somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

শিক্ষক থেকে আবার ছাত্র হলাম

১৫ ই সেপ্টেম্বর, ২০২১ রাত ১১:২৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র হবার সুবাদে যে প্রশ্নের মুখোমুখি আমাকে সবচেয়ে বেশি হতে হয়েছে তা হল- কতদিনে ইংরেজি শেখা যায়। দুই বছর একটা IELTS কোচিং সেন্টারের সাথে সংযুক্ত থাকার কারণে অল্প কিছু ধারণা ছিল। আমার সেই ক্ষুদ্র জ্ঞান থেকে যতটুকু পেরেছি সবাইকে উত্তর দেয়ার চেষ্টা করেছি। মজার ব্যাপার হল যাদের পরামর্শ দিয়েছি তাদের কেউই তাদের ইংরেজি পরিস্থিতির উন্নতি করতে চেষ্টা করেনি, বরং কেউ কেউ মাসখানেকের ব্যবধানে একাধিক বার একই প্রশ্ন করেছেন। এখন পর্যন্ত আমি যে প্রশ্নতে সবচেয়ে বেশি বিরক্ত হই তা হল- কিভাবে আমার/ আমার সন্তানের ইংরেজি ভাল করব। বর্তমানে আমি এক কথায় উত্তর সারি।
মানুষ কেন ইচ্ছা থাকা স্বত্বেও ইংরেজি ভাষা ঠিকভাবে শিখতে পারে না বা শ্বাসরুদ্ধকর (ইংরেজিতে কথা বলতে যেয়ে শ্বাস আটকে যাওয়া)উচ্চারণে ইংরেজি বলে বা ইংরেজি বইয়ের প্রতি অনিহা (বাংলাদেশে অনুবাদ সাহিত্য জনপ্রিয় হবার পর থেকে এই প্রবণতা আরো বেড়েছে) পোষণ করে? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে দেখলাম গলদটা গোড়ায়। আমরা প্রাইমারি থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত প্রায় বারো বছর ধরে ইংরেজি পড়ি। মজার ব্যাপার হল Tense পড়ি প্রতি বছরই, তারপরও কেন জানি Tense ভীতি আমাদের যায় না। টিউশনি করার সময় দেখেছি ইংরেজি টিউটরের ডাক পড়ে পরীক্ষার তিন মাস আগে। সিলেবাস তো শেষ করতেই হয় এই অল্প সময়ের মধ্যে তার উপর মাঝে মাঝে বাড়তি আবদার থাকে “আমার বাচ্চাটাকে একটু ইংরেজিতে ভাল করে দিও বাবা যেন একটু আধটু বলতেও পারে”। কিন্তু সময় মাত্র তিন মাস! এটা বুঝি যে অন্যান্য বিষয়গুলোর যেরকম চাপ তার সাথে তাল মিলিয়ে সারা বছর ইংরেজি পড়ার সময় করা সম্ভব না। তারপরও এরকম আবদার শুনলে দাঁতে দাঁত চেপে ‘হু’ বলে চলে আসা ছাড়া উপায় ছিল না।
এখন যখন আমার ইংরেজি শেখা নিয়ে ভাবি তখন বুঝি ভাষা শেখা একটা ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। একে সময়ের বেড়াজালে ফেলে শিকার করা সম্ভব না। স্কুলে দুইজন ভয়ংকর ইংরেজি শিক্ষক পেয়েছিলাম যারা আমার ব্যাকরণের ভিত তৈরি করেছেন এবং মাধ্যমিকে স্কুল পরিবর্তনের পর একজন শিক্ষকের সান্নিধ্য পেয়েছি যিনি সেই ভিতের উপর শব্দভাণ্ডারের পলস্তারা দিয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির আগে থেকে আমি ইংরেজি বই সাবলিল ভাবে পড়তে পারতাম। এই তিনজনের কাছে আমি চিরকৃতজ্ঞ থাকব। বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে শুধু ভাষাকে পলিশ করেছি।
