somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

চশমিশ আর একটা পরীর গল্প (শেষ পর্ব)

০৩ রা এপ্রিল, ২০১৪ সন্ধ্যা ৬:২১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

প্রথম পর্বের লিঙ্ক

দ্বিতীয় পর্বের লিঙ্ক

ছয়
কথায় আছে, অভাগা যেদিকে চায় সাগর শুকায়ে যায়। পরদিন বিকেলে মরার ওপর খাঁড়ার চূড়ান্ত ঘা টা আসে। ভাবী ফারহানকে মুদির দোকানে পাঠিয়েছিলেন। রাস্তায় সাবিহার সাথে দেখা। সাবিহা নাতাশার বন্ধু, ফারহানের সাথে হাই হ্যালো ধরণের সম্পর্ক। একজনের কথা আরেকজনের কাছে লাগানোর ব্যাপারে সাংঘাতিক ‘নামডাক’ আছে তাঁর।

হাই-হ্যালোর পাট না চুকাতে চুকাতেই সাবিহার কথার তুবড়ি শুরু হয়। “তোমার ফ্রেন্ড আছে না, জেরিন? ও তো আজকাল প্রেম-টেম করে, না? আজকাল শওকত ভাইয়ের সাথে এইখানে সেইখানে ঘুরতে দেখি। শওকত ভাইকে চিনো তো? ঐ যে, আঙ্কেল, মানে নাতাশার বাবার বন্ধুর ছেলে, জাতিসংঘে চাকরি করে। নাতাশার পার্টিতে দেখলাম ভাইকে গানও শুনাইলো। মেয়েটার সাথে মানিয়েছে খুব!”

ফারহানের চেহারা দেখে মনে হয় ওকে কেউ চিরতার পানি জোর করে খাইয়ে দিয়েছে। কোন মতে সাবিহাকে খসিয়ে চলে আসে। বাসায় ফেরার একটু পর থেকেই ফারহানের মনের মাঝে কেমন যেন একটা যন্ত্রণা হতে থাকে। মনটা কেমন যেন ভারী ভারী লাগে, পৃথিবীটা কেমন পান্ডুর, বিবর্ণ লাগে। ভেতরটা ফাঁকা ফাঁকা লাগে, কি যেন নেই, কি যেন নেই। হায়, এও ছিলো কপালে! অন্য সময় হলে ফারহান সাবিহার কথায় পাত্তাও দিতো না। কিন্তু গতকাল থেকেই ফারহানের মাথা কেমন যেন গরম হয়ে আছে।

