কিছুদিন আগে অর্থনীতি নিয়ে কিছু পড়াশুনার উদ্দেশ্যে বেগম সুফিয়া কামাল গণগ্রন্থাগারে যাই। সেখানে যথাস্থানে ব্যাগ জমা রেখে সিড়ি বেয়ে উপরে উঠলাম। ব্যাগ রাখার স্থানে অজস্র ব্যাগ। বুঝলাম যে গ্রন্থাগারে অনেক মানুষ এসেছে। ভিতরে প্রবেশ করে দেখলাম গ্রন্থাগারের ভিতরে অসংখ্য ছেলে মেয়ে। তারা মনোযোগ দিয়ে পড়াশুনা করছে। তবে একটু লক্ষ্য করতেই বুঝা গেল যে বইগুলো একটাও গ্রন্থাগারের বই নয়। সবগুলোই বিভিন্ন চাকরীর প্রস্তুতির জন্য বা প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার জন্য লিখিত বই। কোনো চেয়ার ফাঁকা নেই। একটা-দুইটা যাও ফাঁকা আছে তাও সেগুলোর সামনে বই ভাজ করে রাখা বা চেয়ার একটু কাত করে টেবিলে ঠেস দিয়ে রাখা যাতে বুঝা যায় যে এগুলোতে বসার মানুষ আছে শুধু হয়তোবা কোনো কারণে বাইরে গেছে, কিন্তু এখনি এসে পড়বে।
শেষ পর্যন্ত খালি একটা চেয়ার পেলাম। কিন্তু বসতেই পাশ থেকে এক মেয়ে রিনরিনে গলায় বললো, আঙ্কেল, এটা আমার ফ্রেন্ডের চেয়ার। ও এখনি এসে পড়বে। আপনি প্লিজ অন্য চেয়ার দেখুন। উঠে পড়লাম। তার ফ্রেন্ডের চেয়ারে তো আর বসা যায় না। খালি দেখে আরেকটা চেয়ারে বসার উপক্রম করতেই সামনে থেকে একজন বললো, হ্যালো ব্রাদার, এই চেয়ারে মানুষ আছে। আরেকটা চেয়ারের কাছে যেতেই আরেকজন বললো, সরি আপনি অন্য চেয়ার দেখুন। শেষপর্যন্ত একটা চেয়ারে বসতে পারলাম। তবে মিনিট খানেক যেতে না যেতেই একটা ছেলে এসে বললো, এক্সকিউজ মি, এটা আমার চেয়ার। আপনি অন্য চেয়ারে যান। লজ্জিত আমি তাড়াতাড়ি স্যরি বলে উঠে পড়লাম। সারা গ্রন্থাগার ঘুরেও কোনো খালি চেয়ার পেলাম না। সবাই চাকরীর প্রস্তুতির জন্য পড়ছে। MP3, র্যাডিকেল, আজকের বিশ্ব, খায়রুলস বেসিক ম্যাথ, ওরাকল ইত্যাদি বিভিন্ন বই নিয়ে ছেলেমেয়েরা পড়ছে বা খাতায় নোট করছে, অঙ্ক করছে।
শেষপর্যন্ত শেলফের পাশে যে ফাঁকা জায়গা থাকে সেখানে দাড়িয়ে দাড়িয়ে কিছু পড়লাম, কয়েকটা পেজের ছবি তুললাম। সেখানে দাড়ানো অবস্থায় দেখলাম আমার মতো চেয়ারে বসতে না পেরে ফ্লোরে বসে একটা ছেলে উবু হয়ে গ্রন্থাগারের বই পড়ছে। আর অদূরে আরেকজন লোক আমার মতোই দাড়িয়ে দাড়িয়ে শেলফ থেকে বই নামিয়ে দেখছে এবং পড়ছে। সারা গ্রন্থাগারে আমিসহ তিনজন পেলাম যারা চাকরির পড়া নয় গ্রন্থাগারের বই পড়ছে। আর বাকি কয়েকশো ছেলেমেয়ে মনোযোগ দিয়ে চাকরির জন্য পড়ছে।
চাকরি প্রত্যাশী পড়ুয়াদের চাপে সাধারণ পাঠকরা যেন কোনঠাসা। তাদের যেন কোনো স্থান নেই গণগ্রন্থাগারে। একটি রাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরিতে সবার পড়াশুনার অধিকার থাকলেও চাকরিপ্রার্থী বিশেষ গোষ্ঠীর কারণে সাধারণ পাঠকরা লাইব্রেরিতে কেনো আসন পায় না। বিষয়টি অনেক দিন ধরে শুনে আসছি। নিজে এবার চাক্ষুস দেখলাম।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, দু’বছর আগেও পাবলিক লাইব্রেরির এমন চিত্র ছিল না। স্কুল, কলেজ কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া তরুণ-তরুণীরা বই পড়ার জন্য এখানে ভিড় জমাতো। নানা ধরনের বইয়ের মধ্যে খুঁজে নিতো তার মৌলিক জ্ঞান। অথচ এখন পাবলিক লাইব্রেরিতে ক্যারিয়ার কেন্দ্রিক জ্ঞান চর্চায় একমুখী হয়েছেন তরুণরা। চাকরি প্রত্যাশী তরুণদের ভিড়ে অন্যান্য পাঠকরা সুযোগ পাচ্ছে না। ফলে পাবলিক লাইব্রেরির স্বকীয়তা হারিয়ে যাচ্ছে বলে মনে করেন তারা। তবে শিক্ষার্থীরা বলছেন, চাকরির জন্য পড়াশোনায় যে, অন্য কোনো কিছু শেখা যায় না, এটা পুরোপুরি ঠিক না। কারণ চাকরির জন্য সাহিত্য, গণিত, ইংরেজিসহ অনেক বিষয়েই পড়তে হয়। তাই কিছুটা হলেও তো জানা বা শেখা হচ্ছে। আচ্ছা এটা তো যার যার বাসায়ও করা যায়। পাবলিক লাইব্রেরিতে এসেই যে করতে হবে এমন তো কোনো কথা নেই। এখানে পড়াশুনার পরিবেশ আছে কিন্তু এই পরিবেশ তো সব পাঠকদের জন্য, শুধু চাকরি প্রত্যাশী তরুন-তরুনীদের জন্য নয়। দীর্ঘ বছর কর্মক্ষেত্রে বিচরণ করার সুবাদে আমি অসংখ্য মানুষকে চিনি যারা জীবনে কোনো দিন পাবলিক লাইব্রেরিতে গিয়ে এমপিথ্রি বই না পড়েও বিসিএস, ব্যাংক বা অন্য কোনো সরকারি চাকরি পেয়েছে।
তবে বিষয়টা স্পর্শকাতর। কারণ চাকরি তো সবারই দরকার। আবার আমাদের মতো পাঠকদেরও কিছু পড়াশুনা করা দরকার। তাই এর পক্ষে বিপক্ষে কিছু না বলে আমি বরং পাবলিক লাইব্রেরি কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করবো গণগ্রন্থাগারের উপরে আরো একতলা বা দু’তলা বানিয়ে সেখানে চাকরির পড়ুয়াদের পাঠকক্ষ বানাতে এবং নিচের দুইতলা-তিনতলা যথারীতি সাধারণ পাঠকদের জন্য রাখতে। তাতে মনে হয় দুই দিকই রক্ষা হয়।
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই মে, ২০১৮ দুপুর ১২:৩৮