somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বারবারিয়ানস রাইজিং

১৮ ই সেপ্টেম্বর, ২০২০ রাত ১২:২২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

বারবারিয়ানস রাইজিং

'যুগে যুগে পরাধীনতার শৃঙখল কখন গলার ফাঁসে পরিণত হয়েছে? কেউ বলবেন অর্থনৈতিক শোষণ তুঙ্গে উঠলে, বা শ্রেণী সংঘাত চরম আকার ধারণ করলে; অনেকেই অবশ্য দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও ভঙ্গুর শাসন ব্যবস্থার কথা বলবেন- এগুলো জাতীয় সমস্যা, উপনিবেশ উত্তর তৃতীয় বিশ্বের দেশে এ সমস্যাগুলো জনগণ হাতের রেখার মতই মেনে নেয়। মানুষের দেয়ালে পিঠ ঠেকে যখন; উদাহরণ দিয়ে বললে ভাল বোঝা যাবে। প্রথমে আমাদের দেশের ইতিহাসটা একবার ঝালিয়ে নেই, বোডিকাকে দিয়েই শুরু করা যাক…'

"Excuse me, which country are you from?" লম্বা, সুদর্শন এক যুবকের প্রশ্নে ভাবনার সুঁতো কেটে গেল, "ইংল্যান্ড।"

"Are you a journalist?" যুবকের চোখে ভীতিমাখা আগ্রহ। অনেকক্ষণ থেকেই খেয়াল করছি সে আড়চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। কিন্তু পরিস্থিতির বিচারে আগ বাড়িয়ে কথা বলার সাহস পাচ্ছিল না। দূরত্ব ও পরিস্থিতি নিরাপদ মনে করে আগ্রহের ঝাঁপি খুলে বসেছে, "হ্যাঁ, আমি সাংবাদিক।" একজন বিদেশিকে বাংলায় কথা বলতে শুনে যুবক বেশ অবাক হল, "আপনি বাংলা জানেন!"

"আপনি ইংরেজি জানতে পারলে আমার বাংলা জানা কি অস্বাভাবিক কিছু?" "না, মানে…", যুবক কি উত্তর দিবে ভেবে পেল না। বাঙ্গালী যুবকের এই হতকচিত ভাবটা অস্বাভাবিক নয়। বেচারা প্রায় দুইশ বছরের উপনিবেশিকতার দুর্গন্ধ এখনো গা থেকে মুছে ফেলতে পারেনি, তার ওপর বিগত চব্বিশ বছরের অভ্যন্তরীণ উপনিবেশবাদের ফলাফল তো রয়েছেই। আসলে প্রাচীন আমল থেকেই ভাষা বর্বর/সভ্য পার্থক্যের মানদণ্ড হিসেবে কাজ করে আসছে। সভ্যতার ব্যাটন (baton) যখন প্রাচীন গ্রীক, রোম ও ইউরোপ থেকে এ অঞ্চলে সর্বশেষে পাকিস্তানিদের হাতে এসে পৌছায় তখন 'সাদা চামড়ার পবিত্র দায়িত্ব'- এর জোয়াল স্বেচ্ছায় নিজ কাঁধে তুলে দৃঢ়হস্তে তা পালনে বদ্ধপরিকর পাকিস্তানিরা সেই ব্যাটন দিয়েই স্বদেশীদের প্রহার করে নিজেদের উর্দু ভাষা ও সামরিক সংস্কৃতিতে সভ্য বানাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। ২৪ বছরে স্বদেশীদের হাতে মাতৃভাষাকে ক্রমাগত লাঞ্চিত হতে দেখে হঠাৎ করে পুরনো শাসকগোষ্ঠীর মুখে মাতৃভাষার ব্যবহার দেখে স্বাভাবিকভাবেই এই বাঙ্গালী বিভ্রান্ত হয়। যুবককে অপ্রতিভ পরিস্থিতি থেকে রক্ষা করার জন্য তার দিকে হাত বাড়িয়ে দিলাম, "আমি এডি, আপনার নাম?"

"শহিদ, শহিদুল ইসলাম। কিছু যদি মনে না করেন তাহলে একটা কথা জিজ্ঞেস করব?"

"অবশ্যই।"

"আপনি এখানে কেন? মানে, আমাদের সাথে কেন?"

"আমি সাংবাদিক, যেখানে সংবাদ সেখানেই যাব।"

"কিন্তু সংবাদগুলো কি সব ঢাকায় না?"

"আপনি বোধহয় জানেন না যে ঢাকা থেকে সব বিদেশি সাংবাদিকদের ঘাড় ধরে বের করে দিয়েছে। আমি অবশ্য আগেই রাজশাহীতে চলে এসেছিলাম। পূর্ব পাকিস্তানে বর্তমানে আমিই বোধহয় একমাত্র বিদেশি সাংবাদিক…" আমার কথা শুনে শহিদের মুখ শক্ত হয়ে গেল, "প্লিজ বাংলাদেশ বলুন।"

"স্যরি, বাংলাদেশে…" শহিদ মাথা নিচু করে বলল, "দুঃখিত, আমি আসলে ওভাবে বলতে চাইনি। কিন্তু নিজেকে পাকিস্তানি বলে পরিচয় দেয়ারও রুচি নেই। সেজন্য…"

"I understand that, it's ok…" শহিদের বুক থেকে বড় দীর্ঘশ্বাস বের হল, "কি লাভ? পাকিস্তান, বাংলাদেশ- কিছুতেই যায় আসে না এখন। না ঘর আছে না মাটি, দেশ বলব কোন জায়গাকে?" আমার দিকে তাকিয়ে মাথা নেড়ে বলল, "No, You don't understand, আমাদের অবস্থা তিব্বতিদের মত হতে চলেছে..."

পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করে শহিদের দিকে বাড়িয়ে দিলাম। সে ইতস্তত করে এদিক-ওদিক দেখে একটা তুলে নিল। মুখভর্তি ধোঁয়া ছেড়ে শহিদকে জিজ্ঞেস করলাম, "প্রায় আট কোটি মানুষ আপনারা, রুখে দাড়াচ্ছেন না কেন?"

"রুখে দাড়াব! বাঁশ আর লাঠি-সোঁটা নিয়ে! এ ধরণের কথা ভাষণে শুনতে ভাল লাগে, প্র‍্যাক্টিক্যালি সম্ভব নাকি?"

"বোডিকার গল্প জানেন?"

"বোডিকা!" হতবম্ভ যুবককে পেছনে ফেলে কাফেলার সামনের দিকে এগিয়ে গেলাম। অনেকক্ষণ হল কাফেলা নড়ছে না। অনাকাঙ্ক্ষিত এই যাত্রাবিরতি নিরাপত্তার খোঁজে পথে নামা রাহীদের কাছে স্বাগতপূর্ণ হলেও স্বাভাবিক নয়। এর মধ্যেই পথশ্রান্ত নারীরা সূর্যদেবের চোখ রাঙ্গানি থেকে নিজ নিজ সন্তানদের রক্ষা করার জন্য আম বাগানের ছায়ার চাদরে বিশ্রামের ব্যবস্থা করেছে। বাচ্চারা দীর্ঘ ত্রিশ কিলোমিটার পদযাত্রার ক্লান্তির পর মায়েদের কোলে বিশ্রামের সন্ধানে ব্যস্ত। কাফেলার মাথায় পুরুষদের জটলা, খোঁজ নেয়ার জন্য সেদিকেই গেলাম। কাফেলার দলপতি হুমায়ুনকে ঘিরে জনাকয়েক মানুষ উত্তপ্ত বাক্য বিনিময়ে ব্যস্ত। বিদেশি একজনকে আসতে দেখে তারা চুপ হয়ে যায়। কথা বলার সুযোগ পেয়ে হুমায়ুন নিজের সাফাই গাইতে শুরু করে, "বুইঝছেন না কেনে, ক্যাম্প প্যার হলেই নদী..."

"পাগলের মত কথা বলছ কেন তুমি? ক্যাম্পের সামনে দিয়ে কিভাবে যাব? এতগুলো মানুষের নিরাপত্তার কথা..." বয়স্ক একজন তেড়ে-ফুড়ে উঠলেন।

"ইপিআর কি পাকিস্তানি জোয়ান নাকি? মুদেরই ছ্যালে-প্যালে, ভয় কিয়ের?"

