পত্রিকায় খবরটা যখন পড়লাম তখন বিশ্বাস হয়নি। টুকটুকি নামের ১১ বছর বয়সি মেয়ে আত্মহত্যা করেছে। এই ছোট্ট মেয়েটিও বখাটের লোলুপ দৃষ্টি থেকে রেহাই পায়নি।
কয়েকদিন আগে একজন বন্ধুর সাথে তর্ক হচ্ছিলো। সে বলছিল আজকাল ফেসবুকের বিভিন্ন পেজে মেয়েদের বিভিন্ন ধরণের ছবি আপলোড করা হয় এবং তা নিয়ে বিভিন্ন আলোচনা হয়। আমি এরকম একটা পেজের মেম্বার, যে পেজের উদ্দেশ্য মেয়েদের পোশাক যেন শালীন হয় সে বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টি করা। পেজটির উদ্দেশ্য আমার যথেষ্ট সৎ বলেই মনে হয়। আমার বন্ধুটির যুক্তি ছিল মেয়েদের ছবি নিয়ে আলোচনা করার কি আছে, মানুষ কেন নিজের দুর্বল চাহিদা দমন করে না। আমি পাল্টা যুক্তি দেখিয়েছিলাম, ছবি যে আপলোড করা হয়, মেয়েরা ছবি তুলতে দেয় কেন? আর মেয়েরা যদি উগ্র পোশাক পরে চলাফেরা করে তাহলে কয়দিন নিজেকে সংযত রাখা সম্ভব। আমার যুক্তি ছিল আমি একজন ইভটিজারকে সমর্থন করছি না, কিন্তু অনেক সময়ই দেখা যায় মেয়েদের আচরণ ইভটিজিঙের পেছনে দায়ী। আমি জানি আমি পুরোপুরি সঠিক না, কারণ এমন অনেক ঘটনা আছে যেখানে হয়তো মেয়েটার কোন দোষ নেই। টুকটুকি মেয়েটার বয়স মাত্র ১১। তার পক্ষে আর যাই হোক, উগ্র সাজ-সজ্জা করে চলা সম্ভব বলে মনে হয় না। মাঝে মাঝে মনে হয় এসব বখাটেকে পশু বললেও পশুর অপমান হয়। কারণ পশু প্রয়োজনের অতিরিক্ত কিছুই করে না।
বেশ কয়েক বছর আগে পত্রিকায় একটা খবর পড়ে কষ্ট পেয়েছিলাম। তৃষা নামের একটা মেয়ে বখাটেদের তাড়া থেকে বাঁচতে যেয়ে পুকুরে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেছিল। আবার এরকম একটা ঘটনা ঘটলো। আমরা এমন একটা দেশে বাস করি যে দেশে ছোট মেয়েরা পর্যন্ত নিরাপদ নয়। কিন্তু দেশের আর কি দোষ, দেশ যারা চালায় তারা গরীব মানুষের শেয়ারের টাকা নিজেদের পকেটে ভরতে পারে, কিন্তু একটা ছোট মেয়ের নিরাপত্তা দিতে পারে না। আবার এরাই বলে আমাদের আমলে আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ছিল। বড় বড় কথা বলতে তাদের এতটুকু লজ্জাও লাগে না।
একটি দেশে নিরাপদভাবে বাস করার জন্য আইনের শাসন একটি আবশ্যক বিষয়। মজার ব্যাপার হচ্ছে Transparency International Bangladesh-র তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশের সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্থ দুটি বিভাগ হচ্ছে যথাক্রমে পুলিশ এবং বিচার বিভাগ । আইনের শাসনের তো এ দেশ থেকে বাবারে মারে বলে পালানো উচিৎ। অনেক সময়ই বখাটেরা আইনের হাত গলে পার পেয়ে যাচ্ছে। ফলে দিনে দিনে তারা আরও বেপরোয়া হয়ে উঠছে।
রাস্তাঘাটে প্রায়ই ইভটিজিং-র দৃশ্য আমাদের চোখে পড়ে। অনেক সময়ই আমরা স্রেফ ঝামেলা এড়াতে দেখেও না দেখার ভান করি। একবার চিন্তা করুন তো, যে মেয়েটা যদি আপনার মেয়ে-বোন হত আপনি তাহলে কি করতেন? আমরা সবাই যদি প্রতিবাদ করি তাহলে কি সম্ভব না? একসাথে রুখে দাঁড়ালে কি ইভটিজারদের প্রতিহত করা সম্ভব না?
আপুরা বলতে পারেন আমরা তাদের পোশাক নিয়ে কথা বলার কে? অনেক সময়-ই কিন্তু এরকম হয় যে একটা মেয়ের উগ্র পোশাকের কারণে তাকে টিজ করা হয়। তখন অনেকেই তার পাশে এই যুক্তিতে এসে দাঁড়ায় না যে, ওই মেয়েই তো খারাপ। ওকে যে টিজ করবে এটাই তো স্বাভাবিক। তাই বলছি, আপুরা একটু শালীনভাবে চলাফেরা করুন। তারপরও যদি টিজের শিকার হন, তাহলে অন্তত এটুকু বলতে পারবেন, আমরা, আপনাদের ভাইরা কেন আপনাদের রক্ষা করতে পারছি না ।
যখন আমাদের বোন টুকটুকি তৃষা আত্মহননের পথ বেছে নেয়, তখন আমরা দীর্ঘশ্বাস ফেলি। খুব হলে জাতীয় জাদুঘরের সামনে মানববন্ধন করি। আমাদের বিবেক থাকলে আমাদের একটিবারের জন্য হলেও লজ্জিত হওয়া উচিৎ।আমরা যদি সকলেই সোচ্চার হতাম তাহলে হয়তো এই মেয়েটিকে প্রাণ নাও দিতে হতে পারতো। আমি একজন অন্তর্মুখী এবং ভীরু মানুষ। অনেকেই হয়তো তাই। কিন্তু সকলে যদি একতাবদ্ধ হই, আমার মনে হয় সকল ভয়কে জয় করা সম্ভব। আসুন না, সকলে ইভ টিজিঙের বিপক্ষে আসে দাঁড়াই।তাহলে অন্তত নিজেদের বিবেকের কাছে তো পরিস্কার থাকতে পারবো।
আর সবশেষে টুকটুকিকে বলছি, যে বয়সে তোমার সাথীদের সাথে খেলা করার কথা, স্কুলে যাওয়ার কথা, রঙিন গল্পের বইয়ের পাতা উল্টানোর কথা, সে বয়সে তুমি যে না ফেরার দেশে পারি দিয়েছ, তার দায় আমাদের সকলের। আমি সত্যি খুব দুঃখিত আপু।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



