আজ আইনষ্টাইনের জন্মদিন, ছোটদের জন্য আপেক্ষিক তত্ত্ব নিয়ে লেখার চেষ্টা করেছিলাম। সেটাই আজ এই মহা বিজ্ঞানীর জন্মদিনে আমার শ্রদ্ধার্ঘ্য।
ছোটদের আপেক্ষিক তত্ত্ব।
আমরা যদি বলি “পানি তিন কোণ বিশিষ্ট” তা কি কোন অর্থপূর্ণ কথা হল? আবার যদি জিজ্ঞেস করি বাড়িটি রাস্তার ডান দিকে না বাম দিকে? প্রশ্ন টি সহজ মনে হলেও এর উত্তর দেয়া সম্ভব নয় । এভাবে বলা যেতে পারে যে তুমি যদি ব্রীজ থেকে বনের দিকে যাও তাহলে বাড়িটি তোমার বাম দিকে পড়বে অথবা যদি তুমি বনের দিক থেকে ব্রীজের দিকে যাও তাহলে বাড়িটি তোমার ডান দিকে পড়বে। অর্থাৎ রাস্তার ডানে বা বামে বললেও তোমাকে যে কোন একটি দিক উল্লেখ করতে হবে।
দিন বা রাত- এ ব্যাপারটিও নির্ভর করছে স্থানের উপর। যখন বাংলাদেশে দিন তখন আমেরিকায় রাত। এখানে কোন স্ববিরোধিতা নাই। দিন বা রাত শব্দ দুটি আপেক্ষিক এবং কোন স্থানের কথা উল্লেখ না করলে এর অর্থ খুঁজে পাওয়া যাবে না।
আমরা প্রায়ই বলি ’উপরে ও নীচে’। এই শব্দ দুটি কি পরম না আপেক্ষিক? বিভিন্ন সময় মানুষ এর উত্তর বিভিন্ন রকম ভাবে দিয়েছে। যখন মানুষ জানতো না যে আমাদের পৃথিবীটা গোলাকার বরং ভাবতো সমতল তখন উপরের দিক টা পরম বা চরম বলেই গন্য হতো। খাড়া বা উল্লম্ব দিক কে ভূপৃষ্ঠের সব স্থানে একই রকম ভাবা হতো ফলে স্বাভাবিক ভাবেই মানুষ “সোজা উপরে” বা “সোজা নীচে” কে পরম ভাবতো। মস্কো শহরে যারা খাড়া হয়ে হাঁটছে, তারা ভাবছে যে তখন নিউজিল্যান্ডের লোকেরা ঝুলছে। কিন্তু নিউজিল্যান্ডের লোকেরা ভাবছে যে তারাই সোজা হয়ে হাঁটছে আর মস্কোর লোকেরা ঝুলে আছে।
যখন আবিষ্কার হলো যে পৃথিবী গোলাকার তখনই এই পরম উল্লম্বের ধারণা চুপসে গেল। খাড়া দিক বা উল্লম্ব দিক সংক্রান্ত ধারণাটি পরম কিছু নয় বরং আপেক্ষিক। প্রকৃতপে গোলাকার পৃথিবী পৃষ্ঠে একটা উল্লম্ব রেখা আঁকতে হলে নির্দিষ্ট একটি বিন্দু প্রয়োজন যার মধ্যে দিয়ে রেখাটি অতিক্রম করবে। ফলে ভূপৃষ্ঠের বিভিন্ন স্থানে /বিন্দুতে উল্লম্ব রেখা /দিক বিভিন্ন হবে। তাই ভূপৃষ্ঠে কোন নির্দিষ্ট বিন্দু উল্লেখ না করলে ‘উপরে বা নীচে’ শব্দ দুটি অর্থহীন হয়ে যায়।
