নির্যাতন-০২
কাজী সায়েমুজ্জামান : কোন ব্যক্তিকে রিমান্ডে দেয়া হলেই পুলিশের পোয়াবারো। একটি নির্দিষ্ট অংকের টাকা আদায়ের জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে তারা। এ নিয়ে চলে পুলিশের রমরমা বাণিজ্য। দাবী অনুযায়ী অর্থ না পেলে আসামীর কপালে জুটে বিভিন্ন কায়দায় নির্যাতন। কাউকে গ্রেফতারের পরপরই পুলিশ তাদের হেফাজতে নেয়ার জন্য তৎপর হয়ে ওঠে। এজন্য প্রয়োজনীয় আইনী ধারাও যুক্ত করে তারা। রিমান্ড মঞ্জুর হওয়ার পর আসামীর স্বজন ও অভিভাবকদের সঙ্গে যোগাযোগ করে তদন্তকারী কর্মকর্তা। স্বজনদের ভয় দেখানো হয় নির্যাতন আর ক্রসফায়ারের। বাধ্য হয়েই তদন্তকারী কর্মকর্তাদের দাবী অনুযায়ী অর্থ পরিশোধ করেন আসামীর স্বজনেরা। এ বাণিজ্যে অনেক আইনজীবী মধ্যস্ততার ভূমিকাও পালন করেন।
রাজধানীর জজকোর্ট হাজতে রিমান্ড ফেরত বিভিন্ন মামলার আসামী, আইনজীবী ও অভিভাবকদের সঙ্গে সরজমিনে কথা বলে তদন্তকারী পুলিশের বিরুদ্ধে নির্যাতন আর অর্থ আদায়ের অভিযোগ পাওয়া গেছে। মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থার আইনজীবী মাহমুদা আক্তারের সহযোগিতায় এদের সাক্ষাতকার নেয়া হয়। এসময় অর্থ পরিশোধে অক্ষম আসামীরা তাদের শরীরে নির্যাতনের বিভিন্ন চিহ্নও দেখিয়েছেন।
গত ৫ জুলাই জজকোর্টের হাজতে গিয়ে দেখা গেল, পুলিশ হেফাজত শেষে অনেক আসামীকে আদালতে হাজির করতে সেখানে জড়ো করা হয়। এদের অনেকেই ঠিকমতো হাটতে পারছিলেননা। এসময় হাজত করে সামনে গিয়ে এ প্রতিবেদক তাদের সঙ্গে কথা বলতে চেষ্টা করেন। তবে রিমান্ডে কি হয়েছে তা নিয়ে কেউ মুখ খুলতে সাহস পাচ্ছিলেননা। তারা আশংকা করে বলছেন, কিছু বললে ফের রিমান্ডে নেয়া হবে। এ নিয়ে অনেকের চোখে মুখেই আতংক আর ভয়ের চিহ্ন। এদের বেশিরভাগ নাম পরিচয় গোপন রাখার শর্তে নির্যাতনের বর্ণণা দেন। তাদের ভয়, নাম ঠিকানা জানালে তদন্তকারী কর্মকর্তা তাদের ছাড়বেননা। হেফাজতে থাকা অবস্থাতেই আরও মামলায় নাম অন্তর্ভূক্তির ভয় দেখানো হয়েছে বলেও তাদের দাবী। এসময় কয়েকজন আসামী সাহস করে কথা বলতে থাকেন। কুমিল্লার দ্বেবীদ্বার থানার কটক শাহ গামের শফিকুল ইসলামের পূত্র কাজল। এবার রাজধানীর রমিজউদ্দিন ডিগ্রি কলেজ থেকে পরীক্ষা দিয়েছেন। তাকে একটি ছিনতাইয়ের মামলায় রিমান্ড শেষে হাজির করা হয়েছে। কাজল জানান, দণিখান থানায় ২৭ তারিখে তাকে রিমান্ডে নেয়া হয়। তাকে তিন দিনের হেফাজতের আবেদন করে পুলিশ। এতে আদালত এক দিনের পুলিশ হেফাজত মঞ্জুর করে। কাজল অভিযোগে বলেন, পরে তাকে থানার হাজতে নিয়ে রাখা হয়। রাত সাড়ে ১১ টায় একজন এসআই একটি গামছা দিয়ে চোখ বেধে ফেলেন। পরে হ্যান্ড ক্যাফ লাগিয়ে পাইপ দিয়ে চার পাঁচটি আঘাত করে। এসময় জানতে চায়, অস্ত্র কোথায় রেখেছিস। আমি বলি আমার কাছে কোনদিনও অস্ত্র ছিলনা। পরে সে আমার অভিভাবকদের মোবাইল ফোনের নম্বর চায়। আমার সমনে বসেই তাদের সঙ্গে ফোনে কথা বলে। আমার পরিবার টাকা দিতে রাজী হয়। পরদিন সকালে ১০ হাজার টাকা ওই এসআই’র হাতে তুলে দিতে হয়েছে। তার সঙ্গে গ্রেফতার হওয়া আরেক আসামী চাদপুরের শাহরাস্তি থানার