চট্রগ্রাম, যাকে সবাই জানি বন্দর নগরী হিসেবে, সে,সাথে চট্রগ্রাম দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর এবং সবচেয়ে বড় বিভাগও বটে। পাশাপাশি চট্রগ্রামের ট্যুরিস্ট স্পট এর অভাব নেই, অসংখ্য প্রাকৃতিক ও কৃত্রিম নয়নাভিরাম দৃশ্য ও দারুন সব নান্দনিক শিল্প ও নিজস্ব ভাষা শৈলী নিয়ে বাংলাদেশের বুকে ঠাঁই নিয়েছে চট্রগ্রাম জেলা। রাজধানী ঢাকা থেকে চট্রগ্রাম এর দূরত্ব অনেক কম হওয়া স্বত্তেও শিক্ষা কিংবা কর্মক্ষেত্রের কারনে আমার কখনো চট্রগ্রামে অবস্থান করা হয়নি। অনেক বন্ধু-বান্ধব ও আত্নীয় স্বজন থাকার পরেও চট্রগ্রামে আমার যাওয়া হয়নি, বেড়ানো হয়নি, ঘুরে দেখা হয়নি...
তাই এবারের মতো সুযোগ আর হাত ছাড়া করিনি, সাথে ছিলো প্রিয় বিটবক্স গ্রুপের একাংশ এবং অবশেষে আপসোস ঘুচলো তবে পূর্নতা পায়নি। পূর্ণতা পাওয়ার জন্য আরো ঘুরতে হবে, কারন চট্রগ্রাম কে দেখতে অনেক সময় লাগবে। আমাদের ট্যুরের প্রথম পর্ব শুরু হয়েছিলো ঢাকা টু সীতাকুণ্ড, চট্রগ্রাম থেকে। রাতের একটায় সায়দাবাদ বাস টার্মিনাল থেকে শ্যামলী পরিবহনে (নন-এসি) উটলাম (আমাদের টিকিট পূর্বেই কাটা ছিলো, এবং সার্ভিস লো ক্লাস লেভেলের), রাতের যাত্রী যা করে আমরাও তাই করলাম, ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে সকাল ৬.১৫ টায় আমরা সীতাকুণ্ড নেমে পড়লাম...
আগে থেকেই আমাদের কোনো হোটেল/আবাসিক বুক দেওয়া ছিলোনা। ওখানে গিয়েই আমরা হোটেল ৯৯ (ভালো সার্ভিস দেয়নি, নেক্সট টাইম কেউ গেলে ওখানে গিয়ে খুজলে আরো পাবেন) এ বুক দিলাম। সবাই উঠে পড়লাম। ফ্রেশ হয়ে সবাই রেডি হয়ে বেরিয়ে পড়লাম চন্দ্রনাথ পাহাড়ের চূড়ায় উঠার জন্য। এর মাঝে আমরা সকালের নাস্তা করে নিলাম অতিথি রেস্টুরেন্টে (সার্ভিস মোটামুটি মানের)। নাস্তা শেষে আমরা ৬ জন মিলে একটা সিএনজি হায়ার করে চন্দ্রনাথ পাহাড়ে চলে গেলাম, পাহাড়ে উঠার পূর্বে অবশ্যই বাঁশের লাঠি ও পানির বোতল (যদি ছোট ব্যাগ থাকে ব্যাগে নিবেন, নাহলে দরকার নেই, পাহাড়ের প্রতি ধাপে ধাপে দোকান পাবেন) নেবেন...
পাহাড়ের দুই পাশ দিয়েই উঠা যায়, তবে বুদ্ধিমানের কাজ হচ্ছে বাম পাশ দিয়ে উঠে ডান পাশ দিয়ে নামা, আবার যে পাশ দিয়ে উটবেন সে পাশ দিয়েও নামতে পারবেন। আমরা বাঁপাশ দিয়ে উঠে ডান পাশ দিয়ে নামলাম। এটা সত্য যে পাহাড়ে উঠা অনেক কষ্ঠের, কারন আপনাকে মধ্যাকর্ষন বলের বিরুদ্ধে কাজ করা লাগবে। প্রতি ধাপে ধাপে রেস্ট না নিলে উঠা খুবই মুশকিল। পাহাড়ের দৃঢ়তা আমাকে মুগ্ধ করেছে, এর আগে এতো উঁচুতে আমি উঠিনাই। আল্লাহর অনন্য সৃষ্টি প্রাকৃতিক সৌন্দর্য কি অবলীলায় দাঁড়িয়ে আছে, যা কিনা আপনাকে আল্লাহর আনুগত্য প্রকাশের জন্য একটু হলেও ভাবাবে !!!