পরদিন সকালে ফারহানের নাম্বারে জেরিনের ফোন আসে।
- “কিরে, এক সপ্তাহের জায়গায় দুই সপ্তাহ ট্যুর করে আসলি, এসে একটাবার জানাইলিও না কবে আসছিস, আমার জন্য কি আনছিস।”
- “এই, একটু ব্যস্ত ছিলাম।”
- “গত চার বছরে এই প্রথম শুনলাম ফারহান আবদুল্লাহ ব্যস্ত ছিলো।”
- “হুম। যাকগে, অক্সফোর্ডে চান্স পাওয়ায় অভিনন্দন।” ফারহান প্রসঙ্গ পাল্টানোর চেষ্টা করে।
- “আমি তো তোকে বলিই নাই আমার কোথায় হইসে।”
- “খবর টবর তো পাই। কোনকিছুই চাপায় রাখা যায় না।” ফারহান ইচ্ছা করেই খোঁচাটা দেয়।
- ঢং তো ভালোই শিখছিস রে! তোর গলা কেমন ঠাণ্ডা আর অপরিচিত লাগতেসে। কি হইসে বল তো? নিজেকে লুকিয়ে রাখছিস কেন?”
- “তোর কেন মনে হইলো আমি নিজেকে লুকিয়ে রাখতেসি?” ফারহানের গলা আরো ঠাণ্ডা শোনায়।
- “কারণ গত সপ্তাহখানেক ধরে তোর কোন খোঁজ-খবর নাই”
‘হাহ্‌, ভাগ্যও আজকাল মজা নেয়’ ফারহান মনে মনে ভাবে। ‘গত এক সপ্তাহ তোমার সাথে কীভাবে কীভাবে মনের কথাগুলা বলবো এগুলা প্ল্যান করতে করতেই যে গেছে সেইটা যদি তুমি জানতা!’ একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে ফারহান। এখন তো সবই শেষ!
- “তুইও তো আমার কোন খবর নিস নাই” ফারহান অবশেষে বলে।
- “কারণ আছে দেখেই খবর নিই নাই। শোন, কাল একটু ক্যাম্পাসে আসবি? তোর সাথে একটু দরকার আছে।”
- “তোর বয়ফ্রেন্ডের সাথে পরিচয় করায় দিবি?”
- “বয়ফ্রেন্ড কই পাইলি?”
- “আমার সাথে নাটক করবি না জেরিন” এবারে ফারহান একটু গরম হয়, “গত দুই সপ্তাহ ধরে তুই কার সাথে ঘুরিস-টুরিস সবই আমার কানে আসে”
- “ফারহান, তোর কি হইসে? এমন করছিস কেন?” জেরিনের গলা আহত শোনায়।
- “আর কেমন করবো? তোর বয়ফ্রেন্ডের সাথে তুই সুন্দর ঘুরছিস, ডেটে যাচ্ছিস আর আমাকে একটাবার জানানোর প্রয়োজন মনে করিস নাই। গত কয়দিনে একটা খবর পর্যন্ত নিস নাই!”
- “ছি ফারহান! এগুলা কি বলিস! তুই ভাবলি কীভাবে শওকত ভাই আমার বয়ফ্রেন্ড?”
- “ওহ, এখনো বুঝি ভাই ডাকিস?” ফারহানের গলায় ব্যাঙ্গ ঝরে। “নাকি আমার সামনে দেখে ডাকলি? সেদিন যে বুমারসে দেখলাম, সেখানেও কি ভাই বলেই ডাকছিলি?”
- “ও, ঐটা তাহলে তুই ছিলি? আমারও মনে হচ্ছিল তুই।”
- “সন্দেহ হইলে ফোন করতে পারতি একটা। ওহ, ভুল হয়ে গেসে। ডেটের মাঝখানে নিজের ছেলেফ্রেন্ডকে ফোন দিলে বয়ফ্রেন্ড আবার কিছু মনে করতে পারে।”
- “তুই যে একটা স্টুপিড সেইটা কি তুই জানিস?” এবারে জেরিনেরও মেজাজ খারাপ হয়। “একসাথে বেরোইলেই মানুষ বয়ফ্রেন্ড গার্লফ্রেন্ড হয়? যেটা জানিস না সেইটা নিয়ে এতো বাড়াবাড়ি কেন করিস? আর আমি কার সাথে বেরোই না বেরোই তাতে তোর কি? তুই কি জেলাস?”
- “আমার জেলাসিতে এখন তো আর কিছুই আসে যায় না। আর আমার মনে হয় আমাদের আর মেশা উচিৎ হবে না। আমার কষ্ট লাগতেসে এই ভেবে যে শেষ মুহূর্তে এসে তুই আমার সাথে এমন ন্যাকামিটা করলি।”
- “আমি নাটক করতেসি? কোন মুখে তুই এমন কথা বলিস? তোকে আজকে আমি চিনতে পারতেসি না, তোকে আমার বন্ধু ফারহানের মতো লাগতেসে না।”
- “আমি তোর বন্ধু হইতে হইতে ক্লান্ত। আমাদের মনে হয় এইখানেই থামা উচিৎ। নাটক আর ভালো...”
জেরিন ফারহানকে থামিয়ে দেয়।
- “তুই যখন এতোই ক্লান্ত, তখন যা, আমি তোরে মুক্তি দিলাম। আর কখনোই তোকে জ্বালাবো না। তুইও আমাকে আর কখনো ফোন দিবি না। আমি কার সাথে মিশি না মিশি এসব নিয়ে মাথা ঘামাবি না। আর দয়া করে আমার ওপর যেমন না বুঝেই এমন করছিস অন্যদের সাথে এমনটা করিস না।” জেরিন ফোনটা কেটে দেয়।

ফোন রাখার পর জেরিন আর কান্না ধরে রাখতে পারে না। সে আশাও করেনি ফারহানের মতো এতো ভালো একটা ছেলে এমন করবে। সে সিদ্ধান্ত নেয় ফারহানের সাথে আর যোগাযোগ রাখবে না। জেরিন সারাটা দিন কাঁদে। কাঁদতে কাঁদতে ক্লান্ত হয়ে যায়। তবু কান্না শেষ হয় না।

