ভারত সমগ্র রাজ্যে কার্ফ্যু জারি করে, হাজার হাজার সৈন্য মোতায়েন করে, স্কুল-কলেজ-ইউনিভার্সিটি বন্ধ করে দিয়ে, ইন্টারনেট সার্ভিস বন্ধ করে দিয়ে, রাজ্যের সাবেক তিন তিনজন মূখ্যমন্ত্রীকে গৃহবন্দী করে, সমগ্র রাজ্যকে পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন করে জম্মু-কাশ্মীরের স্বায়ত্ত্বশাসন আজ ছিনিয়ে নেয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। এমনকি, জম্মু-কাশ্মীরের হিন্দুপ্রধান অঞ্চল লাদাখকে রাজ্য থেকে বিচ্ছিন্ন করে, সরাসরি কেন্দ্রের শাসনের আওতায় নিয়ে নেয়ার প্রস্তুতি চলমান। এ যেন ঠিক বলিউড, অস্ত্রের মুখে পরিবারকে জিম্মি করে আদালতে ভুয়া সাক্ষীর মাধ্যমে আইনের বিচার প্রতিষ্ঠা।
কাশ্মীরের জনগণ ভারত রাষ্ট্রের সাথে যে প্রতিশ্রুতিতে আবদ্ধ ছিল এতকাল, আজ তার শেষ সুতাটাও ছিন্ন হয়ে গেলো। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের সময় জম্মু-কাশ্মীর ভারতের কোনো অঙ্গরাজ্য ছিল না৷ রাজা হরি সিং-এর স্বাধীন রাজতন্ত্র ছিল। কিন্তু, ১৯৪৭ সালের ২২শে অক্টোবর কিছু পার্বত্য দস্যুরা কাশ্মীর আক্রমণ করলে, রাজা হরি সিং ভারতের কাছে সেনা সাহায্য চান৷ তখন ভারত সরকার রাজা হরি সিংকে ভারতভূক্তির শর্তে সাহায্য করে। তখন ভারতের সংবিধানে জম্মু-কাশ্মীরকে ৩৭০ আর্টিকেল অনুযায়ী স্বায়ত্তশাসনের 'বিশেষ মর্যাদা' দেবার সংস্থান রাখা হয়৷ ৩৭০ ও ৩৫ ধারার ওপর নির্ভর করে কাশ্মীরে নিচের কয়েকটি আইন বলবৎ ছিল-
এক. ৩৭০ আর্টিকেল অনুযায়ী জম্মু-কাশ্মীরের নাগরিকদের বিশেষ অধিকার দেয়া হয়েছে।
দুই. এই ধারা অনুযায়ী জম্মু-কাশ্মীরের বিধানসভা স্থির করতে পারে রাজ্যের ‘স্থায়ী নাগরিক’ কারা এবং তাদের বিশেষ অধিকার কী হবে? অর্থাৎ কাশ্মীরে কারা স্থায়ী নাগরিক সেটা কাশ্মীরের রাজ্য সরকার ঠিক করবে। ভারতের কেন্দ্র সরকারের হস্তক্ষেপ করার কোনো অধিকার থাকবে না।
তিন. কেবল স্থায়ী নাগরিকরাই ওই রাজ্যে সম্পত্তির মালিকানা, সরকারি চাকরি বা স্থানীয় নির্বাচনে ভোট দেয়ার অধিকার পাবেন। ভারতের অন্য রাজ্যের কেউ সেখানে সম্পত্তি ক্রয় করার অধিকার রাখে না।
চার. রাজ্যের নাগরিক কোনো মহিলাও যদি রাজ্যের বাইরের কাউকে বিয়ে করে তাহলে সে সম্পত্তির অধিকার থেকে বঞ্চিত হবে। তার উত্তরাধিকারীদেরও সম্পত্তির উপরে অধিকার থাকবে না। (যদিও ২০০২সালে একটি ঐতিহাসিক মামলায় জম্মু কাশ্মীরের হাইকোর্ট ৪নম্বর আইনটি স্থগিত করে দেয়।)