ভাষার ভিত ধারাবাহিকভাবে গড়তে হয়। যেহেতু আমরা ইংরেজদের গোলামি করে এসেছি এবং বিশ্বজনীন ভাষা হিসেবে ইংরেজি ব্যবহারের রীতি আমাদের এই ভাষা শিখতে বাধ্য করে। চাকুরি বা বিদেশ গমনের জন্য এর শিক্ষা অপরিহার্য তা সবাই বলে। IELTS কোচিং সেন্টারে শিক্ষকতা করার সুবাদে জানি যে সেইসব জায়গায় তিন মাসে ইংরেজি শিক্ষা- র নামে যে প্রতারণা করা হয় তার মূলে হল আমাদের দূর্বল প্রাইমারি শিক্ষা ব্যবস্থা। বারো বছর ইংরেজি শেখার পর তিন মাসে ইংরেজি শেখানো কোন বড় ব্যাপার না। এই ধরণের প্রতিষ্ঠানগুলো (বিশেষ করে যেগুলো সুপরিচিত) ধরে নেয় গ্রাহক বারো বছরে কিছু না কিছু শিখে এসেছে, আমাদের দায়িত্ব হল চর্চার অভাবে যে জং ধরেছে তা পালিশ করা, এবং এটা যৌক্তিক। কিন্তু যেসব গ্রাহক সেখানে আসেন তাদের অধিকাংশেরই ভিত বড়ই নড়বড়ে। সেই নড়বড়ে ভিতের উপর ইমারত তোলা সহজ কাজ নয়, বিশেষ করে তিন মাসে।
এবার আসি গ্রাহকরা তিন মাসে ভাষা শিক্ষা নিয়ে কি ধরণের ধারণা পোষণ করেন। বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থার আরেকটি অভিশপ্ত দিক হল (অন্তত আমার কাছে) শিক্ষক নির্ভরশীলতা। বর্তমানে এর প্রবণতা ভয়ংকরভাবে বেড়েছে। একজন গ্রাহক ইংরেজি ভাষা শিক্ষা কোর্স করতে এসে চিন্তা করেন “ভাল প্রতিষ্ঠানে এসেছি, শিক্ষকরা অনেক নামকরা, এবার আমার ইংরেজিতে বস হওয়া কেউ ঠেকাতে পারবে না (একটু বাড়িয়ে বললাম আর কি)। তাকে বস বানানোর শতভাগ দায়িত্ব সেই নামকরা শিক্ষকদের। তারা শুধু ক্লাসে আসবেন, লেকচার শিট নিবেন, তারপর বাড়ি গিয়ে হিন্দি নাটক/সিরিয়াল দেখবেন। কোনদিন ক্লাস টেস্ট থাকলে সেদিন অফিসে কাজের চাপ বেড়ে যায় বা বাসায় কোন অনুষ্ঠান, পারিবারিক ঝামেলা থাকে। তিন মাস পর কোন রকমে একটা সনদ নিয়ে যেখানে জমা দেয়া দরকার দিলে তার দায়িত্ব শেষ। আবার বেকায়দায় যদি কোনদিন কোথাও ঠেকে যান তবে সেই নামকরা শিক্ষকদের গুষ্টি উদ্ধার করে ছেড়ে দেন, শিক্ষকরা তাদের দায়িত্ব ঠিকভাবে পালন করেনি।
আমার এই পোস্টের উদ্দেশ্য কোচিং সেন্টার বা শিক্ষকদের ওকালতি করা নয়, বরং ভাষা শিক্ষা। করোনাকালে অনেকেই নতুন ভাষা শেখার চেষ্টা করছেন। ভাষা শিক্ষার ব্যাপারে আমার নিজের ধারণা ছিল আমার পক্ষে নতুন ভাষা শেখা সম্ভব না। আমি আমার নিজের এলাকার স্থানীয় ভাষা এত বছরে রপ্ত করতে পারিনি। স্টেশনে নেমে রিকশা করতে গেলে রিকশাওয়ালা মামা আমার ভাষা শুনে মামু পাইছি ভেবে দ্বিগুন ভাড়া হাঁকায় (গালি খাবার পর অবশ্য ন্যায্য ভাড়াতে রাজি হয়)। যাই হোক ভাবলাম সময়টাকে কাজে লাগাই, কিছু একটা শিখি। সৈয়দ মুজতবা আলি আমার সবচেয়ে প্রিয় লেখক, তার চাচা কাহিনী শত শত বার পড়েছি। তাই ভাবলাম গুরুর মত জার্মান শিখি। কোচিং এর অভিজ্ঞতা থেকে জানি সেখানে গেলে অযথা হাজার হাজার টাকা পানিতে ফেলে আসা ছাড়া কিছু হবে না। তাছাড়া আমার কোন সনদ দরকার নেই, জার্মান ভাষায় কাফকা আর গ্যেটে পড়ার মত বিদ্যা অর্জন করতে পারলেই বুঝব শিখতে পেরেছি (এই মুহুর্তে কাফকার মেটামরফসিস ভাঙ্গা ভাঙ্গা জার্মানে ডিকশনারি আর নোটবুক কাছে রেখে পড়ছি