"জানো বিভীষণ ঘরেরই শত্রু? শহরে বাঙ্গালিরাই বাঙ্গালিদের ঘর দেখিয়ে দিয়েছে পাকিস্তানিদের।"

"বিভীষণরে মুই চিহনি নাকে, মোকে আবার শহরে য্যাতে হবে। আমার এত টাইম নাইকো…"

"ব্রাদার, কি হয়েছে এখানে?" গন্ডগোলের মধ্যে একজন মধ্যবয়স্ক লোককে জিজ্ঞেস করলাম। শহিদের মত মুখে প্রকাশ না করলেও ভদ্রলোকের অভিব্যক্তি শহিদের মতই ছিল, "You see, EPR checkpost ahead. হুমায়ুন তা অগ্রাহ্য করে সামনে আগাতে চাচ্ছে। তা কি পসিবল? আপনিই বলুন, এর চেয়ে ঘুরে যাওয়া ভাল না?" ভদ্রলোকের কথা শুনে বনী ইসরায়েলের বারজন গুপ্তচরের কথা মনে পড়ে গেল। মোজেস যখন বনী ইসরায়েলের বারজন গুপ্তচরকে প্রতিশ্রুত ভূমি কেনানের পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে পাঠিয়েছিলেন তখন তাদের দশজন নগরের সুরক্ষা ব্যবস্থা ও জনসংখ্যার আধিক্যে ভীত হয়ে মোজেসকে বলেছিল কেনানে দানব বাস করে, তা দখল করা সম্ভব নয়। তথাকথিত দানবভীতির মূল্য বনী ইসরায়েলদের চল্লিশ বছর ধরে দিতে হয়েছিল। এখানে উপস্থিত সদস্যরা এখনও গুপ্তচর পর্যন্ত পাঠায়নি। তাদের কতদিনে বা কিভাবে এর মূল্য পরিশোধ করতে হবে তা ঈশ্বরই ভাল বলতে পারবেন, "তাহলে কি আমাদেরও চল্লিশ বছর চক্কর কাটতে হবে?" আমার কথা শুনে পাশের লোকটি চমকে উঠল, "চল্লিশ বছর চক্কর কাটতে হবে মানে?"

"এমনি বললাম। কেউ এগিয়ে গিয়ে দেখছে না কেন ক্যাম্পে সিপাহি আছে কিনা?" আমার পরামর্শ শুনে সবাই একে অপরের দিকে তাকাতে লাগল। সেই সুযোগে হুমায়ুন আমাকে একটু দূরে নিয়ে এসে বলল, "স্যার, কিছু একটা রাস্তা করেন। রশীদ স্যারে মোরে খালি আপনেরে বর্ডারে পৌছায়ে দিতে বুলছে। বাকি গো দায়িত্ব মুই নিতে পাইরব না।"

"সিগারেট খাবে, হুমায়ুন?" হুমায়ুনকে একটি সিগারেট ধরিয়ে দিয়ে বললাম, "এদের তো রাস্তায় ফেলে দিতে পারবে না, হুমায়ুন। তোমারই দেশের মানুষ, বিপদগ্রস্ত। তার উপর রোদের মধ্যে এতটা পথ হেটে এসেছে। একটা উপায় বের করতে হবে।" হুমায়ুন দুই তালুর মধ্যে দিয়ে সিগারেটে টান দিয়ে বলল, "স্যার, সব ইপিআর শহরে পাঞ্জাবিদের সাথে যুদ্ধ কইরছে, ইধার কেউ নাই। হামি য্যায়ে দেইখে আইসতে পারি মাগার হামার কেউ বিসওয়াস কইরবে না। সাথে কেউ গেইলে একটা বিবস্থা হয়।" হুমায়ুনের পিঠ চাপড়ে বললাম, "ভাল কথা বলেছ তো। দেখলে এতগুলো মানুষের মধ্যে একমাত্র তোমার মাথাই পরিস্কার। এটাই করা যাক, এর মধ্যে তুমি মানা-সালওয়ার ব্যবস্থা করতে পারবে?" আমার দাবি শুনে হুমায়ুন ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল, "মানা-সালওয়া কি, স্যার?"

"খাবার, কিছু খাবারের ব্যবস্থা করতে পারবে? পেটে দানা গেলে এরা ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করতে পারবে। বর্ডার পৌছাতে আমাদের কত সময় লাগতে পারে?"

"এখন রওনা দিলে দ্যাড় ঘন্টা। দিনে দিনে পৌছালি ভাল।"

"তাহলে এক কাজ কর, এক ঘন্টা খাবার বিরতি নেই। এর মধ্যে আমি তোমার সঙ্গীর ব্যবস্থা করি। দেরি কোরো না," হুমায়ুনকে বিদায় করে ইশারায় শহিদকে কাছে ডাকলাম, "ইয়াং ম্যান, যুদ্ধ করবেন?"

"বাঁশ আর লাঠি-সোঁটা দিয়ে? কেন মস্করা করছেন?"

"যুদ্ধ শুধু অস্ত্রের হয় না, ইয়াং ম্যান। বোডিকা পারলে আপনি কেন না? তার ওপর আপনি পুরুষ মানুষ।"

"বোডিকা কে তা তো বললেন না।"

"আমাদের ন্যাশনাল হিরোইন।"

"হিরোইন? কার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে?"

"সেই সময় যারা সবচেয়ে শক্তিশালী ছিল তাদের বিরুদ্ধে।"

"লাঠি দিয়ে?"

"হ্যাঁ, ইস্পাতের লাঠি দিয়ে। এখনকার অস্ত্রের তুলনায় তার অস্ত্রকে লাঠিই বলা চলে। চলেন, তার আগে পেটে কিছু দেয়া যাক। খাবার আসছে, খেতে খেতে সবার সাথে আলোচনা করি।"

কিছুক্ষণের মধ্যে হুমায়ুন মুড়ি, গুড় (মোলাসেস ধরণের মিষ্টান্ন) আর চা নিয়ে এল, সাথে স্থানীয় জনা কয়েক মানুষ, "স্যার, গুড়ের চা লিয়ে আইসছি, এক চুমুকে দিল ঠান্ডা হইয়ে য্যাবে।"

শহিদকে দিয়ে খাবারের একটা বড় অংশ তার পরিবার এবং বাকি মহিলা ও বাচ্চাদের জন্য পাঠিয়ে দিলাম। মানা-সালওয়া না হোক, এরকম পরিস্থিতিতে ঈশ্বর যে খাবারের ব্যবস্থা করেছেন তাই বা কম কি। হুমায়ুন পুরুষদের এক জায়গায় ডেকে সেখানে চাদর বিছিয়ে খাবারের আয়োজন করেছে৷ উপস্থিত সফরসঙ্গীরা তখনও বিচলিত, পরিবারের নিরাপত্তার দুর্ভাবনা তাদেরকে কুরে কুরে খাচ্ছে৷ পরিবেশন করা গুড়-মুড়ি শেষ হয়ে আসলে হুমায়ুন ও খাবার সরবরাহকারী স্থানীয় লোকেরা কাঁসার গ্লাসে চা ঢেলে দেয়ার পর মোদ্দা কথাটা পাড়লাম, "কেউ যেয়ে দেখে আসতে পারে ক্যাম্পে কারা আছে। এভাবে সময় নষ্ট করলে পেছন থেকেও বিপদ আসার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। হুমায়ুনের সাথে কেউ একজন যেয়ে দেখে আসুক।" কাউকে কিছু বলতে না দেখে আবার বললাম, "আমি জানি আপনারা যার যার পরিবারের কথা ভেবে চিন্তিত। আমি আন্দাজ করতে পারছি আপনারা কোন না কোন বিপদের মুখোমুখি হবার পরই এ রাস্তা ধরেছেন। কিন্তু সেই বিপদ এখনো কাটেনি। আপনাদের দেশি সৈন্যদের প্রতিরোধ কতক্ষণ টিকবে তা বলা মুশকিল৷ সেটা আর এক মাসও হতে পারে বা এক দিন। আমরা যত সময় নদীর এপাড়ে আছি ততক্ষণ বিপদের মধ্যে আছি। নিজেদের স্বার্থেই আপনাদের উচিৎ হবে যাত্রা শুরু করার ব্যবস্থা করা। এখন বলুন হুমায়ুনের সাথে কে ক্যাম্প চেক করতে যাবেন?"

