আগামী কাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার ভর্তি পরীক্ষা। একদিন আগেই ঢাকা চলে এসেছি যেন পরীক্ষার আগে কোন ক্লান্তভাব না থাকে। উঠেছি বড় ভাইয়ার বাসায়। বনশ্রী। পড়ালেখা ভালই করে এসেছি কিন্তু বেশ নার্ভাস। রাতে ঘুমাতে যাবার আগে সব প্রয়োজনীয় জিনিস গুলো ফাইলে ঢুকিয়ে রেডি করে রাখলাম। নৈর্ব্যত্বিক প্রশ্ন হয় তারপরও একগাদা কলম নিয়ে নিলাম। যদি লাগে?!
সকালে ভোর বেলায় উঠেছি। ফজরের নামাজ পড়লাম। সকালে ঠান্ডা না থাকা সত্ত্বেও আমি কাপাকাপি করছি। টেনশন! ভর্তিযুদ্ধ তো না, যেন জীবন যুদ্ধ! পরীক্ষা ১০ টায়। আমার সিট পড়েছে কলা ভবনে। শুনেছি বনশ্রী থেকে ঢাবি অনেক দুর । যেতে অনেক সময় লাগে। তাই আমার ফাইলটা নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম ৭টার সময়। হাতে সময় ৩ ঘন্টা। মেলা সময়! ভাইয়া বলে দিয়েছিল, ‘ফাল্গুন’ বাসে চড়লে ওরা একদম শাহবাগ মোড়ে নামায় দিবে। ঢাবি তে এর আগেও আমি গেছি। চিনতে সমস্যা হবে না আমার। ফাল্গুন বাসের টিকিট কেটে রামপুরা ব্রীজের উপর লাইন দিয়ে দাড়ায় আছি। আমার সামনে ৩-৪ জন আর পিছে ৬-৭ জন। মুহূর্তেই বাস চলে এল। ভেবেছিলাম এত সকালে ফাকা বাস পাব, কিন্তু একি! পুরা বাসই মানুষে গিজগিজ করছে। ঠেলাঠেলি করে ভিতরে উঠতেই পিছ থেকে লোকজন চিল্লাচিল্লি করা শুরু করল, “ভেতরে যান, ভেতরে যান”। আমি ভাল ছেলের মত চাপাচাপি করে ভেতরে চলে গেলাম। একটু ফাকা পেয়ে দাড়াতেই পাশের লোকটি চিৎকার দিয়ে উঠল, “দেন দেন, পাড়া দেন! পাড়া দিয়া পিষ্যা ফেলান”। আমি হতভম্ভ হয়ে গেলাম। ‘দঃখিত’ বলে ক্ষমা চাইলাম।
বাসে এদিক ওদিক তাকিয়েই বুঝলাম অধিকাংশই ভর্তি পরীক্ষার্থী। আমার সামনেই ছিটে যে ছেলেটি বসেছিল তাকে তার বাবা বলছে, “সব নিয়েছ কিনা চেক করে দেখ”। ছেলেটি তার ফাইল খুলে দেখা শুরু করল। এমন সময় আমারো মনে হলো, “আমি সব নিয়েছি তো?? চেক করে দেখি তো”। ওমা!! আমি তো প্রবেশপত্রই আনি নাই! রোল নম্বরও তো আমার মুখস্ত নাই! এবার?? বাসটির হেল্পার তখন ডাকছে, “রামপুরা বাজার। রামপুরা বাজার নামার আছে? রামপুরা বাজার গেটে আহেন”! আমি বলে উঠলাম,“ওই নামব, নামব”। ঠেলাঠুলা দিয়ে নেমে পড়লাম। আমার টেনশন আর প্রেসার দুটাই হাই! ঘড়িতে তখন ৭.