এ আমার জীবনের সত্যি ঘটনা। রাজধানীর জিগাতলা মোড়ে অবস্থিত ঢাকা স্টেট কলেজের একাদশ শ্রেনীর ছাত্র ছিলাম তখন।
দিনটা ছিল ১৬ ফেব্রুয়ারি, ১৯৯৯। বুড়িগঙ্গার তীরের ওয়াইজ ঘাট। শীতার্ত বিকেলের নরম আলোয় তল্পিতল্পাসহ সহপাঠি জাভেদকে নিয়ে উঠে পড়লাম বিশাল লঞ্চ ‘মৌচাক-১’ এ। আমাদের গন্তব্য সুন্দরবন, হিরনপয়েন্ট আর মংলা বন্দর। ঢাকা স্টেট কলেজের ছাত্র হিসেবে শিক্ষা সফরে অংশ নিতে চলেছি আমরা।
মৌচাকে থাকা ‘মৌমাছি’দের বুকে নিয়ে গোধুলির আধো আলো আর আধো রহস্য ভরা অন্ধকারে ধীরে ধীরে যাত্রা শুরু করলো আমাদের জলদানব।
সবে ফাস্র্ট ইয়ারের ছাত্র আমরা। হৃদয়ে নানা আলোর রঙিন নাচন! যা দেখি তাই-ই ভালো লাগে। হৈচৈ করাতেই পৃথিবীর সব সুখ নিহিত রয়েছে বলে মনে হয়। মুহুর্তের মধ্যেই লঞ্চের ফ্লোরে বিছানা বিছিয়ে তাস নিয়ে বসে পড়লাম সবাই। চারদিক চিৎকার-চেঁচামেচি আর মাইকে ভেসে আসছে জেমস্ এর গান ..‘তুমি যদি নদী হও, আমি হবো জেগে থাকা চাঁদ...’। শহরের কোলাহল ছাড়িয়ে বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, ডাকাতিয়া নদী পাড়ি দিয়ে রাত দেড়টায় গিয়ে পড়লাম বিশাল প্রমত্তা মেঘনায়। ফাল্গুনের কুয়াশাঝরা জোছনায় ভিজে ভিজে জ্যাকেটের ওপর চাদর জড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছি লঞ্চের ছাদে। সঙ্গে সহপাঠি আকাশ, পায়েল, রুবেল, রিয়াজ, পাভেলসহ আরও অনেক বন্ধু। কেউ গান গাইছে, কেউ গিটার বাজাচ্ছে। আমি হেঁড়ে গলায় কিছুক্ষণ ওদের সঙ্গে তাল মেলানোর চেষ্টা করে সবে ক্ষান্ত দিয়েছি। স্যারদের লুকিয়ে লুকিয়ে কেউ কেউ যে সিগারেট ধরানোর চেষ্টা করিনি, তা অবশ্য বলবো না। তবে ছিল না সীমা লংঘনের কোন ঘটনা। আমাদের সঙ্গে কলেজের দ্বিতীয়বর্ষের শিক্ষার্থীরা এ সফরের সহযাত্রী ছিলেন।
পরদিন বরিশাল, খুলনা হয়ে নানা নদীর ঘোলা জল পাড়ি দিয়ে আমরা গিয়ে পেৌছলাম হিরন পয়েন্টে। সকাল থেকে সারা দুপুর বেড়িয়ে সেখান থেকে দ্বিগরাজ হয়ে বিকেলে গিয়ে পৌছলাম দুবলার চর। দুবলার চরে সমুদ্রের পাড় ধরে সারা বিকেল জুড়ে কাদা-পানি ছিটিয়ে হৈচৈ আর গোসল। গায়ের কাদা ধুতে গিয়ে দুবলার চরের একটি পুকুরে গেলাম। সেখানে পুকুর ঘাটে সহপাঠিদের (কু!)বুদ্ধিতে আমার পাশে বসে হাত-পা ধুতে থাকা কলেজের বাংলা বিভাগের প্রভাষক রোখসানা আপার হাজব্যান্ডকে ‘আরে দুলাভাই! কেমন আছেন!!’ বলেই দিলাম এক ‘রাম ধাক্কা’। ধাক্কা খেয়ে তিনি যথারীতি পুকুরে ঝপাত। পুকুর ঘাটে থাকা তার আপন শ্যালিকা ‘বর্ণালী’ হেসে গড়িয়ে পড়লো। (জানি না এটা দুলাভাইয়ের মনে আছে কিনা, থাকলে এ সুযোগে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি)। রাতে শুরু হলো মনোজ্ঞ সাংষ্কৃতিক অনুষ্ঠান। মানবিক বিভাগের ফাস্র্টবয় হিসেবে অধ্যক্ষ দিলওয়ারা আপা ও স্যারদের কাছে ছিল আমার খুবই ভালো ‘ইমেজ’। (যদিও কাসে চিরকুট চালাচালির চিরায়ত অভ্যাসটি ছাড়তে না পারার কারনে একবার বাংলা বিভাগের তাহমিনা আপার চোখ এড়াতে পারিনি। বাধ্য হয়ে ‘ভেজা বেড়াল’ উপাধিটি বরণ করে নিতে হয়েছিল!) এই ইমেজে’র কারনেই হয়তো দিলওয়ারা আপা সেদিনের সেই সাংষ্কৃতিক অনুষ্ঠান উপস্থাপণার দায়িত্ব দিলেন। সঙ্গী (নাকি সঙ্গীনি বলবো?) হিসেবে যাকে পেলাম সে বিজ্ঞান বিভাগের মেধাবী ছাত্রী ছিল। তার নাম বিশেষ কারনে বলতে চাইনা। কেননা, এ ঘটনাটা তাকে নিয়েই। তবে এটুকু বলি, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘চোখের বালি’ উপন্যাসের নায়িকার নামে তাঁর নাম। স্থাস্থ্য খুবই ভালো, লম্বা, গায়ের রং শ্যামলা। বড় বড় দুটি চোখ। হাসতে পারে প্রচুর। মাথায় স্কার্ফ পরতো সে।
অনুষ্ঠান উপস্থাপণার দায়িত্ব পেয়ে প্রস্তুতি নিলাম। ক্রীপ্ট তৈরী করলাম। সহপাঠিদের কে কি পারফর্ম করবে তা জানলাম। সবশেষে সাদা রংয়ের একটি পাঞ্জাবী পরে মঞ্চে এলাম। আমার সহ-উপস্থাপিকার তখনো দেখা নেই। অনুষ্ঠান বিলম্বিত হতে লাগলো। সবাই অপেক্ষায়। বান্ধবীরা সবাই খুঁজতে গেল তাকে লঞ্চের তার নির্দিষ্ট কেবিনে। অবশেষে প্রায় ৩৫ মিনিট পরে ও এলো। থমকে গেলাম ওকে দেখে। প্রচুর সেজেছে সে। গাঢ় গ্রীণ কালারের শাড়ি। তার সঙ্গে ম্যাচ করা খাটো হাতার ব্লাউজ, কানের দুল, নাকফুল। চোখে গাঢ় করে কাজল আঁকা। দেরীর হেতু বুঝলাম- এতোক্ষণ ধরে সে সেজেছে। মনে মনে ভাবলাম -‘সেরেছে, ওর পাশে নির্ঘাত আমাকে বান্দরের মতো লাগবে!’ পিকনিকে আমার কাছের মানুষ ইংরেজি বিভাগের প্রভাষক মনোয়ার স্যারকে মিনমিন করে সে কথা বলতেই তিনি বললেন, ‘তোমার কাজ তুমি করো।’ শুরু হলো অনুষ্ঠান। আমাদের দূজনের জমজমাট উপস্থাপণা। যতদূর মনে পড়ছে, সে রাতের সেই সাংষ্কৃতিক অনুষ্ঠানটি অংশগ্রহণকারী এবং দর্শক সকলেরই হৃদয়ে গভীর দাগ কাটতে সমর্থ হয়েছিল। এক পর্যায়ে উপস্থাপিকা নিজেও গেলে উঠলো-‘মনে করো যদি সব ছেড়ে হায়/ চলে যেতে হয় কখনো আমায়/মনে রবে কি/রজনী ভরি......।’