আমরা যদি বলি ‘এখন ৫টা বাজে’ কিন্তু বললাম না কোথায় বাংলাদেশে না ইংল্যান্ডে,তাহলে এটা কি কোন অর্থ বহন করে?।
আমরা যদি বিভিন্ন অবস্থান থেকে একটি বস্তুর গতি পর্যবেণ করি তাহলে দেখা যাবে যে এর গতিও পরিবর্তিত হচ্ছে। যেমন একটি প্লেন থেকে যদি একটি পাথর নিপে করা হয়, তাহলে প্লেন থেকে দেখা যাবে যে পাথরটি সোজা মাটিতে পড়ছে কিন্তু ভূমি থেকে দেখা যাবে যে এটি একটি বাঁকা পথে পড়ছে যা একটি প্যারাবোলা’র আকার নেবে।
আমাদের দৈনন্দিন অভিজ্ঞতা থেকে আমরা বুঝতে পারি যে একটি গতিশীল ট্রেনের ভিতরে অবস্থিত কোন বস্তুর আচরণ বা গতি একটি গতিহীন ট্রেনের ভিতরের মতই। চলমান ট্রেনের ভিতর একটি বলকে উপরে ছুরে মারলে সেটি সোজা হাতে এসেই পড়বে। মোটকথা যতণ একটা ল্যাবরেটরি সোজাপথে সমান গতিতে চলছে একটি স্থির ল্যাবরেটরি সাপেক্ষে তখন উভয় ল্যাবরেটরির মধ্যের বস্তুগুলির আচরণের পার্থক্য বোঝা যাবে না। যখনই গতিশীল ল্যবরেটরির গতির পরিবর্তন হয় তখনই ভেতরের বস্তুগুলির উপর এর প্রভাব বুঝতে পারা যায়।
স্থিতাবস্থা’র ধারণাটি হারিয়ে গেল - দেখা যাচ্ছে যে সমান গতিতে সরল পথে চলমান একটি ল্যাবরেটরির কোন প্রভাব এর অভ্যন্তরের বস্তুগুলোর উপর পড়ে না।
সরল পথে সমান গতিতে চলমান কোন ল্যাবরেটরিকে স্থির ভাবা যেতে পারে। এর অর্থ হলো কোন চরম বা পরম স্থিরাবস্থা নেই বরং অসংখ্য রকমের স্থিরাবস্থা বিদ্যমান। অর্থাৎ অসংখ্য স্থির ল্যাবরেটরি রয়েছে যে গুলি একটি অপরটির সাপেক্ষে সমান গতিতে সোজা পথে চলমান বা গতিশীল।
যেহেতু স্থিরাবস্থার ধারণাটি পরম বা চরম নয় বরং আপেক্ষিক, আমাদেরকে সবসময় মনে রাখতে হবে অসংখ্য গতিশীল ল্যাবরেটরির ব্যাপারটি যারা সমান গতিতে সরল পথে একে অপরের সাপেক্ষে গতিশীল রয়েছে।
এভাবে আমরা প্রকৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ বিধি সর্ম্পকে ধারণা পেতে সম হলাম যার নাম আপেক্ষিক গতির বিধি (principle of relative motion)। এই বিধি অনুযায়ী কোন কাঠামোর মধ্যে বস্তু সমুহের গতি, যারা সমান গতিতে সোজা পথে পরস্পর সাপেক্ষে চলমান তারা একই নিয়মের অধীন। এটাই আইনষ্টাইনের বিশেষ আপেক্ষিক তত্ত্বের প্রথম সূত্র।