২০ বাজে। সামনে একটা রিক্সা দেখতেই, “ওই বনশ্রী যাবা”? রিক্সায়ালার না সুচক উত্তর! “আরেহ চল”। বলেই রিক্সায় উঠে পড়লাম। রিক্সায়ালা বিরক্ত হয়ে, “পঞ্চাশ ট্যাকা দিতে হইব”। “দিব, তুমি আগাও”। মনে মনে দোয়া পড়তে শুরু করে দিয়েছি। বনশ্রী ‘এ’ ব্লকের সবচেয়ে উচা বিল্ডিংটাতেই ভাইয়ার বাসা, ১৫ তলায়। আমি বিল্ডিং এ ঢুকে দৌড়ে লিফটের সামনে যেয়েই টাশকি খেয়ে গেলাম। লিফট বন্ধ। সিকিউরিটিকে জিজ্ঞাসা করলে বলল, “কারেন্ট নাই, জেনারেটরে সমস্যা”। কি আর করা, কারেন্ট বাবাজির জন্য ওয়েট না করে সিড়ি দিয়ে উঠা শুরু করে দিলাম। বাংলাদেশে কারেন্টের জন্যে অপেক্ষা করে বসে থাকার মত বোকামি আর হয় না। ১১ তলায় পৌছাতেই কারেন্ট চলে এল। লিফট সে সময় ৯ তলায়। নিচে যাচ্ছে। তাই আমাকে পুরাটাই সিড়ি দিয়ে উঠতে হলো। প্রবেশপত্র নিয়ে তাড়াহুড়া করে আবার বেরিয়ে পড়লাম। ‘এ’ ব্লক থেকে একটা রিক্সা ঠিক করলাম রামপুরা ব্রীজ পর্যন্ত যদিও অল্প একটু রাস্তা। ১০ টাকা ভাড়া। একটুখানি যেতেই মনে পড়ল, আমি চশমা আনি নাই। ইদানিং চশমা ছাড়া কাছের জিনিস দেখতে কষ্ট হয়, একটু কিছুক্ষন দেখলেই প্রচন্ড মাথা বেথা শুরু হয়। অগত্যার গতি নেই। রিক্সায়ালাকে বললাম, “মামা রিক্সা ঘুরাও, চশমাটা ফেলে আসছি। চশমা নিয়ে আবার ব্রীজে আসব”। রিক্সায়ালা, “৩০ টাকা দেওন লাগব”। “চল চল, দিব”। এবার লিফট চালু আছে। ১৫ তলায় উঠে গেলাম। কলিং বেল দিতে যাব ঠিক এই মুহূর্তে খেয়াল করলাম, চশমা বাবাজি আমার শার্টের বুক পকেটে আরাম করে বসে আছে। আমি চরমভাবে হাপাচ্ছি! এবার নিজের উপর প্রচন্ড মেজাজ গরম হলো। আজ আমার পরীক্ষা আর আমি এগুলো কি করছি!
ঘড়িতে বাজে ৮.১০। আবার সেই ফাল্গুন বাসে উঠলাম। যথারীতি ঠেলাঠেলি করে আবার পেছনে চলে যেতে হল। মৌচাক আসার পর বসার যায়গা পেয়ে গেলাম। এবার একটু শান্তি হলো। বাসও তাড়াতাড়ি আগাচ্ছে। শুক্রবার বলে হয়ত রাস্তায় কোন জ্যাম নাই। এদিকে আমি কান খাড়া করে রেখেছি যে হেল্পার কখন শাহবাগ ডাকবে। কিছুদুর যাবার পর হেল্পার ‘কাকরাইল কাকরাইল’ বলে ডাকল। ওখানে একটা বিল্ডিং এ বড় করে লেখা দেখলাম, ‘রাজমনি’। ওটা হয়ত ছিনেমা হল। কাকরাইলেই বাসটা যেন প্রায় ফাকা হয়ে গেল। অল্প ক’জন দাড়িয়েছিল। বাকিরা সব নেমে পড়ল। আমি যথারীতি কান খাড়া রেখে শাহবাগ ডাক শোনার অপেক্ষায় বসে থাকলাম। ঘড়িতে বাজছিল ৮.৪৫। কিছু সিগন্যালে শুধুমাত্র দাড়াতে হল। এছাড়া বাস বেশ জোরেই টানছে। কিছুক্ষন পর হেল্পার ডাক দিল, “কাটাবন। কাটাবন নামার আছে”? এভাবে ‘বাটার সিগন্যাল’, ‘সাইন্সল্যাব’ ডেকে যাচ্ছে হেল্পার। সময় অনেক পার হয়ে গেল কিন্তু শাহবাগ এখনো পেলাম না। আমার একটু ভয় লাগা শুরু হল। তখন আবার ভাবলাম, শাহবাগের পাশেই ঢাকা ভার্সিটি আর শাহবাগ ডাকবে না তা কি হয়?? অল্প একটু পরেই ঢাকা কলেজ দেখতে পেলাম। তখন আমি উঠে গেলাম। হেল্পার কে গিয়ে বললাম, “আমারে শাহবাগ নামায় দিয়েন”। হেল্পার বড় বড় চোখ করে আমার দিকে তাকালো। বলল, “নামেন নামেন। সেই কক্ষন