আর অডিওবুক শুনছি)। ইংরেজির মত জার্মান ভাষা শিক্ষার ম্যাটেরিয়ালগুলো সহজলভ্য না। ইন্টারনেট ঘাঁটা শুরু করলাম। প্রথম তিন মাস গেল শুধু ম্যাটেরিয়াল জোগাড়ে। সাথে সাথে ডুয়োলিঙ্গো অ্যাপ ব্যবহার করছি। তিন মাস পর দেখি কিছু মুখস্ত বাক্য ছাড়া তেমন কিছুই শেখা হয়নি। হতাশা তখন আমাকে রীতিমত গ্রাস করে ফেলেছে। তখন চিন্তা করতে শুরু করলাম ইংরেজি কিভাবে শিখেছি, আর হিন্দি গান কিভাবে দুই-তিন বার শুনে গুন গুন করে গাইতে পারি। উত্তরটা খুবই সোজা- লিসেনিং স্কিল। ইউটিউবে অভিজ্ঞরাও একই পরামর্শ দেন। জার্মান সিনেমা ও নাটক দেখা শুরু করলাম দেদারসে। এক মাস পর দেখি তাতেও তেমন উন্নতি নেই। বুঝলাম সাবটাইটেল দিয়ে ভাষা শেখার ক্ষমতা থাকলে এতদিনে জাপানিজ, তামিল, তেলেগু আর মালায়লাম শিখে যেতাম। এই রাস্তায় যাওয়া যাবেনা। ফেসবুকে বিভিন্ন ভাষা শিক্ষা গ্রুপে জয়েন করেছিলাম। সেখানে একজন পরামর্শ দিল গান শুনতে। এর মধ্যে স্পোটিফাই বাংলাদেশে সেবা দেয়া শুরু করেছে। ২৭০+ টাকা/মাস দিয়ে স্পোটিফাই সাবস্ক্রিপশন কিনলাম। শুরু করলাম জার্মান গান শোনা, রামস্টাইন বিশেষভাবে পছন্দ হল। প্রথম প্রথম গানের লিরিক সামনে রেখে গান শোনা শুরু করলাম। ডিকশনারি মোবাইলেই আছে, গান শুনতে শুনতেই শব্দার্থ বের করি। কিছুদিনের মধ্যেই উন্নতি লক্ষ্য করলাম, কিন্তু সমস্যা হল লিরিক সামনে না রাখলে অর্থ বুঝি না। এর কারণও বের হল- জার্মান পড়া হয় না। রিডিং ভাষা শেখার জন্য একটি অপরিহার্য টুল। বস্তুত সবচেয়ে পুরনো ও কার্যকরী টুল। আবার ইন্টারনেট জাল ফেলা শুরু করলাম। আমার লেভেলে পড়ার মত ম্যাটেরিয়াল পাওয়া সহজ ছিল না। এরপর ছোট ছোট প্যাসেজ পড়ে শব্দার্থ বের করে পড়া শুরু করলাম। একমাস পর ভয়ংকর উন্নতি লক্ষ্য করলাম। বর্তমানে আমার ভাষা শিক্ষা শুরু করার পর সাত মাস অতিবাহিত হয়েছে। ইণ্টারমিডিয়েট লেভেলের জার্মান পড়তে পারি, পডকাস্টগুলো দুইবারে বুঝতে পারি। যখন কোন কিছু করার জুত থাকে না তখন কানে ইয়ার প্যাড লাগিয়ে গান শুনি বা অডিওবুক শুনি। দুই বছর টার্গেট করে শেখা শুরু করেছিলাম, আশা করছি তার আগেই শিখে যাব।
এই সাত মাসে আমার উপলব্ধি হল ভাষা শেখা কঠিন কিছু নয়। পৃথিবীতে শতকরা একভাগ মানুষ পলিগ্লট বা বহুভাষী, এরা পাঁচ বা তার বেশি ভাষা জানেন। ইউটিউবে একজনকে ফলো করি যিনি ২০ টি ভাষা জানেন এবং ২১ নম্বর ভাষা শিখছেন। তিনি পঞ্চাশের পর থেকে শুরু করেছিলেন। এখন তার বয়স ৭৩। এর জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন নিয়মানুবর্তিতা। এই সাত মাসে আমাই একদিনও কামাই দেই নাই। সারাদিন যতই ব্যস্ততা থাকুক অন্তত ১৫-৩০ মিনিট পড়েছি। শোনার প্রক্রিয়া তো সবসময়ই চলছে (এই মুহুর্তে গান শুনছি)। হতাশা আসবে, মানুষের ব্যঙ্গ তীরের মত ধেয়ে আসবে- এগুলোও উপভোগ্য। সত্য বলতে আমি এই প্রক্রিয়ার প্রেমে পড়ে গেছি। ইচ্ছে আছে জার্মান শেখার পর নতুন কোন ভাষা শিখব।

সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই সেপ্টেম্বর, ২০২১ রাত ১২:০২
৬টি মন্তব্য ৬টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বাংলাদেশের লোকসংস্কৃতিঃ ব্যাঙের বিয়েতে নামবে বৃষ্টি ...

লিখেছেন অপু তানভীর, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:০০



অনেক দিন আগে একটা গল্প পড়েছিলাম। গল্পটা ছিল অনেক এই রকম যে চারিদিকে প্রচন্ড গরম। বৃষ্টির নাম নিশানা নেই। ফসলের মাঠ পানি নেই খাল বিল শুকিয়ে যাচ্ছে। এমন... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশি ভাবনা ও একটা সত্য ঘটনা

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:১৭


আমার জীবনের একাংশ জুড়ে আছে; আমি চলচ্চিত্রাভিনেতা। বাংলাদেশেই প্রায় ৩০০-র মত ছবিতে অভিনয় করেছি। আমি খুব বেছে বেছে ভাল গল্পের ভাল ছবিতে কাজ করার চেষ্টা করতাম। বাংলাদেশের প্রায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাকি চাহিয়া লজ্জা দিবেন না ********************

লিখেছেন মোহাম্মদ সাজ্জাদ হোসেন, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:৩৫

যখন প্রথম পড়তে শিখেছি তখন যেখানেই কোন লেখা পেতাম পড়ার চেষ্টা করতাম। সেই সময় দোকানে কোন কিছু কিনতে গেলে সেই দোকানের লেখাগুলো মনোযোগ দিয়ে পড়তাম। সচরাচর দোকানে যে তিনটি বাক্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

=এই গরমে সবুজে রাখুন চোখ=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১

০১।



চোখ তোমার জ্বলে যায় রোদের আগুনে?
তুমি চোখ রাখো সবুজে এবেলা
আমায় নিয়ে ঘুরে আসো সবুজ অরণ্যে, সবুজ মাঠে;
না বলো না আজ, ফিরিয়ো না মুখ উল্টো।
====================================
এই গরমে একটু সবুজ ছবি দেয়ার চেষ্টা... ...বাকিটুকু পড়ুন

কুড়ি শব্দের গল্প

লিখেছেন করুণাধারা, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:১৭



জলে ভাসা পদ্ম আমি
কোরা বাংলায় ঘোষণা দিলাম, "বিদায় সামু" !
কিন্তু সামু সিগারেটের নেশার মতো, ছাড়া যায় না! আমি কি সত্যি যাবো? নো... নেভার!

সানমুন
চিলেকোঠার জানালায় পূর্ণিমার চাঁদ। ঘুমন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

×