“আমি দুধের গ্লাস মুখে নিতেও ভয় পাই, যদি তা ফেটে স্প্লিন্টারগুলো আমার মুখে এসে বেধে, এমন না যে ব্যাপারটা নিছক দুর্ঘটনা হবে, এটা যদি কারো পরিকল্পনা হয় তবে?”- কথাগুলো লিখেছে বিখ্যাত সাহিত্যিক ফ্রানজ কাফকা তার বান্ধবী মিলেনা জেসেনকাকে। জীবন সম্পর্কে কাফকার অনুভূতি এমনই ছিল। ইংরেজি সাহিত্যে পড়া-শোনা করেছেন বা ইংরেজি সাহিত্য সম্পর্কে আগ্রহ আছে এমন মানুষদের মধ্যে খুব কম সংখ্যকই আছেন যারা কাফকার নাম শোনেননি বা তার লেখা The Metamorphosis পড়েননি। আমি যখন তৃতীয় বর্ষে The Metamorphosis পড়ি তখন আতঙ্কে কেঁপে উঠেছিলাম। কেঁপে ওঠার কারণটা এটা নয় যে প্রধান চরিত্র একটি পোকায় পরিণত হয়েছে। গল্পের মূল বক্তব্য সেটা নয়। মূল বক্তব্য হল পরিত্যাগের আতঙ্ক। একটি পরাবাস্তব পরিস্থিতিতে কাফকা এই অনুভূতিকে এত ভয়ংকর বাস্তব রূপ দিয়েছেন যার ফলে পাঠকরাও প্রধান চরিত্র ও লেখকের এই ভীতি নিজেদের মধ্যে ধারণ করে নেন। গল্পটি আমাকে এমনভাবে নাড়া দিয়েছিল যে পরের বেশ কয়েকদিন আমি আমার প্রিয়জনদের সাথে ঠিকভাবে কথা বলতে পারিনি। এরপর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম বইটি আর কখনো পড়বো না।
প্রায় ছয়-সাত বছর পর সপ্তাহখানেক আগে বইটি আবার কিনলাম। কাফকার সাহিত্যরস উপভোগ করা আমার লক্ষ্য নয়। বরং জার্মান রিডিং অনুশীলন করার জন্য বইটি কেনা। ইন্টারনেট থেকে জার্মান ভাষায় লেখা গল্পটি ডাউনলোড করে প্রিন্ট করেছিলাম, ইংরেজিটা ভাল করে কয়েকবার পড়ে জার্মানটা নিয়ে বসব। এতদিন পরে এসেও দেখলাম আতঙ্কের মাত্রাটা কমেনি। অনেক কষ্টে জার্মানটা পড়ে শেষ করে ভাবলাম কাফকার অন্য বইগুলোতে পাঠকের জন্য সে কি ধরণের পরিবেশ তৈরি করে রেখেছে। এরপর বসলাম তার The Trial বইটা নিয়ে। The Metamorphosis কাফকার সবচেয়ে পরিচিত বই হওয়ার কারণ হল এখানে সে সার্বজনীন একটা মানবিক অনুভূতিকে চারিত্রিক রূপ দিয়েছে। The Trial অবশ্য একটু আলাদা। প্রাপ্তবয়স্ক, যারা সব সময় শাসন ও অনুশাসনের মধ্য দিয়ে নিজেদের জীবনতরী পার করার চেষ্টায় মত্ত্ব তাদের উদ্দেশ্যেই এই বই। প্রধান চরিত্রের সাথে রিলেট করার মত অনেক ইস্যু রয়েছে। আবার এখানেও কাফকা পরাবাস্তবতার একটি আবহ তৈরি করেছে, গতানুগতিক ধারার একটি সমাজ যা হঠাৎ করেই প্রধান চরিত্রের কাছে অচেনা মনে হয়। The Metamorphosis এর সাথে এই জায়গায় এই বইয়ের একটি মিল রয়েছে। আসলে কাফকার প্রায়ই সব গল্পই প্রধান চরিত্রকে একটি দুরাবস্থার মধ্যে ফেলে দেয়, প্রকাশ করার ধরণ ও মাধ্যমটা শুধু আলাদা। একেক গল্প মানব জীবনের একাকিত্বের ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিকোন নিয়ে আলোচনা করে। The trial এবং পরে আরেকটি বই পড়লাম The Castle (অসমাপ্ত বই)। এই দুইটি বই আমলাতন্ত্রের অদ্ভুত অদ্ভুত দিকগুলো কিভাবে ব্যাক্তিকে পর্যদুস্ত করে সেটা দেখানোর চেষ্টা করেছে। শুধু পটভূমি দিয়ে নয়, সাথে উপন্যাসগুলোর শব্দচয়নও ছিল mechanical ও interupted যা উপন্যাসগুলোকে আরো বাস্তব রূপ দিয়েছে।