ফোন রাখার পর ফারহানের ভেতর একটা অসহ্য কষ্ট দলা পাকিয়ে উঠতে থাকে। এতো ভালো বন্ধুত্বের শেষটা এতো খারাপ হলো? ফারহানের মরে যেতে ইচ্ছা করে। ‘কি থেকে কি হয়ে গেল? মেয়েটাকে ব্যাখ্যা করার একটা সুযোগ দেওয়া উচিৎ ছিল। জেরিন তো মিথ্যা বলার মেয়ে না! কেন এমন করলাম? এতো খারাপ কেন আমি?’ অপরাধবোধে ফারহান ছটফট করে।


সাত
ফারহানের ওপর দিয়ে গত দুই সপ্তাহ নরকযন্ত্রণা বয়ে গেছে। অসংখ্যবার তাঁর মনে হয়েছে জেরিনকে তাঁর সরি বলা উচিৎ। কিন্তু কীভাবে বলবে, কোন মুখে দাঁড়াবে ওর সামনে কিছুই বুঝে উঠতে পারেনি। নিজেকে খুব এলোমেলো লাগে ফারহানের। এই সময়টাতে সে পুরো একা একা থেকেছে, বন্ধুদের আড্ডায় যায়নি, ঠিকমতো খাওয়া দাওয়া করেনি, নিজের যত্ন নেয়নি। একটা সময় থাকতে না পেরে সে তাঁর ভাবীর সাথে ব্যাপারগুলো শেয়ার করে। ভাবীর সাথে কথা শেষ হতে না হতেই বেল বেজে ওঠে। ভাবী দরজা খুলতে চলে যান। একটু পরে আবার ফেরত আসেন।
- “রাফসান আর এক ভদ্রলোক তোর সাথে দেখা করতে এসছে। কি নাকি জরুরী দরকার।”
বসার ঘরে যেয়ে ফারহান অবাক হয়। রাফসানের সাথে শওকত বসে আছে। ফারহান কিছু বলার আগেই শওকত কথা বলে ওঠে।
- “ফারহান, তুমি হয়তো আমাকে চিনবে না। আমি তোমাকে চিনি। ঘণ্টা তিনেক পরেই জেরিনের ফ্লাইট, সুতরাং সময় নষ্ট করার সময় নেই। আগে যা বলি মন দিয়ে শোন, কথা শেষ হলে কোশ্চেন অ্যানসার সেশন।”
ছোট্ট একটা কাশি দিয়ে শওকত কথা শুরু করে।
- “দেখো ফারহান, ভালবাসায় অনেক সময় জেলাসি জিনিসটা কাজ করে। রাফসানের কাছ থেকে আমি জেনেছি এটাই তোমার প্রথম বার। সুতরাং, ভুল ত্রুটি বেশী হওয়াটাই স্বাভাবিক। যাই হোক, আসল কথায় আসি। জেরিনের সাথে আমাকে তুমি হয়তো বেশ কিছুদিন দেখেছো। তুমি না, অনেকেই আসলে দেখেছে। অনেকে হয়তো মনে করেছে আমাদের মধ্যে কিছু চলছে। ব্যাপারটা কিন্তু তা না, আমাদের মধ্যে সম্পর্কটা অনেকটা ভাইবোন ধরণের। আসল ঘটনাটা খুলে বলি। আমার সাথে আসলে নাতাশার বিয়ের কথাবার্তা চলছে। নাতাশার থ্রুতেই জেরিনের সাথে আমার পরিচয়। আর চাকরীর প্রয়োজনে আমাকে বাইরে বাইরে থাকতে হয়, এবার অনেকদিন বাদে দেশে এসছি। নাতাশার যেহেতু ফাইনাল পরীক্ষা চলছিলো, তাই নাতাশা জেরিনকে দায়িত্ব দিয়েছিলো আমাকে একটু ঘুরিয়ে দেখানোর। যেহেতু মানুষ গুজব ছড়াতে পছন্দ করে, তাই হয়তো অন্য কিছু মনে করেছে।”
- “তাহলে ফারহান ঢাকার বাইরে যখন ছিলো জেরিন তখন কেন যোগাযোগ করে নাই?” ফারহানের ভাবী বলেন। সবার চোখ চলে যায় ভাবীর দিকে। উনি যে কখন বসার ঘরে এসেছেন কেউ খেয়ালই করেনি।
- “এখানে আসলে দোষটা আমারই। জেরিন চাইছিলো ফারহান ঢাকায় ফিরলে মনের কথা বলে দেবে। আমার কাছে পরামর্শ চাইছিলো কীভাবে কি করবে। আমিই বলেছিলাম, ‘ও যেহেতু ট্যুরে আছে, ওকে এখনি কিছু জানিও না, এখন কথা বললে ও কিছু যদি বুঝে যায়?’” ভাবী কটমট করে তাকাতে শওকত দ্রুত আবার ব্যাখ্যা করে, “মানে ফারহানের মনে ওরকম কিছু আছে কিনা জানি না তো, তাই ভেবেছি জেরিন সিগন্যাল দিলে যদি ওর ট্যুরটা নষ্ট হয়? আমি বুঝে উঠতে পারিনি যে প্ল্যানটা এমন ব্যাকফায়ার করবে। আর যেদিন আমাদের বুমারসে দেখেছিলো সেদিন আসলে আমরা ফারহানকে কীভাবে কি বলা হবে, কোথায় বলা হবে - ওসবেরই প্ল্যান করছিলাম। সেজন্যই জেরিন তোমাকে হয়তো ডাকেনি। আর যেহেতু তোমাদের ভুল বোঝাবুঝির পেছনে আমারও কিছুটা হাত আছে, আমি এমন কিছু করতে চাই যাতে ব্যাপারগুলো আবার ঠিক হয়ে যায়” ফারহানের দিকে ফিরে শওকত বলে।
- “আমার এখনো কিছু মাথায় ঢুকতেসে না। আমাদের যে ভুল বোঝাবুঝি হইসে এই ব্যাপারে জেরিন আপনাকে কিছু বলসে?” ফারহান জিজ্ঞেস করে।
- “Oh god no! জেরিন সপ্তাহখানেক ধরে পুরো চেঞ্জ। দেখা করে না, ফোন ধরে না, মেসেজের উত্তর দেয় না। এর মধ্যে আমি একটা সার্ভের কাজে খাগড়াছড়ি গিয়েছিলাম, নাতাশাও এই কদিন দেশে ছিলো না। নাতাশা ফিরেছে সকালের ফ্লাইটে, আমি ফিরেছি একটু আগে। এর মধ্যে রাফসান নাতাশার সাথে কথা বলতে এসেছিলো, আসলে আমার আর জেরিনের ব্যাপারটা কি এই নিয়ে খোঁজ করতে এসছিলো আরকি। রাফসানের কথা শুনে নাতাশার একটু সন্দেহ হয় যে তোমাদের মধ্যে কোন ভুল বোঝাবুঝি চলছে। আর আর আজ যেহেতু চলে যাবে, বুঝতেই পারছো, জেরিন বেশ ব্যস্ত। এর মধ্যেও আমি আর নাতাশা অনেক কষ্টে জেরিনের মুখ দিয়ে সব বের করলাম। এরপর নাতাশা রাফসানের সাথে কথা বলে আমাকে ওর সাথে পাঠালো তোমার সাথে কথা বলতে। জেরিন এখনো জানে না যে আমি এখানে এসছি।”

