাকে পাগল ভাববে।"
"আশ্চর্য! তোমাকে পাগল কী ভাবব। তুমিতো পাগলই।"
"দেখো, বলব না কিন্তু।"
না না, তুমি খুব ভালো। এবার বল।"
কিছুক্ষন জেনের দিকে তাকিয়ে রইল শুভ। এরপর শুরু করল।
"আমি প্রচুর বই পড়ি। এভাবে একবার একটা বই পড়ে ফেললাম। পাঁচশর উপরে পৃষ্ঠা। বই শেষ হলেও আমার সেই ঘোর শেষ হলো না। আমি অনেক দিন সেই ঘোরে আচ্ছন্ন হয়ে রইলাম। সময়টা ছিল শীতের শেষ। পরের বছর আমি শীতের শেষের দিকে কিসের যেন একটা টান অনুভব করলাম। পরে বুঝলাম এটা সেই জগতের টান। মেয়েটার নাম ছিল সামিরা। আমার অনুভবের সাথে সামিরা মিশে গেলো। এরপরে পেরিয়ে গেছে বারোটি বছর। আমি এই বারোটি বছরে ডুবে ছিলাম সামিরার মাঝে। একদিন মনে হল, সামিরার কাছে আমি যাব। যে শহরটায় সামিরা বড় হয়েছে, হেসে খেলে বেড়িয়েছে সেই শহরটায় আমি যাব। প্রতিটি রাস্তায়, প্রতিটি অলিতে গলিতে আমি সামিরাকে খুজে ফিরব। প্রতি বছর আমি এখানে এসে সামিরাকে খুঁজে ফিরি জেন। এখানে বসে আমি আমার ভুবনে চলে যাই। কল্পনায় সামিরা কে দেখি। এ শহরের বাতাসে আমি সামিরার গন্ধ খুজি।"
জেন কী বলবে ভেবে পেল না। হঠাৎ তার মনে হলো জীবনে যদি এক দিনের জন্যও সামিরা হতে পারতাম!
শুভর কানে বাজছিল Leo Sayer এর When I need you, just close my eyes and I with you...

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