অনুষ্ঠান শেষ হলো রাত দেড়টায়। তখনো রাতের খাবার খাইনি। বন্ধু ‘আকাশ’কে দেখি আমার খাবার লঞ্চের নিচতলা থেকে নিয়ে এসেছে। বললো- নে, খেয়ে নে। অনেক কষ্ট করেছিস।’ খেয়ে দেয়ে অবশেষ অত সন্তর্পনে উঠ পড়লাম লঞ্চের ছাদে। উদ্দেশ্যটা আর কিছু নয়, ধুমপান করা। যাহোক, ধুমপান করছি। কিছুক্ষণ পর দেখলাম কুয়াশা আর জোৎস্নায় ধুয়ে যাচ্ছে পুরো পৃথিবী। তীব্র কুয়াশা ঝরে ঝরে পড়ছে নদীর বুকে। চলন্ত লঞ্চের বাতাসের ঠান্ডার তীব্রতা আমার মাঙ্কি ক্যাপ ভেদ করে ধারালো ছুরির মতো কেটে নিয়ে যেতে চাইছে আমার দু’কান। গভীর নিশুতি রাতের নির্জনতাকে ভেঙ্গে খান খান করে দিচ্ছে লঞ্চের ইঞ্জিনের শব্দ। নদীর বেয়ে আসা পানিকে দু'ভাগে চিরে এগিয়ে চলেছে আমারে মৌচাক-১। লঞ্চের ওপর আর কেউ নেই। সবাই সারাদিনের পরিশ্রমে শ্রান্ত। হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছে। এলোমেলোভাবে পায়চারী করছি লঞ্চের ছাদে।
-সাব্বির! এদিকে এসো।
ডাক শুনে ফিরে তাকালাম। আমার উপস্থাপিকা। দাড়িয়ে আছে ছাদে োঠার সিড়ির শেষ ধাপে। কাছে যেতেই এক হাত তুলে আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো- টেনে তোলো আমাকে। শাড়ি পরে থাকায় ওপরে উঠতে পারছে না সে। হাত বাড়িয়ে টেনে তুললাম। বললাম-কী ব্যাপার ঘুমাওনি এখনো?
-না।
-কেন?
-তোমাকে খুঁজছিলাম।
-কেন বলো তো?
-বলছি, আগে বসো। এখানে আমার পাশে বসো।
বসলাম। কিছুক্ষণ পর আমার ডান বাহু জড়িয়ে ধরে সে, বললো-
-দেখেছো সাব্বির, আজকের চাঁদটা কী সুন্দর!!
-হ্যাঁ। স্বীকার করলাম, চাঁদটাকে সত্যিই অপূর্ব লাগছে।
-অনুষ্ঠানে আসতে দেরী করলে কেন?
-মঞ্চের কাছে এসে দেখি যে তুমি পাঞ্জাবী পরেছো। তাই কেবিনে ফিরে শাড়ি পরতে গিয়ে দেরী হয়ে গেলো।
-কেন, আমার পাঞ্জাবীর সাথে তোমার শাড়ির কী সম্পর্ক?
জবাব নেই। আবার চুপ। উত্তর দিক থেকে ধেয়ে আসা ঠান্ডা বাতাসের তীব্রতা এরই মধ্যে আরও বেড়েছে। শাড়ির ওপরে পরা ওর চাদরের একাংশ পতপত করে উড়ছে। বাতাসের কারনে সরে গিয়ে ভারী বুকের উপর থেকে মাঝে মাঝেই সরে যাচ্ছে চাদর। ওর গায়ের পারফিউমের কোমল গন্ধ এসে লাগছে নাকে। থুতনি নিজ হাঁটুর ওপর দিয়ে ওদিক ফিরে চুপচাপ বসে রইলো সে। নিরবতার মধ্যে দিয়ে কেটে গেল আরও কয়েক মুহূর্ত।
-কী হলো? কিছু বলছো না যে? আমাকে কেন খুঁজছিলে? জানতে চাইলাম এক সময়।
উত্তর নেই। পল পল করে কেটে গেল আরও কিছু সময়।
‘ধুর, আমার ঠান্ডা লাগছে, আমি যাই’ বলে উঠে দাঁড়াতেই ঝট করে সে তাকালো আমার দিকে। অবাক বিস্ময়ে হতচকিত হয়ে গেলাম। সে কাঁদছে। অশ্রুমালা এসে জমা হয়েছে তার দু’ কপোলে। চাঁদের আলোয় চিক চিক করছে সে অশ্রু।
-তুমি এতো বোকা কেন, সাব্বির?