রাফসান এতক্ষণ চুপ ছিলো। এবারে সে মুখ খোলে।
- “দ্যাখ ফারহান, ট্যুর থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত যা যা হইসে তাতে কিন্তু এই প্রমাণ হয় যে ওকে ছাড়া তুই খুব একটা ভালো থাকবি না। আমার মনে হয় ও বাইরে যাওয়ার আগেই তোর ওকে বলা উচিৎ। এটাই তোর শেষ সুযোগ। তোর এখনি ওর সামনে যেয়ে বলা উচিৎ। তুই ওর সাথে ঝগড়ার ব্যাপারটা যদি আগেই আমাদের সাথে শেয়ার করতি তাহলে অনেক আগেই হয়তো ব্যাপারটা মিটিয়ে ফেলা যেত। যাই হোক, একটা সুযোগ যেহেতু আছে, আমার মনে হয় তোর যাওয়া উচিৎ।”
ফারহান উত্তর দেবার আগেই ফারহানের ভাবী মুখ খোলেন, “যাবে না মানে! ওর ঘাড় যাবে। একটু আগে জেরিন জেরিন করে আমার সাথে যে কান্নাকাটি করসে, এরপর না গেলে আমি ওর হাড্ডি ফাটায় ফেলবো! রাফসান, ভাইয়া, একটা সিএনজি পাও নাকি দেখতো। আমি ওর ভাইয়াকে একটু বলে আসি যে একটু বাইরে যাচ্ছি।”
- “তাঁর দরকার হবে না, আমি গাড়ি নিয়েই এসছি।” রাফসান উত্তর দেবার আগেই শওকত বলে।

সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় ফারহান ভাবীকে বলে, “ভাবী, তুমি কেন কষ্ট করে যাবা?”
- “আমি না গেলে তোদের দুজনকে একটু আলাদা স্পেস কে বের করে দিবে? নাকি সবার সামনে বলতে চাস?