শাহবাগ ছাইড়া আসছি। জলদি নামেন”। সামনেই একটা মোড়ে বাস থামলো। আমাকে নামায় দিলো। বাস থেকে নেমে কোনদিক যাব বুঝতেছিলাম না। চারিদিকে শুধু বইয়েরই দোকান। সুটেড বুটেড এক ভদ্রলোককে জিজ্ঞাসা করতেই সে উল্টা দিকে হাত দেখায়ে গডগড করে হেটে চলে গেল। বোঝা গেল খুব ব্যস্ত উনি। আমি খুবই অস্থির হয়ে পড়লাম। পুরা শরীর গরম হয়ে গেল। উপায় না দেখে আমি উল্টা দিকে হাটতে লাগলাম। ঢাকা কলেজ পার হয়ে সাইন্সল্যাবের মোড়ে এসে এক ট্রাফিক পুলিশকে জিজ্ঞাসা করলাম শাহবাগ কোন দিকে। আমি বাসে করে যে দিক দিয়ে আসলাম সেদিকে হাত দেখায় বলল সোজা চলে যান পেয়ে যাবেন। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, “হেটে যাওয়া যাবে”? “হ্যা হ্যা যাবে। কাছেই তো”। কথাটা শুনে বেশ সস্তি পেলাম। দ্রুত গতিতে হাটা শুরু করলাম। আমার বুক দুরু দুরু করছে। প্রচন্ড হাপাচ্ছি। ৯:২৫ বেজে গেছে। আমি এখনো পরীক্ষা হলেই পৌছাতে পারলাম না। মনে হচ্ছে আমি বোধহয় পরীক্ষাটা আর দিতে পারবো না। কি মারাত্মক কথা। স্বপ্নের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আর পড়া হবে না।
হাটছি আর মনে মনে দোআ পড়ছি। আল্লাহ একটু সহায় হও! ওদিকে সূর্য মামুজান আমার দিকে তাকিয়ে খিল খিল করে হাসছে। আর আমি ঘামে ভিজে যাচ্ছি। অনেক্ষন তো হাটলাম! বাটার সিগন্যাল পার হয়ে কাটাবন মোড়ে আসলাম। আর কত দুর?! কাটাবনে এসে একজনকে জিজ্ঞাসা করলাম শাহবাগ কোথায়। সে বলল, সামনের ওই বড় মোড়টাই শাহবাগ মোড়। তখন একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লাম। যাক কাছে চলে এসেছি। শাহবাগে এসে জাদুঘরের সামনে আসতেই আমার রাস্তাটা মনে পড়ে গেল। কলা ভবন তো আমি চিনি। ঘড়িতে দেখলাম ৯:৪৫ বাজে। হাটার গতি আরো বাড়িয়ে কলা ভবনে চলে এলাম। আমার রুম নম্বর ৪০৫২। ভেতরে ঢুকেই দৌড়ে ৪তলায় চলে গেলাম। সেখানে রুম চিনিয়ে দেবার জন্য স্বেচ্ছাসেবক দাড়িয়ে ছিলেন। তারা আমাকে রুম চিনিয়ে দিলেন। তাদেরকে যেন ফেরেশতা মনে হচ্ছিল। রুমে ঢুকে গেলাম। তখন ঘড়িতে ৯:৫৫। পরীক্ষা শুরু হয়ে গেল। কিছুক্ষন পর একজন ম্যাডাম আসলেন প্রবেশপত্র চেক করার জন্য এবং উত্তরপত্র সাইন করে দেওয়ার জন্য। ম্যামকে প্রবেশপত্র দেবার সময় প্রবেশপত্রের সাথে আরেকটি কাগজও চলে যাচ্ছিল। আমি অন্য কাগজটি সরিয়ে ম্যামকে প্রবেশপত্রটি দিলাম। কাগজটির দিকে চোখ পড়তেই দেখলাম ওটাও আরেকটা প্রবেশপত্র। তফাৎ টা হলো ম্যামকে যেটা দিলাম সেটা রঙিন প্রিন্টের আর অন্যটা সাদা কালো প্রিন্টের। তখন মনে পড়ল শুধুমাত্র রঙিন প্রিন্টের প্রবেশপত্রটি আনতে আমি কিই না দৌড়ঝাপ করলাম। হায়রে কপাল!