পরিস্থিতি সবিস্তারে ব্যাখ্যা করার পরও ভলান্টিয়ার পাওয়া গেল না। আব্দুর রশিদ সাহেবের উপর কিছুটা করুণা অনুভব করলাম। তিনি যখন হুমায়ুনের সাথে আমাকে পাঠাচ্ছিলেন তখন তাকেও পরিবারসহ সঙ্গী হবার জন্য পরামর্শ দিলে তিনি বলেন, "সবাই মিলে না-পাকদের ঠ্যাঙ্গাতে শুরু করলাম আর এখনই চলে যাব!"

"কতদিন প্রতিরোধ করবেন? কোন না কোন সময় গোলা - বারুদ শেষ হয়ে যাবে। তখন এমনিতেই পিছু হটতে হবে। ধরে নেন এটা ট্যাক্টিকাল রিট্রিট।"

"মনে হচ্ছে আমাদের উপর আপনার ভরসা নেই। মনে রাখবেন, সাতচল্লিশের আগ পর্যন্ত আপনাদের লাঠির ডগায় রেখেছিল এই বাঙ্গালীরাই, বাকিরা তো আপোস করেছে।"

আফসোস, ব্রিটিশদের লাঠির ডগায় রাখা বাঙ্গালীরা আজ নিজেরাই লাঠির ভয়ে পর্যদুস্ত। সেটা আত্মবিশ্বাসের অভাব নাকি পাকিস্তানি আর্মির নৃশংসতার উপর আস্থা নাকি দুটোই বোঝা মুশকিল। আব্দুর রশিদের নিজের স্বদেশীদের উপর ভরসা থাকতে পারে, কিন্তু আমার ভরসা ধীরে ধীরে কমে আসছিল। ঈশ্বর বনী ইসরায়েলদের চারিত্রিক দুর্বলতা ও বিশ্বাসের অভাবের কারণে বারবার তাদের ধ্বংস করার ইচ্ছা পোষণ করেছিলেন তখন মোজেস তাকে নিবৃত্ত করেন। আমি মোজেস তো নই আবার বাঙ্গালীও নই, মানবিক কারণে করুণার উদ্রেক হলেও তার স্থায়িত্ব বেশিক্ষণ হবে না। তার উপর পশ্চিমে একটু একটু করে কালো মেঘ জমতে শুরু করেছে। ইন্দ্রদেব ও সূর্যদেবের মধ্যকার মৌসুমি লড়াইয়ের অনর্থক ভিকটিম হবার কোন মানে হয় না। লড়াই শুরু হবার আগেই মানে মানে নিরাপদ স্থানে মাথা গোঁজার ঠাই খোঁজা নশ্বরদের জন্য বিচক্ষণ হবে। উপস্থিত সকলকে লক্ষ্য করে একটু উঁচু স্বরে বললাম, "দেখুন কয়েকজনের নিষ্ক্রিয়তা সকলকে বিপদে ফেলতে পারে। আমি সেটা মেনে নিতে রাজি নই, অন্তত আপনাদের ভয়ের কারণে আমি বিপদে পড়তে রাজি নই। যদি কেউ ক্যাম্প চেক করতে যেতে না চান তাহলে হুমায়ুনকে নিয়ে আমি যাব। সেক্ষেত্রে আমরা যদি নিরাপদ মনে করি তাহলে আর পিছিয়ে আসব না, আপনাদের রেখে বর্ডারের দিকে এগিয়ে যাব। আপনারা এখানে যতক্ষণ ইচ্ছা অপেক্ষা করতে পারেন…"

আমার কথা শুনে এক বৃদ্ধ ডুকরে উঠলেন, "নিজেদের মানুষ যখন গাদ্দারি করেছে সেখানে আপনার মত বিদেশির কাছ থেকে কি আর আশা করব, সাহেব? এখন তো আল্লাহও মনে হচ্ছে আমাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন…", বলে হাউ-মাউ করে কাঁদতে শুরু করলেন। বাকিরা এমনভাবে তাকাল যেন বৃদ্ধের দুঃখ-দুর্দশার কারণ আর কেউ নয় বরং আমি। এদিকে ইন্দ্রদেব কালোরথে চেপে সূর্যদেবকে দ্বৈরথে আহবান জানানোর জন্য স্থান নির্দিষ্ট করে ফেলেছেন। দুর্ভাগ্যবশত তা আমরা যেখানে রয়েছি তার কাছেই। পবনদেবতাও হরিণে আবিষ্ট হয়ে তার ঝান্ডা বন বন করে ঘূরিয়ে ইন্দ্রদেবের কালোরথকে ঝেটিয়ে বিদায় করে দেয়ার জন্য সন্নিকটে। "রাজায় রাজায় যুদ্ধ হয় উলুখাগড়ার প্রাণ যায়"- যেমন এই মুহূর্তে নিরাপদ স্থানে ঠাই না নিলে আমাদের অবস্থাও উলুখাগড়ার মতই হবে। করুণার ধুলোকে মন থেকে ঝেড়ে যখন সিদ্ধান্ত নিচ্ছি যে একাই এগিয়ে যাব তখন পেছনের সুরেলা আওয়াজে থেমে যেতে হয়, "ভাই, আমাকেও আপনার সাথে নিন।"

ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি ছোট শিশু কোলে প্রায় পঁচিশ বছর বয়সের এক তরুণী। তরুণী শাড়ির আঁচল দিয়ে কোলের শিশুটিকে যথাসম্ভব ঢেকে রেখেছে। আমার জিজ্ঞাসু দৃষ্টির জবাবে তরুণী বলল, "ঝড় আসছে। বাবু এমনিতেই অসুস্থ, ঠান্ডা লেগে যেতে পারে। সামনে হয়ত পাকিস্তানিরা থাকতে পারে আবার নাও পারে। কিন্তু খোলা জায়গায় থাকলে আবার ঝড়ের মাঝে পড়ব।" তরুণীর কথা শুনে আমি ও হুমায়ুন দৃষ্টি বিনিময় করলাম। খোলা জায়গায় আসলেই থাকা যাবে না। এদিকে হুমায়ুনের সাথে তর্করত বৃদ্ধ হা হা করে উঠলেন, "বৌমা, পাগল হয়ে গেছ নাকি? বুঝতে পারছ না যে সামনে পাকিস্তানিরা থাকতে পারে?"

"আব্বা, থাকতে পারে আবার নাও পারে। ঝড় আসছে, আমি বাবুকে নিয়ে খোলা জায়গায় থাকব না। সামনে যদি কিছু হয় তো দেখা যাবে…"

বোডিকা? সন্তানের মঙ্গলের জন্য ব্যগ্রতা? এই তরুণীর উদ্যোগেও কি বাকিরা সাড়া দিবে? দিলে ভাল, না হলে অপরাধবোধের বোঝা নিয়ে এ স্থান ত্যাগ করতে হবে। তরুণীর আয়োজন বাকিদের চোখে পড়লে কাফেলাতে ইতস্তত একটা ভাব দেখা যায়। সুযোগটা কাজে নেয়া যায়, "চলুন, আপনি আমাদের পিছে পিছে আসুন। ব্যাগটা হুমায়ুনের কাছে দিন, হাটতে সুবিধা হবে।" তরুণী ব্যাগটা হুমায়ুনের কাছে দিতে গেলে বৃদ্ধ তা নিজের হাতে তুলে নেন, "চলেন, কিছু হলে অন্তত সবার একসাথে হবে।" আমাদের যাবার আয়োজন দেখে শহিদ হতবিহবল হয়ে যায়, "সত্যিই চলে যাবেন?" শহিদকে বললাম, "দেখুন ইয়াং ম্যান, এখনও সময় আছে, চাইলে আমাদের সাথে যেতে পারেন। নিরাপত্তা আকাশ থেকে পড়বে না, খুঁজে নিতে হবে।" কিংকর্তব্যবিমূঢ় যুবককে পেছনে রেখে আমরা সাড়ে চারজন মানুষ ক্যাম্পের দিকে রওনা হলাম।

