আজকের পর্বঃ আমি ও প্রকৃতি
_________________
আমাদের গ্রামটা ছবির মত সুন্দর। একটু ভুল হলো মনে হয় আসলে শুধু আমাদের গ্রাম না বাংলাদেশের সব গ্রামগুলোই ছবির মত সুন্দর।
সাত বছর বয়সে আব্বার সাথে একবার গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে গিয়ে সেই যে প্রকৃতির প্রেমে পড়লাম আজো সেই প্রেম অটুট আছে বহাল তবিয়তে। সেই থেকে যে কোন ছুটিতে আমি গ্রামে যাবার জোর বায়না করতাম কারণ গ্রাম সবসময় আমার কাছে অপার বিস্ময়ের ছিল ।দিগন্ত বিস্তৃত ফসলের মাঠ,হরেক রকম গাছপালা,নানা প্রজাতির ফুল ফল লতাপাতা আর সীমাহীন নিস্তব্ধতা।
পাখি প্রজাপ্রতি,কাঠ বিড়ালি আর হ্যাঁ গঙ্গা ফড়িং আমায় পাগল করে দিতো সেই প্রথম দিন থেকেই। আমি ছোট বেলায় একটা গঙ্গা ফড়িং ধরার জন্য ঘন্টার পর ঘন্টা কাটিয়ে দিতাম। যদিও সফল হতাম খুব কম সময়ই ।গঙ্গা ফড়িং এর পিছনে সুতা বেঁধে তাকে বাতাসে উড়িয়ে ধরে রাখা আমার প্রিয় খেলার একটি খেলা ছিল। যদিও এখন জানি এটা ঠিক না,মহা অন্যায়।তখন কি ছাই অত বুঝতাম না-কি?
দিনের বেশির ভাগ সময় আমি একা একা মাঠ ঘাট বন বাঁদাড় ঘুরে পাখি ফুল প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতাম।কেউ কেউ আমার মাথায় সমস্যা আছে এমন মন্তব্য করতো তাতে আমি কিছুই মনে করতাম না।যার মুখে যা আসে বলুক তাতে আমার কি।পথ চলতে বা একান্ত প্রকৃতি দর্শনের সময় কেউ কেউ উপযাচক হয়ে বাবার নাম কোন বাড়ির ছেলে এসব জিজ্ঞেস করলে ভীষণ বিরক্ত হতাম। আসলে ঘাসের উপর জমা শিশিরের খেলা। হিম জমে জমে টুপ করে তার গড়িয়ে পড়া, আবার সেই শিশির বেলা বাড়লে রোদ চড়লে কোথায় মিলিয়ে হাওয়া হয়ে যাওয়া, এ এক মহা রহস্য হয়ে ধরা দিতো আমার কাছে ।
আমি অবাক হতাম যত বার দেখতাম ততবারই।
পাখিদের খেজুরের রস খাওয়া কাঠবিড়ালির কিচির মিচির শব্দে আনাগোনা তারপর কি জানি কি দেখে চিকচিক ডাক ছেড়ে হুট করে ছুটে চলা। কাঠঠোকরা অদ্ভুত আওয়াজ।এর মাঝে হঠাৎ মাঠ ভেঙে অল্প কয়েকদিন বয়সের ছাগল ছানার ভয় পেয়ে চিল চিৎকারে দিক বিদিক ছুটে চলা।যেন চলমান চলচ্চিত্র।
অন্য দিকে আকাশ জুড়ে হঠাৎ ঝাঁক বেধে টিয়া পাখির উড়ে যাওয়া কি যে অদ্ভুত! এত পাখি!!! তাদের অন্য রকম ডাক আমায় পাগল করে দিতো। আমি দুচোখ মেলে দেখতাম যতক্ষণ তারা দৃষ্টির অগোচরে না হতো।
ভালো লাগতো দিগন্ত বিস্তৃত কাশের বন।কেমন যেন অদ্ভুত এক মায়ায় জড়ানো ছবির মতো,আমি এক ছুটে কাশ বনের মধ্যে টুপ করে ডুব মেরে একা হয়ে যেতাম প্রায়ই।নিজেকে মুক্ত স্বাধীন মনে হতো তখন।নিজেকে এই যে সমস্ত কিছুর মধ্যে থেকে বিচ্ছিন্ন করা এর মধ্যে অন্য রকম এক আনন্দ কাজ করতো।
একদিন এরকম একা একা বসে আছি কাশের বনে বাতাসের আওয়াজ শুনছি আর মুগ্ধ হয়ে আকাশের মেঘদলের উড়ে যাওয়া দেখছি। হঠাৎ শুনি কিসের যেন আওয়াজ। খুব একটা জোর না আশপাশে তেমন কোন শব্দ নেই বলে এই শব্দটা কানে বাজছে তির তির করে। পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখি ওরে বাবা একি!