গতির আপেক্ষিকতার আবিষ্কার মানব জাতির একটি বৌদ্ধিক অর্জন। এর আবিষ্কার না হলে পদার্থ বিজ্ঞান আজকের পর্যায়ে আসতে পারত না। আমরা দেখেছি গতির আপেক্ষিকতা আর অসংখ্য জড় কাঠামোর উপস্থিতি। জড় কাঠামোর মধ্যে বস্তুর গতির নিয়ম একই রকম। যা হোক আরেক রকমের গতি আছে যা প্রথম দৃষ্টিতে মনে হয় আমাদের উপরের ধারণার সঙ্গে মেলে না। এটি হলো আলোর প্রবাহ। আলো তাৎক্ষনিক ভাবে প্রবাহিত হয় না যদিও এর বেগ প্রচন্ড, সেকেন্ডে ৩,০০,০০০ কিলোমিটার। এটা এত প্রচন্ড যে একে অনুধাবন করাই কঠিন, কেননা আমরা আমাদের দৈনন্দিন জীবনে এর চেয়ে অনেক কম বেগ স¤পন্ন বস্তু নিয়ে কাজ করি। ১৮৮১ সালে অ্যালবার্ট মিচেলসন নামের একজন বিখ্যাত বিজ্ঞানী একটা পরীক্ষা করেছিলেন। তিনি এতে অত্যন্ত নির্ভূল ভাবে বিভিন্ন দিকে আলোর বেগ মাপতে সক্ষম হয়েছিলেন। মিচেলসনের এই পরীক্ষা পরবর্তীতে বিভিন্ন ভাবে বিভিন্ন অবস্থায় করে অকল্পনীয় একটা ফলাফল পাওয়া গেছে। মিচেলসন আবিস্কার করলেন যে ঘূর্ণায়মান পৃথিবীতে আলো সবদিকে একই বেগে প্রবাহিত হয়।
বিভিন্ন কাঠামো যদি পরস্পরের স্বাপেক্ষে চলতে থাকে তাহলে তাদের গতি পৃথক হবে কিন্তু অপর দিকে আলোর গতি (৩ ল কি:মি:/সেকেন্ডে) সব কাঠামোর জন্য একই। অর্থাৎ এটি পরম । এটা হচ্ছে আইনষ্টাইনের বিশেষ আপেক্ষিক তত্ত্বের দ্বিতীয় সূত্র।
বিশ শতকের শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনষ্টাইন ১৯০৫ সালে এই আবিষ্কার করেন।
এই দুটো সূত্রের সাহায্যে আমরা প্রকৃতিকে অনেক গভীর ভাবে বুঝতে পারি।
সময় আপেক্ষিক
মনে করি একটি ৫৪,০০,০০০ কিলোমিটার লম্বা ট্রেন (আমরা এর নাম দেব আইনষ্টাইন ট্রেন) একটা সোজা পথে সেকেন্ডে ২,৪০,০০০ কি.মি. বেগে চলছে এবং একটা নির্দিষ্ট সময়ে ট্রেনটির ঠিক মাঝামাঝি স্থানে একটা বাতি জ্বালানো হলো এবং বাতির আলো পৌছার সঙ্গে সঙ্গে সামনের এবং পেছনের বগির দরজা খুলে গেল। ট্রেনের যাত্রীরা এবং ষ্টেশনের প্লাটফর্মে দাঁড়ানো যাত্রীরা কি দেখবে?