সাহসী এই তরুণী আবার প্রমাণ করে দিল অতি ক্ষুদ্র নির্ঝরও মাঝে মাঝে দামোদরের জন্ম দেয়। প্রথমে নারীরা আমাদের পিছু নেয়। পুরুষেরা তখনও দ্বিধাবিভক্ত, খানিক পর তল্পিতল্পা গুটিয়ে তারাও আমাদের সঙ্গী হয়। বোডিকাও নিজের সন্তানের জন্য সম্রাট নিরোর বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলেছিল, প্রথম বাঁধা আসে তার নিজের গোত্র থেকে। আইসেনি গোত্র রোমের সাথে চলমান সম্পর্কে খোঁচাখুঁচি করতে চায়নি। ক্লডিয়াসের পর নিরোর আগমনকে ঋতু পরিবর্তনের মতই স্বাভাবিকভাবে নিয়েছিল। কিন্তু বোডিকাকে নিরস্ত্র করা যায়নি। ধীরে ধীরে তার সাথে যোগ দিয়েছিল সমগ্র ব্রিটেন। এই তরুণী হয়ত পুরো দেশকে তার নেতৃত্ব দেয়নি, কিন্তু এই মুহূর্তে যাদের মনের শৃঙখল ভাঙ্গার প্রয়োজন তাদের ঠিকই ভীতিমুক্ত করেছে।

এ পরিস্থিতিতে শহিদের মধ্যে কিছুটা কর্মস্পৃহা দেখা যায়। সেটা আসন্ন বিপদে পরিবারের নিরাপত্তার কথা ভেবেও হতে পারে আবার তার সমবয়সী তরুণীর সাহসের কারণেও হতে পারে। হুমায়ুন কিছুটা রেকি করার মত করে আগাচ্ছিল, শহিদও তার সঙ্গী হয়। সঙ্গী পেয়ে হুমায়ুনও সাহস পাচ্ছিল।

"ভয় লাগছে," সামনে এগিয়ে গিয়ে শহিদকে জিজ্ঞেস করলাম।

"তা তো লাগছেই।"

"ভয় পাওয়া ভাল, এতে নিরাপত্তার গ্যারান্টি থাকে?"

"আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করব?"

"অবশ্যই।"

"আপনার কেন মনে হচ্ছে সামনে সিপাহি নেই?

" ইনফরমেশন।"

"কি রকম?"

"আপনাদের শহরে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে, রাইট?"

"হ্যাঁ।"

"সেটা কারা?"

"পুলিশ, ইপিআর…"

"তাহলে এখানে সিপাহি কেন থাকবে? তাছাড়া থাকলে স্থানীয়রাও আপনাদের মত ঘরছাড়া হত। আপনি কি খেয়াল করেননি যে আপনাদের দেখে এরা অবাক হয়েছে?"

"হ্যাঁ।"

"তাছাড়াও আমার কাছে প্রমাণ আছে।"

"কি প্রমাণ?"

সামনের ঝোপ সরিয়ে বললাম, "এই যে প্রমাণ।" পরিত্যক্ত আধা-পাকা একটি স্থাপনা, দরজা-জানালাগুলো কেউ তাড়াহুড়ো করে খুলে রেখে চলে গেছে। বাতাসের ঝাপটায় সেগুলো হাতপাখার মত নড়ছে। বেড়াগুলো উপড়ানো, একটি চাঁদ-তারা খচিত সবুজ-সাদা পতাকা কোনমতে বেড়াকে আকড়ে রেখেছে, বাতাস একটু তীব্র হলেই এই এতিম কাপড়ের টুকরোর কোন হদিশ পাওয়া যাবে না। ক্যাম্পের একপাশে টেবিল, চেয়ার, বেঞ্চ স্তুপ করে রাখা, সেগুলো আবার আধা-পোড়া। ক্যাম্পের সামনের রাস্তায় পড়ে আছে উর্দুতে লেখা একটি বোর্ড, তাতে একগাদা বুটের ছাপ। ক্যাম্প ছাপিয়ে দৃষ্টি গেলেই পদ্মা, আমাদের গন্তব্য সেটাই। তবে আকাশের অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে দিল্লি এখনো অনেক দূর। কিন্তু আকাশের ঝর্ণার ধারা খুব দূরে নয়। পশ্চিম দিগন্ত থেকে বৃষ্টি ঝাপিয়ে আসছে। হুমায়ুনকে পাঠালাম কাফেলার পেছনে তাগাদা দিতে। কিছুক্ষণের মধ্যে কাফেলা হুড়মুড়িয়ে গায়ের উপর এসে পড়ল। সামনে নিরাপত্তা ও বিপদ একসাথে দেখতে পেয়ে তারা ক্যাম্পের দিকে ছুটল।

সবাই টিনশেডের ঘরে ঢুকতেই ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নেমে এল, সাথে প্রবল বাতাস। ভয় হল এই বোধহয় ছাদটা উড়ে যাবে। পুরুষেরা তাড়াতাড়ি দরজা-জানালাগুলো বন্ধ করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। বাকিরা ঘরের মাঝখানে চাদর বিছিয়ে ত্রস্ত হরিণ পালের মত মাটিতে গোল হয়ে বসল। বাইরে দেবতাদের তান্ডব শুরু হয়ে গেছে। টিনের ছাদে বৃষ্টি শব্দ ও ফাঁক-ফোকর দিয়ে ঢুকে পড়া বাতাসের গোঁ গোঁ শব্দের মিলিত নিনাদ কর্কশ পরাবাস্তব আবহের সৃষ্টি করেছে। মাঝে মাঝেই আধপাকা স্থাপনাটি জ্বরগ্রস্ত রোগীর মত কেঁপে কেঁপে উঠছে। দিনের অন্ধকারে ইন্দ্রের বাণ ছেড়ে ছেড়ে নিজের উপস্থিতি জানান দিচ্ছে। উপমহাদেশে একটি প্রথা আছে- বিদ্যুৎ চমকানোর সময় বাইরে না তাকানো। হয়ত দেবতাদের মল্লযুদ্ধ প্রত্যক্ষ করা থেকে বিরত রাখতেই এই প্রথার চালু করা হয়েছিল। দেব দর্শন মঙ্গলজনক নয়। দেবতাদের দর্শনের জন্য নয় বরং বাংলার প্রকৃতির এই মৌসুমি দুরন্তপনা দেখার জন্য পাশের কামরায় গিয়ে পশ্চিমমুখী জানালা খুলে দিতেই বৃষ্টির ঝাপটায় মুখ ভিজে গেল।

"একে বলে কালবৈশাখী, আজকের ঝড়ের তেজটা বেশি", মধ্যবয়স্ক লোকটি পেছনে এসে দাড়িয়েছেন।

" তাই তো দেখছি…"

"আমার নাম আনন্দ।"

"এডি।"

"আপনার ব্যাপারে শুনেছি। আপনি তো সাংবাদিক, আপনার কি মনে হয় আমাদের দেশের খবর বাইরে জানতে পারলে আন্তর্জাতিকভাবে কি ধরণের ব্যবস্থা নেয়া হতে পারে?"

"কি ভাবছি সত্যটা বলব?"

"অবশ্যই।"

"আন্তর্জাতিকভাবে কোন ব্যবস্থাই নেয়া হবে না। জাতিসংঘের মোড়লেরা এখন অন্য বিষয় নিয়ে ব্যস্ত, আপনাদের নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় তাদের নেই।"

"কি বলছেন? জাতিসংঘ এরকম একটা পরিস্থিতিকে বিচারের আওতায় আনবে না?" আনন্দ বাবু যারপরনাই অবাক হলেন।

"উহু, কেউ চায় না ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়াতে। তার উপর বড় মোড়লের ঘরের মোষ তাকেই গুতাচ্ছে। আপনারা যদি নিজেরা উদ্যোগী হয়ে কিছু না করেন তাহলে মোড়লেরা দূর থেকে আলোচনাই করবে, কাজের কাজ কিছু হবে না। আপনাকে এখানে দেখে আপনাদের দৌড় সম্পর্কে একটা ধারণা করা যায়। এই যদি আপনাদের হাল হয় তবে আপনাদের প্রেসিডেন্টের কথা মেনে নেয়াই বুদ্ধিমানের কাজ হবে।"

"এতদিনের আন্দোলন, সংগ্রাম সব পানিতে ফেলে দেব!"