আট
কপালটা খারাপ। ওরা মাত্র অর্ধেক রাস্তা এসেছে, এমন সময় নাতাশার ফোন আসে। জেরিনরা এখন এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে বেরুবে।
- “তুমি তো সাথে যাচ্ছ, তাই না?” শওকত জিজ্ঞেস করে।
- “হ্যাঁ, সে তো যেতেই হবে।”
- “গুড। আমি ওদের নিয়ে সরাসরি ওখানে আসছি।” শওকত ফোনটা কেটে দেয়।

গাড়ি মিরপুর রোড দিয়ে ছুটে চলে। ফারহানের মনে হয় গাড়িটা উড়তে পারলে বেশী ভালো হতো। উত্তেজনায় ফারহানের মনে হয় ওর কলজেটা যেন লাফাচ্ছে। জেরিনের মুখ থেকে কি যে শুনতে হয়! অপেক্ষার প্রহরটা কাঁটার মতো ফারহানের সর্বাঙ্গে বিঁধতে থাকে। একটা সময় গাড়ি এসে এয়ারপোর্টে পৌছায়। শওকত তাগাদা দেয়, “জলদি, চেক ইনের কিন্তু বেশী বাকি নেই।”

দূর থেকে ওরা নাতাশাকে দেখতে পায়। ফারহানের ভেতরটা ধরাস করে ওঠে। নাতাশা আছে কিন্তু জেরিন নেই। নাতাশা ইশারা দেয় যে জেরিন চেক ইন করে ফেলেছে। একটা হতাশায় ফারহানের ভেতরটা ছেয়ে যায়, হাত পা দুর্বল লাগে, মনে হয় ও যেন দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না। রাফসানের মুখ দেখে মনে হচ্ছে কেঁদে ফেলবে। এর মধ্যেও শওকতের মুখটা হাসি হাসি দেখায়। “সমস্যা নেই, ওখানে টিকেট কেটে ঢোকা যায়।” আরে তাই তো! টেনশনে ফারহান বেমালুম ভুলে গেছে। নিজেকে সে মনে মনে গালি দেয়, ‘গাধা কোথাকার! সমানে গাধামি করে যাচ্ছিস!’ আরে! ঐতো, জেরিন দাঁড়িয়ে আছে। আরে! মেয়েটাকে কেমন যেন মলিন, অসুস্থ দেখাচ্ছে। মুখ ফ্যাকাসে, চোখের নিচে কালি।
- “দাঁড়া, আগে আমি ওর মার সাথে একটু কথা বলে আসি।” কোন উত্তরের অপেক্ষা না করে ভাবী জেরিনের মায়ের দিকে এগিয়ে যান।
- “আন্টি, ভালো আছেন?” ভাবী জেরিনের মা কে জিজ্ঞেস করেন।
- “আরে মলি! তুমি এইখানে।” জেরিনের মা জিজ্ঞেস করেন।

অল্প সময়ে ফারহানের ভাবী সব খুলে বলেন। অবশ্য সব খুলে বলতে হয় না। গত দু’ সপ্তাহ ধরে জেরিনের যে অবস্থা উনি দেখেছেন তাতে পরিস্থিতি আঁচ করতে উনার খুব একটা বেগ পেতে হয়নি। উনি বার কয়েক ফারহানের ভাবীর সাথে কথাও বলতে চেয়েছেন। কিন্তু জেরিন জেদ করায় আর বলা হয়ে ওঠেনি।

- “আন্টি, আমার দেবরটার অবশেষে মেরুদন্ড গজাইসে। ও আর জেরিন একলা একটু কথা বলুক, কেমন?”
- “তুমি ফারহানকে নিয়ে আসো, আমি জেরিনকে আনছি”
জেরিনকে আনার সময় সময় জেরিনের বাবা বেশী সময় বাকি নেই বলে একটু গাইগুই করছিলেন। জেরিনের মা ইশারা দিয়ে থামিয়ে দেন। সবার থেকে একটু আড়ালে নিয়ে ভাবী ওদের দুইজনকে ছেড়ে দেন।
- “তোদের দুইজনের কথা বলা দরকার। চলেন আন্টি, আমরা ওইদিকে যাই।”