আমরা পাহাড়ের সকল ধাপে রেস্ট এর পাশাপাশি সুন্দর দৃশ্য ধারণ করার চেষ্টা করলাম, নিজেরা নিজেদের ছবি তুললাম। তবে আমরা আমাদের বন্ধু ও বিটবক্সের এক্স এমডি Rkb কে নিয়ে টেনশনে ছিলাম, কারন কাচ্চি খেতে খেতে ভুড়ির যা হয়েছে, তাতে একটু পরেই "আমি আর পারবোনা উটতে" এই বাক্য শোনা লাগছিলো। তবুও আলহামদুলিল্লাহ সবাই সর্বোচ্চ চূড়ায় উটলাম, চন্দ্রনাথ মন্দির দেখলাম, একজন বিদ্যুৎ কর্মী হিসেবে অবাক হয়েছি সেখানে পিডিবির পোল ও বিদ্যুৎ এর লাইন দেখে। উপরের প্রচন্ড সূর্যতাপে চেহারার যখন বারোটা বাজার অবস্থা, তখন সাথে ঘামাক্ত শরীরেও আমরা ছবি তোলা থেকে বিচ্যুত হইনি...
পরিশেষে আমরা ডানপাশ দিয়ে নামা শুরু করলাম। উঠার চাইতে নামাটাই আমার কাছে রিস্কি মনে হলো। কারন কোনোভাবে একটু পা ফসকালেই ঘটে যেতে পারে মহাবিপদ। আর ডানপাশের সিঁড়ি গুলাও একটু সোজাসুজি রকমের, কিন্তু বুকে শাহস ও মনে আনন্দ নিয়ে আমরা দ্রুত সময়ে নেমে গেলাম। চন্দ্রনাথ পাহাড়ের পর্ব শেষ করে সীতাকুণ্ড থেকে আমরা লেগুনাতে করে রওনা দিলাম নাপিত্তাছড়া ঝর্নার উদ্দেশ্যে। মেইন সড়কে নেমে নাপিত্তাছড়া ঝর্নার উদ্দেশ্যে যাওয়ার জন্য আপনাকে ৩ কিমিঃ এর বেশি হাটতে হবে। কারন মাটির চিকন রাস্তা দিয়ে অটো কিংবা রিকশা বা সিএনজি কিছুই চলেনা...
আমরা হেটে যাবো বলেই মনস্থির করলাম, কারন এসেছি যখন খালি হাতের ফেরার অপশন নাই। যদিও চন্দ্রনাথ পাহাড়ে আমাদের সাথে মোটিভেশান থাকলেও এই পর্যায়ে ছিলোনা (মোটিভেশান কি, জানতে ইকবক্স করুন)। যাওয়ার প্রক্কালে আমরা রাহাত হোটেল (ঘরোয়া পরিবেশে রান্না হয়, মোটামুটি ভালো সার্ভিস দিয়েছিলো।) লান্সের বুকিং দিয়ে গেলাম, এবং তার কাছ থেকে জানলাম নাপিত্তাছড়া ঝর্নায় পানি তেমন নেই, গোসল করে মজা পাওয়া যাবেনা, আমরা চলে গেলাম ছোট একজন গাইডার নিয়ে বাঘবিয়ানি ঝর্নার উদ্দেশ্যে... বাঘবিয়ানি ঝর্না নাপিত্তাছড়া ঝর্না থেকেও আনুমানিক ২ কিমি বেশি দূরে। আমরা গাইডারের পিছু পিছু পাহাড়ের ঢাল ও ঝর্নার পানি প্রবাহের রাস্তা ধরে হাটা শুরু করলাম। এই সময়টায় পায়ে এংলেট থাকাই ভালো, ভেজানো যাবে এমন কেডস/লোপার থাকলেও সমস্যা নেই (খালি পায়ে না যাওয়াই উত্তম), খালি পায়ে গেলে পিচ্ছিল পাথরে যেকোন সময় বিপদ হতে পারে, পাথরে পা কাটাও যেতে পারে। নাপিত্তাছড়া ঝর্নার নিচ থেকে উপরে পাহাড়ে উঠার সময়টা এডভেঞ্চারের মতো লাগছিলো...
একটা সময় আমরা পৌঁছে গেলাম বাঘবিয়ানি ঝর্নার দারপ্রান্তে, ট্যুরিস্ট সংখ্যা ভালোই ছিলো, যে যার মতো গোসল ও মাস্তিতে ব্যাস্ত, সুযোগ বুঝে আমরাও গোসলে নেমে পড়লাম, আনন্দ করলাম, ছবি তুললাম, তারপরে আবার ব্যাক করা শুরু করলাম। এখানেও এক্স-এমডিকে তাকে নিয়ে বিপত্তি, তার বাঁশের লাঠি হারানো গেছে, সাথে মোটিভেশান ছিলোনা। তার ভুড়িওয়ালা শরীর রক্ষার্থে আমার বাঁশের লাঠি তাকে দিয়ে দিলাম। যাওয়ার পথে আমরা পাহাড়ের উপর দিয়েই ভিন্ন পথে গেছি, নাপিত্তাছড়া ঝর্না হয়ে যাইনি, এতে টাইম একটু বেশি লাগলেও, পাহাড় থেকে নাপিত্তাছড়া ঝর্নায় নামার এডভেঞ্চার থেকে মুক্তি মিললেও অন্যপথে ছোট ছোট পাথর খুব প্যারা দিয়েছিলো। তবুও পথ তো থেমে থাকবেনা, আমরাও থেমে থাকিনি...