"সেই কাজটা কি ইতিমধ্যে করা হয়ে যায়নি?"

কিছুক্ষণ চুপ থেকে ভদ্রলোক বাষ্পকন্ঠে বললেন, "পুরো পৃথিবী মুখ ফিরিয়ে নিলেও ভগবান এ অন্যায় সহ্য করবেন না। তিনি কিছু না কিছু করবেনই।"

"...পৃথিবীতে সবার জীবন চালিত তাদের কর্মফলের ওপর। আমি এতে কোন হস্তক্ষেপ করি না, আমি তোমার অত্যান্ত কাছ থেকে সবকিছুর সাক্ষী হই মাত্র। এটাই ঈশ্বরের ধর্ম..."

"উদ্ভব গীতা," ভদ্রলোক বিড়বিড় করে বললেন, "তাহলে কি আমরা একেবারেই এতিম হয়ে গেলাম?"

"এ্যাপারেন্টলি তো তাই মনে হচ্ছে, যদি না..."

"যদি না কি?"

"যদি না আপনারা নিজেদের ব্যবস্থা নিজেরা করেন।"

"সেটা কিভাবে সম্ভব? আমরা সামান্য ছা-পোষা মানুষ, মিলিটারির বিরুদ্ধে কি করতে পারি? আমাদের পরিবার-পরিজনদেরই বা কি হবে?"

"এখনই বা তাদের কি হবে? সারাজীবন শরণার্থী হয়ে কাটাবে?" ভদ্রলোক কোন উত্তর খুঁজে পেলেন না। আমাদের আলোচনার মাঝে কখন শহিদ পিছে এসে দাড়িয়েছে টের পাইনি। সম্ভবত শরণার্থী কথাটা শুনে আপসেট হয়েছে। আপসেট হবারই কথা, ব্যাপারটা সহজ নয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শরণার্থী শব্দটাতে নতুন ভীতির মাত্রা যোগ করেছে। তাছাড়া ফিলিস্তিন পরিস্থিতি শব্দটির সংজ্ঞায় পরিবর্তন এনেছে। শরণার্থী মানে এখন হিন্দিতে যাকে বলে ধোবি কা কুত্তা। অবশ্য পূর্ব পাকিস্তানে রয়ে গেলে তাদের অবস্থা আরো সঙ্গীন হবার সম্ভাবনাই বেশি। পাল্লায় মেপে ভারতকেই তারা নিরাপদ আশ্রয়স্থল হিসেবে বেছে নিবে। বিকল্প যে নেই তা নয়, কিন্তু সেই বিকল্পটা ঝুঁকিপূর্ণ। পাক আর্মির থাবাকে ঠেকিয়ে দেয়া নগরের পালিয়ে আসা নাগরিকদের কাছ থেকে তা আশা করা কতটুকু যৌক্তিক হবে তা বিতর্কের বিষয়।

কালবৈশাখির তাণ্ডবে রুগ্ন ঘরের নিচের আমার শ্রোতারা যে ভবিষ্যতের ভাবনার চেয়ে জীবন বাঁচানোকেই মুখ্য বিষয় ধরেছিল তা তাদের নিরবতাই আমতা আমতা করে প্রকাশ করছে। বাইরের ঝোড়ো বাতাসও যেন অবজ্ঞাভরে দু'টো কটু কথা শোনাচ্ছে। জীবন না হয় বাঁচল, কিন্তু তারপর? অসহায় অতিথিকে নিজের স্বার্থেই মেজবানের সীমাবদ্ধতার ব্যাপারে অন্ধ থাকতে হয়, কিন্তু মেহমানদারিরও একটা সীমা আছে। মানবতার খাতিরে কর্তা মুখ বুজে থাকলেও পরিবারের বাকি সদস্যরা তা মেনে নিবে তার নিশ্চয়তা কি? ভারত সবসময়ই পাকিস্তানের ভাঙ্গন চেয়েছে, ক্ষেত্রবিশেষে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ মদদ যোগান দিয়েছে এই ভাবনাও অস্বাভাবিক না। কিন্তু তারা কি পূর্ব পাকিস্তানকে সিন্দাবাদের ভূতের মত বহন করতে প্রস্তুত? বা করলেও সেটা কত সময়ের জন্য? বাংলাদেশের মানুষেরই কি আশা করা সাজে যে ভারত প্যাকেটে মুড়িয়ে স্বাধীনতা তাদের হাতে তুলে দিবে? শহিদ ভুল বলেনি, তাদের অবস্থা তিব্বতের মতই হতে যাচ্ছে। কিন্তু তার তখনকার সেই বক্তব্যে উপলব্ধি ছিল না, ছিল শুধু বিবশ হাহাকার- উপলব্ধি হাহাকারের চেয়ে বেশি হতাশাজনক।

'...সম্রাট ক্লডিয়াসের সময় ব্রিটনরাও নিজেদের রোমের হাতে সঁপে দেয়। সম্রাটের কতৃত্ব মেনে নিয়ে বিনাশের ভয়ে রোমানদের হাতে তুলে দেয় তাদের উপর যে কোন অত্যাচার করার অধিকার। হিস্পানিয়া, গল, গথ, ভিজিগথদের পর ইউরোপের শেষ বর্বর সম্প্রদায়ের স্বাধীনতার অহংকার ধুলোয় মিশে যায়। এক সময়ের গর্বিত জাতি বিদেশিদের হাতে লাগাম ও চাবুক তুলে দেয়। আইসেনি গোত্রের রাণী বোডিকা ও তার অপ্রাপ্তবয়স্ক দুই কন্যার সাথে যা ঘটেছিল তা তাদের ভীতি ও অপরিণামদর্শিতার অকাল পরিণতির নিদর্শন মাত্র। পরাধীনতার শৃঙখল গলার ফাঁসে পরিণত হয় ঠিক সেই সময়েই, যখন শত্রু চৌকাঠ পেরিয়ে ঘরে ঢুকে সম্মানে হাত দেয়…'

ঝড় তখন তুঙ্গে উঠেছে। বাতাস ও বজ্রপাতের শব্দ ছাপিয়ে পাশের ঘর থেকে প্রার্থনার শব্দ ভেসে আসছে। মাঝে মাঝে মনে হয় প্রার্থনার মাধ্যমে যদি সব বিপদের আসান হত! কিন্তু বাস্তবতা হল কলিযুগে ঈশ্বর সাড়া দেন না বললেই চলে। এ যুগে মানব সম্প্রদায় ঈশ্বরের ছুড়ে ফেলা খেলনায় পরিণত হয়েছে, ঘরের মেঝেতে হেলায় পড়ে থাকা তুলো ওঠা পুতুল, যা দানে বিলিয়ে দেবারও যোগ্যতা হারিয়েছে- "Whose but his own? Ingrate, he had of mee/ All he could have; I made him just and right,/ Sufficient to have stood, though free to fall./ Such I created all th’ Ethereal Powers/ And Spirits, both them who stood and them who fail’d;/ Freely they stood who stood, and fell who fell…"

