এক.
আমি তখন দক্ষিণ কোরিয়ার কিউং হি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি। এই ক্যাম্পাসটা গিওনগি প্রদেশে। রাজধানী সউল থেকে ঘন্টাখানেক লাগে বাসে যেতে। আমি কোরিয়ার অভিজাত এলাকা বুঝতাম মেয়েদের চেহারা দিয়ে। যেই এলাকার মেয়েরা সুন্দর সহজেই ধরে নেই এলাকাটি অভিজাত। একবার আনসান গিয়েছিলাম। শ্রমিকদের বসবাস ওই এলাকায় বেশি। ওই এলাকায় মেয়েদের তুলনায় আমার বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা তার আশাপাশের মেয়েরা সুন্দর। দেখলে তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছা করে। তবে কোরিয়ায় কোনো মেয়ের দিকে তাকানো যাবেনা- এটা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ক্লাসেই সবক দিয়ে দেওয়া হয়েছে। তবে আমি একটা ক্ষেত্রে মানতে পারিনি। সেই গল্পটাই আজ করছি।
আমাদের ডরমিটরির অবস্থান ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের গেট দিয়ে ঢুকে একটু আগালেই ডানদিকে পাহাড়ের ঢালে। ক্লাসে দুভাবে যাওয়া যেতো। ডরমিটরি থেকে বের হয়ে ঢাল বেয়ে উপরে উঠে বাম দিকে মুল সড়ক ধরে। আরেকটি হলো- ডরমিটরি থেকে বের হয়ে ডান দিক থেকে সিড়ি বেয়ে আরেকটি ফ্যাকাল্টি পার হয়ে স্টেডিয়ামের পাশ দিয়ে পাহাড়ে উঠতে হবে। তারপর জঙ্গলের মধ্য দিয়ে হেটে আমাদের ফ্যাকাল্টি ভবনের সামনে দিয়ে নেমে সোজা ক্লাসে। মুল সড়কে গেলে বাসে যাওয়া যায়। কোনো ভাড়া দিতে হয়না। ড্রাইভারকে গামছা হামিদা বা ধন্যবাদ বলাটাই ক্যাম্পাস এলাকায় ছাত্রদের ভাড়া। যেটা বলছিলাম, এ পথে যাওয়ার আরেকটা কারণ ছিল। যে ফ্যাকাল্টি পার হয়ে যেতে হয় সেখানে একটা কোরিয়ান মেয়ের সাথে দেখা হতো। তার দিকে না তাকিয়ে থাকতে পারতাম না। বাঙালি একজন লেখক মানুষ আমি। আবেগাপ্লুত হয়ে ভাবতাম মানুষ কীভাবে এত সুন্দর হতে পারে! মেয়েটাও লক্ষ্য করেছে। তার সাথে আমার দেখা হয়। আর আমি কোরিয়ান নির্দেশা লঙ্ঘন করে তাকে দেখি।
কোরিয়ার একটা ডিগ্রি নিতে আমার জীবন ওষ্ঠাগত হয়েছে। এর পুরোটাই অবদান আমার প্রফেসরের। আমার ক্লাসের সিনিয়র আফগান শিক্ষার্থী হামিদ ভাইকে বলেছিলাম, কিছু নির্দেশনা দেন। তিনি বলেছিলেন, প্রফেসর উ হতে সাবধান। দেখা গেলো আমার ভাগে তিনিই পড়েছেন। তার মানসিক নির্যাতনে আমি অসুস্থ হয়ে পড়ি। এই কঠিন সময়ের মধ্যে আব্বা মারা গেলেন। তার লাশ পুকুরে পাওয়া যায়। আমার এনজাইটি ডিজঅর্ডার হয়ে যায়। জোরে জোরে শ্বাস নিয়ে তখন বেঁচেছিলাম। আমি তখন নিজেকে ভীষণ অসহায় বোধ করছিলাম। রোমান্স পুরাপুরি উধাও যখন থিসিস রিভিউ দেওয়ার তারিখ ও সময় দিলেন সাইকো প্রফেসর।