এতো মস্ত বড় সাপ। আমার সামনে একেবারে ফনা তুলে দাঁড়িয়ে আছে মহারাজ! আমি বিষ্ময়ে বিমূঢ়। ভয়ও পেয়েছি খুব। আমি বরাবরই সাপকে মারাত্মক ভয় পাই। কি মনে হতে ভয়ে চোখ বন্ধ করে মটকা মেরে দাঁড়িয়ে রইলাম এছাড়া কি উপায় কারণ পা দুটো আর আমার নিয়ন্ত্রণে নেই যে তখন। কতক্ষণ দাঁড়িয়ে আছি জানি না।অনেক পরে চোখ মেলে দেখি সাপটি ধীরে ধীরে চলে যাচ্ছে। যাক বাবা বড় বাবা বড় বাঁচা বেঁচে গেছি এই যাত্রায়।
আরেকবার যেতে যেতে গ্রাম ছেড়ে অনেকটা দুর চলে এসেছি কখন জানি নিজের অজান্তে একটা ঘিঞ্জি পাড়ার মধ্য দিয়ে হাঁটছি। জায়গাটা যথেষ্ট নোংরা। এখানে ওখানে বিষ্ঠা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।কাটামাটি গরু গোবর সব মিলিয়ে জঘন্য অবস্থা এসব দেখে আমার গা ঘিন ঘিন করে উঠল আমি নাক মুখ চেপে দ্রুত বেগে চলেছি যতদুর সম্ভব ।
এই কারণ হেতু সম্ভবত একটা কুকুর আমার পিছু নিয়ে ঘেউ ঘেউ ডাকতে লাগলে আমি পাত্তা না দিয়ে দুরত্ব বাড়াবার জন্য জোর বাড়ালে সেও জোর বাড়ালো এক সময় আমি ভয়ে আতঙ্কে আরও জোরে ছুটতে ছুটতে গিয়ে দেখি সেও জোরে ছুটছে। ওমা! একি বিপদ। আমি ভয়ে আতঙ্কে সামনে একটা সুপারি গাছ দেখে সেই গাছে সাই সাই করে উঠে পড়লাম।কুকুরটির দলবল নিয়ে নিচে ভয়ঙ্কর তর্জন গর্জন শুরু করলো।পারলে আমাকে ছিড়ে খায়।অচিরেই বেশ কিছু লোকজন ও জড়ো হয়ে গেল তারা বলাবলি করতে লাগলো আরে মিয়া বাড়ির শহুরে ছেলেটারে গৌতমের কুকুর খেয়ে ফেলল রে।কে কোথায় আছিস তাড়াতাড়ি আয়।
সমবেত জনতা কুকুর গুলোকে তাড়িয়ে দিল আর আমাকে গাছ থেকে নামিয়ে আনলো যত্ন সহকারে।এর আগে কোনদিন গাছে না চড়া আমি কি করে যে গাছ বেয়ে অত উঁচু উঠে গেলাম এখনও ভাবলে অবাক হই।ওরা অবশ্য অনেক কসরত করে আমাকে নামিয়ে এনে ভীষণ যত্ন করে বাড়ি পৌঁছে দিয়েছিল।বাসায় অবশ্য এই ঘটনার জন্য বকা খেতে হয়েছিল।কি আর করা।
আরেকবার মেঠো পথ ধরে হাঁটছি। পরণে বেশ রঙ চঙে লাল টকটকে জামা।রোদ থেকে গাঁ বাঁচাবার জন্য দাদীজানের দেওয়া হাতে একটা ছাতা। আমি বন্ধ ছাতা হাতে গুনগুন করে গান গাইছি রবি বাবুর গান
" আজ ধানের ক্ষেতে রৌদ্র ছায়ায় লুকোচুরি খেলা রে ভাই লুকোচুরি খেলা।
নীল আকাশে কে ভাসালে সাদা মেঘের ভেলা ও ভাই লুকোচুরি খেলা।।
রঙিন পোশাকে নাচানাচি দেখে কি-না জানি না হঠাৎ দেখি আলপথে ঘাস খাওয়ার কাজে ব্যস্ত একটা ষাঁড় ছুটতে ছুটতে এসে ঠিক আমার দিকে তেড়ে এলো আমি তো পড়ি কি মরি দে ছুট সেই ষাঁড় ও আমার পিছন পিছন ছুট।কতক্ষণ জানি না ভয়ে আতঙ্কে আমার দম বন্ধ হবার দশা।হঠাৎ পাঠ্য বইতে পড়া একটা গল্প মনে পড়ে গেল সেই গল্পে ছাতা মেলে ধরে তেজি ষাঁড়ের হাত থেকে রক্ষা পেয়েছিল ছেলেটি।আমি তৎক্ষনাৎ ঘুরে দাঁড়িয়ে হাতে রাখা বন্ধ ছাতা মেলে ধরতেই ষাঁড়টি আচমকা এমন ঘটনায় থমকে গেল যেন।ছাতাকে আড়াল করে আমি সুযোগ বুঝে আস্তে আস্তে সরে গেলাম। কিছু দুর সরে আসার পর বুঝতে পারলাম বাঁ পাখানি ভীষণ রকম মচকিয়ে গিয়েছে। সেদিন বাসায় ফিরতে খুব কষ্ট হয়েছিল । ব্যথাও ছিল কয়েকদিন। আর বকাঝকা? সে আর বলতে!
আজ এটুকুই থাক তবে পরে আবার আরেকদিন বলবো না হয় আমার ছন্নছাড়া জীবনের গল্প।
© রফিকুল ইসলাম ইসিয়াক

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।