এই প্রশ্নের উত্তর আমরা অংক কষে দেখবো। ট্রেনের মধ্যের বগির যাত্রীরা দেখবে যে বাতি জ্বলার ৯ সেকেন্ড পরে (২৭,০০,০০০/৩,০০,০০০) আলো সামনের এবং পেছনের বগিতে পৌছাবে এবং দুই বগির দরজা একসঙ্গে খুলে যাবে, কারণ মিচেলসনের পরীা অনুসারে ট্রেনের স্বাপেে আলো সব দিকে একই বেগে প্রবাহিত হবে।
ষ্টেশনের প্লাটফর্মের স্বাপেওে আলো সেকেন্ডে ৩,০০,০০০ কি.মি বেগে প্রবাহিত হবে এবং পেছনের বগি যেহেতু আলোর উৎসের দিকে এগিয়ে আসছে, তাই আলো ২৭,০০,০০০/(৩,০০,০০০+২,৪০,০০০) = ৫ সেকেন্ড পর পেছনের বগিতে পৌছাবে। কিন্তু সামনের বগিতে পৌছাতে ২৭,০০,০০০/(৩,০০,০০০-২,৪০,০০০) = ৪৫ সেকেন্ড সময় লাগবে। অর্থাৎ প্লাটফর্মে দাঁড়ানো দর্শক দেখবে যে দুই বগির দরজা ভিন্ন ভিন্ন সময়ে খুলবে। পেছনের বগির দরজা আগে খুলবে এবং সামনের বগির দরজা ৪৫- ৫=৪০ সেকেন্ড পরে খুলবে।
এভাবে দেখা যায় যে ট্রেনের যাত্রীর একই সময়ে ঘটে যাওয়া দুটি ঘটনা প্লাটফর্মে দাঁড়নো যাত্রীর কাছে ৪০ সেকেন্ড সময়ের বিরতিতে ঘটছে। সময় আপেক্ষিক, এই আবিষ্কারের ফলে প্রকৃতি সম্বন্ধে মানুষের ধারণার বৈপ্লবিক পরিবর্তন হলো।
বেগের সীমা আছে
আমরা কি ‘সুপার লাইট টেলিগ্রাফি ’ অর্থাৎ আলোর গতির চেয়ে বেশী গতিতে সংকেত পাঠাতে পারি? না এটা অসম্ভব। পরীক্ষনিরীক্ষায় সময়ের পরম প্রকৃতির প্রমাণ না পাওয়ায় আমরা এই সিদ্ধান্তে এসেছি যে সংকেত পাঠানোর ঘটনা তাৎক্ষনিক হতে পারে না। সংকেতের গতি স্থানে এক বিন্দু থেকে আরেক বিন্দু পর্যন্ত অসীম হতে পারে না। অপর পক্ষে বলা যায় যে এটা একটা নির্দিষ্ট গতির চেয়ে বেশী হতে পারে না যাকে বলা হয় ‘নির্ধারণ কারী’ গতি। এই সীমা নির্ধারণকারী গতি আলোর গতির সঙ্গে মিলে যায় ।
প্রকৃতপক্ষে গতির আপেক্ষিকতার নীতি অনুযায়ী সব ‘প্রসঙ্গ কাঠামো’র ক্ষেত্রে (যারা একে অপরের সাপেক্ষে গতিশীল) প্রাকৃতিক বিধিগুলি একই রকম হবে। এই ‘নির্ধারণ কারী গতি’ আবিষ্কার হওয়াটা মানুষের মননশীলতার একটা বিরাট উল্লম্ফন।
