“কি দারুণ ভিউ!! তাই না?” বলতে বলতে হাতের আঙ্গুল ধরার চেষ্টা করলো লতিফ।
এবারও হাত সরিয়ে ফেললো স্বাতী। লতিফ আজ বেশ কয়েকবারই হাত ধরার চেষ্টা করেছে। মেয়েদের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বেশ প্রখর হয়; আনমনা ভাব করে প্রত্যেকবারই ঠিক মুহূর্তে সরে গেছে স্বাতী। এমন না যে লতিফ ওর হাত আগে ধরেনি। অবশ্যই ধরেছে আর ভবিষ্যতেও ধরবে। পানচিনি হয়ে গেছে; বিয়ের দিনতারিখ নির্ধারণ চলছে। মাসখানেকের মধ্যেই দলিল দস্তাবেজে সই করে শুধু হাত কেন এই পুরো মানুষটাই লতিফের হয়ে যাবে। লতিফের বোন বিদেশ থেকে আসার অপেক্ষা।
হাত সরিয়ে আঙ্গুলে কানের পেছনে চুল সরালো স্বাতী। বারান্দার গরাদ নেই। অত্যাধুনিক এই ফ্ল্যাটের বারান্দা কাঁচে ঘেরা; কোমর উঁচু রেলিঙয়ের ওপরে ঝকঝকে এলুমিনিয়ামের ফ্রেমে দুপাল্লা কাঁচের দেয়াল। অনেক অনেক নীচে রাস্তায় গাড়িদের লাল আলোর সারি সারি রক্তচক্ষু। উনিশ তলার ওপর থেকে রাতের শহরটাকে খুব ঝলমলে লাস্যময়ী দেখাচ্ছে; বাইজী বাড়ির মতো। রাতের ঘাগরায় আলোর চুমকির ঢেউ তুলে শহর এখন যৌনআবেদনময়ী উমরাওজান “ইন আঁখো কে মস্তি কে...মস্তানও হাজারো হ্যায়...”
- জানো...ছাদের কোনায় মাকড়শার জালে একবার বৃষ্টিশেষে জলের বিন্দু আটকে ছিলো। মেঘ ঝরে সূর্য হাসতেই জালে বন্দী জলকনারা হীরের মতো ঝকমক করছিলো। শহরটাকে এখান থেকে তেমনটাই দেখাচ্ছে...বিন্দু বিন্দু আলো দিয়ে তৈরী মোহময় জাল।
- তুমি সবসময় ছাদের গল্প করো...পাবে ওখান থেকে এমন ভিউ?
স্বাতী হাসিহাসি মুখে মাথা নেড়ে মানা করলো। দোতলা বাড়িটা বড্ড পুরোনো; ওরা ওখানে ভাড়া থাকে অনেক বছর। বাড়িটার সাথে সাথে মা-বাবারও বয়স বেড়েছে। বাসাটা অবশ্য ছেড়ে দিতে হবে; এখানে নতুন ফ্ল্যাটবাড়ি উঠবে। দোতলা ছাদ থেকে শহরটা অন্যরকম দেখায়; কোন আটপৌঢ়ে সাধারণ মেয়ে, রূপটান নেই। খোলা এলো চুল; বুকের ওপর এলিয়ে পড়ে রয়েছে আঁচল, অবিন্যস্ত। অন্যরকম সুন্দরী, যাকে বুঝতে হলে, যার গভীরে ঢুকতে গেলে, অনেক কসরত করতে হবে। তার কোমরের মেদ আঁচলে ঢেকে সুন্দর নরম এক অবয়ব তৈরী করে। যার শরীরের ভাঁজ কোনো বনেদী পুকুরঘাটের শ্যাওলা মাখা সিঁড়ি, পা দিলেই অতলজলের আহ্বান! যার চোখে লেখা আছে আছে আরব্য রজনীর সহস্র গল্প...কিন্তু সে শেহেরজাদী নয়!!