আমি প্রফেসরের অ্যাপয়েনমেন্ট অনুযায়ী ডরমিটরি থেকে যখন বের হলাম হাতে সময় কম ছিল। এবারও আমার প্রিয় নির্জন পথ বেছে নিলাম। দেখলাম, মেয়েটিও আসছে। কোরিয়ানরা ততদিনে আমার কাছে বিদঘুটে কর্কষ জাতি হিসেবে পরিগণিত হয়েছে। আজকে আর মেয়েটির দিকে তাকাইনি। সে বিপরীত দিক থেকে আসছে। আমি এড়িয়ে যেতে চেষ্টা করলাম। নাহ! মেয়েটা পথ আগলে দাড়ালো। আমাকে কী যে বললো বুঝতে পারলাম না। আমি শুধু বললাম, হানগুগ মাল মুল্লায়ও। কোরিয়ান ভাষা জানিনা। মেয়োটাও ইংরেজি জানেনা। প্রফেসরের সাথে দেখা করবো বলে, মোবাইল ফোন সাথে নেইনি। নয়তো ট্রানসেলেট করা যেতো। মেয়েটা আমার কথা বুঝতেছেনা। আমি মেয়েটার কথা বুঝতেছিনা। একটা বিষয় বুঝতে চেষ্টা করলাম। মেয়েটা কী খ্রীষ্ট ধর্ম প্রচারক। তারা পথে ঘাটে এমন করে। নিশ্চিত হলাম। সে ধর্ম প্রচারক না। তার হাতে একটা ব্যাগ ছিল। ব্যাগটা আমাকে দিয়ে দিলো। যেতে যেতে দেখলাম, এক ব্যাগ চকলেট বিস্কুট। আর তার মোবাইল ফোন নম্বর। আমি ডরমিটরিতে ফিরে নেপালি ক্লাসমেট প্রকাশের রুমে গেলাম। সে অনেক দিন ধরে কোরিয়ান একটা মেয়ের সাথে প্রেম করবে বলছিলো। তাকে মেয়েটার ফোন নম্বর দিলাম। বললাম, এর সাথে চ্যাট করে দেখতে পারো। আমি চকলেট আর বিস্কুটগুলো নিলাম। এরপর আর কখনোই মেয়েটার সাথে আমার দেখা হয়নি। হায়! ভাষার সমস্যার কারণে বুঝতেই পারলাম না-মেয়েটা কী বলতে চাইছিলো! শ্রীকান্ত উপন্যাসে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় লিখেছিলেন,
আমি সমস্তই দেখিলাম, সমস্ত বুঝিলাম। যে গোপনেই আসিয়াছিল, তাহাকে গোপনেই যাইতে দিলাম। কিন্তু এই নির্জন নিশীথে সে যে তাহার কতখানি আমার কাছে ফেলিয়া রাখিয়া গেল, তাহা কিছুই জানিতে পারিল না।
আমার অবস্থাটাও সেরকমেরই।
একটা গান মনে পড়তো। আখ হ্যায় ভরি ভরি আওর তুম, মুজকুরানে কি বাত করতি হো। জিন্দেগী খাপা খাপা আওর তুম, মুঝকুরানে কি বাত করতি হো।
দুই.
কোরিয়া থেকে ফিরে যশোরের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে কাজ করেছি। যশোর জেলা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো ১৭৮১ সালে। আজ থেকে প্রায় ২৪৪ বছর আগে। তবে তার আগেই এই এলাকায় ইংরেজ নীলকরদের অত্যাচারে যশোরবাসী অতিষ্ঠ ছিল। যশোরে একজন নীলকর ছিলেন লেখক। তার নাম টমাস ম্যাচেল। তিনি যশোরে অবস্থানকালে ডায়রি লিখেছিলেন। যার পাণ্ডুলিপি অপ্রকাশিত হয়ে পড়ে ছিল ব্রিটিশ লাইব্রেরীতে। সেই পান্ডুলিপি বাংলায় ‘নীলকর টমাস ম্যাচেলের দিনলিপি (১৮৪০-১৮৫২)’ নামে প্রকাশিত হয়েছে। বইটিতে যশোরের বসবাসরত সেই সময়ের ইংরেজদের কেচ্ছা কাহিনী লিখে গেছেন। তাদের ভাষাগত সমস্যা ছিল প্রকট। সেটিও তার লেখায় উঠে এসেছে। তিনি ৫ আগস্ট ১৮৫০ সালের যে ঘটনাটা লিখে গেছেন- চলুন শুনে আসি।