আনন্দ বাবু পাশের ঘরে চলে গেছেন। শহিদ তখনও ঠায় হয়ে দাড়িয়ে। দিনের অন্ধকারে তার চেহারা আবছা আবছা দেখা যাচ্ছে। তার মনে কি চলতে পারে? অসহায়ত্বের ক্রোধ? ভীরুতার গ্লানি? কে জানে? তার মুখে ভাবনার যে মেঘ পড়েছে তা ছাপিয়ে বোঝার উপায় নেই। অন্যদিকে কালবৈশাখির তাণ্ডব শান্ত হবার পথে। বাইরে মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে। জানালা দিয়ে পদ্মার বুকে বৃষ্টির ধারা ছন্দময় সুর তুলেছে। ভেবে ভাল লাগছে যে আমরা আবার যাত্রা শুরু করতে পারব। আমার সফরসঙ্গীদের মত আমিও কিছুটা বাধ্য ভারতে যাবার জন্য। পূর্ব পাকিস্তানে আমার পেশার মানুষেরা এখন অবাঞ্চিত। আমার সফরসঙ্গীরাও হয়ত তাই, পাকিস্তানের হর্তাকর্তারা হয়ত চাইছে অবাঞ্চিত যা আছে সবাইকে বের করে নতুন করে শুরু করতে। ভাবনাটা যেই দৃষ্টিকোণ থেকেই করা হোক না কেন, মাটির তুলনায় মানুষ খুব তুচ্ছ। জেনারেলরা তা উপলব্ধি করেছে, অন্যপক্ষ কখন করে সেটাই দেখার বিষয়।

জানালাটা লাগিয়ে দিয়ে পাশের ঘরের পরিস্থিতি যাচাই করতে গেলাম। মানুষদের যাত্রার জন্য প্রস্তুতিরও সময় দেয়া দরকার। হুমায়ুন সবার থেকে একটু দূরে বসেছিল, আমাকে দেখে এগিয়ে আসে, "স্যার নৌকাতে য্যাইতে হবে, এতজনের লেগে বড় নৌকা লাইগবে।"

"তা তো অবশ্যই। পাওয়া যাবে তো, হুমায়ুন? এপাড়েই থেকে যেতে হবে না তো?"

"না স্যার। একজনরে বুলে র‍্যাখেছি, বৃষ্টি থ্যামলেই খুঁইজতে য্যাব।"

"তোমার অনেক কষ্ট হয়ে যাচ্ছে, হুমায়ুন। আমার জন্য তোমাকে অনেক খাটনি করতে হল।"

হুমায়ুন জিব কেটে বলল, "ছি! ছি! কি বুলছেন, স্যার? কষ্ট হবে কেনে? আপনি রশীদ স্যারের মেহমান, আপনেরে সহীহ সালামতে বিদায় না দিলে পেষ্টিজ থ্যাকে ক্যামনে?" বাইরে তাকিয়ে বলল, "স্যার, বৃষ্টি কমছে, আমি নৌকার ব্যাটারে লিয়ে আসি," হুমায়ুন দরজা খুলে বের হয়ে গেল। হুমায়ুনের বাইরে যাওয়া দেখে ত্রস্ত হরিণপাল নড়ে-চড়ে বসল। কেশে গলা পরিস্কার করে বললাম, "আপনারা তৈরি হয়ে যান। যে কোন সময় আমাদের বের হতে হবে।" গতবারের চেয়ে এবার কাফেলার মধ্যে ব্যস্ততা দেখা গেল। স্বাভাবিক, নদী পার হলেই নিরাপত্তা, আর কোন ক্যাম্প, বা অন্য কোন জুজুর ভয় নেই। তাদের এই অগস্ত্য যাত্রায় আর কোন প্রতিকূলতা থাকবে না। তাদেরকে প্রস্তুত হবার সুযোগ দেয়ার জন্য আমার ব্যাগটা নিয়ে বাইরে আসলাম।

ঝড়-বৃষ্টির পর চারপাশে স্নিগ্ধ ও শান্ত একটা পরিবেশ তৈরি হয়েছে। টিনের চাল বেয়ে কয়েক ফোঁটা পানি মাথায় পড়াতে চমকে উঠলাম। সিড়ির দুই ধাপ নেমে ক্যাম্পের পশ্চিমের বেড়ার কাছে গিয়ে সিগারেট ধরালাম। তিনশ মিটার পরই পদ্মা, শেষ প্রতিবন্ধকতা। অবশ্য ব্যাপারটা এমন না যে ফারাও সৈন্যদল নিয়ে পিছে তাড়া করছে আর আমাদেরকে নদীর বুক ফেড়ে রাস্তা বের করতে হবে। নদী যেভাবে ফুসছে তাতে ভাটি থেকে সৈন্য আসারও সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। তবুও মন খচখচ করছে, হুমায়ুন নৌকা জোগাড় করতে না পারলে সমস্যাই হবে। অপর পাড়ে অপেক্ষারত আমার ভারতীয় মেজবান টেনশনে পড়ে যেতে পারেন। ঘাড় ঘুরিয়ে সফরসঙ্গীদের দেখে মায়া হল, আমি হয়ত রাতে কলকাতার ভাল কোন হোটেলে উঠব, কিন্তু এদের কপালে কি আছে কে জানে৷ হয়ত তাদেরকে খোলা মাঠে থাকতে হবে বা লোকাল স্টেশনের প্লাটফর্মে। রাতে খাওয়া জুটবে কি না তারই কি নিশ্চয়তা আছে, সামনে কবে খাওয়া জুটবে সেটাই বা কে জানে। নিরাপত্তার যে নিশ্চয়তার জন্য তারা হিযরত করছে তাই মিলবে কি না এখনো শিওর না। শুধু নিশ্চিত যে পেছনে যে বিপদ ফেলে এসেছে তা আর তাড়া করবে না, এটাও নিশ্চিত যে জীবন তারা পেছনে ফেলে এসেছে তা আর মিলবে না। হুমায়ুনের দেরি দেখে কিছুটা অস্থির হয়ে উঠলাম। Time is of essence now. প্রতি মুহূর্তের দেরি পরিস্থিতিকে বিপদজনক করে দিতে পারে। সফরসঙ্গীরা দল বেধে পিছে দাড়িয়ে আছে। মুহূর্তের জন্য নিজেকে মোজেস মনে করে হেসে উঠলাম, যদিও এই ঘর-ছাড়া শরণার্থীরাও ঈশ্বরের প্রতিশ্রুত ভূমির সন্ধানেও বের হয়নি। বরং তাদের নিজের মাতৃভূমি ত্যাগ করতে হয়েছে। দূর থেকে তিনজন মানুষ আসতে দেখে বাস্তবতায় ফিরে আসলাম। হুমায়ুনের চোখে একই সাথে প্রাপ্তি ও দুশ্চিন্তা। কাছে এসে আমাকে ফিসফিস করে বলল, "কাইলকে আর্মি ইদিকে বোট লিয়ে আসছিল। আইজকেও আইসতে পারে। হামি যেরে ঠিক কইরছিলাম হেই মামুর ব্যাটা য্যাতে চাইচ্ছে না, ইরা য্যাবে।"

পরিস্থিতি অনুধাবন করে শঙ্কিত হলাম। হুমায়ুনকে কাছে ডেকে বললাম, "এই কথা আর কাউকে বলার দরকার নেই। ওরা দুইজন মাঝি?" হুমায়ুন মাথা ঝাকালো। "ওদের বলে দাও মুখ বন্ধ রাখতে।"

"জ্বি স্যার", হুমায়ুন মাঝিদেরকে ব্রিফ করতে চলে গেল। সিগারেট পা দিয়ে পিষে কাফেলার কাছে গেলাম। সবাইকে উদ্দেশ্য করে বললাম, "নৌকা এসেছে, আপনারা সবাই আস্তে আস্তে নৌকায় উঠে পড়েন," শহিদকে ইশারা করে কাছে ডাকলাম, "সবাইকে নিয়ে উঠে পড়ো। বাচ্চাদের মাঝে বসাবে," শহিদ মাথা নেড়ে চলে গেল। একই শহরের বিভিন্ন পরিবার, বিভিন্ন পরিচয়, বিভিন্ন ধর্মের লোক নিয়ে যাচ্ছি, যেন নোয়ার আরেক কিশতি। শেষবারের মত আর্মি অধ্যুষিত দেশটাকে, শহিদের বাংলাদেশ, পেছন ফিরে দেখে এক অণু বাংলাদেশ অধিষ্ঠিত নৌকার দিকে পা বাড়ালাম।

নৌকার কাছে পৌছালে হুমায়ুন এগিয়ে এলো, "স্যার, ইদের সব বুঝ্যায়ে দিলছি।" হুমায়ুনের পিঠ চাপড়ে বললাম, "ধন্যবাদ হুমায়ুন। তুমি না থাকলে বিপদে পড়ে যেতাম।"

হুমায়ুন হাত কচলে বলল, "স্যার, আইজকে যে বেয়াদবি কইরছি মাফ করে দিয়েন। হামার মাথাটা একটু গরম, তাই চিল্লাচিল্লি করি। আইজকে ফাস্ট এই কাইজ করছি, তাই মিজাজ ঠিক ছিল না। কালকে থেকে আর এরকম হবে না।"

"কালকে আবার কেন আসবে? রশীদ সাহেবের আরো মেহমান আছে নাকি?"