যদি সূর্য ভেঙ্গে দুটিতে পরিণত হয় তাহলে পৃথিবীর গতিও প্রাকৃতিক ভাবে পরিবর্তিত হবে। ১৯ শতকে বিজ্ঞানীরা জানতেন না ‘নির্ধারন কারী’ গতি কোনটি। তারা ধারণা করতেন যে সূর্য ভেঙ্গে যাওয়ায় পৃথিবী তাৎনিক ভাবে এর গতি পরিবর্তন করেছে। যদিও দুটুকরো হওয়া সূর্য থেকে পৃথিবীতে আলো এসে পৌছাতে ৮ মিনিট সময় লাগতো। সূর্য ভেঙ্গে দুটুকরো হওয়ার ৮ মিনিট পরে এর আলো পৃথিবীতে পৌছার পরেই পৃথিবীর গতি পরিবর্তিত হবে; এর পূর্ব পর্যন্ত পৃথিবী আগের মতই ঘুরতে থাকবে যেন সূর্য দ্বিখন্ডিত হয়নি। সূর্যে বা সূর্যপৃষ্ঠে যাই হোক না কেন ৮ মিনিট পরে ছাড়া কোন কিছুই পৃথিবীতে হবে না
খেয়ালী ঘড়ি - মনে করি আমরা সেই আইনষ্টাইন ট্রেনে ভ্রমন করছি অসীম দূরত্বে, যেখানে দুটি ষ্টেশনের মধ্যে দূরত্ব ৮৬,৪০,০০,০০০ কিলোমিটার। ট্রেনের গতি সেকেন্ডে ২,৪০,০০০ কিলোমিটার হলে ঐ দূরত্ব অতিক্রম করতে আমাদের ১ ঘন্টা সময় লাগবে।
দুই ষ্টেশনেই ঘড়ি আছে। একজন যাত্রী ১ম ষ্টেশনে ট্রেনে উঠে ষ্টেশনের ঘড়ির সঙ্গে তার ঘড়ির সময় মিলিয়ে নিলেন। ২য় ষ্টেশনে পৌছে তিনি দেখবেন যে তার ঘড়িটি স্লো হয়ে গেছে অথচ ঘড়ি টি মেকারের কাছে নিয়ে গেলে সে বলছে যে ঘড়ি ঠিকই আছে এতে কোন যান্ত্রিক ত্র“টি নেই। তাহলে কেন এমন হলো?
ঘটনাটি বোঝার চেষ্টা করি। মনে করি যাত্রীটি চেয়ারে বসে একটি টর্চ জ্বালালেন (টর্চটি মেঝেতে আটকানো আছে এবং সোজা উপরে অর্থাৎ ছাদে একটি আয়না লাগানো আছে।) আলোক রশ্মি টি আয়নায় প্রতিফলিত হয়ে টর্চে ফিরে আসবে। যাত্রীর কাছে আলোক রশ্মির গতিপথ টিকে মনে হবে একটা সরল রেখা অর্থাৎ আলোক রশ্মিটি সোজা উপরে যাবে এবং সেখান থেকে সোজা নীচে ফিরে আসবে । (যেমন হাতে একটা বল নিয়ে উপরে ছুঁড়ে দিলে আবার হাতেই এসে পড়ে), কিন্তু প্লাটফর্মে দাঁড়ানো পর্যবেকের কাছে ব্যাপারটি অন্য রকম দেখাবে। টর্চের আলো ছাদে পৌঁছানোর সময়েই আয়নাটা কিছুটা সরে যাবে ট্রেনের গতির কারণে। আবার আয়নাতে প্রতিফলিত হয়ে ফিরে আসার সময়ে টর্চটিও একই পরিমানে সামনে সরে যাবে।
প্লাটফর্মে দাঁড়ানো পর্যবেকের কাছে মনে হবে যে আলোক রশ্মিটি বেশী দূরত্ব অতিক্রম করেছে। (ট্রেনের ভিতরের যাত্রীর কাছে যা মনে হয়নি)। আমরা জানি যে আলোর গতি পরম গতি এবং সেটা ট্রেনের যাত্রী বা প্লাটফর্মে দাঁড়ানো পর্যবেক, উভয়ের কাছেই। তাহলে আমরা এই সিদ্ধান্তে আসতে পারি যে ষ্টেশনে যে অতিরিক্ত সময় অতিক্রান্ত হয়েছে সেটা সেই আলোর যাওয়া এবং আসার সময় যা ট্রেনের যাত্রীর কাছে মনে হয়নি।