কিছুক্ষণ একটু অস্বস্তিকর নীরবতা কাজ করে। ফারহানের কেমন লজ্জা লজ্জা করতে থাকে। এরপর জেরিনই প্রথম মুখ খোলে।
- “হাই।”
- “হাই।”
তারপর দুজনেই আবার চুপ। এরপর ফারহান আবার মুখ খোলে। “জেরিন, কীভাবে শুরু করবো জানি না। আর আমি এতো সাজিয়ে গুছিয়ে সুন্দর করে বলতে পারি না। তাই সরাসরিই বলতেসি। আমি তোকে ভালোবাসি। বললে তুই যদি ভুল বুঝিস, দূরে সরে যাস - এই ভয়ে এতদিন বলি নাই। কিন্তু না বললেও যে দূরে সরে যেতে পারিস সেটা আমার মাথায় আসে নাই।” ফারহান কাঁপা কাঁপা গলায় কোনমতে কথাগুলো বলে। বুকের মধ্যে অলরেডি ধুকপুক ধুকপুক শুরু হয়ে গিয়েছে। হৃদয়টা যেন ঘোড়ার বেগে দৌড়াচ্ছে। না জানে কি উত্তর আসে!

- “সত্যি? আমার বিশ্বাস হচ্ছে না!”
- “সত্যি বলছি। অনেক ভালোবাসি তোকে! ফিরে এসে বিয়ে করবি আমাকে?”

জেরিনের মলিন মুখে এতক্ষণে হাসি ফোটে। তারপরই একটা শঙ্কা এসে ভর করে ওর মাঝে। “কিন্তু আমি যে কয়েক বছরের জন্য বাইরে চলে যাচ্ছি? বাইরে গেলে যদি ভুলে যাস?”
- “যাবো না। সত্যি দেখিস, যাবো না। একবার তোকে অনেক কষ্ট দিয়ে ফেলসি। আর দিবো না, দেখিস।”
- “আমি যদি ভুলে যাই?”
- “ভুলবি না।” ফারহান দৃঢ় গলায় বলে। তাঁর গলায় এমন কিছু একটা কাজ করে যেটা জেরিনের আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে আনে।
- “আমি ওখানে গিয়ে যত তাড়াতাড়ি পারি নেট নিবো। তুই একটা ভালো ওয়েবক্যাম কিনবি।” বলতে বলতে জেরিন ফারহানের হাত ধরে। প্রথমবারের মতো একজন আরেকজনের হাত ধরে। একজন আরেকজনের চোখের দিকে টাকায়। একটা শিহরন, একটা ভালোলাগার অনুভূতি, কিছু অস্থির হৃদস্পন্দন।

এরপর ওদের টুকটাক কিছু কথা হয়। দূর থেকে ভাবী আর জেরিনের মা দাঁড়িয়ে দেখেন।
- “জানো মলি, মেয়েটাকে আজ দুই সপ্তাহ পড়ে হাসতে দেখতেসি।”
- “আমার ভাইটাকেও আজকে একটু নরমাল লাগতেসে আন্টি।”
- “জানো, আমি আগ থেকেই জানতাম ওদের মধ্যে কিছু একটা আছে।”
- “আপনি অনেক ওপেন মাইন্ডেড আন্টি। সাধারণত গার্জেনরা এগুলা মানে না।”
- “আমি আসলে মেয়েটার পছন্দের ওপর হস্তক্ষেপ করতে চাই নাই। তাছাড়া ছেলেটাও ভালো। আবার ভয়ও হচ্ছে। এতোদিন কি ওরা ধরে রাখতে পারবে?
- “দেখা যাক আন্টি। ওরা তো এখন অনেক বড়। আর যেহেতু ব্যাপারটা গার্জেন লেভেলে চলে আসছে, আমার মনে হয় ওরা দুই জনেই সতর্কভাবেই চলবে। ভালো কিছু যেন হয় সেই আশাই আমাদের করতে হবে। জানেন তো, নিয়তের ওপরই বরকত নির্ভর করে।”
- “হুম। ওদের একটু ডেকে নিয়ে আসো তো মলি। ওর বাবা বারবার ফোন করছে। প্লেন ছাড়তে তো আর বেশী সময় বাকি নাই।”