তিনি লিখেছেন, বাঙালিদের কথা প্রসঙ্গে মনে পড়ে গেল মজার একটা ঘটনা। যশোরের যিনি ডাক্তার তাঁর স্ত্রীর বাংলা ভাষা সম্পর্কে খুব ভাল ধারণা ছিল না। কলকাতায় থাকাকালীন তিনি তাঁর এ ধরনের ভাষাজ্ঞান নিয়ে তবুও কাজ চালাতে পেরেছিলেন, কিন্তু যশোরের গ্রামদেশে নীলকর সমাজে ভদ্রমহিলার ভাষাজ্ঞান নিয়ে খুব মজা করা হতো। একবার এক বেচারি গরুর গাড়ির গাড়োয়ান ভদ্রমহিলার কোচগাড়ির চাকার সঙ্গে নিজের গাড়ির চাকা আটকে ফেলে। ঘটনাটা ঘটে ক্লাব হাউসের কাছেই। তখন সেখানে অনেক নীলকর বসে ছিল। ক্রুদ্ধ মহিলা তার কোচম্যানকে দিয়ে বেচারা গাড়োয়ানকে চাবকাতে চাইলেন। সেই নির্দেশ দিতে গিয়ে তিনি বলে ফেললেন, 'বহুত বিমার হি, বহুত বিমার হি'। যার অর্থ হল, 'ও খুব অসুস্থ, ও খুব অসুস্থ'। আসলে তিনি বলতে চেয়েছিলেন, 'খুব মারো'। কল্পনা করে নেওয়া যেতে পারে ভদ্রমহিলার মুখে এদেশীয় এমন ভাষা শুনে ক্লাব হাউসের লোকজন কীরকম আমোদ পেয়েছিল। একদিকে তো ভদ্রমহিলা রেগে লাল, রাগত স্বরে তিনি কোচম্যানকে চিৎকার করে বলে যাচ্ছেন- গাড়োয়ান খুব অসুস্থ, আর ওদিকে কোচম্যান কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে ভেবে পাচ্ছে না আসলে তাকে কী করতে হবে।
তার মানে বাঙালিরা নীলকরদের হাতে মার খেতেন। বাঙালিও বুঝতেন না কেন মার খাচ্ছেন। আর ইংরেজ যেটা বলতেন নিজেও জানতেন না কী বলে মারছেন।
তিন.
গল্পে আবার কোরিয়ায় ফিরে যাই। কোরিয়ার কম লোকজনই ইংরেজি জানে। আমার এক ক্লাসমেট ইকুয়েডরের। সে বললো, সায়েম, এখানকার রাস্তাঘাটে চলাচল অনেক কঠিন। কোথাও কিছু প্রয়োজন হলে লোকজন ইংরেজি বুঝেনা। আমি তাকে বললাম, যারা ইংরেজি বুঝেনা, তাদের ইংরেজি বলতে যাও কেন! তাদের সাথে তোমার মাতৃভাষা ল্যাটিনোতে কথা বলবা। দেখবা ঠিকই বুঝে। বেশ কয়েকদিন পর। হঠাৎ মেয়েটা আমাকে বললো, সায়েম কী ম্যাজিক জানো! আমি বললাম, কেন? সে বললো, এর মধ্যে একদিন একজনকে ইংরেজিতে জিজ্ঞাসা করলাম। সে বুঝতে পারলোনা। যখনি লাটিনোতে বললাম- সে বুঝতে পারলো। এর রহস্যটা কী? আমি বললাম, এর রহস্য একেবারেই সোজা। যখন ইংরেজি বলো, তখন তোমার খেয়াল থাকে ইংরেজির দিকে। ইংরেজি তো তোমার মাতৃভাষা না। আর যখন ল্যাটিনো বলেছো- সাথে শরীরের অঙ্গ প্রত্যঙ্গ হাতে চোখে নাড়াচাড়া করেছো। লোকটা তোমার ভাষা থেকে কিছুই বুঝেনি। যা বুঝেছে তা হাতের ইশারা থেকে। এরপর থেকে যখনি কোন কোরিয়ান ইংরেজি বুঝতোনা। আমি বাংলায় বলা শুরু করতাম। এটা আমার জাপান ভ্রমণেও কাজে দিয়েছিলো। ইশারা ভাষা সবাই বুঝে। শুধু শুধু মুখ বুজে হাত পা কে নাড়াতে চায়। এসময় ইংরেজি বললেই বা কী! ইংরেজি বলার তো একটা ধকল আছে। খেয়াল করতে হয় কী বলছি। বাংলায় বললে হাত-টাত নাড়িয়ে বুঝানো সহজ হয়! বিদেশে যারা আছেন, আমার টেকিনিকটা কাজে লাগিয়ে দেখতে পারেন।
চার.
