শুক্রবার। সোহেলের মনটা সকাল থেকেই খারাপ। মন খারাপ ব্যপারটা নিয়েই সে দোকান খুলছে। তার বড় ভাই সাইদ একটা ফোনের দোকান চালায়। সেই দোকানে তাকে প্রতি শুক্রবার বসতে হয়। সকালে যখন সে শুয়ে ছিল, সাইদ এসে খুব বাজে ভাবে ধমক দিয়ে তাকে বিছানা থেকে নামিয়েছে। সপ্তাহে সাত দিনই যারা ব্যাগ কাঁধে নিয়ে ভোরে টলতে টলতে অফিসে যায়, তারাও শুক্রবারে ঘুমায়। সোহেলের ও মন চায়। কিন্তু পারে না। শুধু এই কারনেই যে ওর মন খারাপ তা না। আরো কারন আছে। অনেক বড় কারন।
বেলা দশটা এগারোটার দিকে দোকানে একটা মহিলা ঢোকে। অদ্ভুৎ মহিলাটার শুধু একটা চোখ খোলা। আর পুরো চেহারাটা ওড়নায় ঢাকা। সোহেলের কাছ থেকে ফোন চেয়ে নিয়ে কোন একটা নাম্বারে ফোন লাগায় মহিলা। কথাবার্তায় মনে হয় তার ছেলে টেলে হবে। শুক্রবার সকালে লোকজনের এই ফোনালাপ সে আগ্রহ নিয়ে শোনে। সে বুঝতে পারে কি করে এই রকম বিরক্তিকর ব্যবসা মানুষ দিনের পর দিন করে যায়।
সোহেলের কাছ থেকে ওর দোকানের লোকেশন জেনে নিয়ে মহিলাটা কাউকে আসতে বলে। কথা বলতে বলতে মহিলার মুখের নেকাব একপাশে সরে যায়। তাকে দেখে চমকে ওঠে সোহেল। সে স্পষ্ট বুঝতে পারে মহিলাটার চেহারায় এসিড মারা হয়েছিল। এতো কাছ থেকে এসিডদগ্ধ কাউকে সে আগে দেখেনি।
কথা শেষ করে মহিলাটা বসে ছিল। কৌতুহল চেপে রাখতে না পেরে সোহেল জিজ্ঞেস করে, আপা কিছু মনে না করলে একটা কথা জানতে চাই।
- বলেন।
-আপনার চেহারায় কী হয়েছিল?
-কেন আপনি দেখে বুঝেন না? এসিড। বলেই মহিলাটা চুপ করে যায়।
কিছুক্ষন অস্বস্থিতে ভোগার পর আবার সোহেল জিজ্ঞেস করে, আপা কিছু মনে না করলে আরেকটা প্রশ্ন করতে চাই।
-করেন।
-আমাকে কী বলা যাবে, কী হয়েছিল? নিতান্ত কৌতূহল। কোন সমস্যা হলে বলতে হবে না।
একটু সময় চুপ থেকে মহিলাটা শুরু করে, আমার এলাকার মেম্বারের ছেলে আমাকে আমাকে বিয়ে করতে চেয়েছিল। রাজী হইনি বলে সে আমাকে এসিড মারে।
-আপনি রাজী হন নি কেন বলা যাবে? কোন সমস্যা থাকলে থাক।
- একটা বখাটে ছেলেকে কে বিয়ে করবে? আর আমি নিজেও একটা ছেলেকে ভালো বাসতাম।
মনের মধ্যে অনেক প্রশ্ন গিজগিজ করে সোহেলের। কিন্তু বলতে সাহস পায় না। এর মধ্যেই তারচে চার পাঁচ বছর ছোট একটা ছেলে আসে। সোহেল জিজ্ঞেস করে, এটা কে?
- আমার ছেলে।
- পরে আপনার কোথায় বিয়ে হয়েছিল?
- কেন? আমি যে ছেলেটাকে ভালোবাসতাম।
- এই ঘটনার পরেও সে আপনাকে বিয়ে করে?
-দেখতেই তো পাচ্ছেন আমার একটা ছেলে আছে।
স্তব্ধ হয়ে যায় সোহেল। নিজের কান কেই যেন বিশ্বাস করতে পারে না। মহিলা বেড়িয়ে যাচ্ছিল। হঠাৎ সোহেল জানতে চায়, আপনার স্বামীর নাম কী?
- জয়নাল।
সপ্তাহ খানেক আগে সোহেল একটা মেয়েকে নিয়ে ওদের বাসায় এসেছিল। বিয়ে করতে চায়। এখনই না। শুধু প্রস্তাব দিয়ে রাখতে চায়। কারন মেহেটা কালো। ওর বাবা ওকে বিয়ে দিয়ে দিতে চায়।কারন কালো মেয়েদের খুব বেশি সম্বন্ধ আসে না। যেকোন ভাবেই কালো মেয়ের বাবারা চায় মেয়েকে পাত্রস্থ করতে।
সোহেলদের বাসা থেকে একবাক্যে ওকে না করে দিয়েছে। কারন, মেয়ে কালো। কোন কালো মেয়ে ওদের বাসার বউ হতে পারবে না। এজন্য সেদিন থেকে ওর মন খারাপ। কেউ বুঝতে চায় না। কালো মেয়েটাকেই ওর ভালো লাগে। সে কী করবে তাও বুঝতে পারে না।
হঠাৎ তার মনে হয়, জয়নালের তাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে কী করতে হবে। শুধুমাত্র ভালোবাসার জন্য জয়নাল যদি পারে, সে কেন পারবে না। বুকের ভিতর চেপে থাকা গুমোট কষ্টটা তার ঝলমল আনন্দে পরিনত হয়।
একটানে দোকানের সাটার নামায় সোহেল। তার আর তর সইছে না।তার ইচ্ছা করছে এক নিমিষেই যেন উড়াল দিয়ে তার ময়না পাখির কাছে চলে যায়। তাকে নিয়ে উড়ে বেড়ায়, সাতাঁর কাটে, দূর অজানায় হারিয়ে যায়।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