জেরিন চলে যায়। বাসায় ফিরে আসার সময় ফারহানের মনে মিশ্র অনুভূতি কাজ করে। একদিকে আবার আনন্দ, অন্যদিকে দূরত্বের বেদনা, ভবিষ্যতের শঙ্কা ওর মধ্যে কাজ করতে থাকে। সামনে দুজনকে অনেক লম্বা আর কঠিন একটা পথ পাড়ি দিতে হবে। অনেক লম্বা একটা পথ।

মেঘে মেঘে বেলা গড়িয়ে গত চারটা বছর কেটে গেছে। নাহ্‌ এই চারটা বছর রূপকথার গল্পের মতো মসৃণ ছিলো না। এর মধ্যে অনেক ঝড়-ঝাপ্টা এসছে, অনেক বন্ধুর পথ অতিক্রম করতে হয়েছে, অনেক সমস্যা মোকাবেলা করতে হয়েছে, অনেক দুঃসময় এসেছে। কিন্তু কেউ কারো হাত ছেড়ে দেয়নি। দুজনের ঝগড়া হয়েছে, আবার মিটমাটও হয়ে গেছে। ঈদের দিনগুলোতে জেরিনের মন খারাপ থাকতো। ফারহান চেষ্টা করতো ঐ দিনগুলোতে জেরিনকে স্কাইপে লম্বা একটা সময় দেবার। কত দিন, কত রাত, কত ঘণ্টা স্কাইপ, ফেসবুক আর ইয়াহু ম্যাসেঞ্জারের সামনে পার হয়েছে গুণে শেষ করা যাবে না। কতবার মাস শেষ হবার আগেই নেটের ব্যান্ডউইথ শেষ হয়ে গেছে, তখন রাফসানের কাছ থেকে কি দেশে থাকলে শওকত ভাইয়ের কাছ থেকে মডেম ধার করতে হয়েছে (ও, এখানে বলে রাখা ভালো শওকত ভাইয়ের সাথে ওর একটা চমৎকার সম্পর্ক হয়ে গেছে)। দুজনের বাস যেহেতু পৃথিবীর দুই কোণায়, চাইলেই চট করে যোগাযোগ করা যায় না। কেউ কোন কষ্টে পড়লে চট করে একজন আরেকজনের সাথে শেয়ার করতে অনেক সময়ই পারতো না। এই নিয়ে একটা হতাশা কাজ করেছে। কত কষ্ট ওদের ভালোবাসার আকাশকে ঢেকে দিয়েছে। কিন্তু ভালোবাসা যেখানে খাঁটি, দুজন দুজনকে যেখানে পাগলের মতো ভালোবাসে, সেখানে কোন বাধাই বাধা হয়ে থাকতে পারে না সেটা প্রমাণ হয়ে গেছে। সবকিছু ছাপিয়ে কষ্টের আগুনে পুড়ে ওদের ভালোবাসা আরো গভীর, আরো খাঁটি হয়েছে। জেরিন পিএইচডি নিয়ে ফিরেছে, এখন একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াচ্ছে। ফারহান এখন বাংলাদেশ ব্যাঙ্কে চাকরি করছে।

জেরিন চলে যাবার চার বছর পর, আজকের দিন। সন্ধ্যাবেলা, চারদিকে আলো ঝলমল করছে, আশেপাশে অনেক হৈ চৈ, অনেকগুলো গলা একসাথে গল্প করছে, কেউ কেউ হাসছে। একটা বিয়ের অনুষ্ঠান হচ্ছে। হ্যাঁ, ফারহান আর জেরিনের বিয়ে। বিয়ে শেষ, আয়নায় বড় কনের মুখ দেখাদেখি হচ্ছে। দুজনকে খুব মানিয়েছে। জেরিনকে আজ অন্য দিনের থেকেও অনেক বেশী সুন্দর লাগছে, ঠিক যেন একটা পরী! চশমিশ ফারহানকেও মন্দ লাগছে না। ফারহানের বিশ্বাস হচ্ছে না এই মেয়েটার সাথে তাঁর মাত্র বিয়ে হয়েছে। সে বারবার অবাক হয়ে জেরিনের দিকে তাকাচ্ছে।

জেরিন ফিসফিস করে বলে, “এতো বারবার কি দেখো? আগে কখনো আমাকে দেখো নাই?” “গত চার বছরে কাছ থেকে খুব বেশী দেখি নাই। জানো, আমার এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না যে তোমার সাথে আমার বিয়ে হইসে।” ফারহানও ফিসফিস করে। জেরিন হেসে ফেলে, “পাগল একটা!”

