তবে, খানিক বাদে বুঝলাম যে আসলে এটা ভূমিকম্প না(ভূমিকম্প হলে তো মা এতক্ষণে বাসার সবার ঘুম হারাম করত)। তাহলে অন্য কোন কারণে বিছানাটা কাঁপছিল। কিন্তু কী কারণে?
ধুর! এই মাঝ রাতে কে আর এটা নিয়ে মাথা ঘামাবে। সকালে উঠে বাসার কাজের মেয়েটাকে নিয়ে দুই সদস্যের তদন্ত বাহিনী গঠন করে অনুসন্ধান চালাতে হবে
---------
পরদিন সকালে এ কথাটা যেন কেমন করে মাথা থেকে আউট হয়ে গেল। কারণ ঘুম ভাঙ্গার পর নিজেকে বিছানাতেই উদ্ধার করলাম। এরপর খুব তাড়াহুড়ো করে রেডি হয়ে ক্লাসে চলে গেলাম।
ক্লাস শেষে ফাহিমের সাথে দেখা হতেই সে আক্রমণ করে বসলো, “এই চান্দু, কাল রাতে ফোন ধরলি না কেন রে? এতবার ট্রাই করলাম কিন্তু তুই...???? গন্ডার কোথাকার!”
“গন্ডার?!
আমার থমকে যাওয়া দেখে ফাহিম আগুনে ঘি দিয়ে বলল, “কিরে গন্ডার? তোর চামড়ার মতো দেখি মাথাটাও মোটা! কি ভেবেছিলি? বল!”
উদ্বেগ লুকিয়ে খুব শান্তভাবে উত্তর দিলাম, “কিছু না! আগে তুই আমার প্রশ্নের উত্তর দে, তোকে না কতবার বলেছি যে আমাকে চান্দু ডাকবি না! আমার নাম শশী! তালব্য শ, তালব্য শ-এ দীর্ঘ-ঈ কার। শ-শী! এটা তোর মনে থাকে না?!”
--“হইছে! হইছে! তোমার ব্যাকরণ ক্লাস বন্ধ করো প্লিজ! শশী, চন্দ্র, চাঁদ, চান্দু সব একই কথা- ঘাড়ের নাম গর্ধনা। কিন্তু চন্দ্র, কাল রাতে তোমাকে আকাশে দেখিনি যে?”
--“মেঘ করেছিল যে!”
“আচ্ছা শোনো, তোমাকে না অনেকদিন ধরে একটা কথা বলব বলব করেও বলা হয় না।”
“কি কথা? বলে ফেল! তোর কথাতে তো আর কেউ ট্যাক্স নিচ্ছে না। গত চার বছর ধরে তো বিনা ট্যাক্সেই শুনে আসছি
ক্লাসের বাহিরে উদাস দৃষ্টিতে তাকিয়ে সে বলল, “কি সুন্দর বৃষ্টি হচ্ছে, না?”
“তুই এই কথাটা বলতে চাচ্ছিলি? বেশি ভান করিস নাতো! কি বলতে চাস বলে ফেল।”
হঠাৎ ফাহিমের কবি ভাবনার উদয় হল (যা ওর চরিত্রের একটা বিরল দিক), “এমনো দিনে তারে বলা যায়, এমনো ঘন ঘোর বরিষায় ...” বলেই সে আমার দিকে তাকালো।
আমিও লাজুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম তার দিকে। কি বলব ভেবে পাচ্ছিলাম না! তুই থেকে তুমি বলতে অভ্যেসগত কারণে মুখে বাধছিল যদিও। তবুও বললাম, “উহ! থামলে কেন? বলো না!”
“দোস্ত, আমার পকেটে না আজকে একদম টাকা নাই। চা খাওয়াবি
“যাসসালা! এই কথা বলতে এত অভিনয় করলি? যাহ! খাওয়াবো না!”
“আরে! না, না! কথাটা চা খেতে খেতে বলতে ইচ্ছে করছে। তাই, শুনতে চাইলে চা তো খাওয়াতেই হবে।”
অতঃপর ফাহিমের মনের সরল স্বীকারোক্তি শোনার জন্যই ওকে চা খাওয়াতে বাধ্য হলাম। ক্যান্টিনে বসে দু’কাপ চায়ের অর্ডার দিয়েই খুব আগ্রহ নিয়ে জানতে চাইলাম, “কিরে? কথাটা বললি না যে?”
“আরে, এত অস্থির হচ্ছিস কেন? চা আসুক। এরপরেই বলছি। তুই কিন্তু কিছু বলতে পারবি না, আর কিছু মনেও করতে পারবি না, বলে রাখলাম।”
কতদিন ধরে যে ফাহিমের মুখে সে কথাটা শোনার জন্য অপেক্ষা করেছি তার ইয়ত্তা নাই, আর চা আসার এতটুকু সময় পারব না? তাই অগত্যা, চায়ের জন অপেক্ষা করলাম।
চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে একটু আমতা আমতা করতে করতে ফাহিম অবশেষে বলতে শুরু করলো, “শশী, আমি না……আমি না...মানে...আমি না ......।।”
“কী তখন থেকে ...নামিআ...নামিআ....করছিস? এই নতুন করে নামিআ’র উৎপত্তি
হল কোথা থেকে?”
“ধুর! তোকে কিছু বলতে চাওয়াটাই ভুল ডিসিশন। একটা গোপন নথি ফাঁস করতে চাইছিলাম। আর তুই কি না?! দিলি তো মুডটা নষ্ট করে?”