কক প্যারাডক্স - ষ্টেশনের দর্শক যখন দেখলো যে ট্রেনটি ১০ সেকেন্ড ভ্রমন করলো তখন ট্রেনের ভিতরে উপবিষ্ট যাত্রীর ঘড়িতে ৬ সেকেন্ড সময় অতিক্রান্ত হয়েছে। তার মানে ট্রেনটি যদি ১ ঘন্টা পরে আবার ঐ ষ্টেশনে ফিরে আসে তখন যাত্রীর ঘড়িতে মাত্র (৬0*৬)/১0=৩৬ মিনিট সময় অতিক্রান্ত হবে। অপর কথায় ষ্টেশনের ঘড়ির তুলনায় যাত্রীর ঘড়ি ২৪ মিনিট পিছিয়ে গেছে বা স্লো হয়ে গেছে।
এটা এখন সহজেই বোঝা যাচ্ছে যে ট্রেনের গতি যত বেশী হবে সময়ের পার্থক্যও তত বেশী হবে।
ট্রেনের গতি যদি আলোর গতির কাছাকাছি হয় তাহলে ষ্টেশনের ঘড়ির তুলনায় যাত্রীর ঘড়ির সময় একটা নির্দিষ্ট হারে কমতে থাকবে, অর্থাৎ আলোর গতির ০.৯৯৯ শতাংশ গতিতে ট্রেনটি চললে যাত্রীর ঘড়িতে ১ মিনিট সময় অতিক্রান্ত হলে ষ্টেশনের ঘড়িতে ১ ঘন্টা পেরিয়ে যাবে। অর্থাৎ স্থির ঘড়ির তুলনায় গতিশীল ঘড়িতে সময় ধীরে প্রবাহিত হবে।
টাইম মেশিন - এখন এস আমরা দেখি যদি আমাদের আইনষ্টাইন ট্রেনটি সরল পথে না চলে একটি বৃত্তাকার পথে চলে তা হলে কি দাঁড়ায়। এটি চলতে শুরু করার একটি নির্দিষ্ট সময় পরে আবার শুরুর স্থানে এসে পৌঁছাবে। আমাদের আগের পর্যবেণ অনুযায়ী যাত্রী দেখবে যে তার ঘড়ি ধীরে চলছে। এভাবে ট্রেনের গতি অনেক অনেক বাড়িয়ে দিয়ে দেখা যাবে যে যাত্রীর ঘড়িতে ১ ঘন্টা সময় অতিক্রান্ত হলে ষ্টেশনের ঘড়িতে কয়েক বছর সময় পেড়িয়ে গেছে। যাত্রীর ঘড়ি অনুযায়ী ১ দিন ভ্রমনের পরে ষ্টেশনে নেমে যাত্রী দেখবে যে তার সব আত্মীয় স্বজন ও বন্ধুরা অনেকদিন আগে ইহলোক ত্যাগ করেছেন।
দৈর্ঘ্য সংকোচন - এবার আমরা কল্পনা করি যে আমাদের আইনষ্টাইন ট্রেনটি একটি ষ্টেশনের প্লাটফর্মকে অতিক্রম করলো যার দৈর্ঘ্য ২৪,০০,০০০ কিঃমিঃ। প্লাটফর্মের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে পৌছাতে ট্রেনটির ২৪,০০,০০০২,৪০,০০০ = ১০ সেকেন্ড সময় লাগবে, প্লাটফর্মের ঘড়ি অনুযায়ী। কিন্তু যাত্রীর ঘড়িতে এর পরিমান হবে মাত্র ৬ সেকেন্ড। যাত্রীর কাছে মনে হবে প্লাটফর্মের দৈর্ঘ্য ২৪,০০,০০০ কিলোমিটার নয়, বরং ২,৪০,০০০৬ = ১৪৪০০০০ কিলোমিটার।
অর্থাৎ যাত্রীরা দেখবে যে প্লাটফর্মটি ছোট হয়ে গেছে, আবার প্লাটফর্মে দাঁড়ানো যাত্রীদের কাছে মনে হবে যে ট্রেনটিই দৈর্ঘ্যে খাটো হয়ে গেছে (৬ঃ১০ অনুপাতে)। সব চলমান বস্তুই সংকুচিত হয় তাদের চলার (গতির) দিকে। বস্তুটি তার সত্যিকার আকারে দেখা যায় যখনই আমরা এমন একটি কাঠামো থেকে দেখি যা বস্তুটির তুলনায় স্থির।