শায়লা রাফসানকে দেখায় ব্যাপারটা। “ইস্‌, দেখসো! বিয়ে হইসে পাঁচ মিনিট হয় নাই, এখনি সবার সামনে গুজুর গুজুর শুরু হয়ে গেছে।” “আমি চিন্তা করতেসি ওরা তুই থেকে তুমিতে অ্যাডজাস্ট করতে পারতেসে নাকি” রাফসান মজা করে। “প্রেম করার পরেও তো গত চার বছর ওরা তুই তুই করেই কাটাইসে।”

আমাদের গল্প এখানেই শেষ। ও কয়েকজনের কথা না বললেই নয়। রাফসান আর শায়লার গত বছর বিয়ে হয়েছে। নাতাশা আর শওকতের বিয়ে হয়েছে, গত বছর তাঁদের ফুটফুটে একটা মেয়েও হয়েছে। শওকতের ইচ্ছাতেই মেয়ের নাম জেরিন রাখা হয়েছে। ফারহানের ভাস্তি একটু টেনশনে আছে। তাঁর ধারণা মা চাচার মতো চাচীকেও তাঁর থেকে বেশী ভালোবাসবে। চাচা অবশ্য বলেছে, সে মাকে বলে দেবে চাচীকে মা যেন ওর থেকে একটু কম ভালোবাসে।

সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা এপ্রিল, ২০১৪ সন্ধ্যা ৬:২১
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

এ যুগের বুদ্ধিজীবীরা !

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১:৪০


ডিসেম্বর মাসের চৌদ্দ তারিখ বাংলাদেশে বুদ্ধিজীবী দিবস পালন করা হয়। পাকিস্তান মিলিটারী ও তাদের সহযোগীরা মিলে ঘর থেকে ডেকে নিয়ে হত্যা করেন লেখক, ডাক্তার, চিকিৎসক সহ নানান পেশার বাংলাদেশপন্থী বুদ্ধিজীবীদের!... ...বাকিটুকু পড়ুন

মায়াময় স্মৃতি, পবিত্র হজ্জ্ব- ২০২৫….(৭)

লিখেছেন খায়রুল আহসান, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৭

ষষ্ঠ পর্বের লিঙ্কঃ মায়াময় স্মৃতি, পবিত্র হজ্জ্ব- ২০২৫-….(৬)

০৬ জুন ২০২৫ তারিখে সূর্যোদয়ের পরে পরেই আমাদেরকে বাসে করে আরাফাতের ময়দানে নিয়ে আসা হলো। এই দিনটি বছরের পবিত্রতম দিন।... ...বাকিটুকু পড়ুন

টাঙ্গাইল শাড়িঃ অবশেষে মিললো ইউনস্কর স্বীকৃতি

লিখেছেন কিরকুট, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১০:৫৭



চারিদিকে যে পরিমান দুঃসংবাদ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে এর মধ্যে নতুন এক গৌরবময় অধ্যায়ের সূচনা হলো বাংলাদেশের টাঙ্গাইলের তাতের শাড়ি এর জন্য, ইউনেস্কো এই প্রাচীন হ্যান্ডলুম বুননের শিল্পকে Intangible Cultural... ...বাকিটুকু পড়ুন

আধা রাজাকারি পোষ্ট ......

লিখেছেন কলিমুদ্দি দফাদার, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৩:৫৬


আমি স্বাধীন বাংলাদেশে জন্মগ্রহণ করেছি। আমার কাছে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা, বা পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে আজকের বাংলাদেশের তুলনা—এসব নিয়ে কোনো আবেগ বা নস্টালজিয়া নেই। আমি জন্মগতভাবেই স্বাধীন দেশের নাগরিক, কিন্তু... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইন্দিরা কেন ভারতীয় বাহিনীকে বাংলাদেশে দীর্ঘদিন রাখেনি?

লিখেছেন জেন একাত্তর, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৫:২০



কারণ, কোল্ডওয়ারের সেই যুগে (১৯৭১সাল ), আমেরিকা ও চীন পাকিস্তানের পক্ষে ছিলো; ইন্দিরা বাংলাদেশে সৈন্য রেখে বিশ্বের বড় শক্তিগুলোর সাথে বিতন্ডায় জড়াতে চাহেনি।

ব্লগে নতুন পাগলের উদ্ভব ঘটেছে;... ...বাকিটুকু পড়ুন

×