পরীক্ষা দিয়ে বের হয়ে কয়েকটা বড় বড় নিশ্বাস নিলাম। পরীক্ষা দিতে ঢোকার সময় মাথা যেমনটা গরম হয়ে ছিল এখন তার চেয়ে কয়েকগুন বেশী ঠান্ডা মনে হচ্ছে। পরীক্ষা যে ভাল হয়েছে তা কিন্তু নয়। পরীক্ষা যে আমি দিতে পেরেছি এতেই আমি খুবই আনন্দিত। এত বেশী আনন্দিত যে আমার হৈ হৈ করে চিল্লাতে ইচ্ছা হচ্ছে! কলা ভবন থেকে বের হয়ে একজন স্বেচ্ছাসেবককে পেয়ে জিজ্ঞাসা করলাম ফাল্গুনের টিকেট কাউন্টার কোথায়। সে আমাকে রাস্তা দেখায় দিল এবং কোথায় টিকিট কাটতে পারবো তা বুঝায় দিল। আমি তার দেখিয়ে দেয়া রাস্তা দিয়ে হাটতে লাগলাম। চারিদিকে মানুষে গিজগিজ করছে। কিছুদুর যেতেই একটা ছোট মোড়। সেখানে অল্প কিছু রিক্সা দাড়ায় আছে। রিক্সা দেখেই আমার মনে হল, “আচ্ছা! আমি যদি রিক্সায় যাই তাইলে বেশ আরামে যাওয়া যাবে। আর তার চেয়েও বড় কথা রাস্তা চেনা যাবে সহজে। বাহ ভাল বুদ্ধি”! এক রিক্সায়ালাকে বললাম, “রামপুরা বনশ্রী যাবা”? রিক্সায়ালার সেই রকম ভাব! বলে, “২০০ টাকা”। আমি বললাম, “১৫০ দিব যাবা”? রাজি হয়ে গেল। আমিও রিক্সায় চেপে বসলাম। রিক্সা যাচ্ছে আর আমি এদিক ওদিক তাকিয়ে এলাকার নাম মুখস্ত করছি। আর মনে মনে একটা ম্যাপ তৈরী করছি। আমার চোখে মুখে মনে খালি আনন্দ আর আনন্দ। পরীক্ষা দিতে পারার আনন্দ! রিক্সায়ালা আমাকে কাটাবন, হাতিরপুল বাজার, বাংলামটর, মগবাজার, মৌচাক, মালিবাগ রেলগেট, রামপুরা হয়ে বনশ্রী নিয়ে গেল। রিক্সা জার্নিটা আমার কছে দারুন মজাদার ছিল।
বাসায় ফিরে ফ্রেশ হয়ে খাওয়া দাওয়া করে ফেইসবুকে বসেছি। আমার এক বন্ধু ম্যাসেজ করল। সরাসরি পরীক্ষার কথা না জিজ্ঞেস করে সে লিখেছে, “কিরে কেমন গেল দিনটা”? আমি লিখলাম, “আর বলিস না। বিড়ম্বনার এক শেষ!” ম্যাসেজটা লিখে Enter বাটন চাপ দিতে যাব ঠিক এই মুহূর্তে কারেন্টটা চলে গেল
বিশেষ দ্রষ্টব্য:
১। এই গল্পটি সম্পূর্ন কাল্পনিক। বাস্তব কোন ঘটনা নয়। আসলে পরীক্ষার দিন আমার ভাইয়া আমাকে বাইকে করে নিয়ে গেছিল আবার বাইকে করেই নিয়ে এসেছিল।
২। সামহোয়ার ইন ব্লগে এটা আমার প্রথম লেখা ছিল। কিন্তু সম্ভবত এই লেখাটি হোম পেজে আসে নি তাই আরেকবার পোস্ট দিলাম।