ক্যাপ্রিসিয়াস (খেয়ালী) গতি -
মনে কর একজন যাত্রী ঘন্টায় ৫ কিঃ মিঃ বেগে ট্রেনের সামনের দিকে হাঁটছেন। ট্রেনটি ঘন্টায় ৫০ কিঃমিঃ গতিতে চলছে - রেল লাইনের স্বাপেক্ষে লোকটির গতি কত? এটা নিশ্চিত ভাবে ৫০+৫=৫৫ কিঃমিঃ/ঘন্টা। আমাদের এই হিসাব টা গতি সংযোগ করার সূত্র অনুযায়ী সঠিক । যদি আইনষ্টাইন ট্রেনে যাত্রীটি সেকেন্ডে ১,০০,০০০ কিঃমিঃ বেগে সামনের দিকে হাঁটতে থাকে তাহলে রেল লাইনের সাপেে তার গতি হওয়া উচিৎ ২,৪০,০০০+১,০০,০০০=৩৪০০০০কিঃমিঃ/সেকেন্ড। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এমন গতির অস্তিত্ব নাই। কারণ এটা আলোর গতির চেয়েও বেশী হয়ে যাচ্ছে যা নির্ধারিত।
বৃদ্ধিমান ভর
কোন বস্তুর ভর হলো তার একটি গুরুত্বপূর্ণ ধর্ম। আমরা মনে করি যে এই ভর সবসময় একই রকম এবং এটা গতির সঙ্গে সম্পর্কিত নয়। একই পরিমান বল নিরবিচ্ছিন্ন ভাবে প্রয়োগ করা হলে কোন বস্তুর গতি বৃদ্ধি পায় এবং তা প্রত্য ভাবে বল প্রয়োগের সময়ের সঙ্গে সম্পর্কিত।
মনে কর কোন বস্তুর উপর দুই সেকেন্ড ধরে বল প্রয়োগ করা হলো, তাহলে আমরা বস্তুটির গতি বের করতে কি করবো। আমরা সাধারণত বেগের যোগ ফলের নীতি অনুযায়ী ১ম সেকেন্ডের পরে অর্জিত গতির সঙ্গে পরবর্তী সেকেন্ডে অর্জিত গতি যোগ করবো। আমরা এরকম যোগ করতে পারবো যতক্ষন না এটি আলোর গতির সমান গতি অর্জন করে।
এখন কিন্তু আর পুরানো নিয়ম খাটবে না। আপেক্ষিক তত্ত্ব অনুযায়ী আমরা যে ফলাফল পাবো তা সাধারণ নীতি অনুযায়ী ফলাফলের চেয়ে কম হবে। তার অর্থ হলো ‘উচ্চ গতি’ বল প্রয়োগের সময়ের অনুপাতে বৃদ্ধি পাবে না। বরং কিছুটা কমবে কারণ এটা প্রাকৃতিক একটা ব্যাপার কেননা প্রকৃতিতে একটি নির্ধারিত গতি আছে। একটা নির্দিষ্ট পরিমান বল প্রয়োগের ফলে বস্তুর গতি বাড়তে থাকবে ধীরে ধীরে যতন না এটা আলোর গতির কাছাকাছি যায়, যেন সেই নির্ধারিত গতি অতিক্রান্ত না হয়।
যতন পর্যন্ত কোন বস্তুর গতি বল প্রয়োগের সময়ের আনুপাতিক হারে বৃদ্ধি পেতে থাকে ততন পর্যন্ত ভর কে স্বাধীন ভাবা যেতে পারে। কিন্তু যখন বস্তুটির গতি আলোর গতির কাছাকাছি হয় তখন সময় এবং গতির সম্পর্ক আর থাকে না এবং ভর ই তখন বেগের উপর নির্ভরশীল হয়ে পরে। যেহেতু ত্বরণের সময় অসীম হারে বৃদ্ধি পায় এবং বেগ যেহেতু সর্বোচ্চ সীমা অতিক্রম করতে পারে না, সেহেতু আমরা দেখি যে বেগ বৃদ্ধির সাথে সাথে ভর বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং তা অসীম হবে যখন বস্তুটির বেগ আলোর গতির সমান হবে।