“আচ্ছা। আচ্ছা। আর কিছু বলব না। এবার বল। আমি কান পেতে রইলাম
বাইরে বাজ পড়ার প্রচন্ড আওয়াজ হচ্ছিল। এর মাঝেই ফাহিম বলল, “আমি (?) ভালবাসি।”
খুবই আনন্দের সাথে লজ্জাভরা কন্ঠে পুরো বাক্যটা না শুনেই বললাম, “আমিও।”
অট্টহাস্যে ফেটে পড়ে ফাহিম যখন বলে উঠল, “তুইও মানে? তুইও ‘বৃষ্টিকে’ ভালবাসিস নাকি? তার মানে কি তুই...? ছিঃ! ইন্নালিল্লাহ!”
হতবাক হয়ে চেয়ে রইলাম। এরপর বুঝলাম, বাইরে বিদ্যুৎ চমকানোর সময় প্রচন্ড আওয়াজে আমি সেই দুর্লভ বাক্যে ‘বৃষ্টি’ শব্দটা শুনতে পারিনি। অতঃপর সামনে পড়ে থাকা চায়ের কাপটার মতই ভালবাসাটাও ধরা ছোঁয়ার বাইরেই রয়ে গেল। কিন্তু আপ্রাণ চেষ্টা করে মনের আবেগ লুকালাম, “বৃষ্টি কি তোর শ্বশুর বাড়ির সম্পত্তি নাকি যে ভালবাসতে নিষেধ আছে? আর আমি তোর বৃষ্টির কথা বলছি না! আমি আকাশের বৃষ্টির কথা বলছি।”
“মাফ চাই আম্মা! তোর এসব কাব্য-কবিতা আমার মাথায় ঢোকে না। তাই ব্যর্থ চেষ্টা করে কি লাভ? চল তোকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে আসি।”
“না! থাক! আমি আজ হেঁটে যাব ভাবছি।”
“তাহলে হেঁটেই এগিয়ে দিয়ে আসি।”
খুব ভাল করেই জানি ওকে বারণ করে লাভ নাই। তাই বৃষ্টিতে ভিজে হাঁটতে হাঁটতে বাসায় গেলাম। রাস্তায় চলার সময় ফাহিমের মুখে যেন ১০মণ খই একই সাথে ফুটছিল। কিন্তু পুরোটা পথ আমি একদন্ড কথা বলিনি। শুধু বাসার একদম কাছে পৌঁছে ওকে বললাম, “তোর কাছে তো টাকা নাই! রিকশা ভাড়া লাগবে?”
“না। টাকা আছে।”
“তাহলে তখন মিথ্যে বললি কেন? আমি কিন্তু মাইন্ড খাইলাম!”
“তখন তোর টাকা খসাতে ইচ্ছে করলো তাই মিথ্যে বলেছিলাম। আর আমি তো এমন কত মিথ্যেই বলি! সব কি তুই বুঝতে পারিস? পারিস না! তাই অযথা মাইন্ড করে কি লাভ?” এরপর “আজ আসি” বলেই এক দৌড়ে রাস্তা পার হয়ে ফাহিম চলে গেল। আর আমি বাসার নিচে দাঁড়িয়ে বৃষ্টিতে ভেজা ঝাপসা চশমা দিয়ে ওর চলে যাওয়া দেখলাম।
--------------------
ডায়রীটা বন্ধ করেই শশী জানালা দিয়ে বাইরে তাকালো। ‘ডায়রী লেখা’ শশীর দৈনন্দিন অভ্যাসের আওতায় পড়ত না কখনই। তবে মাঝে মাঝে মনের ভীষণ মান-অভিমানের কথা বলার কাউকে না পেলে ডায়রী খুলে ইচ্ছেমতো হ-য-ব-র-ল লিখে ফেলত। পরে আবার সেই এলোপাথাড়ি লেখাগুলো পড়ে নিজের মনে খুব হাসত- ডায়রীতে লেখা বিচ্ছিন্ন গল্পগুলো তো জীবন থেকে নেয়া স্মৃতিরই অংশ।
বেচারা ডায়রীটাকে যে কত এমন আবোল-তাবোল কথা সইতে হয়েছে!!! আর এছাড়া তো ডায়রীটার আর কোন উপায়ও ছিল না, ওর মনের কথাই বা শোনাবে কাকে?
আজ আর সেদিনের মতো বৃষ্টি পড়ছে না, তাই বাইরের প্রখর রোদের দিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে না পেরে শশী জানালার পর্দা সরিয়ে দিল। এরপর রকিং চেয়ারটাতে হেলান দিয়ে কানে হেডফোন দিয়ে রেডিও চ্যানেলগুলো ঘোরাতে ঘোরাতে হঠাৎ একটাতে থমকে গেল।
আচ্ছা, এই রেডিও-আলারা কি করে বোঝে যে কোন গানটা কখন/কোন সময় প্লে করা উচিৎ?! আর গানের কথা/সুরগুলোও এমন হয় যে শ্রোতার মনের পরিস্থিতির সাথে প্রায়ই মিলে যায়! শশী মনে মনে ভাবল, "সত্যিই তো ফাহিম! এখন আমার কোন কিছুই আর আগের মতো নেই, এমনকি আমিও না; হয়তো তুই নেই তাই!"
ছবি কৃতজ্ঞতা
(এই গল্পের সকল চরিত্র কাল্পনিক। তাই, ফাহিম এবং শশীরা নামের মিল দেখিয়া দয়া করিয়া ভচকাইবেন না!)

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।