"না স্যার। হামি এখন রাস্তা চিনি। ভাব-সাব দেইখে মনে হলছে এদের মত লোক আরো আছে। উদেরও লিয়ে আইসপো পাইরলে।"

"তোমাকে তো মেডেল দেয়া উচিৎ দেখছি…"

"মেডেল লাইগবে না, স্যার। পারলে আমার একটা ছবি বিদিশি পেপারে দিয়েন আর কলম দিয়ে দুইটা কথা লিখেন।"

"অবশ্যই লিখব…"

"আমি তাহলে যাই স্যার, দোয়া রাইখেন," বিদায় নিয়ে হুমায়ুন শহরের দিকে রওনা দিল। পিছন থেকে হুমায়ুনকে দেখে হাসি পেল। বেচারা একটা ছবি ছাপাতে চায় অথচ সেই ছবি তোলার কথাই ভুলে গেল। আমিও আর পেছন থেকে ডাকলাম না। কিছু ঘটনা, কিছু চরিত্র গল্প হয়েই থাকুক। ইতিহাস এদের নিয়ে মাথা ঘামায় না, because history is about kings and queens, but stories are about people.

দিগন্তের কালো রেখা আমাদের গন্তব্য। নৌকার সামনের উঁচু অংশটাতে নিজের জায়গা করে নিলাম, উদ্দেশ্য উত্তর-দক্ষিণে নজর রাখা। আমার সম্মতি পেয়ে মাঝিরা নৌকা ছেড়ে দিল। নোয়াও বুঝি এরকম পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছেন। অবশ্য তার তুলনায় আমার দায়িত্ব খুবই সামান্য। তার উপর দায়িত্ব ছিল পৃথিবীতে প্রাণের অস্তিত্ব বজায় রাখা, আর আমার উপর অল্প কিছু মানুষের প্রাণ রক্ষার দায়িত্ব বর্তেছে।

ঢেউয়ের ধাক্কায় নৌকা সোজা রাখতে মাঝিদের বেশ যুদ্ধ করতে হচ্ছে। নদীর পানি গলুইয়ে আছড়ে আমার গা ভিজিয়ে দিলে কিছুটা সরে বসলাম। আনন্দ বাবু তার বাচ্চাদের কোলে জড়িয়ে বসে আছেন। আমার তাকিয়ে আছি দেখে আমার দিকে হাত নাড়লেন। বাচ্চাদের মায়ের কোলে দিয়ে আমার দিকে এগিয়ে এলেন। তার দেখাদেখি শহিদও এগিয়ে এল। তিনজন চুপচাপ বসে আছি। গানবোটের টহলের ব্যাপারটা তখনও মাথায় ঘুরছিল। মনের আশঙ্কা বোধহয় মুখে ছাপ ফেলেছিল। আনন্দ বাবু জিজ্ঞেস করলেন, "কোন সমস্যা আছে নাকি, এডি সাহেব?"

"না, সমস্যা কি? বিপদ তো পিছনে ফেলে এসেছি।"

ফেলে আসা ভূমির দিকে তাকিয়ে আনন্দ বাবুর মুখ কালো হয়ে গেল, "রাগ করে পাশের বাড়ির লোকও কোনদিন হিন্দু বলে গাল দেয়নি। অথচ ধর্মের জন্য আজকে দেশ ছাড়া হতে হল। বাপ-দাদা সাতচল্লিশের পর দেশ ছাড়লো না নিজের মাটির দাবিতে। সেই ছাড়তেই হল চব্বিশ বছর পর। আর কোনদিন হয়ত ফিরে যাওয়া হবে না।"

"আমার বড় ভাই", শহিদ মাথা নিচু করে কথাগুলো বলল, "কোনদিন রাজনীতি নিয়ে মাথা ঘামায়নি। বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢোকার পর থেকে সবার মত আমিও স্টুডেন্ট পলিটিক্সে ঢুকে পড়ি। ভাই বলতেন রাজনীতি ছেড়ে পড়া-শোনা কর, তার মত সিএসপি জয়েন করতে হবে। অথচ সেদিন আমার খোঁজে এসে ওরা ভাইকে ধরে নিয়ে গেল। চারদিন আমরা অপেক্ষা করেছি, ভেবেছি ওদের ভুল ভাঙ্গলে ভাইকে ফেরত দিবে…," জামার হাতা দিয়ে চোখ মুছে বলল, "এলাকার লোকজন পরামর্শ দিল পরিবার নিয়ে ভারতে চলে যেতে, অনেকেই গেছে। কিন্তু ভারত কি আমার দেশ? সেখানে গিয়ে কি করব? ভাইয়ের বাচ্চাগুলো কি ঠিকভাবে খেতে-পরতে পাবে? পরিবারের যথেষ্ট নিরাপত্তা থাকবে? আর কোনদিন কি বাড়ির ছাদে বসে সবাই রেডিওতে গান শুনতে পারব?"

এ প্রশ্নগুলোর জবাব নেই। অবশ্য আমি উত্তর দিতে বাধ্যও নই। বাতাস থেকে আড়াল করে সিগারেট ধরিয়ে বললাম, "ভিরিএথাসের গল্প শুনবে?"

'...ভিরিএথাসের কথাই ধরা যাক না। সন্ধি করার নামে রোমান গভর্ণর গ্যালবা লুসিথানিয়ার জনগণকে ডেকে যখন তাদেরকে গণহারে হত্যার আদেশ দিয়েছিল ভিরিএথাস ও তার পরিবারও সেখানে উপস্থিত ছিল। বৌ-বাচ্চা হারিয়ে ভিরিএথাস যখন উদ্ভ্রান্তের মত এদিক-সেদিক ঘুরছিল তখন লুসিথানিয়ার বেঁচে যাওয়া মানুষ জন তাকে অনুরোধ করে তাদেরকে পথ দেখানোর। সর্বহারা এই জনগণ নিয়ে ভিরিএথাস রোমের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রাম গড়ে তোলে… '

নৌকা তখন মাঝ নদীতে। স্রোতের টানে নদীর বুকে কোণাকুণি এগিয়ে চলছে। আপাতদৃষ্টিতে শান্ত মনে হলেও নদীতে বেশ ঢেউ আছে, জায়গায় জায়গায় পানি গোল হয়ে পাক খাচ্ছে। সর্বহারা অসহায় মানুষগুলোর দিকে তাকালাম। অনেকেই এখনো ফেলে আসা ভূমির দিকে তাকিয়ে আছে। বাকিরা মাথা নিচু করে আসন্ন ভবিষ্যতের দুশ্চিন্তায় মগ্ন। আনন্দ বাবু তার পরিবারের কাছে ফিরে গেছেন। স্ত্রীর সাথে কোন একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারে আলোচনা করছেন। তার স্ত্রী মাথা নিচু করে চোখের পানি ফেলছেন। বাচ্চাগুলো অবাক হয়ে মা-বাবার কথোপকথন শুনছে। শহিদ তখনো শক্ত হয়ে আমার পাশে বসে। পরিবারের জন্য উদ্বেগ ও অপরাধবোধ তাকে কুরে কুরে খাচ্ছিল। সামনে দিগন্তের কালো রেখাটি ধীরে ধীরে সবুজ রং ধারণ করতে শুরু করেছে, আর পিছে দিগন্ত কালো হয়ে গেছে। উত্তর-দক্ষিণ থেকে কোন টহল বোটের আভাস পাওয়া যাচ্ছে না দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লাম। নিরাপত্তা আর অল্প সময়ের দূরত্ব। কিছুক্ষণের মধ্যেই নৌকা তীরে ভিড়ল।