লোটরা বাজার গ্রামের ফজলুর রহমানের পুত্র নুর হোসেন। তার অভিযোগ তাকে রাতে উত্তরা গণ কবরস্থানে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে চোখ বেধে তাকে মাটিতে শুইয়ে থাকতে বলে পুলিশ সদস্যরা। তাকে শেষ বারের জন্য অস্ত্র কোথায় তা জিজ্ঞাসা করে। অস্ত্র না দিলে কুল হু আল্লাহ সুরা পড়ে নিতে বলে। এরপরও অস্ত্র না পেয়ে তাকে থানা হাজতে ফিরিয়ে নেয়া হয়। এ সময় তার কাছে অর্থ দাবী করা হয়। নুর হোসেন দাবী মতো তদন্তকারী কর্মকর্তাকে টাকা দিতে পারেননি। এ কারণে হাত পায়ের বিভিন্ন অংশে লোহার পাইপ দিয়ে তাকে বেদম পেটানো হয়েছে । তিনি এ প্রতিবেদককে তার আঘাতের চিহ্ন দেখান।
২৭০, জগন্নাথ সাহা সড়কের বাসিন্দা শেখ কালাচনের পুত্র মনজুর হোসেন অভিযোগ করে বলেন, আমাকে লালবাগ থানা পুলিশ গ্রেফতার করে আদালতের মাধ্যমে রিমান্ডে নেয়। থানা হাজতে নেয়ার পর তদন্তকারী কর্মকর্তা জানতে চায় আমি কি করি। আমি বিদেশে ছিলাম বলে তাকে জানাই। একথা শুনেই সে আমাকে বলে, ৫০ হাজার টাকা দে নয়তো তোর নামে মার্ডার মামলা দেয়া হবে। আমার কছে টাকা নাই বললে সে টেবিলের ওপর সোজা করে হাত রাখতে বলে। এরপর লাঠি দিয়ে কয়েকটি আঘাত করে। শেষে বলে, মার যখন দিয়েছে এখন ২০ হাজার টাকা দিলেই হবে। এর মধ্যেই রিমান্ডের মেয়াদ শেষ হয়ে যায়। দ্বিতীয় দফায় হেফাজতে নেয়ার জন্য আবেদন জানলে আদালত তা মঞ্জুর করেনি। এখন আমাকে কারাগারে পাঠানোর কারণে ফের মারের হাত থেকে বেঁচে গেলাম।
১৩৮৩/৮,এ, নতুনবাগ খিলগাঁয়ের বাসিন্দা এনামুল হকের পুত্র জাভেদ এনাম জনান, তাকে উত্তরা থানা পুলিশ গ্রেফতার করে। ১২ জুন তাকে রিমান্ডে নেয় পুলিশ। এ মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা এস আইকে ১০ হাজার টাকা দেয়ার পর আর মার খেতে হয়নি।
এদিন হাজতে রিমান্ড শেষে ফেরত মক্কেলকে দেখতে যান দেখতে আইনজীবী শহীদুল হক। তার মক্কেল ৫৫৬, মধ্য মনিপুরের বাসিন্দা আসিন মৃধার পুত্র মনির হোসেন। তাকে মারামারি ও ভাংচুরের মামলায় গ্রেফতার করা হয়। এসময় আইনজীবী রিমান্ডে তাকে মারধর করা হয়েছে কিনা জিজ্ঞাসা করেন। মনির তাকে জানান, প্রথম আমার কাছে টাকা চেয়েছিল। আমি টাকা না দেয়ার কারণে লাঠি দিয়ে তদন্তকারী এসআই আমাকে পিটিয়েছে।
জজকোর্টের আইনজীবী মাইনুল ইসলাম খান জানান, আমরা শুনানী চলাকালে রিমান্ডে আসামীদের ওপর নির্যাতন চালানো হয়েছে বলে বিচারকদের কাছে অভিযোগ করি। এতে বিচারক চিকিৎসার জন্য লিখে দেন। তবে আমার আইনপেশার জীবনে কোন ঘটনার ক্ষেত্রে ম্যাজিষ্ট্রেট তদন্ত করার আদেশ দেননি। ২২নং কোর্ট হাউজ স্ট্রীট, পারেজায়ার সেন্টারের আরেকজন আইনজীবী শামিম আহম্মেদ বলেন, অনেক সময় আসামীর আত্মীয় স্বজনরাই অর্থ নিয়ে তদন্তকারী কর্মকর্তাকে দিতে বলেন। তারা আসামীকে যেন মারধর না করা হয় তার নিশ্চয়তা চান। অনেক মামলায় জিজ্ঞাসাবাদে কোন নির্যাতনের সুযোগ নেই বললেও অভিভাবকরা তা মানতে চাননা। তারা আমার মাধ্যমেই তদন্তকারী কর্মকর্তাকে অর্থ দিতে চাপাচাপি করেন।
প্রথম পর্ব
Click This Link

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।