তিনটি গল্পই (একটি নভেলা ও দুইটি উপন্যাস) কাফকার মানসিক পরিস্থিতির বহিঃপ্রকাশ। অকৃতদার কাফকা কয়েকবার বাগদান করলেও বিয়ে করেনি। বিয়ে পরবর্তী যৌন জীবন সম্পর্কে কাফকা ছিল বেশ ভীত, যদিও পতিতালয়ে যাবার অভ্যাস তার ছিল। এছাড়া তার মধ্যে anandonment issue টি ছিল প্রখর, পরিত্যক্ত হবার ভয়ে বারবার সে বিভিন্ন সম্পর্ক থেকে দূরে চলে এসেছে। সাধারণ মানুষের মধ্যেও এই অনুভূতি কাজ করে, কিন্তু সেটা পরিমিত পরিমাণে। আমরা সবাই প্রিয়জনদের দূরে চলে যাবার ভয় পাই, কিন্তু তাই বলে নতুন সম্পর্ক তৈরিতে সেটা বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় না। মনোবিজ্ঞানী পেরেজ আলভারেজ দাবি করেন কাফকা শিজয়েড পার্সোনালিটি ডিজঅর্ডারে ভুগত। শিজয়েড পার্সোনালিটি ডিজ অর্ডারে ভোগা রোগীদের মধ্যে সামাজিক জীবনের প্রতি অনীহা, গোপনীয়তা, ঠাণ্ডা আচরণ, সহানুভূতির অভাব ইত্যাদি দেখা যায়। এই ধরণের রোগীরা নিজেদের তৈরি এক কল্পনার জগতে বাস করেন। কাফকার এই কল্পনার জগতে বাস ও তার তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণ ক্ষমতার কারণেই আমরা হয়ত বিশ্বখ্যাত উপন্যাসগুলো পড়ার সুযোগ পেয়েছি।
কর্মজীবনে কাফকা তেমন সফল ছিল না। লেখা-লেখিতে বিঘ্ন ঘটায় কয়েকবার সে চাকুরি ছেড়েছে। একবার ব্যবসা শুরু করলেও তাও দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। দাপ্তরিক কার্যক্রমে আমলাতন্ত্রের আধিপত্য ও উতকেন্দ্রতা অবশ্য এর পেছনে একটা বড় কারণ ছিল। তাই তার গল্পে বারবার সেই ব্যাপারটি উঠে এসেছে। একজন মানুষ, সাধারণ বা উচ্চপদস্থ, কিভাবে আমলাতন্ত্র দ্বারা পিষ্ট হয় The Trial ও The Castle উপন্যাস চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। মজার ব্যাপার হল এই দুইটি উপন্যাসের প্রধান চরিত্রের পদবি K, শুধু K. হয়ত কাফকা K দিয়ে নিজেকেই বুঝিয়েছে। তার মত মেধাবী ও অসামাজিক মানসিক রোগীর মন জানা আমার মত সাধারণ মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। যক্ষ্মায় মারা যাবার আগে কাফকার তিনটি উপন্যাস অসমাপ্ত ছিল। মারা যাবার সময় কাফকা তার বন্ধু ম্যাক্স রডকে বলে গিয়েছিল যাতে সে পাণ্ডুলিপিগুলো ধ্বংস করে ফেলে। ম্যাক্স রড অবশ্য তা করেনি। সে নিজে সেগুলো যতখানি সম্পাদনা করার প্রয়োজন ছিল তা করে প্রকাশ করেছে। ভাষাবিদরা বর্তমানে ম্যাক্স রডের সম্পাদনাগুলো নিয়ে গবেষণা করছে যাতে সেগুলোতে কাফকার লিখনশৈলী ফিরে আসে, যাকে তারা নাম দিয়েছে Kafkaesque.
“ভালবাসা আমার কাছে এমন যে তুমি হলে একটি ছুরি যা আমি নিজেই নিজেকে বিদ্ধ করেছি”- ভালবাসা নিয়ে এরকম মন্তব্য করা বোধহয় শুধু একজন পাগলের পক্ষেই সম্ভব। প্রতিনিয়ত সে যুদ্ধ করেছে নিজের সাথে, তার মানসিক রোগকে নিয়তি মেনে নিয়ে আড়ালে থেকেছে। এমনকি তার মৃত্যু পর্যন্ত সে ছিল সাহিত্য সমাজে একজন অজানা ব্যাক্তিত্ব। বন্ধু ম্যাক্স রড তার মৃত্যুর পর একে একে বইগুলো প্রকাশ করলে সাহিত্য সমাজে কাফকা হয়ে ওঠে জনপ্রিয় নাম। জার্মান সাহিত্যে গ্যেটের সাথে যে কয়েকজনের নাম একসাথে উচ্চারণ করা হয় সেই তালিকায় কাফকার নাম আসে। হাতে গোণা যে কয়েকজন মানসিক রোগে ভোগা প্রতিভাশালী লেখক পৃথিবীতে জন্ম নিয়েছেন কাফকা তাদের মধ্যে অন্যতম।
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই অক্টোবর, ২০২১ রাত ১০:৩৬