জেনে অবাক হলাম যে তীরটাও বাংলাদেশের অংশ, নদী পার হয়ে এক টুকরো বাংলাদেশ। তীর পেরিয়ে সামনের খোলা বিস্তীর্ণ মাঠে অস্বাভাবিক জন সমাগম। যাত্রীরা একে একে নৌকা থেকে নেমে এল। কয়েকজনকে দেখলাম মাটিতে মাথা ঠেকিয়ে বিলাপ করছে। হয়ত মাতৃভূমিকে শেষবার বিদায় জানানোর চেষ্টা। আমাদের দেখে কয়েকজন ইউনিফর্মধারী এগিয়ে এল, সম্ভবত ভারতের বর্ডার সিকিউরিটি। দেখলাম আনন্দ বাবু এগিয়ে গিয়ে তার সাথে কথা বলছেন। আনন্দ বাবুর সাথে কথা বলে অফিসার গোছের একজন আমাকে দেখে এগিয়ে এল, "স্যার, আপনার পাসপোর্টটা যদি একবার দেখাতেন।"

ব্যাগ থেকে পাসপোর্ট বের করে অফিসারের হাতে দিলাম, "পাসপোর্ট দেখাতে পারব, কিন্তু ভিসা যে নেই। দয়া করে পুশ ব্যাক করবেন না।"

অফিসারটি উচ্চস্বরে হেসে উঠল, "আপনাকে পুশ ব্যাক করতে গেলে এদের সবাইকেও করতে হবে।"

"এদের তাহলে পুশ ব্যাক করবেন না!"

"কেন করব? গত ২৬ তারিখ থেকেই পূর্ব পাকিস্তানের গোটা সীমান্ত থেকে এভাবে শরণার্থী আসছে। কতজনকে আবার নরকের দুয়ারে ফেরত পাঠাবো?"

"কেন্দ্রের নির্দেশ?"

"আনন্দ বাবু বলেছেন যে আপনি সাংবাদিক। কেন্দ্র থেকে কোন নির্দেশ আসেনি, আমরা নিজেদের উদ্যোগেই ব্যবস্থা করছি।"

"কি ধরণের ব্যবস্থা?"

"অস্থায়ী শরণার্থী ক্যাম্প। এক পশ্চিম বঙ্গেই প্রায় পাঁচশ মত ক্যাম্প খোলা হয়েছে।"

"এগুলোর খরচ কে বহন করবে?"

"ওই যে বললাম নিজেদের উদ্যোগে, স্থানীয় ভাবে। এনিওয়ে, আপনি তো ক্যাম্পে থাকবেন না, তাই না? আপনার কি ধরণের ব্যবস্থা করেছেন? বিএসএফ- এর রেস্ট হাউস আছে পরের শহরে, চাইলে ব্যবস্থা করতে পারি।"

"আমার প্রতি এত সদয় হবার কারণ?"

"শুনলাম আপনি এই মানুষগুলোকে পথ দেখিয়ে নিয়ে এসেছেন, পুরস্কার হিসেবে এই ধরণের ট্রিটমেন্ট আশা করতেই পারেন।"

"ধন্যবাদ, আমাকে নিতে লোক আসবে," ভীড়ের মধ্য থেকে কৃষ্ণলাল চ্যাটার্জি আমার দিকে তাকিয়ে হাত নাড়ল, "ওই যে চলে এসেছেন।" কৃষ্ণলাল এগিয়ে এসে বললেন, "খুব দুশ্চিন্তায় ছিলাম, মশাই। পথে কোন সমস্যা হয়নি তো? আমি সারাদিন ভাবছিলাম ভুল মেসেজ পেয়েছি কি না…" অফিসারকে বললেন, "আমিও সাংবাদিক, ইনি আমার গেস্ট।"

"কলকাতায় যেয়ে গেস্টের কাগজ-পত্র ঠিক করুন আগে।"

"আনন্দ বাবু আর ওই ছেলেটাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন?"

"আপনি মশাই খুব ঝামেলার লোক। ওদেরকে ক্যাম্প তদারকির কাজ দেয়া হবে। এজন্য আলাদা করা হচ্ছে," কৃষ্ণলাল বাবুর দিকে ঘুরে বললেন, "আপনার গেস্টকে নিয়ে কেটে পড়ুন তাড়াতাড়ি, নইলে সত্যি সত্যিই পুশ ব্যাক করব," অফিসার চলে গেলেন।

"চলুন, রাতের ট্রেনে কলকাতা ফিরব। হোটেলে আপনার থাকার ব্যবস্থা করেছি। অসুবিধা নেই তো?"

"না," দূর থেকে দেখলাম আনন্দ বাবু তার পরিবারের কাছে ফিরে এসেছেন। স্ত্রীর হাত ধরে নদীর পাড়ে চলে গেলেন। কৃষ্ণলাল ও সেদিকে তাকিয়ে চমকে উঠলেন, "সে কি!" আনন্দবাবু নদীর পানি দিয়ে তার স্ত্রীর মাথার সিঁদুর মুছে দিলেন। আর বাঙ্গালী রমণী তার হাতের শাঁখাগুলো পানিতে ফেলে দিল।

"চলুন, যাওয়া যাক," আমার ডাকে কৃষ্ণলাল সম্বিৎ ফিরে পেলেন, "এখানকার লোকাল ডেলিকেসি কি? ট্রেনে ওঠার আগে চেখে দেখার সময় হবে? ভাল সিঙ্গারা পাওয়া যায়…"

'... কিংবা অ্যালেরিক, যে কি না একজন রোমান সিপাহি হয়েও শিকড়ের টানে ভিজিগথদের রাজা হয়েছিল। যার পরাক্রম অহংকারী রোমানদের তার পদলুন্ঠিত হয়েছিল। কিংবা সেই সব তথাকথিত বর্বর যারা অন্যায় ও শোষণের বিরুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়েছিল। সদ্য স্বাধীন ঘোষিত বাংলাদেশ আজ সেই সন্ধিক্ষণে দাড়িয়ে। রোমান সেনাবাহিনীর প্রচণ্ড দাপট, আধুনিক অস্ত্র, জেনারেলদের নৃশংসতা এবং সম্রাট ও সিনেটের লোভ ও অহংকারের বিরুদ্ধে গথ, ভিজিগথ, জার্মানিক গোত্র, ব্রিটন বা লুসিথানিয়ার বিদ্রোহ হালে পানি পায় নি। চব্বিশ বছরের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক শোষণের পর সামরিক বাহিনী কর্তৃক সংঘটিত এই গণহত্যা বাঙ্গালীকে বিকল্প পথ দেখাচ্ছে। সেই পথ তাদের শৃঙ্খল মোচন করবে না কি ইতিহাসের ব্যর্থ বিপ্লবগুলোর তালিকায় নতুন নাম যোগ হবে তা সিদ্ধান্ত নেয়ার দায়িত্ব এখন সদ্য স্বাধীনতা ঘোষিত বাংলাদেশের আট কোটি মানুষের।'





সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই সেপ্টেম্বর, ২০২০ রাত ১২:২৩
২টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।

লিখেছেন ৎৎৎঘূৎৎ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতীয় পণ্য বয়কটের কেন এই ডাক। একটি সমীক্ষা-অভিমত।।

লিখেছেন সাইয়িদ রফিকুল হক, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৩:১৫



ভারতীয় পণ্য বয়কটের কেন এই ডাক। একটি সমীক্ষা-অভিমত।।
সাইয়িদ রফিকুল হক

বিএনপি ২০২৪ খ্রিস্টাব্দে দেশে অনুষ্ঠিত “দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে”-এ অংশগ্রহণ করেনি। তারা এই নির্বাচনের বহু আগে থেকেই নির্বাচনে অংশগ্রহণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

একটি ছবি ব্লগ ও ছবির মতো সুন্দর চট্টগ্রাম।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৮:৩৮


এটি উন্নত বিশ্বের কোন দেশ বা কোন বিদেশী মেয়ের ছবি নয় - ছবিতে চট্টগ্রামের কাপ্তাই সংলগ্ন রাঙামাটির পাহাড়ি প্রকৃতির একটি ছবি।

ব্লগার চাঁদগাজী আমাকে মাঝে মাঝে বলেন চট্টগ্রাম ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

×