সেখান থেকে আমরা রাহাত হোটেলে (মোটামুটি ভালোই সার্ভিস দিয়েছিলো) এসে ড্রেস চেঞ্জ করে লান্স করলাম। ফেরার পথে তখন টাইম ছিলো দুপুর ৩.৩০ টার মতো। ফেরার পথে আমাদের সাথে হঠাৎ মোটিভেশান দেখে আমরা ফুলকিত হলাম, সেক্সিবয় Kibria মোটিভেশান থেকে বিদায় নিয়ে নিলো। কিন্তু অনেক ট্যুরিস্টকে ঝর্নায় যেতে দেখলাম, যদিও তারা বাঘবিয়ানি ঝর্নায় যেতে পারবেনা, কারন ঝর্নায় ৫ টার পরে যেতে নিষেধ বা প্রবেশ নিষে মেইন রোড থেকে আমরা লেগুনায় চড়ে সীতাকুণ্ড চলে আসলাম, সেখান থেকে ভেবে চিনতে কম সময়ে সিএনজি যোগে গুলিয়াখালী বীচের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। আমরা গোধূলি লগ্নে বীচের ঘাটে পৌঁছালাম, সেখানে থেকে বোটে উটলাম (বোটের সার্ভিস ভালো লাগেনি, পর্যাপ্ত ট্যুরিস্ট থাকার পরেও আরো ট্যুরিস্ট এর জন্য অপেক্ষা করছিলো।) ঠিক যখন সূর্য মামা তার রক্তিম রঙ দেখিয়ে ডুবে যাবে তখনি আমরা বীচে পৌঁছালাম, তবে আরো ১০-১৫ মিনিট আগে পৌঁছালে আমরা আরো দারুন কিছু দৃশ্য উপভোগ করতে পারতাম। এই জায়গায় আমাদের টাইম শিডিউল মিস ম্যাচ হয়েছিলো, পাশাপাশি সিএনজি ও বোট কিছু টাইম কিল করছে আমাদের...
বীচ থেকে ফিরে আসাটা ছিলো আরো চ্যালেঞ্জিং, কারন ভাটা পড়ার কারনে পানি কম ছিলো, বোট চলেনি পাশাপাশি বোট ঐ পাড়ে ছিলো ও না। তবে অন্যান্য ট্যুরিস্টদের মতো আমাদেরকেও হেটে আসা লাগছিলো, এবং বিষয়টা খুবই এঞ্জয়েবল ছিলো, কারন মোবাইলের ফ্লাশ মেরে একটু শুকনা ও মাঝে মাঝে ভেজা মাঠ কিংবা কাটা ঝাউগাছ এর শিকড়ের ভেতর দিয়ে হাটতে হয়েছিলো...
অবশেষে ঘাটে এসে আমরা সিএনজি ভাড়া করলাম, এইক্ষেত্রেও সিএনজি সার্ভিস ছিলো অতি জঘন্য। কারন সন্ধ্যার পর যত অন্ধকার হচ্ছিলো, ট্যুরিস্টদের কাছ থেকে বেশি ভাড়া নেওয়ার পায়তারা তত বেশি বেকে বসেছিলো ড্রাইভারদের মনে (অবশ্য এটা আমাদের বাঙালির রক্তে মিশে থাকা স্বভাব)। আমরা চলে এলাম সীতাকুণ্ড বাজারে, তখন রাত প্রায় ৮ টা...
এবার সবাই মিলে ডিনার এর জন্য রেস্টুরেন্ট খুঁজতে লাগলাম, অবশেষে নবাব রেস্টুরেন্টে আমরা ডিনারে করতে বসে পড়লাম। কিন্ত ডিনারে আমরা ভাত কিংবা ভারী খাবার না খেয়ে রুটি ও ডাল ভাজি খেলাম, এবং শেষে নবাব রেস্টুরেন্টের দুধ চা'টা অসাধারণ ছিলো, খাবারের মানের পাশাপাশি দাম ও সাশ্রয়ী (ট্যুরের এইটা খুব ভালো লাগছিলো, দাম কম, রান্না ভালো।) খাবার পর্ব শেষ করে আমরা হোটেলে চলে গেলাম, ফ্রেশ হলাম, ততক্ষনে বিবাহিত বন্ধুরা শরীরের বিষ ব্যাথা সারানোর জন্য তাদের বউদেরকে খুব মিস করতেছিলো, আমরা ব্যাচেলররা আপসোস করলেও মজা পাচ্ছিলাম। এরপরে শুরু করলাম পরের দিনের প্লান। একটা সময় সারাদিনের ক্লান্তি আমাদেরকে আলিঙ্গন করতে লাগলো, আমরাও হারিয়ে গেলাম পরের দিনের প্লান মাথায় নিয়ে ঘুমের রাজ্যে...
#চট্রগ্রাম #সীতাকুণ্ড #চন্দ্রনাথ #পাহাড় #বাঘবিয়ানি #ঝর্না #গুলিয়াখালী #বীচ #বিটবক্স
-সাইফুল্যাহ আমিন
চট্রগ্রাম/ ১৪-১০-২০২২ ইং