আজকের ৩৭০ অনুচ্ছেদটি বাতিলের অবৈধ বিল পাশের মাধ্যমে কাশ্মীর হারালো তাদের স্বায়ত্তশাসনের গৌরব। এখন কাশ্মীরকে দুটি ভাগ করা হয়েছে। পরবর্তীতে আরো ভাগ করতে করতে হায়দারাবাদের মত করে ফেলবে। ভারতের সবচেয়ে বড় প্রদেশ একসময় ছিল স্বাধীন হায়দারাবাদ, যার এখন কোনো অস্তিত্ব নেই৷
৩৭০ আর্টিকেলের কারণে জম্মু-কাশ্মীর অন্য যে কোনো ভারতীয় রাজ্যের চেয়ে বেশি স্বায়ত্তশাসন ভোগ করত। সেখানে অন্য অঞ্চলের লোকজন সম্পত্তি কিনতে পারতেন না। এখন থেকে সেটি পারবেন। এ অনুচ্ছেদের কারণেই মূলত কাশ্মীর ভারতের অন্তর্ভুক্ত হয়। এ অনুচ্ছেদ নিজেদের সংবিধান ও একটি আলাদা পতাকার স্বাধীনতা দেয়। এ ছাড়া পররাষ্ট্র সম্পর্কিত বিষয়াদি, প্রতিরক্ষা এবং যোগাযোগ বাদে অন্যান্য সকল ক্ষেত্রে স্বাধীনতার নিশ্চয়তাও দেয়। এটি বাতিল হওয়ার ফলে অনুচ্ছেদ ৩৫এ হিসেবে পরিচিত সংবিধানের অনুচ্ছেদটিও হুমকির মুখে পড়েছে বলে মনে করছে বিবিসি।
এ অনুচ্ছেদের কারণে ভারত শাসিত কাশ্মীরের ‘স্থায়ী নাগরিক’ কারা তা সংজ্ঞায়িত করা যেত। এখন আর সেটি করা যাবে না। অর্থাৎ যেকোনো রাজ্য থেকে সাধারণ মানুষ সেখানে থাকা শুরু করলে রাষ্ট্রীয় নিয়ম অনুযায়ী নির্দিষ্ট সময় পর নাগরিকত্ব পাবেন। সেটি যদি হয়, তাহলে সংখ্যাগুরু মুসলিমরাই অদূর ভবিষ্যতে সংখ্যালঘু হয়ে পড়তে পারে।
প্রকৃতপ্রস্তাবে আর্টিকেল ৩৭০ না থাকলে কাশ্মীরের সাথে ভারতের সম্পর্কের সাংবিধানিক ভিত্তিটাও আর থাকে না। আর সেজন্যেই সমগ্র কাশ্মীর এখন ভারতীয় সেনাদের করদরাজ্যে পরিণত হইছে। সাংবিধানিকভাবে কাশ্মীরের দখল পুরাপুরি না নিতে পেরে, বিজেপি এখন সরাসরি অসাংবিধানিক পথেই, সেনা-আগ্রাসনের মাধ্যমে কেড়ে নিতে চাইতেছে কাশ্মীরের মানুষের স্বাধিকার। ভারত রাষ্ট্রের আগ্রাসনের এই চূড়ান্ত সময়টিতেও, বিশ্বের যাবতীয় মানবতাবাদ ও অন্যান্যরা নীরব দর্শকের ভূমিকায় অবতীর্ণ। কেবল কাশ্মীরিরা এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াইলেই তারা মুখ খুলবেন।
হিন্দুত্ববাদের এ ভয়াবহ আগ্রাসনের ব্যাপারে বিশ্বব্যাপী উচ্চকণ্ঠে প্রতিবাদ করা দরকার। কাশ্মীরের আজাদির আন্দোলনকে যারা বছরের পর বছর 'জঙ্গিবাদ' হিসেবে চিহ্নিত করছে, তাদেরও একহাত নেয়া প্রয়োজন। এদের হাতে দেশের রাজনীতি ও মানুষ নিরাপদ নয়।
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই আগস্ট, ২০১৯ বিকাল ৫:৪০