মেয়েটিকে আমি প্রথম দেখি পারিবারিক ছবির একটি অ্যালবামে ।
খুব সম্ভবত তখন শীতকাল চলছিল । তাঁর গায়ে চাদর জড়ানো ছিল ।
মুখে স্ফটিক হাসি । ছবিতে তাঁর চুলগুলো লাগছিল ভেজা ভেজা ।
চোখ আদ্র , কোমল ।
এতো নিখুঁতভাবে কারো ছবি দেখা যায় আমি জানতাম না । আমার কেমন যেন লাগল ।
মনে হলে ভালোভাবে দেখে কিছু বের করা যায় নাকি !
কালো রঙের চাদর জড়ানো সে ছবিতে , ছবিতে কোনায় সে ,ফটোগ্রাফার তাঁকে ফ্রেম থেকে হয়তো বাদ দিতে চেয়েছিলেন , পরে দেননি । অথবা এমনও হতে পারে , ছবি তুলার সময় সে ছিলনা , কোন কাজে ছিল , হঠাৎ এসে যোগ দিলো ।
পারিবারিক সে ছবিতে সবার মধ্যে নিজেদের খুশি ঢেলে সাজানোর ব্যাপারটা ছিল ।
হাসির কারখানা , মেয়েটির ভেতর সেটি ছিলনা । কেন ?
নিজেকে কি সে আড়ালে রাখতে পছন্দ করে ?
লুকনো হাসির পুরো প্রমান যেন তাঁর দু'ঠোঁটে ! বাহ !! যেন জীবনানন্দের কবিতা থেকে উঠে আসা এক মায়াবী নারী ।
এমনভাবেই চলছিল , আমার দিন । রাতে নিশাচর হই , দিনে ঘুমাই । বিকেলে ঘুম থেকে উঠে বিরক্তমুখে সিগারেট ধরাই , মাঝে মাঝে ভাবি ছবিটির কথা । ক্যামেরা দেখলেই কারো হাতে ছবিটি নিয়ে আমি ভাবি ।
মাঝরাতে ঝুম বৃষ্টি নামলে মনে হয় , এইতো আর কদিন পরেই ছুটি । এরকম ব্যাপার ।
এতো সাধারন মেয়েও হয় ?
কীভাবে ? এতো আধুনিক এক ঘরের মেয়ে এতো সাধারন কীভাবে হয় ?
তাঁকে দেখলেই মনে হয় , পরম মমতা সে লালন করে ।
তাঁর ছবি দেখেই মনে হয় , যাকে সহজেই বলা যায় , আপা আমার ফোনে টাকা নেই , আপনার ফোনটা কি একটু দিবেন ?
নির্দ্বিধায় , অপরিচিত কাউকে সে সাহায্য করতে প্রস্তুত , এরকম ।
মনে মনে ভাবি , যে করে হোক তাকে খুঁজে বের করবই
কেন জানি সময় মিলেনা । একদিন নেটে সার্চ দিচ্ছি , তখন তাঁর ফেসবুক আইডি পেলাম । ছদ্মনামে তার আইডি ।
প্রোফাইলে ঢুকলাম । চমৎকার প্রাইভেসি । কিছুই দেখা যায়না ।
শুধু দেখা যায়
- জেন্ডার - ফিমেল ।
একদিন দেখা হয়ে গেলো । আমি বইয়ের দোকান থেকে বের হচ্ছি , সে একই বইয়ের দোকানে ঢুকে বলছে , আমাকে কি একটু শরৎচন্দ্র এর গৃহদাহ উপন্যাসটি দেয়া যায় ?
আমি অবাক হলাম । দোকানটি ছিল আমার পরিচিত । তখন দোকানের ছেলেটি পাশের দোকানে আমি যে বইটি দিয়েছিলাম সেটি আনতে গেছে । ক্যাশে বৃদ্ধ আছেন । আমি নিয়মিত যাই সে দোকানে । বৃদ্ধ আমাকে সাহায্য করতে বললেন - সেলফ দেখিয়ে দিলেন । মেয়েটি এতো কিছু খেয়াল করছে না । বই চেয়েই চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে । বইটি বের করে দিলাম । নিজেকে কেমন জানি অপেশাদার লাগছিল । সপ্নের মুখোমুখি ! এটা কি স্বপ্ন ? প্রেমেরই আল্পনা ?
সে তখন বলল , আমাকে একটু বইটা প্যাকেট করে দিবেন প্লিজ ? আমার বন্ধুকে বার্থডে গিফট দেবো । বৃদ্ধ দোকানদার একটি প্যাকেট দিলেন ।সে নিজেই প্যাকেটে ভরল । আমি মনে মনে ভাবছি - এখনো কি স্বপ্ন দেখছি ? এই স্বপ্ন কি এখনি ভেঙ্গে যাবে ?
প্যাকেটে ভরেই সে চলে গেলো । বৃদ্ধ আমাকে বলল , মেয়েটা টাকা দিতে ভুলে গেছে , গিয়ে দেখো আছে নাকি । আমি তাড়াহুড়া করে বের হলাম , কিছুক্ষণ খুজে দেখি রাস্তার অপাশে একটা কফিশপে সে বান্ধবী নিয়ে আড্ডা দিচ্ছে । আমি কাছে গিয়ে বললাম , আপনি বইয়ের টাকা দিতে ভুলে গেছেন ?