প্রায় রাতেই স্বাতী ছাদে ওঠে। দোতলা ভাঙ্গা চোরা পুরোনো ছাদ থেকে রাতের শহরের কিছুই দেখা যায় না...শুধুই ক্লান্ত অন্ধকার!! বাসার পেছনে খোলা জংলা জায়গা। একটু দূরেই সুতা সাপের মতো হলদে নোংরা দেয়াল। দেয়ালের কাঁটাতারের ওপাশে স্টাফ কলোনী। পুরোনো ছ্যাতাপরা হলদে কলোনীর ল্যাম্পপোস্টের আলোয় সে অন্ধকারে একটু আলো আধারির খেলা; কখনোবা জংলার আগাছার কাঁটাঝোপে জোনাকীদের সিঙ্ক্রোনাইজড হলদে সবুজ আলোর ওঠানামা।
মা খুব রাগারাগি করে; একদমই পছন্দ করে না রাতে ছাদে যাওয়া। অবিবাহিত মেয়েদের নাকি রাতে বিরেতে ছাদে উঠতে নেই; অমঙ্গল হয়। তারপরেও স্বাতী লুকিয়ে চুরিয়ে রাত বাড়লেই ছাদে ওঠে। চুপচাপ জলের ট্যাঙ্কির পাশে জংপড়া পানির পাইপের সারির ওপরে বসে থাকে। অভ্যেস হয়ে গেছে। কিছুদিন আগেও রাতে ছাদে উঠতো ফোনে কথা বলার জন্য, ধ্রুবর সাথে। ঘুমানোর আগে কথা না হলে ধ্রুব মনখারাপ করতো; শুভরাত্রি না জানালে সারারাত জেগে থাকতো। আসলেই কি জেগে থাকতো? কে জানে!! আজকাল ও আর সত্যিমিথ্যের ফারাক বুঝতে পারে না, বুঝতে চায়ও না। ধ্রুব সম্পর্ক শেষ করে দেবার পরে স্বাতী কেমন যেন অসাড় হয়ে গেছে।
আজও স্বাতী ছাদেই ছিল যখন লতিফ এলো। খুব খুশী; ফ্ল্যাট কিনেছে, স্বাতীকে দেখাতে নিয়ে যাবে। লতিফ উঠতি ডাক্তার; রুগির সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে। বৈষয়িক মানুষ; প্রাকটিস, চেম্বার, রুগিরা, হাসপাতাল আর দামী গাড়ি বাড়িকে ঘিরেই তার গল্পরা আবর্তিত হয়। মাঝে মাঝে স্বাতীর দমবন্ধ হয়ে আসে; লতিফের সাথে বেশীক্ষণ থাকলে ও হাসপাতালের গন্ধ পায়, ভেসে আসে ডেটলের গন্ধ!!
বিয়ের ইচ্ছা ছিলো না স্বাতীর। এর আগে আরো তিনটা বিয়ের প্রস্তাব এসেছিলো। একটুও সাজেনি, কথা বলেনি ভালো করে যখন ওরা বাসায় এসেছিলো। তৃতীয়বার ছেলেপক্ষ মানা করে দেবার পরে বাবা মাথায় হাত রেখে বলেছিলেন “আমার বয়স হয়ে যাচ্ছে রে মা!!” মা ফ্যাকাশে মুখে তাকিয়ে ছিলো। মায়ের এনিমিয়া আছে; তার রক্তশূন্য মুখ সেদিন বড় অসহায় দেখাচ্ছিলো।
নিজের বাজারদর জানে স্বাতী। আফটার অল ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে অর্থনীতিতে পড়ে। বাবা সামান্য চাকুরে; বাবার বিত্ত না থাকলে মনের বিত্তের খোজ কেউ রাখেনা। তার ওপরে ও রুপবতী নয়, কালো নয় তবে গায়ের রঙ তেমন উজ্জ্বলও নয়। লতিফের বাসার লোকেরা যখন ওকে দেখতে এসেছিলো, স্বাতী চড়া মেকআপ দিয়েছিলো। গাঢ় মেরুন লিপস্টিক; আয়নায় তাকিয়ে নিজেকে ওর রক্তচোষা মনে হচ্ছিল। পুশ আপ ব্রা; আঁচলের পাড় একটু সরিয়ে কাত হয়ে দেখেছিলো বুকের সুডৌল গড়ন। হেসে হেসে আদুরে মুখে কথা বলেছে সেদিন স্বাতী। মন জয়ের ছলাকলা ওর বেশ জানা আছে। নিম্ন মধ্যবিত্ত ঘরের মেয়েদের মন জয় করার ট্রেনিং শুরু হয় জন্ম থেকেই। কোন কোন মেয়েকে অবশ্য জয় করে নিতে হয়, যেমনটা মনিকাকে জয় করে নিয়েছে ধ্রুব।