এর পরে যে সমস্যাটি দেখা দিল তা হচ্ছে নিউটনের মহাকর্ষীয় তত্ত্বের সঙ্গে এর অসংগতি। নিউটনের তত্ত্বের মতে বস্তু গুলি পরস্পর কে আকর্ষণ করে এবং আকর্ষণ বল তাদের দূরত্বের উপর নির্ভরশীল।এর অর্থ হলো যদি একটা বস্তুকে সরানো হয় তাহলে অপর বস্তুটির উপর প্রযুক্ত বলের তাৎক্ষনিক পরিবর্তন হবে। অর্থাৎ মহাকর্ষীয় ক্রিয়ার দ্রুতি হওয়া উচিত আলোর দ্রুতির সমান বা তার চেয়ে বেশী। কিন্তু বিশেষ আপেক্ষিক তত্ত্বের মতে মহাকর্ষীয় ক্রিয়ার দ্রুতি হওয়া উচিত আলোর দ্রুতির সমান বা তার চেয়ে কম। ১৯১৫ সালে আইনষ্টাইন এক বিপ্লবী প্রস্তাব উত্থাপন করেন যে মহাকর্ষীয় বল অন্যান্য বলের মত নয়। যাকে ব্যাপক আপেক্ষিক তত্ত্ব বরা হয়। এই তত্ত্ব অনুযায়ী স্থান-কাল সমতল নয় বরং বস্তুর ভর ও শক্তির কারণে বক্র বা মোড়ানো। এখানে পৃথিবী মহাকর্ষ বল দ্বারা সূর্যের চারদিকে ঘুরছে না বরং এটা বক্র স্থানে সোজা পথে চলছে যাকে জিওডেসিক বলা হয়। বস্তু সমুহ চারমাত্রিক জগতে সোজা পথে চলে যাকে ত্রিমাত্রিক জগতে বক্র পথে চলমান বলে মনে হয়। এছাড়া ব্যাপক আপেক্ষিক তত্ত্ব অনুযায়ী মহাকষীয় ক্ষেত্র আলোক রশ্বিকে বাঁকিয়ে দেবে এবং পৃথিবী বা আরও বেশী ভর সম্পন্ন কোন বস্তু পিন্ডের কাছে সময়ের গতি ধীর বলে মনে হবে। ১৯৬২ সালে একটি পরীক্ষায় এটি নির্ভূল ভাবে প্রমানিত হয়েছে।
মহা বিজ্ঞানী আইনষ্টাইনের আপেক্ষিক তত্ত্বের ফলে বোঝা গেল যে সময়, স্থান নিরপেক্ষ নয় বরং এর সাথে মিলেমিশে ‘স্থান-কাল’ নামে একটা বস্তু তৈরী করে; এছাড়া, আরেকটি ফলাফল হলো বস্তুর ভর এবং শক্তির সমীকরণ যা E=mC2 । এ থেকে দেখা যায় যে শক্তি বৃদ্ধির সাথে সাথে বস্তুর ‘ভর’ বৃদ্ধি পাবে ফলে গতি বৃদ্ধির হারও কমতে থাকবে।
আপেক্ষিক তত্ত্ব আমাদেরকে দেখায় যে মহাবিশ্ব গতিশীল এবং প্রসারমান। অর্থাৎ স্থির এবং অপরিবর্তনীয় মহাবিশ্বের প্রাচীন ধারনাসমুহ তাসের ঘরের মত ভেঙ্গে পড়লো।
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই মার্চ, ২০০৯ রাত ১২:২৪

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