সে বলল , আমি জানি , দোকান থেকে বের হয়েই মনে পরেছে , আপনি না আসলেও যাওয়ার সময় দিয়ে যেতাম । তারপর সে বলল , কতো টাকা ?
আমি বললাম বইয়ে দাম লেখা আছে , দেখুন , ১০% কমিশন দেয় এসব বইয়ে , হিসেব করে দেন ।
সে বলল , আপনার জানার কথা , আপনি জানেন না ?
আমি বললাম , আমি দোকানের কেউ নয় , বই কিনতে এসেছি এখানে , আমার বই আনতে গেছে দোকানের ছেলেটা । তাই আপনার কাজটা আমি করেছি ।
মেয়েটি দেখে মনে হল লজ্জিত হল । আমি বললাম , লজ্জা পাবার কিছু নেই ।
মেয়েটি সরিও বললনা , আমি অবাক হলাম । চিন্তা করলাম আগ বাড়িয়ে কিছু আর বলব না । সে পার্স খুলে আমাকে টাকা বের করে দিলো । আমি নিয়ে চলে এলাম । তার নামটিও জিজ্ঞেস করলাম না ।
নেট ঘেঁটে বহু সাধনায় তাঁর সেই ছদ্মনামের আইডি খুঁজে বের করলাম । টাইমলাইনে কিছু ছবি ( ৩টি ) দেখা যাচ্ছে । একটি ছবি দেখে শকড হলাম । একটা ডিস্কোতে তাঁর ছবি , ছেলে একজন তাঁর সাথে , ছবিতে সবুজ আলোর খেলা , মেয়েটির কাঁধে তার হাত । বুকের ভেতর কেমন যেন মোচড় দিলো আমার ।
সেদিন মাঝরাতে ঘুম ভেঙ্গে গেলো , বুকের ভেতর হু হু বেদনার চর জেগে উঠলো ।
এতো স্বপ্ন , কল্পনা , পরবাস্তবতা , এক ছবিতেই শেষ ?
তারপর কিছুদিন পরের কথা , রাস্তায় হাঁটছি , আকাশের দিকে তাকিয়ে ,
মনে হচ্ছে বৃষ্টি হবে । আকাশ ঘিরে আছে মেঘ । সাদা আকাশটা একটু সাদা থাকে , একটু একটু পর পর একদল মেঘ এসে এসে তাকে অদৃশ্য বানাতে চায় , জড়িয়ে ধরে ।
তারপরেও হয়তো ঝড় কেটে গেলে আকাশ আবারো সাদা হয়ে নীলের বুক মেলে দেয় মানুষের চোখের সীমানাজুড়ে ।
আমার মনে হল চাদর জড়ানো মেয়েটিকে খুঁজে বের করতে হবে আবারো । সে আকাশ , তাকে মেঘ হয়ে জড়িয়ে রাখতে হবে , ক্ষণে ক্ষণে কতো মেঘ তাকে জড়িয়ে ধরবে , আকাশকে না জড়ালে কাকে জড়াবে ? তাকে বের করে বলতে হবে ।
সুরঞ্জনা, অইখানে যেয়োনাকো তুমি,
বোলোনাকো কথা অই যুবকের সাথে ;
ফিরে এসো সুরঞ্জনা ;
নক্ষত্রের রুপালি আগুন ভরা রাতে ;
ফিরে এসো এই মাঠে, ঢেউয়ে ;
ফিরে এসো হৃদয়ে আমার ;
দূর থেকে দূরে -- আরও দূরে
যুবকের সাথে তুমি যেয়োনাকো আর।
কী কথা তাহার সাথে? -- তার সাথে !
আকাশের আড়ালে আকাশে
মৃত্তিকার মতো তুমি আজ ;
তার প্রেম ঘাস হয়ে আসে।
সুরঞ্জনা,
তোমার হৃদয় আজ ঘাস ;
বাতাসের ওপারে বাতাস--
আকাশের ওপারে আকাশ।
রূপসী বাংলার কবি মেয়েদের জন্য কিছু লিখে যাননি
যা লিখেছেন , প্রেমিকদের জন্য
তাকে আমি খুবি অপছন্দ করি , যেসব কবিতা আমার লেখার কথা তা উনি ৮০-৯০ বছর আগে লিখে গেছেন । মেয়েটি কি আমার এই বেদনা বুঝবে ?
আচ্ছা , কবিতাটা কি সে বুঝবে ?
পরিশিষ্ট ;/ এটা সত্য ভাষণ । গল্পের আকার দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে । লেখক অসফল নিজেই তা বুঝতে পারছে । আপনাদের গল্প পরে যদি মনে হয় কারো সময় নষ্ট করা হয়েছে তাহলে দু’অক্ষরে গালি দিয়ে দেখতে পারেন ।
প্রিন্স মাহমুদ
৫/৬/২০১৩

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।