লতিফের মা, হবু শাশুড়ি, অবশ্য অনেক বারই কথায় কথায় বলেছেন যে তার ছেলে লম্বায় খাটো না হলে এমন ঘরে এমন সাধারন মেয়ের সাথে বিয়ে দিতেন না। স্বাতী শুনেছে এবং শুনেনি। পাশে দাঁড়ানো মানুষটার দিকে তাকালো স্বাতী। লতিফকে দেখলে হুমায়ূন আহমেদ বলতেন “বল্টু টাইপ ছেলে।“ তার উপন্যাসে এমন ছেলেরা খুব রোমান্টিক; নায়িকারা এদের পছন্দ করে বিয়ে করলে শুধু বেঁটে বলেই বাবারা বিরক্ত হয়। স্বাতীর মতো মেয়েদের জীবনের উপন্যাস যে অন্যভাবে লেখা; লতিফ ওকে পছন্দ করায় বাবা মা হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছেন।
হিল পরেনি আজ ও; আর হয়তো পরবেও না। ধ্রুব পছন্দ করে বলেই হিলজুতো পরা অভ্যেস করেছিল স্বাতী। “শোন মেয়ে...যখন হেঁটে আসো পায়ের আওয়াজের সাথে আমার হৃৎপিণ্ডটাও যে ধুকপুক করে। তবে...” “তবে?? তবে কি?” “একটু আস্তে, একটু সাবধানে হেঁটো মেয়ে!! তোমার চলার পথে আমার স্বপ্নরা বিছানো...পায়ের আঘাতে স্বপ্ন ভেঙ্গে দিও না!!” মানুষ কি আসলেই এমন বদলে যায়...আসলেই!!
ধ্রুবর সাথেই ওর আকাশের অলিগলি চেনা। রাতের আকাশের বুকে অগনিত হীরের ঝলকানি; প্রতিরাতে ওর দৃষ্টি খুঁজে ফেরে মাত্র একটি 'ধ্রুবতারা'র ঝলমলানি শুভরাত্রি বলার জন্য। “সারাটি রাত্রি তারাটির সাথে তারাটিরই কথা হয়....তুমি পূর্ব আকাশে আর আমি উত্তরে!!“ “ধ্রুবতারা কি আসলেই ধ্রুব? কখনো অবস্থান বদলায় না?” সে হেসেছিলো “ধ্রুবতারাও কখনো কখনো দিকভ্রষ্ট হয় ইদানিং!! তার আজকাল সারাক্ষণ ইচ্ছে করে ওই উজ্জ্বল স্বাতী তারার কোল ঘেঁষে বসে থাকতে...”
হঠাত স্বাতী বলে উঠে “তারা কোথায়? আকাশে কোন তারা নেই যে!!” “ওই যে দূরে দেখছো না আলো ওঠানামা করছে...এয়ার পোর্ট!! আলোগুলো প্লেন! ওই গুলোকেই তারা ভেবে নাও। আধুনিক যুগের ডিজিটাল তারা!! গতিশীল...কখনো একজায়গায় থাকে না। হা হা হা!!” নিজের রসিকতায় নিজেই হাসতে থাকলো লতিফ।
সারা শরীর দুলিয়ে হাসতে থাকা মানুষটার দিকে তাকিয়ে স্বাতীর ভীষণ ইচ্ছে করলো বলে “শুনুন বল্টু!! আপনাকে বিয়ে করা আমার সম্ভব নয়।“ ঝলমলে শহরের ওপরে নিকষ কালো অন্ধকার বাদুড়ের মতো ঝুলে আছে। চাপ চাপ গুমোট অন্ধকারের আবর্তে আষ্টেপৃষ্ঠে আবদ্ধ তারাহীন ওই দূর আকাশে এখন বৃদ্ধ বাবার মমতাময় হাতের আঙ্গুল; মায়ের অসহায় ফ্যাকাশে মুখ।
আকাশে ধ্রুবতারা নেই; নক্ষত্রের পতন হয়, ধ্রুবতারাও কখনো কখনো দিক ভুল দেখায়। নক্ষত্রের রূপালী আগুনভরা কোন রাতে স্বাতীকে কেউ খুঁজবে না আর। হাসপাতালের সাদাটে শূন্যতায়, ডেটলের গন্ধে ডুবে যেতে যেতে স্বাতী বললো “বিয়ের ডেটটা কবে ঠিক করবে?”
© শিখা রহমান
(ছবি ইন্টারনেটে সংগৃহীত)
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই নভেম্বর, ২০১৮ দুপুর ১:৪৬