কোরিয়ানদের কথা বলছিলাম। এরা খুব জাজমেন্টাল। ধরুন, একজন বাঙালিকে তারা ভালো দেখেছে। সবাইকেই ভালো মনে করবে। এটা আবার সবার কাছে বলবে। আবার খারাপ দেখলেও সেটা ছড়িয়ে দেবে। কয়েকজনের কাছ থেকে তার প্রমাণ পেয়েছি। একবার কোরিয়ায় প্রবাসি বাংলাদেশিরা আমাকে তাদের একটা অনুষ্ঠানে দাওয়াত দিয়েছিলেন। খাওয়ার পর আবার মাইকের সামনে দাড় করিয়ে দিয়েছেন। কিছু তো বলতে হবে। খাওয়ার পর ভারি কথা শুনতে কে চায়! হালকা কথাই বলেছি। কী বলছিলাম, শুনুন।
বাংলাদেশিরা জাতে বাঙাল। একজন ধনী হলে আরেকজন কাঙাল। একজন উত্তর কোরিয়ার সাপোর্ট করলে আরেকজনকে বাধ্যতামূলকভাবে দক্ষিণ কোরিয়ার সাপোর্ট করবে। কেউ ভারতের সাপোর্ট করলে কেউ পাকিস্তানের ডাই হার্ট সাপোর্টার। একজন আরেকজনের বিরোধী। প্রত্যেকেরই আবার এই সাপোর্টের পেছনে আলাদা আলাদা ইউনিক ন্যারেটিভ মানে বয়ান রয়েছে। যুক্তি রয়েছে। আমি প্রথম কোরিয়ার এসে কে চাইনিজ; কে জাপানিজ’ কে কোরিয়ান- ধরতে পারিনি। অথচ এদের আলাদা বৈশিষ্ট্য রয়েছে। এখন দেড় বছর পার হওয়ার পর কিছুটা বুঝতে পারি। কোরিয়ানরাও আামাদের মানে কে ভারতের; কে পাকিস্তানের; আর কে বাংলাদেশের- বুঝতে পারেনা। এ সুযোগটা আমরা ভালো করেই নিতে পারি।
বাংলাদেশিরা যেখানেই যান খাসলতটা সাথে করে নিয়ে যান। এর মধ্যে একটা যত্রতত্র ময়লা ফেলা। আরেকটা হলো-কয়েকজন একত্রিত হলে চিৎকার করে নিজেদের মধ্যে কথা বলা। এগুলোতে কোরিয়ানরা খুব বিরক্ত হন। তারা প্রথেমই জানতে চান কোন দেশ থেকে এসেছো? ভূলেও বাংলাদেশের নাম বলবেন না। কোরিয়ান ভাষা ভালো বুঝেন না- সেটা প্রথম তাদের বুঝিয়ে দেবেন। পরবর্তীতে কী করবেন- সেই বুদ্ধিটাও দিচ্ছি।
এবার বললাম, কে কে পাকিস্তানকে পছন্দ করেন? আর ভারতকে অপছন্দ করেন? তারা হাত তুলেন। উপস্থিত জনতার অর্ধেক সংখ্যক হাত উঠলো। আমি বললাম, এ রকম কোনো পরিস্থিতির সম্মুখিন হলে যখন কোনো কোরিয়ান বিরক্ত হয়ে দেশ কোথায় জিজ্ঞাসা করেন, তখন বলবেন, বাড়ি ভারতে। ওই কোরিয়ান আজীবন ভারতকে গালি দেবে। বলবে ভারতীয়রা ম্যানার্স জানেনা। চিৎকার দিয়ে কথা বলে। এটা সে ব্রান্ড অ্যাম্বাসাডর হিসেবে কোরিয়ানদের মধ্যে ছড়াতে থাকবে।
এবার বললাম, কে কে ভারতকে পছন্দ করেন? আর পাকিস্তানকে অপছন্দ করেন? তারা হাত তুলেন। বাকী হাতগুলো উঠলো। বললাম, এ রকম কোনো পরিস্থিতির সম্মুখিন হলে যখন কোনো কোরিয়ান বিরক্ত হয়ে দেশ কোথায় জিজ্ঞাসা করেন, তখন বলবেন, বাড়ি পাকিস্তানে। ওই কোরিয়ান বেটা-বেটি বুঝতেই পারবেনা- আপনি পাকিস্তানের না। সে আজীবন পাকিস্তানের গোষ্ঠি উদ্ধার করবে। বলবে, পাকিস্তানিরা ম্যানার্স জানেনা। চিৎকার দিয়ে কথা বলে। এটা সে ব্রান্ড অ্যাম্বাসাডর হিসেবে কোরিয়ানদের মধ্যে ছড়াতে থাকবে।
মোট কথা হলো- বাংলাদেশী হিসেবে কোরিয়ায় এই সুযোগ ছাড়তে যাবো কেন!!
কাজী সায়েমুজ্জামান
৬ জুলাই ২০২৫
ঢাকা।
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই জুলাই, ২০২৫ সকাল ৯:২০

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