-কেন কি করেছি আমি?
-তোমাকে কেউ যে প্রাণপনে ভালোবাসে, সেটা কেন বুঝতে পারো না? নাকি বুঝেও ন্যাকা সাজো?
-মানে? কে আমাকে ভালোবাসে?....তুমি?
নিজের ডান হাতের মধ্যমায় নয়ণের কোণ থেকে এক ফোঁটা অশ্রুজল এনে আমার হাতের ওপর দিয়ে বললো- `এরপরও বোঝ না?' ঝর ঝর করে কেঁদে ফেললো ও। ওর কাজল ধোয়া দু’চোখের দিকে তাকিয়ে কেঁপে উঠলাম! নিজের অজান্তেই মেরুদন্ড দিয়ে শীতল স্রোত বয়ে গেল আমার।
ঠিক সেই মুহূর্তেই মনে পড়লো আমার অতি প্রিয় কবি জীবনানন্দ দাশের কবিতার স্মৃতিময় কয়েকটি লাইন-
‘........বেহুলাও একদিন গাঙ্গুড়ের জলে ভেলা নিয়ে-
কৃষ্ণা দ্বাদশীর চাঁদ যখন সরিয়া গেছে নদীর চরায়
সোনালী ধানের পাশে অসংখ্য অশ্বত্থ বট দেখেছিল হায়!
শ্যামার নরম গান শুনেছিল-, একদিন অমরায় গিয়ে’
-(জীবনান্দ দাশ)
নদী লীন নিসর্গের সেই নির্জনদেশে পলিলেপা জমিনের মাঝে স্রোতস্বিনীর ওপর আমার প্রথম প্রেমবোধের প্রতিমা রচনা করেছিল আমার সেই উপস্থাপিকা। জীবনে প্রথমবারের মতো উপলব্ধিতে আসলো- পৃথিবীর সব নারী, এক নয়। সব নদী একসুরে কল্লোলিত হয় না। মনে হচ্ছিল, বাংলার জলজ প্রকৃতি আর মানুষের মন প্রকৃতি অনাদিকাল থেকে এক সূত্রে গাঁথা। আদিমতার ঘ্রাণ এখানে এখনো তীব্র। জল ডুবু ডুবু নিসর্গে , নদী-নালা ঝোঁপ-ঝাড়ের মধ্যে অবলোকন নিবিষ্ট হলে প্রকৃত ও অতিপ্রাকৃত এক হয়ে যায়। মনোপ্রকৃতির রহস্যময় সম্পর্ক মনমাতানো সুরে মোহিত করে তোলে।
আমাদের দু’জনের অপলক কেটে গেল আরও কিছু সময়।
একটু পর সম্বিত ফিরে পেতেই ভাবলাম, স্যাররা এভাবে আমাদের দুজনকে এতোরাতে নির্জন ছাদে বসে থাকতে দেখলে খুব বকা দেবেন। বুঝিয়ে সুজিয়ে তাঁকে নিচে এনে তার কেবিনে পৌছে দিলাম।
শিক্ষা সফর থেকে ফিরে আমি কেন যেন কাউকেই এ কথাটি বলতে পারিনি। হয়তো লজ্জার তীব্রতায়, কিংবা সংকোচে।
এরপর পেরিয়ে এসেছি জীবনের আরো ১১টি বছর। আমি আমার জীবনের সবগুলো নীলপদ্ম হয়তো আমার সেই উপস্থাপিকাকেই দিয়ে ফেলেছি। আর সেটা আমারই অজান্তে।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




